দিল্লী। পাঞ্জাব। মনিপুর। কেরালা। এলাহাবাদ। মুম্বই। কলকাতা। রায়পুর। কালিকট। হায়দ্রাবাদ। আলীগড়। বেনারস। পুনে। চেন্নাই। শ্রীনগর।
গত পাঁচ বছরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস উত্তাল হয়ে উঠেছে। কখনো বা ছাত্র সঙ্ঘের অধ্যক্ষ গ্রেফতার, কখনো বা দলিত ছাত্রের আত্মহত্যা। কখনো স্টাডি সার্কেল ঘিরে বচসা, কখনো 'দেশদ্রোহ' নিয়ে বিতর্ক। স্বাভাবিক ভাবেই নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে, এর দায় কি ছাত্র রাজনীতির? নাকি এর দায় শাসক দল ও তাঁদের ছাত্রকর্মীদের? এরই মাঝে কখনো কখনো শিক্ষক নিগৃহীত হয়েছেন দেশদ্রোহের দায়ে, কখনো বা অধ্যাপক গ্রেফতার হয়েছেন প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ করবার দায়ে। আলোচনার ঝড় উঠেছে বাকস্বাধীনতার প্রসঙ্গে। গেরুয়াকরণের পুরনো অভিযোগ আবারও নতুন করে ফিরে এসেছে। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী বিজ্ঞান কংগ্রেসের মঞ্চে উঠে গণেশের প্লাস্টিক সার্জারির বিষয়ে বক্তব্য রেখেছেন, মহাভারত যুগে ইন্টারনেট থেকে হলদিঘাটির যুদ্ধে রাণা প্রতাপের জয়, এরকম অনেক বিষয়ের চর্চা হয়েছে।
এরকম সময়ে দাঁড়িয়ে মনে হতেই পারে যে ভারতবর্ষের শিক্ষাক্ষেত্রে মূল সমস্যা অযুক্তির চাষ ও গেরুয়াকরণের উপদ্রব, মূল দ্বন্দ্ব বাক্স্বাধীনতা বনাম স্বৈরাচার। এই অতিসরলীকরণের প্রেক্ষিতে কিছু আলোচনা হওয়া প্রয়োজন, সেই উদ্দেশ্যেই এই লেখা।
২৪ এপ্রিল, ২০০০ সাল। প্রাইম মিনিস্টার্স কাউন্সিল অন ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির কাছে একটি রিপোর্ট জমা পড়লো। বিখ্যাত শিক্ষাবিদ শ্রী মুকেশ আম্বানি ও শ্রী কুমারমঙ্গলম বিড়লার তৈরি এই রিপোর্টের নাম 'এ পলিসি ফ্রেমওয়ার্ক ফর রিফর্মস ইন এডুকেশন'।
সেখানে এই দুই শিক্ষাবিদ জানালেন যে ভারতবর্ষে শিক্ষাক্ষেত্র সম্ভবত সব থেকে বেশি নিয়ন্ত্রিত ক্ষেত্র, এবং এতে তাঁরা খুবই অখুশি। তাঁরা চান, ভারতীয়রা তাঁদের 'মানসিকতার আমূল পরিবর্তন করুন' এবং 'শিক্ষাকে সামাজিক উন্নয়নের একটি অংশ হিসেবে দেখা বন্ধ করুন'। তাঁরা বলেন, ভারতবর্ষে শিক্ষাক্ষেত্রের একটাই কাজ হতে পারে - তা হচ্ছে এমন কিছু 'নমনীয়, প্রতিযোগিতা-উন্মুখ কর্মী তৈরি করা যারা খুব সহজে নতুন স্কিল নিজেদের দখলে আনতে পারে এবং নতুনত্ব দেখাতে (innovate) পারে’।
শিক্ষাবিদ কথাটা টাইপো ভাববেন না। প্রধানমন্ত্রী বাজপায়ির অফিস থেকে যখন এঁদের কাছেই বরাত গিয়েছিল, তখন এঁরাই শিক্ষাবিদ নিশ্চয়। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে এঁদের থেকে যোগ্য মত কেই বা দিতে পারতেন সে সময়ে? তাছাড়া যেই রিপোর্টের শুরুতেই বিড়লা ও আম্বানি বেশ কিছু শিক্ষাবিদ (এবং তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালাম), গবেষক মায় রিলায়েন্স পাওয়ারের চেয়ারম্যানকে পর্যন্ত ধন্যবাদ জানিয়েছেন তাঁদের 'ইনসাইটের' জন্য, সেই রিপোর্টের গুরুত্ব অস্বীকার করে কোন অর্বাচীন?
১৯ বছর বাদে আজ ফিরে তাকালে এই ধরণের ম্যানেজমেন্ট বাজওয়ার্ডে ভরা রিপোর্ট অবশ্য অন্তঃসারশূন্য মনে হতেই পারে। প্রশ্ন জাগতে পারে - ইনোভেট মানে কী? যেই শিক্ষার্থী সমাজ-বিচ্ছিন্ন আদর্শ কর্মী হিসেবে ফ্যাক্টরিতে ঢালাই হচ্ছে, সে কি ইনোভেট করবে - মালিকের পদলেহন করবার ১০১তম উপায়? স্কিল কি গাছে ফলে? গ্রোথ মানে কী, মুকেশভাইয়ের সম্পত্তির বৃদ্ধি?
এরকম আরও চমৎকার একেকটি নিদানে এই রিপোর্ট ভরা। কিন্তু ম্যানেজমেন্ট বাজওয়ার্ডে ভরা ('ইনোভেট'; 'নলেজ ইকনমি'; 'ফাস্ট ট্র্যাক টু নলেজ-বেসড গ্রোথ') এই অন্তঃসারশূন্য রিপোর্টের ভাষা ও যুক্তি ('সামাজিক উন্নয়নের সাথে শিক্ষার কোন সম্পর্ক নেই') আজকে আমাদের চারিপাশে সর্বত্র। শিক্ষানীতি থেকে শুরু করে পাড়ার ম্যানেজমেন্ট ইন্সটিউট (সুলভে বিবিএ ডিগ্রী বেচা হয়), মন্ত্রী থেকে শুরু করে বহুজাতিকের কর্মচারী, সবার মুখেই এই ধরণের কথা শুনতে পাবেন।
সেই নিদান মেনে আস্তে আস্তে শুরু হল রিফর্ম, অর্থাৎ সংশোধন। শিক্ষাক্ষেত্রের অর্থের বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হল, কারণ মুকেশভাই ও বিড়লাভাই তো বলেই দিয়েছেন, ইউজিসির দরকার নেই, ক্রেডিট দেওয়া হোক না হয়। আদর্শ কর্মী পরে লোন শোধ করে দেবে (লোন যদি শোধ করতে না পারে, তাহলে নিশ্চয় সে আদর্শ কর্মী নহে - এনপিএ মাফের সুবিধাটা অবশ্য সে পাবেনা, কারণ সে মুকেশভাই নয়)। শিক্ষার চাহিদা মেটাতে বেসরকারি পুঁজির সাথে সাথে শিক্ষার মতন সংবেদনশীল ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ কেন কমাতে হবে, এর উত্তর তাঁদের রিপোর্টে পাওয়া যায়নি, কিন্তু সেই কথাকে বেদবাক্য মনে করে একের পর এক ডিমড্ বিশ্ববিদ্যালয়কে খোলবার অনুমতি দিলো এনডিএ সরকার। উত্তর প্রদেশের মাঠেঘাটে আখের খেতের মধ্যে এরকম অনেক ইঞ্জিনিয়ারিং ও ম্যানেজমেন্ট ইন্সটিটিউটের ধ্বংসস্তূপ আজও খুঁজে পাওয়া যায়।
২০০৫ সাল। ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন-জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্রেড ইন সার্ভিসেস (ডাব্লুটিও-গ্যাটস) আলোচনার দোহা রাউণ্ডে উচ্চশিক্ষাকে পণ্য হিসেবে 'অফার' করে বসলো ইউপিএ ১-পরিচালিত ভারত সরকার। বলা হল, এটা কেবলমাত্র 'অফার' - 'কমিটমেন্ট' নয়, এবং দোহা ডেভেলপমেন্ট এজেন্ডা-কেন্দ্রিক আলোচনা ফলপ্রসূ না হলে সেটা কেবলমাত্র প্রস্তাবের স্তরেই থাকবে। মিড ডে মিল ও রাইট টু এডুকেশনের সরকার, পিএইচডিধারী প্রধানমন্ত্রীর সরকার এ হেন হঠকারী প্রস্তাব কেমন করে পেশ করলো? শিক্ষা সংগঠনগুলো বার বার এই প্রশ্ন করেও সরাসরি উত্তর পায়নি।
মুকেশভাই ও বিড়লাভাইয়ের যুগান্তকারী রিপোর্ট পড়লেই কিন্তু প্রশ্নের উত্তরটা আর বলে দেওয়ার দরকার হয়না। তাঁরা তো বলেই দিয়েছেন, প্রাথমিক ও সেকেন্ডারি স্তরে সরকার চাইলে খরচ করুন, বাকিটা পুঁজিপতিরা দেখে নেবেন। প্রাথমিক ও সেকেন্ডারি স্তরের শিক্ষা যে উচ্চশিক্ষার সাথে প্রতিযোগিতায় নামেনি, শিক্ষাক্ষেত্রে যে ব্যালেন্স শিটের দুই দিক মিলিয়ে চলা যায়না, সেসবের ধার ধারেননি তাঁরা। ধার ধারেনি সরকারও।
আস্তে আস্তে জনপরিসরের আলোচনা থেকে হারিয়ে যায় এই সর্বনাশা প্রস্তাব। ২০১৫ সালে ডাব্লুটিও-গ্যাটস আলোচোনার নাইরোবি রাউণ্ডের আগে কেউ কেউ এনডিএ সরকারের কাছে জানতে চান, সরকার কি এই প্রস্তাব নাইরোবি গিয়ে ফিরিয়ে নেবে, দেশের যুবসমাজকে বাঁচাবে এই ভয়াবহ 'কমিটমেন্টের' হাত থেকে? আশ্চর্যভাবে, নাইরোবি রাউণ্ডের পরে এই নিয়ে টুঁ শব্দটিও শোনা যায়নি!
এনডিএ ২-এর আমলে অবশ্য এ ধরণের কিছু জনপরিসরে আলোচনা হবে, এ আশা করাও বৃথা। শেষমেশ অল ইন্ডিয়া ফোরাম ফর রাইট টু এডুকেশনের (এআইএফআরটিই, ৭০টি শিক্ষক ও ছাত্র সংগঠন-দ্বারা তৈরি একটি ফোরাম) তরফে পাঠানো একটি মেমোরান্ডামের উত্তরে সরকার জানায় যে নাইরোবিতে এই বিষয়ে কোন নিষ্পত্তি হয়নি। সকালে ঘুম থেকে উঠে জল খাওয়ার আগেও যে সরকারের প্রতিনিধিরা একবার করে "কংগ্রেস আমলের সব কিছু খারাপ" মন্ত্র জপ করে নেন, সেই সরকারেরই কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি মন্ত্রক জানায় যে এ হেন প্রস্তাবের পিছনে একটি 'ফিলজফি' আছে, এবং তা হচ্ছে বিদেশি পুঁজি টানা। অলিখিত থেকে যায় সেই পুরনো যুক্তিঃ সামাজিক উন্নয়নের সাথে শিক্ষার কোন সম্পর্ক নেই, আদর্শ কর্মী প্রস্তুত করার জন্য পুঁজিপতিরা যা করবার করে নেবেন।
সেই আদর্শেই যে নরেন্দ্র মোদীর এনডিএ ২ সরকার একের পর এক যুগান্তকারী সংশোধন এনেছেন, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। শিক্ষা বাজেট কমেছে। কখনো সিএসআইআরের ল্যাবগুলো অর্থের অভাবে বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে (সরকার বলেছেন "চরে খাও"), কখনো বা টিআইএফআরে আধা মাইনে এসেছে। একদিক দিয়ে সিট যেমন কমে গেছে, আরেকদিক দিয়ে সেইরকম কমে গেছে শিক্ষক নিয়োগ, বাড়ছে চাকরির অনিশ্চয়তা ও আমেরিকান মডেলে 'অ্যাডজাঙ্কটিফিকেশন'। হিফা (হাইয়ার এডুকেশন ফাইনান্সিং এজেন্সি) নামক একটি সংস্থানের মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে লোন নিতে হয়েছে, যা পরিশোধ করতে মাইনে বাড়াতে হবে কারণ মুকেশভাইয়ের মতন এঁদেরও এনপিএ মাফ হওয়ার সুযোগ নেই। শিক্ষা লোনের বোঝা বাড়লে একটি দেশের যুবসমাজের কী অবস্থা হতে পারে তা আমরা আজকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দেখে শিখতেই পারি। অথবা বাড়ির আরো কাছে, এই ভারতবর্ষেই, ঋণ জর্জরিত কৃষকদের কথা মনে করে চিন্তা করতে পারি - সত্যিই কি আমরা দেশের ভবিষ্যতের নাগরিকদের এই পথে ঠেলে দিতে চাই? এনপিএর বাদশাদের রিপোর্টে এর উত্তর পাবেন না কিন্তু!
অবশ্য এ কথা উঠতেই পারে যে এত সংশোধন করেও যখন লাভের লাভ হয়নি, যখন দেখা যাচ্ছে যে বৃহৎ সংখ্যক গ্র্যাজুয়েট হয় চাকরি আদৌ পাচ্ছেন না অথবা বাজারের হিসেবে আনএমপ্লয়েবল অর্থাৎ বাতিল হয়ে যাচ্ছেন, তখন আরও আরও সংশোধনের প্রয়োজন, তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, আচ্ছে দিন ব্যাস রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। ম্যানেজমেন্ট স্পিকের ভাষার জাদুকরীটাই অনেকটা এইরকম - বেসরকারিকরণকে বলা হয় উদারিকরণ, আর ধ্বংসকে বলা হয় সংশোধন।
অথবা - যদিও এ কথা বললে আজকে বাতিলের খাতাতে ধরা হয়! - এ কথাও বলা যেতে পারে যে ১৯ বছর আগে তৈরি করা দুই মহান শিক্ষাবিদদের এই সর্বৈবভাবে ব্যর্থ শিক্ষানীতিকে আবর্জনা মনে করে জ্বালিয়ে দেওয়াই কাম্য।
যে পথে চলে কিছু শিক্ষা ব্যবসায়ী ছাড়া কারো উপকার হয়নি, সেই পথে ভারতবর্ষের আগামীদিনের নাগরিকদের কেন হাঁটতে বলা হবে, এই প্রশ্ন গণপরিসরে ফিরে আসা জরুরি।
--------
এনডিএ সরকার যেখানেই ক্ষমতায় আসে, সেখানেই সাধারণত অভিযোগ ওঠে শিক্ষার গেরুয়াকরণের। সঙ্ঘের আদর্শের প্রচার, সঙ্ঘপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর রমরমা, সঙ্ঘপন্থী শিক্ষক নিয়োগ, সঙ্ঘ সহ হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর বিচিত্র ইতিহাস ও বিজ্ঞান চর্চা - এই সকল বিষয়কে গেরুয়াকরণের অঙ্গ হিসেবে দেখা হয়। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসা এনডিএ ২-ও এর ব্যতিক্রম নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে শাখা চালানো, 'দেশদ্রোহী'-দের চিহ্নিত করে সঙ্ঘপন্থী ছাত্র সংগঠনদের তাণ্ডব, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে বাবাজি-সাধুজিদের উপদ্রব, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে দেশপ্রেমের বন্যা, ইত্যাদি ইত্যাদি, এ সমস্ত ঘটনাই খুব নিয়মিত ভাবে ঘটে এসেছে গত পাঁচ বছরে।
সমস্যা হচ্ছে, শিক্ষায় গেরুয়াকরণের বিরোধী অনেকেও যেহেতু উদারিকরণ-বেসরকারিকরণ এবং সংশোধন-ধ্বংস নীতির সাথে জড়িত সমস্ত যুক্তি আত্মস্থ করে ফেলেছেন, অতএব একেকবার একেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তাল দৃশ্য দেখে তাঁরা কেবল গেরুয়া বনাম লাল অথবা গেরুয়া বনাম নীলের একমাত্রিক চিত্র অনুধাবন করতে সক্ষম হন। যারা ছাত্র রাজনীতির পক্ষে, তাঁরা মনে করেন সঙ্ঘের গেরুয়াকরণ রাজনীতির বিরুদ্ধে সরব হলেই ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যার সমাধান হবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি তরতর করে সংশোধনের পথে এগিয়ে যাবে। যারা ছাত্র রাজনীতির বিপক্ষে, তাঁরা মনে করেন ছাত্র রাজনীতির কাঁটা (সব রঙের) সরলেই ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যার সমাধান হবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি তরতর করে সংশোধনের পথে এগিয়ে যাবে।
লাল/নীল বনাম গেরুয়ার একমাত্রিক যুক্তিতে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় জগতের মূল দ্বন্দ্ব আদৌ ধরা পড়েনা। মূলধারার সংবাদমাধ্যম ও জনপরিসরের নানা কণ্ঠস্বর এই দ্বন্দ্বকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন কিছু বাইনারির মাধ্যমে - যেমন বাকস্বাধীনতা বনাম স্বৈরাচার, যেমন যুক্তি বনাম অযুক্তি - যা আদপে অতিসরলীকরণ। এ কথা সত্যি যে নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে হয়ে যাওয়া বিভিন্ন ছাত্র আন্দোলন, এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগেও, একে অপরের সাথে সরাসরি যুক্ত নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছাত্র আন্দোলন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ইস্যু নিয়ে হয়ে থাকে। এ সত্ত্বেও দেশের নানা প্রান্ত থেকে উঠে আসা বিচ্ছিন্ন, অসম্বদ্ধ ছাত্র-কণ্ঠস্বর শুনতে শেখা প্রয়োজন, কারণ সেই কণ্ঠস্বর শুনতে না শিখলে শিক্ষা জগতের মর্মবেদনা আদৌ বোঝা সম্ভব না।
২০১৪-২০১৯ সালের মধ্যে নানা ছাত্র আন্দোলনের একটা খণ্ডচিত্র দেখলে ব্যাপারটা হয়তো পরিষ্কার হবেঃ
●পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সঙ্ঘের ২০১৮ সালের আন্দোলন হয় অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা অংশের ছাত্রছাত্রীদের জন্য পরীক্ষার ফী এক লাফে বেড়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে।
●লোকসভা ভোটে প্রার্থী হিসেবে সদ্য মনোনয়নপত্র পেশ করা কানহাইয়া কুমারের নেতৃত্বে জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সঙ্ঘের ২০১৫ সালের আন্দোলন (পোশাকি নাম, #অকুপাইইউজিসি) হয় এম.ফিল ও পিএইচডি স্কলারদের রিসার্চ স্টাইপেন্ড (নেট-জেআরএফ বহির্ভূত) বন্ধ করে দেওয়ার বিরুদ্ধে। তারপরে জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়ে গেছে একের পর এক (কিছু সফল, কিছু অসফল) আন্দোলন, কোনটা এক ঝটকায় গবেষণার সিট কমে যাওয়ার বিরুদ্ধে, কোনটা প্রসপেক্টাসের দাম অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে।
●দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়, জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়, হিদায়েতউল্লা জাতীয় আইন বিশ্ববিদ্যালয় - সর্বত্র মেয়েরা রাস্তায় নেমে হস্টেল থেকে ঢোকা-বেরোনোর স্বাধীনতা, লাইব্রেরীতে পড়াশোনার স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার হয়েছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের #হোককলরব আন্দোলন একটি যৌন হেনস্থার ঘটনার সঠিক বিচারের দাবিতে শুরু হয়।
●টিসের ছাত্র আন্দোলন ক্ষোভে ফেটে পড়েছে এসসি-এসটি-ওবিসি ছাত্র-ছাত্রীদের ফেলোশিপ বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে।
●সাধারণত ভাবে ‘রাজনীতি বিমুখ’ বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানগুলোতে রিসার্চ স্কলাররা ফেলোশিপ বৃদ্ধির দাবিতে এখনো দেশব্যাপী আন্দোলন চালাচ্ছেন; ‘অরাজনৈতিক’ আইআইটি ছাত্র-শিক্ষকদের নেতৃত্বে হয়েছে মার্চ ফর সায়েন্স।
রিসার্চ স্টাইপেন্ড ও স্কলারশিপ, ফী বৃদ্ধি, সিট কাটের বিরোধিতা; মেয়েদের চলাফেরার স্বাধীনতা এবং যৌন হেনস্থামুক্ত প্রতিষ্ঠান তৈরি করা; এসসি-এসটি-ওবিসি ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা উন্মুক্ত করা - ভারতবর্ষের নানা প্রান্ত থেকে আসা ছাত্রসমাজের বিচ্ছিন্ন কণ্ঠস্বরের চাহিদাগুলো কিন্তু খুব বিচ্ছিন্ন নয়।
এর সাথে যদি শিক্ষক সংগঠনগুলোর বা ছাত্র-শিক্ষক সংগঠনগুলোর যুগ্ম আন্দোলন যোগ করা যায় - যেমন স্থায়ী শিক্ষাকর্মী নিয়োগের দাবিতে দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন, অথবা কিছুদিন আগেই ঘটে যাওয়া নিয়োগে ২০০ পয়েন্ট রোস্টারের ব্যবহার বিষয়ে সফল আন্দোলন - তাহলে কিন্তু গেরুয়াকরণের যুগে উত্তাল বিশ্ববিদ্যালয় ও তার মূল দ্বন্দ্বের একটা পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যায়। লাল/নীল বনাম গেরুয়া জাতীয় তরল, একমাত্রিক বিশ্লেষণের বাইরে বেরিয়ে পর্যালোচনা করলে খুব পরিষ্কার হয়ে যায় যে ছাত্র এবং শিক্ষাকর্মীদের থেকে যে কণ্ঠস্বর উঠে এসেছে বারবার, সেই কণ্ঠস্বর ভারতীয় শিক্ষাক্ষেত্রের গ্যাটসিফিকেশন (নন্দিনী চন্দ্রর ভাষায়) অথবা বিড়লা-আম্বানিকরণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, উন্মুক্ত এবং সার্বজনিক শিক্ষার পক্ষে।
শাসকের ছত্রছায়ায় প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরেরা এই কন্ঠস্বর শুনতে পাননা, বা শুনেও শুনতে চাননা। ন্যাক-নির্ফ-ইনস্টিটিউট অফ এমিনেন্স জাতীয় নানাবিধ ইঁদুর দৌড়ের পথ আটকে যদি ছাত্র বা শিক্ষকবৃন্দ, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেকহোল্ডাররা, দাঁড়ান, তাহলে তাঁদের যে ভাবেই হোক সরিয়ে দেওয়াই কাম্য। অনেক ক্ষেত্রেই ছাত্র-ছাত্রীদের চাহিদার সবথেকে বড় জায়গা যেটা, অর্থাৎ শিক্ষার আর্থিক বোঝা কমানো, সেই জায়গাতে আঘাত হেনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের কন্ঠরোধ করবার চেষ্টা করে থাকেন। সাম্প্রতিক কালে এর নিষ্ঠুরতম উদাহরণ রোহিত ভেমুলা, যার ফেলোশিপ “পেপারওয়ার্কের” অজুহাতে আটকে দেওয়া হয়েছিল এবং যাকে শাসকপন্থী ছাত্র দলের সাথে বচসার অজুহাতে হস্টেল ছাড়া করা হয়েছিল। রোহিত ও তার চার সঙ্গীর আশ্রয় হয়েছিল ত্রিপলের তলায়, “ভেলিওয়ারায়” (দলিত বস্তি)। তারপরের ঘটনা আমরা সকলেই জানি।
----------
এতটা পড়বার পরে যদি কেউ বলেন, এর অর্থ কি ভারতীয় উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার মানের উন্নতি হওয়ার প্রয়োজন নেই? তার উত্তর হ্যাঁ, অবশ্যই আছে।
ভারতবর্ষের জিডিপির ৩.৮৩% শিক্ষাক্ষেত্রে খরচ করা হয়। এর মধ্যে গবেষণার বরাদ্দ ০.৩%। অস্থায়ীকরণের ফলে এক সন্ত্রস্ত, সদা আশঙ্কিত শিক্ষক শ্রেণী তৈরি হয়েছে, যা শিক্ষা এবং গবেষণার মানের সরাসরি ক্ষতি করতে বাধ্য। সরকারি তথ্য অনুযায়ী উচ্চশিক্ষায় গ্রস এনরোলমেন্ট রেশিও জনসংখ্যার ২৫%, যা বিশ্বব্যাপী গড় ৩৫%র থেকে ১০% কম। এই এনরোলড ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে কতজন শেষ পর্যন্ত ডিগ্রী লাভ করেন, এবং কতজন কলেজ-ছুট হন, তার কোন তথ্য নেই। বিড়লা-আম্বানির পরামর্শ মেনে খোলা বেসরকারি ইঞ্জনিয়ারিং কলেজগুলোতে আস্তে আস্তে তালা ঝুলছে, এআইসিটিইর নির্দেশে ২০২০ সাল থেকে আর কোন নতুন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ খোলবার অনুমতি দেওয়া হবেনা। বাজারের সমীক্ষা অনুযায়ী ২৫% ইঞ্জিনিয়ারিং গ্র্যাজুয়েট সঠিক শিক্ষা পেয়ে পাশ করছেন। এরই মধ্যে গত তিন বছরে অনাদায়ী শিক্ষা লোন লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে ২০১৮ অর্থবর্ষে সেটা ৯%তে দাঁড়িয়েছে। বেকারত্বের হার যেহেতু ৬%, ৪০ বছরে সব থেকে বেশি, অতএব এই অনাদায়ী লোনের পরিমাণ যে আরও বাড়বে তা বলাই বাহুল্য। এ কথাও বলা বাহুল্য যে এঁদের মধ্যে কেউই 'রাইট অফ' পাবেন না - সেটা কেবল বৃহৎ পুঁজিপতিরা পেয়ে থাকেন।
উন্নত বিশ্বের নানা দেশে শিক্ষার উদারিকরণ-সংশোধনের অভিজ্ঞতা এবং দেশে গত ১৯ বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও যদি সেই একই পথে এগিয়ে চলা হয়, তাহলে লাভ কার? জিও বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক যদি শিক্ষানীতির পথপ্রদর্শক হন, তাহলে জিত কার, আর হার কার? গ্যাটস চুক্তির 'অফার' যদি 'কমিটমেন্টে' গিয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তার মূল্য কাকে চোকাতে হবে? বিড়লা-আম্বানির ম্যানেজমেন্ট বাজওয়ার্ডে ভরা অন্তঃসারশূন্য রিপোর্টের ভাষা ও যুক্তি আত্মস্থ করা ছাড়া কি আর কোন রাস্তা নেই?
গত কয়েক বছরের ছাত্র ও শিক্ষক আন্দোলন কিন্তু পরিষ্কার বলে দিয়েছে যে তাঁরা এই ছেঁদো যুক্তি মেনে নিতে আর রাজি নন। হয়তো সময় হয়েছে এই কণ্ঠস্বরকে আরও জোরালো করবার।