
মাইকেল গুটেনব্রুনের। অস্ট্রিয়ার কবি ও গদ্যকার। লেখেন জার্মান ভাষায়। নাৎজিবাদের বিরোধিতার জন্য কারারুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত। হিটলার পরাজিত হওয়ায় মুক্তি। আধুনিক জার্মান কাব্যধারা অন্যতম স্বর। লিখছেন কবি ও তরজমাকার হিন্দোল ভট্টাচার্য
মাইকেল গুটেনব্রুনের। প্রতিকৃতি। শিল্পী আভ্রামিদিস জোয়ানিস। ১৯৮৩। ছবি সৌজন্য: দ্য ন্যাশনাল গ্যালারি, আলেক্সান্দ্রোস সুতজোস মিউজিয়াম,এথেন্স।
জার্মান ভাষার আধুনিক কবিতা নিয়ে কথা বলতে গেলে একটি স্পষ্ট বিভাজনের কথা বলতেই হয়। সেটি হল বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে জার্মান কবিতাকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী কবিতা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালীন কবিতা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ের কবিতা। বলা বাহুল্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালীন এবং ঠিক পর পরই যে সমস্ত কবিতা লেখা হয়েছে, সেগুলির মধ্যে জার্মান ফ্যাসিস্ট সময়ের ও যুদ্ধের সময়ের ছাপ স্পষ্ট ভাবেই দেখা যায়। অস্ট্রিয়া, চেক-জার্মান, জার্মান এবং পোলিশ-জার্মান কবিদের কবিতায় সেই সময়কার যন্ত্রণা, ক্রোধ এবং সন্ত্রাসের প্রভাব স্পষ্ট। এই কবিদের কবিতার মধ্যে যেমন দেখতে পাওয়া যায় একধরনের সার্ত্র কথিত ন্যসিয়া, তেমন দেখতে পাওয়া যায় একধরনের প্রতিবাদ, যা ব্যঙ্গ এবং শ্লেষের মধ্যে বিধৃত। আধুনিক অস্তিত্ববাদ এবং ইম্প্রেশনজিমের প্রভাব জার্মান আধুনিক কবিতায় পড়েছে যেমন, তেমন, এই সময়ের কবিদের মানসিকতাকে ছুঁয়ে গেছে পরম শূন্যবাদও। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দশ-পনেরো কি কুড়ি বছর পর যখন ক্ষত শুকিয়ে যায়নি, অথচ তেমন ভাবে মলমও পাওয়া যায়নি, ফ্যাসিবাদের বিপরীতে ভরসা করা মার্কসবাদী কমিউনিস্টদের মধ্যেও সেই একইপ্রকারের ফ্যাসিবাদ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে পূর্ব জার্মানিতে, চেকোস্লোভাকিয়ায়, রোমানিয়ায় এবং পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলিতে।
মাইকেল গ্রুটেনব্রুনের-এর জন্ম ক্যারিন্থিয়ায় ১৯১৯-এ। পেশায় ছিলেন একজন আর্কিটেক্ট। রাজনৈতিক ভাবে তিনি নাৎজিবাদের চরম বিরোধী অবস্থানের জন্য ১৯৩৫ সালে ছ-মাসের জন্য জেলে যান। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি প্রশিক্ষণ নেন একজন গ্রাফিক আর্টিস্ট হিসেবে। কিন্তু আবার গেস্টাপো বাহিনী ১৯৩৮ সালে তাঁকে গ্রেফতার করে রাজদ্রোহের অপরাধে। চার মাস জেলে কাটিয়ে তিনি ফিরে আসেন জীবনে। ১৯৪০ সালে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য জার্মান সরকার তাঁকে সেনায় অন্তর্ভুক্ত করে। যুদ্ধে তিনবার তিনি আহত হন। তাঁর কোর্ট মার্শাল হয় এবং মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতও হন। কিন্তু সেই দণ্ড কার্যকরী হওয়ার আগে জার্মানি যুদ্ধে পরাজিত হয়। ক্যারিন্থিয়ার আঞ্চলিক সরকারের জন্য তিনি ১৯৪৭-৪৮ সাল নাগাদ সংস্কৃতি দপ্তরে কাজ করেন। পরবর্তীকালে শুধুমাত্র লেখক হিসেবেই তিনি জীবন কাটান ভিয়েনায়। থিয়োডর ক্রেমার-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে অস্ট্রিয়ার ঐতিহ্য অনুসরণ করেন তিনি প্রচুর ভার্নাকুলার ভার্স লেখেন সেই সময়ে। কবিতার পাশাপাশি তিনি প্রচুর গদ্যও লিখেছেন। তাঁর লিখিত কবিতাসংকলনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য Schwarze Ruten (১৯৪৭), Opferholz (১৯৫৪), UngereimteGedichte (১৯৫৬), Der Lange Zeit (১৯৬৫) এবং Der abstieg (১৯৭৫)।
অস্ট্রিয়ার গীতিকবিতার ঐতিহ্য তাঁর মধ্যে কাজ করলেও, যুদ্ধ–পরবর্তী কবিতায় তিনি এনেছিলেন সরাসরি কথা বলার এক ধারা। অবশ্য এই সরাসরি কথা বলার ধারার মধ্যে মিশে গেছিল একপ্রকার পরাবাস্তব চিত্রকল্প। ছয় এবং সাত-এর দশকে তাঁর কবিতায় স্পষ্টতই ছাপ ফেলেছে একপ্রকার শূন্যবাদ, অ্যাবসার্ডিটি এবং ইঙ্গিতময়তা। ফলে, জার্মান এবং অস্ট্রিয়ার কবিতার ইতিহাসে, মাইকেল গুটেনব্রানের-এর কবিতা একপ্রকার সন্ধিক্ষণের কবিতা হিসেবেই পরিচিত।
তাঁর জীবনের দ্বিতীয় পর্যায়ের বা বলা ভালো, গীতিকবিতার পোশাক থেকে বেরিয়ে যে গ্রন্থ থেকে তাঁর কবিতা প্রত্যক্ষ ভাবে কথা বলতে শুরু করল, সেখান থেকে কিছু কবিতার অনুবাদ দেওয়া হল এখানে। ১৯৫৯-পরবর্তী কবিতাই মূলত এখানে অনূদিত।

জেরা। জার্মান শিল্পী জর্জ গ্রোস। ১৯৩৮। ছবি সৌজন্য: বেনউরি গ্যালারি অ্যান্ড মিউজিয়াম, লন্ডন
যখন থেকে হাজার বছর শুরু হল...
যখন থেকে হাজার বছর শুরু হল
সকলকেই দেওয়া হল সমান সুযোগ
কীভাবে কাটা মাছ নুনে মাখানো হয়
আর তা বাতাসে শুকোতে ঝুলিয়ে রাখা হয় তা শেখার জন্য।
যখন বাক্যের শেষ কয়েকটি শব্দও মরে যায়
হেরে যাওয়া মানুষের গলায়
আটকে যায় দড়ির ফাঁস
আর পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়।
শাসনের মতো, এই দড়ি, নামে উপর থেকে
শাস্তির মতো, এই দড়ি, নামে উপর থেকে
উপর থেকে এমন ভাবে নামে যেন এটাই ছিল বিধি
হাজার বছর ধরে, যেদিন একটা নিঃসঙ্গ ডিঙি
ভেসে পড়েছিল অজানা সমুদ্রের ঢেউয়ে
শুকিয়ে টিনের মাংসের মতো রাখা ছিল হিমঘরে আমায়
১০,০০০ টনের পুরোনো স্টিমারের পেটে
ডেলোস নামে এক জাহাজের খিদের ভিতর
হাজার বছর ধরে সেই হেরে যাওয়া মানুষ আমি
হাজার বছর ধরে আমারই কাটা শরীরে নুন মাখিয়ে
ফেলে রেখেছ তুমি, আমায়, আমার মতো তোমাকেও
ফেলে রেখেছ, কারণ সকলেই পেয়েছে সমান সুযোগ
নিজেকে শুকনোর, যখন উপর থেকে নামে শাস্তির মতো শাসন
আর আমরা শুধুই অপেক্ষা করি, কখন
ঠিক কখন থেকে শুরু হবে আরও হাজার বছর
কুচকাওয়াজ
সবচেয়ে সুরেলা গান আমি শুনেছিলাম
রাশিয়ান সৈন্যদের গলায়
খেতে না পেয়ে যখন তারা দাঁড়াতে পর্যন্ত পারছে না
“গান গাও! যদি গান গাও, তবে দু-একটা রুটি পেতে পার!”
শুনেই তারা গান গাইত, আমি, তাদের পাশ দিয়ে মার্চ করতে করতে
শুনতাম, তারা গান গাইছে, সুরেলা তাদের কণ্ঠ
বহুদিন পরেও, রাতের অন্ধকারে ভেসে আসত তাদের গান
বহুদিন পরেও, আমি শুনতে পেতাম রাশিয়ান সৈন্যদের গলায়
প্রাচীন সুরেলা সেই গান, মৃত্যুর আগে যে গান জীবিতরা গায় কখনো-কখনো।
শীত
এই শীতে, তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেও ভয় হয়
যে দুঃখ তুমি জমিয়ে রেখেছ তা আমি ব্যাখ্যা করতে পারি না
তোমার চামড়ার ভাঁজে লুকিয়ে পড়েছে তোমার সন্তানদের মৃত্যু
তোমার দীর্ঘনিঃশ্বাসের মধ্যে লুকিয়ে পড়েছে ভাঙা বারান্দার ধ্বংসস্তূপ
তোমার ঘুমন্ত ঠোঁটের মধ্যে শুয়ে পড়েছে তোমার প্রেমিকের বোমায় আদর করা পিঠ
এই শীতে, কোনওকিছুই পচে যায় না, এমনকি ইতিহাসও
এই শীতে অবিকৃত থাকে
তোমার মুখের দিকে তাকাতে ভয় হয়
নিজের কাঁপা কবজি অন্য হাতে তুলে নিয়ে বলি
না, আমাদের কোনো ইতিহাস নেই
আমাদের কোনো ইতিহাস নেই
মাধ্যাকর্ষণ
শীতের সমুদ্রে যারা বেরিয়ে পড়েছে, তারা জানে
কীভাবে ফিরে আসতে হয় সৈকতে
সৈকত মানে শুধুই বালি নয়, ভাঙা বরফ, জমে থাকা বরফ
মানুষের শরীরের উপর পা দিয়ে দিয়ে
যেখানে মানুষ বাঁচার হিসেবনিকেশ করে
ফিরে আসতে হয়
যেমন বৃষ্টি ফিরে আসে মাটির উপর
যেমন বোমা নেমে আসে মাটির উপর
যেমন বুলেট ফিরে আসে মাটির উপর
শীতের সমুদ্রে যারা বেরিয়ে পড়েছে, তারা জানে
কীভাবে ফিরে আসতে হয়, মানুষের উপর দিয়ে
মানুষের কান্নায়, আদরে, স্বপ্নে
কয়েদি
আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা একজন মানুষের
আকাশ ছিনিয়ে নিলে যা পড়ে থাকে, তার নাম জেল
জানলা নয়, রোদ্দুর নয়, মৃত্যুর সঙ্গে
এক বিছানায় শুয়ে থাকতে হয় মানুষকে
মাথার ভিতর শব্দ করে একগুচ্ছ স্প্লিন্টার
শিকলের মতো দেখতে মানুষ এসে বলে যায়
আমার বেঁচে থাকার কথাই ছিল না
জেল, আসলে একটা অপমান
যা মানুষকে তার আত্মা থেকে নির্বাসিত করে
যেটুকু পড়ে থাকে, তা
নিজের মুখের দিকে তাকাতে পারে না

খুব ভাল লাগল হিন্দোলবাবু। অনবদ্য।
অনুবাদ সুন্দর। ব্যখ্যার অংশটি কম ভাবায়।
হিন্দোল | 2409:4060:385:1ea7:d49b:18d3:6001:***:*** | ১৭ জানুয়ারি ২০২১ ১০:৫০101788ব্যখ্যা করিনি। ভূমিকা দিয়েছি।
।। শুভদীপ নায়ক ।। | 42.***.*** | ১৮ জানুয়ারি ২০২১ ১১:২৮101825অসামান্য অনুবাদ হয়েছে । সবকটি কবিতাই প্রাণবন্ত । এবং অস্ট্রিয়ান কবির জীবন সম্পর্কে, তাঁর লেখা সম্পর্কে বাঙালি পাঠকরা জানতে পেরে তাঁদের চেতনা সমৃদ্ধ করতে পারবে । বর্তমান বাংলা তথা দেশের যাবতীয় সংস্কৃতি বিপন্ন । সেই বিপন্নতায় বিশ্বসাহিত্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে জাতির চেতনার বিকাশ ঘটাতে । অনুবাদের মধ্যে তা ঘটতে পারে বলে আমার বিশ্বাস । অনবদ্য অনুবাদ, সাহিত্যগুণসম্পন্ন কাজ ।
Rimi Mutsuddi | 27.57.***.*** | ১৮ জানুয়ারি ২০২১ ২১:১১101838মূল ভাষা জানি না। কিন্তু অনুবাদে যা পড়লাম অসামান্য!
খুব ভালো লাগলো ।