পরিবর্তনের পর
পলিটিক্যাল ডিসকোর্সের বাংলা যদি রাজনৈতিক সন্দর্ভ হয় তবে তা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে সন্দেহ নেই। হয়তো সে কারণেই সোমনাথ মুখোপাধ্যায়ের মা মাটি মানুষ একটি সহজ ব্যাখ্যান হয়ে আমাদের হাতে এসে পড়ল যখন ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসানের পর ক্ষমতার কর্তৃত্ব বিরোধীদের হাতে। মনে পড়ছে ১৮ মার্চের নন্দীগ্রামের কথা। মনে পড়ছে ১৪ নভেম্বরের মহামিছিলে তথাকথিত রাজনৈতিক পতাকাহীন কয়েক হাজার মানুষের একত্রে সন্ত্রাসের রাজনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার কথা। মনে পড়ছে তৃণমূলের বিখ্যাত স্লোগান মা মাটি মানুষের কথা। কিন্তু কী ছিল সেই স্লোগানে, যার ফলপ্রসূত মগজে কারফিউ নিয়ে চলা পশ্চিম বাংলার মানুষ সিপিআই(এম)-এর অপশাসনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেন। তার প্রভাব পড়ল লোকসভা,পুরসভা ও বিধানসভার ভোটে। একচ্ছত্র আধিপত্য দেখিয়ে তথাকথিত বাম শক্তিকে পরাজয়ের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠি দেখিয়ে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন শক্তি।
যে কোনও পরিবর্তন যখন আসে, তার বাইরের রূপটি দেখেই আমরা অভিভূত হয়ে যাই। জানতে চেষ্টা করি না কেন কোনও ভাবনা, কোনও তত্ত্ব এতটা শক্তিশালী হয়ে উঠল যে তা নিশ্চিহ্ন করে দিতে সক্ষম হল একটি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা রেজিমেন্টেড শক্তিকে। তখন পরিবর্তনের বাইরের রূপ আমাদের ব্যাখ্যার শক্তিকে পর্যন্ত পর্যুদস্ত করে রচনা করে এক ভিন্ন রাজনৈতিক সন্দর্ভ। অথচ তা ভিন্ন নয়। কারণ, সেই সন্দর্ভ রচিত হয় দীর্ঘদিন ধরে। অনুঘটকের মতো এক একটি শক্তি এসে সেই পরিবর্তনের স্পৃহাকে জ্বালিয়ে তোলে, জাগিয়ে দেয়। আর তাই সেই পরিবর্তনকে ধরে রাখাটাই আসল পরিবর্তন এবং তা সেই বিরোধী শক্তি নিরপেক্ষ। বিরোধী শক্তি নিরপেক্ষ কেন বললাম? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কবীর সুমন, মহাশ্বেতা দেবী, ব্রাত্য বসু, অর্পিতা ঘোষ এবং অসংখ্য এগিয়ে আসা মানুষ যারা দীর্ঘদিন ধরে অত্যাচারিত মানুষগুলির মুখে ভাষা ফুটিয়ে তোলার কাজটি করেছেন, উল্টোদিকে তারাও সেই শক্তিটি পেয়েছেন সাধারণ সংগ্রামী মানুষের, উভয় উভয়কে শক্তি জুগিয়েছেন। বাংলার এই পরিবর্তনে যেমন শহরাঞ্চলে সিভিল সোসাইটির আন্দোলন এক মুখ্য ভুমিকা নিয়েছে তেমনই গ্রামাঞ্চলে সাধারণ কৃষক-শ্রমিকদের দল অনড় মনোভাব দেখিয়েছেন। শত অত্যাচারের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও লালগড়, নেতাই-এর মানুষরা তাদের লড়াই থেকে পিছপা হননি। কেন? মা মাটি মানুষের জন্য? একটি স্লোগানের জন্য? আমার মনে হয় – না। তারা বুঝতে পারছিলেন পরিবর্তন না হলে, প্রশ্ন তুলতে না পারলে অস্তিত্ব আরও বিপন্ন হবে বই কমবে না। আর তাই মা-মাটি-মানুষ একটি কোড, এমন একটি কোড, যা আমাদের যে কোনও রকমের শাসনের দাঁত নখের সামনে রুখে দাঁড়াতে আমাদেরই শক্ত জোগায়। এই কোড নিয়েই অত্যন্ত সহজ ভাবে ব্যাখ্যানের দিকে যেতে চেয়ে লেখক জানান – “শাসকদলকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে যে পরিবর্তনের সূচনা মাত্র হয়েছে, তা কোন পথে এগোবে, কোথায় পৌঁছাতে চায়, তার দিক নির্দেশ করতে পারে তো এই বিতর্কই যে, মা-মাটি-মানুষ কী? গায়ে মাখার সাবান নয়, রান্নার নতুন মশলাও নয়, তাহলে মা-মাটি-মানুষ কী? এ প্রশ্ন অনুচ্চারিত রেখে, আর যাই হোক, সততার সঙ্গে রাজ্য পরিচালনা করা সম্ভব না, বাংলায় পরিবর্তন আনাও সম্ভব হবে না”। আর এই কারণেই বিবেকের নির্দেশ সংক্রান্ত অংশে তিনি নভেম্বরের মহামিছিল সম্পর্কে লেখেন – “ঐ মহামিছিলকে চিরস্মরণীয় রাখা বাংলার দায়। কেননা, ঐ মিছিলই প্রমাণ করেছিল বাংলার মানুষ একই মানবিকতার সূত্রে গাঁথা। আজও অন্যান্য রাজ্যে- মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ, ওড়িশা, হরিয়ানায় বলপূর্বক জমিদখল চলছে, হত্যা-গুলি-ধর্ষণ–কিছুই বাদ যাচ্ছে না, কিন্তু কোনও রাজ্যের রাজধানীতেই তথাকথিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যাদেরকে ধরে নেওয়া হয় উদারবাদী বাজার-অর্থব্যবস্থা, শিল্পায়ন-উন্নয়নের সমর্থক, কেননা উন্নয়নের ক্ষীর-ননী তো এই শ্রেণিই পায়, রাস্তায় নামছে না। কলিঙ্গনগর বা পস্কো নিয়ে কটক-ভুবনেশ্বরে দলহীন মিছিল, ভাট্টা-পারসোল নিয়ে লক্ষ্ণৌ বা দিল্লিতে ঝাণ্ডাহীন মিছিল, জইতাপুর নিয়ে মুম্বাইতে স্লোগানহীন বিশাল জনসমুদ্র – দেখা তো যাচ্ছেই না, এমনকি স্বপ্নও দেখছেনা কেউ”। প্রথম অধ্যায় হৃদয় থেকে হৃদয়ে যেমন মা-মাটি-মানুষের ধারণার সঙ্গে বিশ্বসৃষ্টির দৃষ্টিভঙ্গির সম্পর্ক তৈরি করেছেন তত্ত্বের কারণ তেমনই বাস্তবের শিকড়েও রয়েছে তার বাসভূমি। একদিকে যেমন তৈরি করেছেন তত্ত্বের কারণ তেমনই আরেকদিকে তত্ত্বের মাধ্যমে বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির সংযোগ। স্লোগান তো শুধুমাত্র আইডেন্টিটি তৈরি করে না, তার মাধ্যমে তৈরি করে একটি ভাবনাকেও। স্লোগান নির্মাণের রাস্তায় থাকেন কেউ কেউ আবার কেউ কেউ সেই নির্মাণের বিনির্মাণ করে স্লোগান থেকে পৌঁছান সত্যে। সোমনাথ-এর সন্দর্ভ এই স্লোগান থেকে সত্যে পৌঁছানোর রাস্তা।
বিতর্ক
আর তাই নির্মিতির মধ্যে বিনির্মাণের পদ্ধতিতে তিনি পৌঁছেছেন একটি সরল সাধারণ সত্যে। এটি ইতিহাসের উপর ভিত্তি করেই। অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মা-মাটি-মানুষ বলতে যা বুঝেছেন তাকে সমালোচনা করেছেন তিনি। যে বন্দেমাতরাম ভারতীয় জাতীয়তাবোধের প্রতীক তা কংগ্রেসের পুরনো জাতীয়তাবাদ। তৃণমূলের ওয়েবসাইটে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে তা সেই ভারতমাতা তথা জাতীয় কংগ্রেসের পুরনো জাতীয়তাবাদের দার্শনিক ভিত্তি, যে দেশমাতৃকাবোধ ভারতবর্ষকে ক্রমশ ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতার ৬৫ বছরে আমরা সেই সংকীর্ণ দুর্নীতিগ্রস্ত ভারতবর্ষকেই পাচ্ছি আর সেই ইন্ডিয়াননেস-এর কথাই তিনি বলছেন তৃণমূলের ওয়েবসাইটে। কিন্তু লেখকের ভাষায় – “তাহলে এই এত লড়াই বাংলার বুকে, বাঙালির দ্বারা- তার কোন অবদান নেই? গত চার পাঁচ বছর ধরে দুনিয়ার সব শক্তিশালী ধনবান ক্ষমতাবান শক্তির জোটের বিরুদ্ধে দাঁতে দাঁত চেপে লড়ল যে বাংলা, মা-মাটি-মানুষের মতাদর্শে তার কোনও ছাপ পড়ল না? সব লড়াই তাহলে জাতীয়তাবাদী? ভারতীয় কল্পিত জাতীয়তাবোধ? দুঃখের সঙ্গে হলেও বলতে হচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস মা-মাটি-মানুষের অর্থ নিজেরাও বোঝেনি বা বোঝার চেষ্টাও করেনি। তাহলে আর জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে তফাত কী রইল? হয়তো ক্ষমতা দখল করার উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক খেলাধুলোর অঙ্গ হিসেবেই এসব করা হয়েছে। যে , ঐ ওয়েবসাইটের মা-মাটি-মানুষের ব্যাখ্যা পড়ে যত কৌতূহলী অবাঙালী বুঝবে, অঃ! এই তবে মা– মাটি-মানুষ! পাতি জাতীয়তাবাদ”! সোমনাথের এই মন্তব্য এবং তার যুক্তিবোধ নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে কিন্তু আমরা তাকে অস্বীকার করতে পারছি না। কারণ অস্বীকার করা যায় না ৬৫ বছর ধরে পাতি জাতীয়তাবাদের শিখণ্ডী দিয়ে আমাদের ভুলিয়ে রাখার ইতিহাসগুলো। কিন্তু সেক্ষেত্রে কী পরিবর্তনের কোনও সম্ভাবনা আমরা দেখতে পেলাম? পরিবর্তন মানে তো শুধু ক্ষমতাদখলের পরিবর্তন নয় এবং আমাদের রাজ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অপশাসনের বিরুদ্ধে আরেকটি শাসনের সুত্রপাতও নয়। পরিবর্তন- এর কথা যদি বলতে হয় তবে তো তা আপামর ভারতবর্ষের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ধ্যানধারণাগুলির বিরুদ্ধেও তৈরি করা একটি সচেতন প্রয়াস। মা–মাটি-মানুষের প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্য যে কংগ্রেসি ঘরানার মেকী ও অন্তঃসারশূন্য জাতীয়তাবাদ নয়, তা যদি প্রতীয়মান না হয়, তাহলে তো পরিবর্তনের সব কথাই ঢক্কানিবাদ মাত্র। সুতরাং খনন করতেই হবে লেখকের ভাবনাবৃত্তকে, যা ছাড়া মা–মাটি-মানুষের ভিতরের কথায় আমরা প্রবেশই করতে পারবনা!
মা-মাটি-মানুষ
চারিদিকে কত সহস্র মানুষ! কত দিক! কত রং! আর এরই মধ্যে খুঁজে চলা আমাদের অস্তিত্ব। ‘ভাব ব্যতীত অভাব’ নিয়ে আমাদের যে ভাবনা এবং সৃষ্টির যে বিভাজন রেখা, তাতে কিছুই খুব অস্পষ্ট লাগে। এই অস্পষ্টতা কোনও নির্বিশেষ অনির্দিষ্ট পূর্ণতার অস্পষ্টতা নয়। পূর্ণতাকে ব্যাখ্যা করারা ক্ষেত্রে আমাদের চিরকালীন অস্পষ্টতায় অস্বাভাবিক কিছু নেই। কারণ পূর্ণতা চৈতন্যস্বরূপ, যাকে স্পষ্টভাবে বুঝতে চাওয়ার মধ্যেই রয়েছে অসহায় স্ববিরোধিতা। বলতে চাইছি আমাদের সাহিত্যকে পড়ার, ভাবার, অনুসন্ধানের এবং বিশ্লেষণের মধ্যে রয়েছে এক ভাব ব্যতীত আস্ফালন। এই আস্ফালন, অপ্রাসঙ্গিক না হলেও, ইতিহাস ও শিকড়কে আমাদের জীবন থেকে আলাদা করে দেয়। ‘পাঠ’ হয়ে পড়ে ‘নির্দিষ্ট এবং চিহ্নিত’। বিশেষ করে এই বিষয়টি ঘটেছে আধুনিকতা সম্পর্কিত ধারণার গোঁড়ার দিকেই। আধুনিকতার সন্দর্ভের এক ইউরোপীয় ছায়াপথ আমরা দেখতে পাই। আর, সেই ছায়াপথকেই অনুসরণ করি। কিন্তু যদি এই ছায়াপথ থেকে বেরিয়ে একটু অন্যরকম ভাবে দেখা যেত! আধুনিক সাহিত্যের সিম্বলিজম থেকে শুরু করে নানাবিধ আধুনিক প্রকরণ যে ঔপনিবেশিক-পূর্ব ভারতীয় তথা বাংলা সাহিত্যে ছিল না তা তো নয়। কৃষ্ণের প্রতি রাধার অভিসারের যাত্রায় কি নেই অবজেক্টিভ কোরিলেটিভ? প্রতীক-ইমেজ-এর পাউন্ড কথিত অজস্র চর্চা গানে, বৈষ্ণব পদাবলীতে এবং অবশ্যই দেহতত্ত্বের কবিতায়, গানে, যা লিখিত হয় দৈনন্দিন জীবন সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে? কিন্ত যখন আধুনিক সময়ের যন্ত্রণাবোধ, নিঃসঙ্গতা, অসুখ, অন্ধকার, বিষন্নতার সঙ্গে মিশে যায় প্রকৃতির প্রষন্নতা, মিশে বড় কোনও জীবনবোধের সঙ্গীত, সেখানে ক্ষয়ের সঙ্গে, ক্ষয়িষ্ণুতার সঙ্গে তৈরি হয় নতুন ভাবে কথা বলার পরিসর। এই প্রসঙ্গে যে ভাবনাটি উঠে আসে, তা হল আধুনিকতার ভিন্ন এক সন্দর্ভ। উত্তর- ঔপনিবেশিক রাজনৈতিক প্রভাবে আধুনিকতার যে সংজ্ঞা ও তার দ্বারা প্রভাবের যে সার্বিক বিশ্ববীক্ষাটি রয়েছে, তা যতোটা উত্তর-ঔপনিবেশিক প্রচ্ছায়ার প্রভাবে, তাতোটাই শিকড় থেকে চ্যুত হয় আন্তর্জাতিক ছত্রছায়ায় নিজেকে হারানোর মতো। পরবর্তীকালে আধুনিকতার রূপ, অধুনান্তিকতার রূপ, উত্তর-আধুনিক বিশ্বে বিশ্বায়িত প্রেক্ষিতে যেভাবে পরিবর্তিত হতে হতে এসেছে, সেই ভাবেই বদলে গেছে আমাদের মনন বিশ্ব। তাই আমার ভাবনায় প্রতিটি ‘লোকাল’- এর আছে ‘গ্লোবাল’ হওয়ার সম্ভবনা। আধুনিকতার তাই নিজস্ব ‘ইউনিভার্সালাইজড’ ভাবনা আদৌ হয় কী? তার নিজস্ব শিকড় থেকে খুঁজে নেয় নিজস্ব আধুনিকতা। তার নিজস্ব ভাষার, সংস্কৃতির সামাজিক, আত্মিক, আধ্যাত্মিক যাপনের মধ্যে থাকে পুরনো ছাঁচের সমস্ত প্রকরণ ভেঙে ফেলে চিন্তা ও দর্শনের জগতকে কাব্যের ভাবের মধ্যে অঙ্গীভূত করা। আর এই প্রেক্ষিতে থেকেই সোমনাথ বলেন –“ মা–মাটি-মানুষ একটি মন্ত্র। সৃষ্টিমন্ত্র। সৃষ্টির ঊষাকাল থেকে আজ পর্যন্ত এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সব রহস্য, সব ইতিহাস বিধৃত আছে ঐ ছোট্ট একটি বাক্যবন্ধে, মা-মাটি-মানুষ; তাই এটা সৃষ্টিমন্ত্র। মা-মাটি-মানুষ – এই শব্দবন্ধে শব্দ তিনটির মধ্যস্থিত হাইফেন দুটো প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ। ঐ দুটো হাইফেন বুঝিয়ে দিচ্ছে শব্দ তিনটির মধ্যে কোনও বিচ্ছিন্নতা নেই। একটা থেকে আরেকটায় চলাচল সম্ভাব।বন্তুত একটা থেকেই আরেকটার জন্ম, তারপর থেকে তৃতীয়টা”। প্রতিটি শব্দ হাইফেন দিয়ে জুড়ে আসলে একটিই শব্দ। এই অখন্ডতার তত্ত্বই লেখক এনেছেন ভারতীয় দর্শনের মধ্যে নিহিত থাকা মানুষে মানুষে অভিন্নতার ধারণায়। বিগ ব্যাং থেকে সৃষ্টি জগতে, ইন্দ্রিয়জগতে তিনি মা–মাটি-মানুষের অন্তর্নিহিত জগতের মধ্যে ডুব দিয়ে দেখেছেন পরিবর্তনের আসল রূপটি কোন পথে আস্তে পারত! সভ্যতার সংকটে মানুষ এবং মা-মাটি-মানুষের যে সংঘাত তাও তিনি দেখিয়েছেন, দেখিয়েছেন কীভাবে ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থায় এই দুই- এর মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে! তৃণমূলের ইস্তেহারে আছে – “আমাদের মন্ত্র হোক সকলের পেটে ভাত, সকলের জন্য কাজ। এ বার আসছে মা-মাটি-মানুষের সরকার। জনগণের সরকার। যে সরকার হবে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, উন্নয়ন ও প্রগতির কর্ণধার”। উলটোদিকে লেখক লিখছেন – “সমস্যাটা নিশ্চয় এতক্ষণে পাঠক পাঠিকারা ধরতে পারছেন। মা-মাটি-মানুষ আর জনগণ এক নয়। মা–মাটি-মানুষ জনগণের নতুন নাম নয়। জনগণের থেকেও মা-মাটি-মানুষ অনেক বিশাল,অনেক মহান। তার ফলেই, জনগণের সঙ্গে মা–মাটি-মানুষকে এক করে দেয়ার ফলেই, আবার বস্তাপচা শব্দগুলো – গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ উন্নয়ন, প্রগতি- ইস্তেহারে জায়গা করে নিল”। এরপর লেখক স্বাস্থব্যবস্থা, অর্থব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, সংস্কৃতি, কৃষি প্রতিটি ক্ষেত্রে মা–মাটি-মানুষ কীভাবে কোথায় অপরিবর্তিত থেকে যাচ্ছে (ইস্তেহার ধরে ধরে) এবং কেবল একজন নেত্রীই হবেন একমাত্র ‘পরিবর্তন’ – তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দিয়ে দিখেয়েছেন। শিল্পায়ন , উন্নয়ন এবং অর্থব্যবস্থা নিয়ে তার এই খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ কোনওমতেই বর্তমান শাসকদলের কাজের বিরুদ্ধে নয়। বরং যাতে মা–মাটি–মানুষের দর্শন এই সমস্ত ব্যবস্থায় সহায়তা করে তার জন্য এক ম্যানিফেস্টো। তার এই ম্যানিফেস্টোর অন্যতম বিশেষ দিকটি হল এই ম্যানিফেস্টো ভারতীয় দর্শনবোধের উপর দাঁড়িয়ে, মার্কসীয় নীতি, আধুনিকতম অর্থনৈতিক ডিসকোর্স যেখানে নেগেশন নয়, বরং সো অহম-ই হয়ে উঠেছে মূল দর্শন ও তার প্রয়োগের ভিত্তি। আমার মনে হয় পরিকাঠামো গত জায়গা থেকে বিচার করলে এবং দর্শনগত জায়গায় চোখ রাখলে সোমনাথ মুখোপাধ্যায়ের মা–মাটি-মানুষ, একটি সহজ ব্যাখ্যান হয়ে উঠতে পারে আমাদের বর্তমান শাসকদল এবং আমাদের প্রত্যেকের ভিতরের পরিবর্তনের জন্য একটি অপরিহার্য গ্রন্থ। মাত্র ৬৪ পৃষ্ঠার এই পুস্তিকাটিকে গ্রন্থ তাই বলাই যায়।
মা মাটি মানুষ
একটি সহজ ব্যাখ্যান
সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
মূল্য ২০ টাকা
INNER CIRCLE ADVERTISING(I) PVT.LTD.
31, Dr.SARAT BANNERJEE ROAD,
KOLKATA - 700029(W.B.)