শুরুতেই বলে রাখা যাক, বর্তমান লেখকের দৃঢ় বিশ্বাস, কোভিড-১৯ নামক একটি অতিমারী পৃথিবী জুড়ে ঘটেছে, ঘটছেও - ভয়াবহতা কিছু হ্রাস পেলেও, অতিমারী পুরোপুরি থেমে যায়নি। এই অতিমারী শুধুই মেডিকেল-ফার্মা ইন্ডাস্ট্রি বা কর্পোরেট লবির ছড়ানো গুজব নয় - এই অতিমারী অতীতের বিভিন্ন অতিমারী, যেমন ধরুন স্প্যানিশ ফ্লু, তাদের মতোই ঘোর বাস্তব। এবং এই অসুখে যাঁরা মারা গিয়েছেন, তাঁরা এমনিই মারা যেতেন, এমন নয় - কোভিড-১৯ না এলে, তাঁরা দিব্যি আরো দু-দশ বছর, কমপক্ষে, চালিয়ে যেতে পারতেন। অতএব, যাঁরা এই অতিমারীকে প্ল্যান্ডেমিক বলছেন, মাফ করবেন, আমি তাঁদের সঙ্গে সহমত নই।
এরই পাশাপাশি এটুকুও বলে রাখা যাক, অতিমারীর গুরুত্ব স্বীকার করলেও, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে, ন্যূনতম সামাজিক সুরক্ষার কথা না ভেবে এদেশে যেভাবে "অতিমারী মোকাবিলা" করা হয়েছে, আমি সেই চরমপন্থী পদক্ষেপের অনেকাংশেই সমর্থক নই - অন্তত, যে পদক্ষেপে কোভিড-মৃত্যু ঠেকানোর যুক্তিতে সমাজের এক বড় অংশের অনাহারে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে, তার সমর্থক তো নইই।
মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। অতিমারীর সাধারণ কিছু ধর্ম থাকে। তার অন্যতম, সময়ের সঙ্গে জীবাণু তার মারণক্ষমতা হারায়। জীবদেহে প্রবেশ না করলে, ভাইরাস সেই অর্থে জীবন্ত হতে পারে না। কেননা, ভাইরাস একটি নিউক্লিক অ্যাসিড (ডিএনএ কিম্বা আরএনএ) মাত্র - বাইরে একখানা কোষ প্রাচীর। জীবন্ত কোষে প্রবেশ করার মুহূর্তে জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করার মতো করেই সে কোষ প্রাচীর বাইরে ছেড়ে রেখে শুধুমাত্র নিউক্লিক অ্যাসিডটুকু কোষে প্রবেশ করে - কোষের নিজস্ব নিউক্লিক অ্যাসিডের সঙ্গে মিলে সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটাতে থাকে। সংক্রমণ বলতে এই।
স্বাভাবিকভাবেই, বিবর্তনের সাধারণ নিয়ম মেনে, ভাইরাল জিনোম-এরও (নিউক্লিক অ্যাসিড) লক্ষ্য, ঠিক কেমনভাবে সবচেয়ে দক্ষতার সঙ্গে জিনোমটিকে টিকিয়ে রাখা যায় - পরবর্তী প্রজন্মে জিনের সংবাহন নিশ্চিত করা যায়। হয়ত নিউক্লিক অ্যাসিডের বিন্যাসে সামান্য অদলবদল আনা গেল, যার ফলে আরো দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকার উপযুক্ত হয়ে ওঠা গেল - যাকে বলে মিউটেশন। অথবা, বদল ঘটল আরো প্রাথমিক কোনো স্তরে। মোদ্দা কথা, যে জীবকোষের বাঁচামরার সঙ্গে ভাইরাসের নিউক্লিক অ্যাসিডের সংখ্যাবৃদ্ধি তথা ভাইরাসের অস্তিত্ব নির্ভরশীল, তাকে পটাপট মেরে ফেললে ভাইরাসের টিকে থাকার স্বার্থ দীর্ঘমেয়াদে রক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। কাজেই, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাইরাস নিজের সংক্রমণ-ক্ষমতা বা কর্মদক্ষতা বাড়িয়ে ফেলতে পারে, কিন্তু সাধারণত তার মারণক্ষমতা হ্রাস পায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক অতিমারী এমন স্বাভাবিক নিয়মেই নিয়ন্ত্রিত হয়ে গিয়েছে - কোভিড-১৯-এর ক্ষেত্রে, সম্ভবত, এমনটিই ঘটছে।
ইতিহাস বলে, কোনো অতিমারীই টিকা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়নি। অতিমারী থেমেছে অনেকাংশে নিজের নিয়মে - এবং, অবশ্যই, অংশত, জনস্বাস্থ্যের বিবিধ কার্যকরী পদক্ষেপের সুবাদে। এর সঙ্গে মৃত্যুহার নিয়ন্ত্রণে কাজে লেগেছে চিকিৎসা এবং শুশ্রূষা। কিন্তু, মাথায় রাখা যাক, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি সবক্ষেত্রে হয় না। বিশেষত, এর আগের বড়সড় অতিমারীর ঘটনা একশ বছর আগেকার - চিকিৎসা বিজ্ঞান তখন হামাগুড়ির পর্যায় পার হয়ে সদ্য টলমলে পায়ে হাঁটতে শিখেছে। বিজ্ঞানের বাকি সব শাখার তুলনায়, গত সত্তর-আশি বছরে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি চমকপ্রদ। অতএব, এই দফার অতিমারী নিয়ন্ত্রণে যে নতুন চিকিৎসাপদ্ধতি এবং টিকার গুরুত্ব আরো বেশি করে সামনে আসবে, তা এককথায় অনিবার্য।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির পাশাপাশি সমধিক গুরুত্বপূর্ণ গত অর্ধশতকে চিকিৎসা ভাবনার বদল। বা আরো নিখুঁত করে বলতে চাইলে, চিকিৎসা-অর্থনীতির বাঁকবদল। চিকিৎসা তো বটেই, তার চাইতেও বেশি করে চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণা এখন ব্যক্তি তথা কর্পোরেট পুঁজির নিয়ন্ত্রণাধীন। চিকিৎসার সুফলের পাশাপাশি সমান, অথবা বেশি, গুরুত্বপূর্ণ, চিকিৎসা থেকে লব্ধ মুনাফা। আর ডিজ্যাস্টার ক্যাপিটালিজম-এর সাধারণ ধর্ম মেনেই, অতিমারীর মত বড়সড় ডিজ্যাস্টার বড়সড় লাভের মওকাও বটে।
অতএব, অতিমারী কালে নতুন নতুন ওষুধ বাজারে এসেছে - চটজলদি ছাড়পত্রও মিলেছে - এবং কোম্পানি কয়েকশো কোটি টাকা লাভ গুণে নেওয়ার পরে জানা গিয়েছে, ওষুধগুলো তেমন কাজের নয়। ব্যাপারটা হয়ত খুবই শকিং, কিন্তু একেবারেই বিস্ময়কর নয়।
এই দফার সুযোগ বলতে ভ্যাক্সিন। কর্পোরেট পুঁজি শাসিত গবেষণাকে যা-ই গালমন্দ করা হোক না কেন, তার দক্ষতা বা এফিশিয়েন্সি নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ নেই। আগেকার দিনে একখানা টিকা বাজারে আসতে সময় লেগে যেত কয়েক দশক - কদিন আগেও সময়টা কমপক্ষে আট-দশ বছর - বায়োটেকনোলজি এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের চমকপ্রদ অগ্রগতির সুবাদে সেই সময় কমে দাঁড়াল কয়েক মাসে। কিন্তু, সমস্যা এই, বীজের প্রকৃতিতে উদ্ভাবন ঘটিয়ে ফলনে চমকপ্রদ উন্নতি সম্ভব হলেও, হাজার উন্নতির পরেও, ধান থেকে চারা গজিয়ে সেই চারা থেকে নতুন ফসল রাতারাতি ওঠানো যায় না - তার জন্যে সময় দিতে হয়, সময় প্রকৃতির নিয়ম মেনেই। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ব্যাপারটাও তেমনই।
গবেষণাগারের টিকা বাস্তব জগতে আমজনতার মধ্যে কতখানি কার্যকর, তার ঝুঁকি বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াই বা কেমন, এসব জানার কোনো শর্টকাট উপায় আবিষ্কৃত হয়নি - একমাত্র পথ, সময়সাপেক্ষ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। কোভিডের বিরুদ্ধে প্রায় যুদ্ধকালীন তৎপরতায় একাধিক কোম্পানি একাধিক পথে একাধিক টিকা আবিষ্কার করে ফেললেও, সময়সাপেক্ষ বিশদ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পথে যাওয়ার ধৈর্য্য দেখানো হল না।
মেনে নেওয়া যাক, প্রেম ও যুদ্ধে কোনো কিছুই অনুচিত নয়৷ এই বিশ্বব্যাপী অতিমারী পৃথিবীতে যে অর্থনৈতিক সঙ্কট ডেকে এনেছে, সেই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে, এই অতিমারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে এটুকু তাড়াহুড়ো অনুচিত নয়। কিন্তু, বিপরীতে একথাও সত্য, আর্থিক মন্দা বলতে যেটা, তার মূল শিকার আমজনতা। এদেশের কথাই ধরুন, এই অতিমারীকালে আমরা পেয়েছি নতুন নতুন বিলিয়নিয়ার - উপরের দিকের লোকজন কতটুকুই বা মন্দার শিকার!!! সেদিক থেকে দেখলে, আমার আগের কথাটাকে বদলে নিয়ে কেউ যদি বলেন, ওই প্রেম আর যুদ্ধের কথাটা ঠিকই - কিন্তু, এক্ষেত্রে তাড়াহুড়োর কারণটা প্রেম, কর্পোরেট-প্রেম, কর্পোরেট মুনাফা-প্রেম - অনুচিতকে অগ্রাহ্য করার আসল যুক্তি সেটাই - এমন যুক্তিকে খুব উড়িয়ে দেওয়া যাবে কি??
কিন্তু, আমরা এখনই সেই আলোচনায় ঢুকব না। একটি বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির কর্ণধার তাড়াহুড়ো করে এমন ভ্যাক্সিন দেওয়াকে জেনোসাইডের তুল্য বলে দাগিয়ে দিয়ে জানিয়েছেন, এই জন্যেই তাঁরা নাকি কোভিড ভ্যাক্সিন নিয়ে এগোতে চাননি। কর্পোরেট কর্তাদের বিবেক, নীতিবোধ ও বৃহত্তর স্বার্থের জন্যে দুশ্চিন্তা নিয়ে পূর্বতন অভিজ্ঞতার সুবাদে ধরেই নেওয়া যাক, এ শুধুই আঙুরফল টকের গল্প - নিজেরা আনতে পারেননি, তাই হিংসের চোটে এসব বলছেন। পাশাপাশি একথা মনে করিয়ে দেওয়া যাক, ট্রায়াল একেবারেই হয়নি এমন নয় - এদেশে যে দুটি ভ্যাক্সিন দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে, তার একটির তিন ধাপের ক্লিনিকাল ট্রায়ালের তথ্য প্রথম সারির জার্নালে প্রকাশিত - তাড়াহুড়ো করে হলেও, সে ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা পরীক্ষিত। আরেকটি টিকার সব দফার ট্রায়াল সম্পূর্ণ হয়েছে কিনা, সেসব নিয়ে কিছু পদ্ধতিগত এবং যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন থাকলেও, ট্রায়াল থেকে যেটুকু জানা গিয়েছে, তা থেকে সে টিকার প্রয়োগ বিপজ্জনক, এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর কারণ নেই।
উল্লেখ করে রাখা যাক, এই রাজ্যে যে কোভিশিল্ড ভ্যাক্সিনের প্রয়োগ হচ্ছে, তার মূল অণুটি ব্রিটেন এবং ব্রাজিলে পরীক্ষিত - সে পরীক্ষা নিয়ে সংশয় নেই। এদেশে সেই মূল অণুটির কপি বা প্রতিরূপ অণু তৈরি করে ব্যবহৃত হচ্ছে। সেই কপিটি নতুন ট্রায়ালের মধ্যে দিয়ে না গেলেও, মূলের সঙ্গে ফলাফল ভিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা কম। অতিমারী পরিস্থিতিতে জরুরি ভিত্তিতে ছাড়পত্র দেওয়ার এটুকু ত্রুটি মারাত্মক কিছু ঘটনা নয় - বিভিন্ন দেশেই এমন পথে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে ও হচ্ছে।
আরেকটি কথা বলে নেওয়া যাক, ফাইজারের বায়োটেকনোলজি-জাত ভ্যাক্সিন এদেশে এখনও আসেনি। সে ভ্যাক্সিনে নরওয়েতে তেইশ জন মারা গিয়েছেন। সকলেই ভ্যাক্সিনের কারণেই মারা গিয়েছেন কিনা, তা এখনও স্পষ্ট নয় - তবু, ধরেই নেওয়া যাক, এঁদের মৃত্যুর কারণ ওই টিকা। এই ভ্যাক্সিন সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতির এম-আরএনএ ভ্যাক্সিন - পৃথিবীতে প্রথম। আগামী দিনে এই পথেই হয়ত আসবে অজস্র সংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধী টিকা।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস ঘেঁটে দেখুন, যেকোনো শুরুতে বিস্তর বিপত্তি থাকে। এই টিকাই বা ব্যতিক্রম হবে কেন! তেইশজন মানুষের প্রাণ খুব খুবই মূল্যবান - কিন্তু, মাথায় রাখা যাক, এই তেইশজনের মধ্যে সবচাইতে কমবয়সী মানুষটির বয়স আশির বেশি, কয়েকজন নব্বই-ঊর্ধ্ব। ভ্যাক্সিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া খুব মারাত্মক কিছু ছিল না - জ্বর, সর্দি-কাশি, পেটখারাপ - সেগুলিই এঁদের ক্ষেত্রে, হয়ত বয়সের কারণেই, প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
যাঁরা ভাবছেন, ক্লিনিকাল ট্রায়ালে তাড়াহুড়ো করে ভ্যাক্সিন বাজারে আনার সুবাদেই এঁদের প্রাণ গেল, তাঁদের মনে করাই, ট্রায়ালে এত বেশি বয়সের মানুষদের সচরাচর নেওয়া হয় না। ঠিক এজন্যই পোস্ট-মার্কেটিং তথ্য সংগ্রহের গুরুত্ব এতখানি। হাজার ট্রায়ালের শেষেও বাজারে আসার পরে, যেকোনো নতুন ওষুধ বা টিকার নতুন ও অপ্রত্যাশিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার দেখা মিলতেই পারে - এবং (এখনও পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুসারে) এক্ষেত্রে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো অপ্রত্যাশিত ছিল না, কিন্তু সেই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার অভিঘাতটি ছিল হিসেবের বাইরে।
কিন্তু, আবারও বলি, এই টিকা এ দেশে দেওয়া হচ্ছে না। এবং অন্তত এই রাজ্যে যে টিকা দেওয়া হচ্ছে, সেই কোভিশিল্ড যে নিরাপদ, সে নিয়ে সংশয়ের কারণ তেমন নেই।
তবু, অনস্বীকার্য, সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। একদিকে টিকা বিষয়ে স্পষ্ট ও স্বচ্ছ বার্তার অভাব - আরেকদিকে সেই স্বাধীনতা দিবসের মধ্যেই টিকা দেওয়ার ঘোষণা থেকেই টিকা নিয়ে কিছুটা যেন তাড়াহুড়ো করা হল, সেই গোলমেলে বার্তা - দুইয়ে মিলে সংশয়ের জায়গাটা তৈরি হয়ে গেল। সংশয়ের চেয়েও বড় কথা - সংশয়ের অনুভব। টিকার মতো একটি বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রে, যে প্রকল্প কিনা প্রয়োগ করা হবে দেশের নাগরিকদের একটা বড় অংশের ক্ষেত্রে, সেক্ষেত্রে জনমানসে ভ্যাক্সিন বিষয়ে ভাবনা, বা পাব্লিক পার্সেপশন, খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সংশয়ানুভব নিয়ে প্রকল্প আদৌ সফল হতে পারবে তো?
টিকাকরণ শুরুই হচ্ছে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের দিয়ে - তাঁদের অনেকের মধ্যেই টিকার নিরাপত্তা নিয়ে বিস্তর সংশয় - চিকিৎসা জগতের বাইরের লোকজন কীভাবে নেবেন এই কর্মসূচি?
সংশয় কাটানোর ব্যাপারে সরকার আরেকটু সক্রিয় হতেই পারতেন। ধরুন, একেবারে শুরুতেই যদি দেশ ও রাজ্যের শীর্ষ নেতা-মন্ত্রীরা টিকা নিতেন, একটা মস্ত সদর্থক বার্তা যেতে পারত। ভোটদানে অংশগ্রহণ বাড়াতে যেমন করে সেলিব্রিটিরা ভোট দিয়ে হাতে কালির দাগ নিয়ে হাসিমুখে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান, এক্ষেত্রেও তেমন ব্যবস্থা করা যেতেই পারত। মোদ্দা কথা, পাব্লিক পার্সেপশনে টিকার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর ব্যাপারে আরো বেশি উদ্যোগী হওয়া জরুরি ছিল।
এবং, আরো বিপজ্জনক, এই প্রকাশ্য উদ্যোগের অভাব টিকা নিয়ে সংশয়, তথা সংশয়ানুভব, আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এমনকি, অসুখের বিরুদ্ধে টিকা দেওয়ার ব্যাপারে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের যে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে - তাতে তাঁরা সম্মানিত বোধ করার পরিবর্তে অনেকেই নিজেদের গিনিপিগ মনে করছেন - এমনটি কোনও জনস্বাস্থ্য-কর্মসূচির পক্ষে অনুকূল পরিবেশ নয়।
টিকা নিয়ে দ্বিতীয় কথাটা হল, যে কোনও টিকার কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকবেই। আগেকার এইচওয়ানএনওয়ান ভাইরাসের টিকার ক্ষেত্রে প্রতি দশ লক্ষ মানুষের মধ্যে জটিল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন পনের-কুড়িজন (বিভিন্ন দেশে হিসেব বিভিন্ন রকম)। এক্ষেত্রে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় হ্রস্বায়িত ক্লিনিকাল ট্রায়াল-লব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে বাজারে আসা টিকার ক্ষেত্রে সংখ্যাটা বাড়তেও পারে। বাড়াবাড়ি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার শিকার যদি কেউ হন, তাঁর চিকিৎসা এবং ক্ষতিপূরণের দায় কে নেবেন? আন্তর্জাতিক মঞ্চে বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির লবি খুবই সক্রিয় - বিভিন্ন দেশে রীতিমত আইন রয়েছে, টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ক্ষতিপূরণের দায় কোম্পানির নয় - এক্ষেত্রেও ক্ষতিপূরণ কোম্পানি দেবে না। তাহলে কে দেবে? দেশের সরকার এতদিকে এত খরচা করতে পারেন, অন্তত এক্ষেত্রে বিপদ-আপদ ঘটলে সমস্ত দায়িত্ব সরকার নিচ্ছেন - এটুকু ঘোষণা আস্থা বহুগুণ বাড়িয়ে দিতে পারত। দুর্ভাগ্য, প্রায় বিপরীত বার্তাই সরকারি উপরমহল থেকে এসেছে।
অতএব, ভ্যাক্সিন নিয়ে সংশয় সব মহলে এবং সব পর্যায়ে। সে সংশয় লাঘবের কোনো সিরিয়াস সরকারি প্রয়াস, এখনও পর্যন্ত, দেখা যায়নি।
আর এখানেই সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার জায়গা। কোভিড ভ্যাক্সিন নিয়ে এই সংশয়, বৃহত্তর ক্ষেত্রে ভ্যাক্সিন নিয়েই সংশয় ডেকে আনবে না তো? সৌভাগ্যের বিষয়, পশ্চিমদেশের পথ ধরে এদেশে এখনও অবধি অ্যান্টি-ভ্যাক্সার লবি, যাঁরা কিনা যেকোনো টিকাকরণের বিরুদ্ধে, তাঁরা তেমন কল্কে পান না।
ভ্যাক্সিনের বিরুদ্ধে এদেশে যেটুকু বিরোধিতা, তা পুরোপুরিই কুসংস্কারজনিত - এবং সে বিরোধিতা খুব বিস্তৃত নয়।
অ্যান্টি-ভ্যাক্সার আন্দোলনের বিলাসিতা পশ্চিমের উন্নত দেশে মানায় - ওদেশে শিশুদের সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম - আক্রান্ত হলে বিনা চিকিৎসায় বা অপুষ্টির চোটে প্রাণ হারানোর ভয় কম। এ দেশে প্রতি বছর কয়েক লক্ষ শিশুর প্রাণ যায় সংক্রামক রোগব্যাধিতে - অতিমারী ও লকডাউনের চোটে সার্বিক টিকাকরণ প্রকল্প এমনিতেই যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত, সে ক্ষতির অভিঘাতের সম্পূর্ণ হিসেবনিকেশ এখনও করা সম্ভব হয়নি - এরপর যদি টিকা বিষয়েই সংশয়ের কারণে সর্বপ্রকার ভ্যাক্সিন নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ কমে, তাহলে তার বিপদ সুদূরপ্রসারী।
কোভিড ভ্যাক্সিন নিয়ে সংশয়ের কারণে যদি যাবতীয় ভ্যাক্সিন নিয়েই সংশয়ের বাতাবরণ তৈরি হয়ে যায়, তাহলে প্রতি বছর ভ্যাক্সিন দ্বারা প্রতিরোধযোগ্য অসুখে শিশুমৃত্যুর সংখ্যাটা কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যার কয়েকগুণ দাঁড়াতে পারে।
কোভিড টিকা নিয়ে যে সংশয়, সেই সংশয় দূর করার জন্যে সরকারের অনেক বেশি সক্রিয়তা জরুরি। জরুরি এখনই। জরুরি শুধু কোভিড-টিকার সাফল্যের জন্যেই নয়, বৃহত্তর জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে। এককথায়, জরুরি - জনস্বার্থে।
বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে অনেকেই অভিযোগ করে থাকেন, এই আমলে, যেকোনো কাজেকর্মে প্রকল্পের কার্যকারিতা কিম্বা তার পেছনের সদিচ্ছার চাইতে বহুগুণ গুরুত্ব পায় সে নিয়ে প্রচার - জনমানসে তা নিয়ে হাইপ সৃষ্টি। প্রধানমন্ত্রী যতটা সময় সংসদে থাকেন, তার চাইতে বেশি সময় ব্যয় করেন মন কি বাত প্রকাশে৷ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও বিধানসভার তুলনায় জনসভার মাধ্যমে সরকার চালানোয় স্বচ্ছন্দ। আক্ষেপ এখানেই, কোভিড টিকার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে জনমানসের সংশয়ানুভব দূর করার ব্যাপারে, তাঁরা সঠিক উদ্যোগটুকু দেখিয়ে উঠতে পারলেন না। নাকি, তেমন উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্বটাই ধরতে পারলেন না!
অরিনদার কথাটা ঠিকই, এবং উপরে বিষাণবাবুর পোস্টটিও যথাযতঃ। তবু এই নামহীন ব্যক্তির স্বপক্ষেও কিছু বলার আছে। যদিও আমি এখানে শুধু অরিনদার কথাটা আলোচনা করছি, সামগ্রিক ব্যাপারটা নয়। নিজে ব্যাপারটা চর্চা করলেই তো আর বিশেষজ্ঞ হওয়া যায় না, তাহলে লোকে এত কাণ্ড করে স্পেশালাইজ করার দিকে যেত না। একটা গল্প বলি। জর্জিয়া টেকের বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংএর প্রচণ্ড ইগোয়িস্টিক এক প্রফেসর একবার এক রিসার্চ নিয়ে আমাকে বলেছিলেন - দুটো গ্রুপের মীন কাম্পেয়ার করতে হবে, যাদের ভেরিয়েন্স সাঙ্ঘাতিক রকম আলাদা। আর ওনার এক স্টুডেন্ট, যে স্ট্যাটিস্টিকস কিছুই জানে না, নিজে কোন বইয়ে দেখেছে নাকি যে টু-স্যাম্পল টি টেস্ট করলেই চলবে এক্ষেত্রে। প্রফেসারের যেহেতু নিজের স্টুডেন্টের উপর অগাধ আস্থা, আর তারা নিজে চর্চা করে বুঝেছে ব্যাপারটা, তাই ডিসাইড করল যে বিশেষজ্ঞের কথা শোনার দরকার নেই।
পুনঃ আমি ঐ পেপারে নিজের নাম দিই নি। এতোটা বাড়াবাড়ি সহ্য করা যায় না।
ঠিক কথা।
:-), যে কারণে আগে রুগীরা ইন্টারনেটের সোর্স দিলে আমি মনে মনে চটে যেতাম, মুখে কিছু বলতাম না। আমার বক্তব্য ঠিক এই লাইনে ছিল না। আমি যেটা বলতে চাইছিলাম, কেবলমাত্র এক তরফা বিখ্যাত লোকের মুখনিঃসৃত বাণী ছাড়াও আরো কেউ যদি অন্য বা উল্টো কিছু বলেন, তখন "আপনি কি অমুকের চাইতে বেশী জানেন" না বলে একটু নিজে যাচাই করে নিলে এবং মিলিয়ে দেখে নিলে ভাল হয়। না হলে অমুকে বলেছেন, তাই উহা সত্য, আপনাকেও মানতেই হবে গোছের একটা জেদের ব্যাপার অনেকের থাকে।
সেটা বই পড়ে না বুঝেও হতে পারে, যে উদাহরণটা তুমি দিলে অভ্যু। উল্টো। টাইপ টু এরর। যেখানে একসপারটের কথা বিবেচনা করা উচিৎ, সেখানে সীমিত জ্ঞান নিয়ে তাঁকে অবজ্ঞা। এটাও হয় তো।
একদম ঠিক কথা।
কলকাতায় একটা সময় ছিল যখন লোকাল ট্রেন পুরোপুরি বন্ধ ছিল যাতে করোনা সংক্রমণ না ছড়ায়। গত বছর হাইকোর্টের নির্দেশে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপূজা উদযাপন হলো করোনা বিধি মেনে।গত তিন চার মাস হলো সাবার্বান ট্রেন চালু হয়েছে ।মেট্রো রেল চলছে। ভিড় ট্রেন এ মানুষ গাদাগাদি করে যাতায়াত করছে।রাস্তাঘাটে বেশিরভাগ লোকজন এখন আর মাস্ক না পরেই দোকান বাজার করছে।
কিন্তু দৈনিক করোনা সংক্রমনের সংখ্যা বাড়ার বদলে কমছে।
ওয়েস্ট বেঙ্গল হেলথ বুলেটিন প্রকাশিত তথ্য অনুুযায়ী ১ লা ফেব্রয়ারি ২০২১ নতুন সংক্রমণ হয়েছে ১৭৯ জন।
যেখানে ১ লা অক্টোবর ২০২১ ,৩২৭৫ জন নতুন সংক্রমিত ছিল।
কি এমন ঘটলো যার কারণে সংক্রমণ কমলো ?
এটা কি হার্ড ইমিউনিটি এর কারণে ? যদি বৃহত্তর কলকাতায় হার্ড ইমিউনিটি অর্জন না করে থাকেে তাহলে করোনা নিয়ন্ত্রণের সর্তকতা মেনে না চলা সত্ত্বেও সংক্রমণ দিন দিন কমতে থাকার কারণ কি?এটা শুধু একা আমার প্রশ্ন নয় আমার বন্ধু বান্ধবদেরেও একই প্রশ্ন।
Epidemiologist অরিন্দম বসু আমার উপরের প্রশ্নের উত্তর দিলে উপকৃত হবো ।