কাদির নেলসন আমেরিকান শিল্পী। গায়ের রঙ - কালো। অর্থাৎ, আফ্রিকান-আমেরিকান বলা হয় যাঁদের, তিনি সেরকম এক মানুষ।
তিনি আর আমি এক্কেবারে সমবয়সী - একই বছরে জন্ম আমাদের - কাজেই, কিঞ্চিৎ বাড়তি ভালোবাসা তাঁর প্রতি, স্বাভাবিক।
কাদির ছবি আঁকেন - চিত্রকর - এবং পত্রপত্রিকা বা বইয়ের অলঙ্করণের কাজও করেন। ইলাস্ট্রেটর হিসেবে তিনি বেশ নামজাদা - অন্যান্য স্বীকৃতি-পুরস্কারের পাশাপাশি বাচ্চাদের বইয়ের ডিজাইনিং-এর জগতের সর্বোচ্চ পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন বারদুয়েক।
কালো মানুষের ছবি এঁকেই তাঁর উত্থান। কাদিরের ছবি দেখে মুগ্ধ মাইকেল জ্যাকসন স্বয়ং তাকে অনুরোধ করেন পোর্ট্রেট এঁকে দেওয়ার জন্যে। সে কাজ শেষমেশ হয়ে ওঠেনি - আচমকা মাইকেল মারা যাওয়ায়।
মাইকেল জ্যাকসন মারা যাওয়ার পরে কাদিরের কাছে আবারও অনুরোধ আসে মাইকেলের পোর্ট্রেট আঁকার - অনুরোধ করেন মাইকেলের বন্ধু, জন ম্যাকক্লেইন। কাদির রাজি হননি প্রথমে - পরে রাজি হন, কেননা প্রথম অনুরোধটির সম্মান রাখার সুযোগ আরেকবার পাওয়া দুর্লভ। মাইকেল বলেছিলেন, বড় - খুব বড় করে আঁকা হোক পোর্ট্রেট - ছোট কিছু তাঁর মনে ধরত না।
বছরখানেক ধরে কাদির আঁকেন মাইকেল জ্যাকসনকে - খানিকটা রেনেসাঁসের ধারা মেনে আঁকা ছবি - সামনে এগিয়ে এসেছেন ছবির কেন্দ্রীয় মুখ - মাইকেল জ্যাকসন - প্রায় মধ্যযুগীয় রাজার বেশে, মাথার উপরে রত্নখচিত রাজমুকুট - আধা-ভাসমান। পিছনে আরো কিছু মুখ আর ইমেজারি - মাইকেল জ্যাকসনের জীবন ও সৃষ্টির টুকরো টুকরো ছবি - থ্রিলার,
ব্যাড ইত্যাদি অ্যালবামের দৃশ্য - প্রিয় কিছু সিনেমার মোটিফ - যেমন, ইটি-র স্পেসশিপ। মাপে যথেষ্ট বড় ছবি - উচ্চতায় সাড়ে চার ফুট, প্রস্থে নয় ফুট। যথাযথভাবেই ছবির নাম - কিং অফ পপ।
মাইকেল জ্যাকসনের মরণোত্তর অ্যালবাম "মাইকেল"-এর প্রচ্ছদ হিসেবে ব্যবহৃত হয় এই ছবি - মাইকেল্যাঞ্জেলোর যেমন সিস্টিন চ্যাপেল, কাদির নেলসনের তেমন মাইকেল, এরকম অনেকেই বলে থাকেন - এবং একটি আইকনিক অ্যালবাম কভার হিসেবে কাদিরের ছবিটি ইতিমধ্যেই স্বীকৃত।
কিন্তু, মাইকেল জ্যাকসন বা কাদিরের আঁকা পোর্ট্রেট নিয়ে আজ লিখতে বসিনি। এই ঘোর করোনা-কালে আম্ফান-লাঞ্ছিত বঙ্গদেশে নির্লিপ্ত হয়ে সে আলোচনা করার বা শোনার মানসিকতা খুব বেশী মানুষের নেই।
আজ কাদিরের আঁকা আরেকখানা ছবি নিয়ে কথা বলব।
আমাদের প্রতিবাদী গায়ক গেয়েছিলেন -
" একদিন ঝড় থেমে যাবে
পৃথিবী আবার শান্ত হবে…"
হ্যাঁ, আম্ফান বা কোভিড মহামারী, সব ঝড়ঝাপটা অতিক্রম করে মানুষ বাঁচবে, সভ্যতা বেঁচে থাকবে। ইতিহাস সাক্ষী, আমরা এমন অনেক ঝড় পার করে এসেছি - ভবিষ্যতেও পারব।
কিন্তু, গায়কের পরের কথাগুলো -
"বসতি আবার উঠবে গড়ে
আকাশ আলোয় উঠবে ভরে…" ইত্যাদি ইত্যাদি…
ব্যাপারটা ঠিক ততোখানি প্রাকৃতিক ও স্বয়ংসিদ্ধ নয়, সম্ভবত। অর্থাৎ, ঠিক যতখানি স্বাভাবিকভাবে ঝড় থেমে যায়, বসতি পুনরায় গড়ে ওঠার কাজটা তার চাইতে একটু বেশী সক্রিয়তা প্রত্যাশা করে।
এই করোনাকাল-কে বিষয় করে কাদির নেলসন যে ছবি এঁকেছেন, সেই ছবিটা দেখে নেওয়া যাক। নাম, আফটার দ্য স্টর্ম। ঝড়ের পরে।
আশ্চর্য আশার ছবি। বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন বর্ণের বিভিন্ন জাতির মানুষ তাকিয়ে আছেন চোখে উজ্জ্বল আশা নিয়ে - গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন - দাঁড়িয়ে আছেন পরস্পরের হাতে রেখে ভরসা আর সহমর্মিতার হাত। আকাশে মেঘের ফাঁক থেকে ফুটে উঠছে আলোর রেখা।
ঝড় থেমে যাবে নিশ্চিত - ঝড় থেমে যাওয়াই নিয়ম।
কয়েক লক্ষ মানুষের প্রাণ নিয়ে করোনাভাইরাস নিশ্চিহ্ন হোক না হোক, ভ্যাক্সিন আবিষ্কার হোক বা না হোক - কোভিড মহামারী থেমে যাবে একদিন - যাবেই। কত লক্ষ মানুষকে গৃহহীন করল শেষমেশ, কত লক্ষ মানুষ সর্বস্ব হারালেন মাত্র কয়েক ঘণ্টায়, তার হিসেব কবে মিলবে জানি না - কিন্তু আম্ফান থেমেছে নিজের নিয়মেই।
তবু, ঝড় থামা আর সভ্যতার পুনরুজ্জীবন একই নির্লিপ্তির ফসল নয়। শুধুই নিজেকে সেফ মার্ক করে যে শেষমেশ আর সেফ থাকা যায় না - সে শিক্ষা দিয়েছে করোনা। আর, আম্ফান শেখালো প্রকৃতির সামনে আমরা সকলেই ক্ষুদ্র - আর পাঁচটা (বা বিলিয়ন) প্রজাতির মতোই একটি প্রজাতিমাত্র - মনুষ্য প্রজাতি - সভ্যতা আর বিজ্ঞানের হাজার অহমিকার
শেষেও তা-ই।
অতএব, সঙ্কট অতিক্রম করে নতুন সভ্যতা, নতুন বাসভূমি গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতে চাইলে বাস্তবের মাটিতে পা রেখে এই পরস্পরের হাতটুকু ধরতে পারার নির্ভরতা বড় প্রয়োজন।
আফটার দ্য স্টর্ম - ঝড়ের পরে - আমরা বাঁচব - ঝড়ের নাম কোভিড হোক বা আম্ফান - আমরা বেঁচে থাকব। শুধু হাতটুকু ধরতে পারা - ধরতে শেখা - ভুলে যাওয়া অভ্যেসটা ফের ঝালিয়ে নেওয়া - জরুরী।
সত্যিই ছবিটায় আশার আলো দেখা যাচ্ছে যেন।
মানুষের আসল শক্তিই ত হাত ধরে থাকায়, এমনকি যখন ছুঁয়ে নেই তখনও।
লেখাটা ভালো। কিন্তু কাদিরের আঁকা ছবি আমার তেমিন ভালো লাগেনি।