আমেরিকার গণতন্ত্র নিয়ে চিন্তিত প্রধান সেবক নিজের দেশের আন্দোলনরত লক্ষ লক্ষ কৃষকের কথা শোনার জন্য প্রয়োজনীয় সময় বের করতে পারেননি। অন্যদিকে কৃষকরাও জানিয়ে দিয়েছেন আইন প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত তাঁরা দিল্লি সীমানা থেকে সরবেন না। সারা দেশেই কৃষকদের আন্দোলনের সংহতিতে বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে। পিছিয়ে রইল না কলকাতাও। ধর্মতলায় এসে পৌঁছল কৃষক আন্দোলনের আঁচ।
“যতোদিন কৃষিআইন বাতিল না করা হবে, ততদিন আন্দোলন চলবে এখানে, প্রয়োজনে দিল্লিতে গিয়েও ধর্না দিতে রাজি আছি”- ধর্মতলার লেনিন মূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে বলছিলেন উত্তর ২৪ পরগনা থেকে আসা কৃষক ও গণআন্দোলনের কর্মী কামাল সর্দার। আপাতত কলকাতাতেই ঠাঁই নিয়েছেন তিনি।
৯ জানুয়ারি থেকে ধর্মতলার ওয়াই চ্যানেলের লেনিন মূর্তির পাশে অনির্দিষ্টকালের জন্য দিল্লির সিংঘু বর্ডারে অবস্থানরত কৃষকদের প্রতি সমবেদনা ও সমর্থন জানিয়ে গণধর্না মঞ্চ প্রস্তুত করেছে ‘অখিল ভারতীয় কৃষক সংগ্রাম সমন্বয় সমিতি’-র পশ্চিমবঙ্গ শাখা। সহযোগী সংগঠন হিসেবে পাশে দাঁড়িয়েছে ‘AICCTU’, ‘AIKKS’, ‘ALL INDIA DSO’, ‘AIKM’, ‘NAPM’, ‘AISA’ সহ আরও নানা সংগঠন। আহ্বায়কদের অন্যতম কার্তিক পাল বলছেন, “২১টি সংগঠন ধর্নায় যোগ দেবে বলে জানিয়েছে। আমাদের এই ধর্না অনির্দিষ্টকালের জন্য চলবে।” ধর্না মঞ্চে প্রথমদিনে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা যে এই আন্দোলনকে সর্বত সমর্থন দিচ্ছেন, তা তাঁদের শরীরী ভাষায় ছিল স্পষ্ট। কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে একরাশ ক্ষোভ উগরে দিয়ে সত্তর শীত পার করা ফতেমা বেগম বললেন, “কেন্দ্রীয় সরকার আম্বানি-আদানিদের হাতের তাস। ভারতে আবার নীলকরদের মতো সাহেব দেখা যাচ্ছে। এরা কৃষকদের নিঙড়ে নিয়ে দাসে পরিণত করতে চাইছে প্রতিনিয়ত।”
বলাই বাহুল্য পাঞ্জাবের কৃষকরা যে ‘ক্রোনোলজি’ কয়েক মাস আগেই বুঝতে পেরেছিলেন তা এখন বাংলার কৃষকরা-ও বুঝতে শুরু করেছে। ধর্নার অন্যতম সংগঠক অভীক সাহা বললেন, “পাঞ্জাবের কৃষকরা যে পরিমাণ ফসলের দাম পেয়ে থাকেন, তার থেকে অনেক কম দাম পেয়ে থাকেন বাংলার কৃষকরা। এই আইন নিয়ে আশঙ্কা প্রথম বাংলাতে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা অনুভব করেছে পাঞ্জাবের কৃষকরা। আন্দোলন দানা বাঁধতে বাঁধতে এখন সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যেই হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান সহ নানা রাজ্যের কৃষকরা এই আন্দোলনে যোগদান করে নিয়েছে। বাংলা থেকে নানা সংগঠনের প্রতিনিধিরা দিল্লি গিয়ে এসে কিংবা তাঁদের সমর্থনে মিছিল-সভা করার পরেও ধর্নামঞ্চের প্রয়োজনীয়তা ছিল, যাতে করে সাধারণ মানুষ-ও তাঁদের কী কী ক্ষতি হতে পারে সেই বিষয়ে অবগত হন।”
শুক্রবার দুপুর থেকে শুরু হওয়া এই মঞ্চের চারপাশে বয়স্কদের পাশাপাশি ২০-২৫ বছরের তরুণ-তরুণীদের সংখ্যাও একেবারে কম ছিল না। ‘আইসা’র অত্রি ভট্টাচার্য এসেছিলেন বেহালা থেকে, সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের নাম নথিভু্ক্ত করা তাঁর দায়িত্ব। অত্রির কথায়, “কৃষকরা আমাদের দেশের মূল ভিত্তি, তাঁদের বেকায়দায় ফেলে সরকার নিজের জাত চেনাচ্ছে।” ‘এআইপিডব্লুইএ’ সংগঠনের পক্ষে ধর্নামঞ্চে এসে নিজেদের সমর্থন ও অবস্থান পরিস্কার করেছে চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরী ও ইন্দ্রাণী দত্ত। তাঁদের কথার নির্যাস, “বিজেপি সরকার সাধারণ মানুষের সরকার নয়, আম্বানি-আদানিদের সরকার। এই সরকারকে উৎখাত করতে পারলেই সমাধান পাওয়া যাবে।”
চোখে পড়ার মত ছিল পথচলতি মানুষের কৌতূহল। রাস্তা পারাপারের সময়ে দাঁড়িয়ে পড়ে মঞ্চের ভাষণে যে অনেকেই কান পাতলেন, তার প্রধান কারণ সম্ভবত পরিচিত চেনা রাজনৈতিক দলের পতাকা না-থাকা। ‘এআইকেএসসিসি’ তাঁদের নিজস্ব পতাকা ও ফেস্টুনে গোটা এলাকা ঢেকে ফেলায় সাধারণে আগ্রহ জন্মেছে স্বাভাবিকভাবেই। মঞ্চে যাঁরা হাজির ছিলেন তাঁদের সবাই কৃষক এমন নয়, কেউ পেশায় গাড়ি চালক, কেউ ছাত্র, আবার কেউ বেসরকারি সংস্থার কর্মচারী।
এই কৃষি আইনের ফলে তাঁদেরও ক্ষতি হতে পারে, এই বোধ সাধারণের মধ্যে ধীরে ধীরে জন্মাচ্ছে। আয়োজক এবং অন্যান্য গণসংগঠনের পক্ষ থেকে ভাষণের পাশাপাশি মঞ্চে গান, একক নাটক পরিবেশিত হয়, যার প্রধান বিষয়বস্তুই ছিল বিজেপি সরকারের কৃষিয় আইনের বিরোধিতা।
আগামী দিনগুলির কর্মসূচি প্রসঙ্গে আয়োজকদের তরফে কল্যাণ সেনগুপ্ত জানান, “১৮ জানুয়ারি মহিলা কৃষক দিবস পালিত হবে।” ভাঙর থেকে আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন পেশায় গাড়িচালক বছর চল্লিশের বেলাল শেখ। তিনি বলেন, “কৃষকরা বিপদে পড়লে তা থেকে আমাদেরও নিস্তার নেই। চাষিরাই আমাদের রোজকার খাবার জোটান। প্রতিটি মানুষের এই আন্দোলনের পাশে দাঁড়ানো উচিত।”
লেনিন মূর্তির পাশের রাস্তায় অনেকগুলি চায়ের দোকান, তাদের স্টলের সামনেই পোষ্টার-ফ্লেক্স লাগানো, চা বানানোর মাঝেও বারবার শোনার চেষ্টা করছিলেন কী নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। দলীয় রাজনীতির চেনা সভাসমিতিতে এরকম আগ্রহ বিরল।
এই প্রসঙ্গই উঠে এল প্রাক্তন বিধায়ক হাফিজ আলম সৈরানির ভাষণে। তিনি বলছিলেন, “কৃষি আইনের প্রভাব শুধুমাত্র কৃষকদের উপর নয়, চায়ের দোকান, পানের দোকানদার, ফলের দোকান, খাবারের দোকানসহ নানা জায়গায় পড়বে, শুধুমাত্র চকচকে আলোসমেত অট্টালিকা বানালেই পেট ভরবে না, পেট ভরার জন্য পরিমিত খাবার চাই। সেই খাবারের সংস্থান নষ্ট করছে বিজেপি সরকার।”
ধর্নামঞ্চে বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থা না থাকায় বাধ্য হয়ে জেনারেটর ভাড়া করে বিদ্যুতের সংস্থান করতে হয়েছে আন্দোলনকারীদের।
অসুস্থতার কারণে এই ধর্নায় সশরীরে হাজির থাকতে পারেননি এনএপিএম নেতা সমর বাগচী। টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, “এই আন্দোলন আমাদের নতুন পথ দেখাবে। বিজেপি সরকার ভয় পেয়েছে তাই আন্দোলন দমাবার নানা কৌশল নিচ্ছে প্রতিনিয়ত, কিন্তু কৃষকেরা তা রুখে দিচ্ছেন। আন্দোলনে কৃষকদেরই জয় হবে।”
রামপুরহাটে ধর্নামঞ্চ
বিধানসভা নির্বাচনের প্রেক্ষিত মাথায় রেখে রাজ্যের সব রাজনৈতিক দলগুলি এই ধর্নামঞ্চের দিকে যে লক্ষ্য রাখছে সে কথা নিশ্চিত করে বলা যায়। সংগঠকদের কথা মত গ্রাম ও শহরতলি থেকে ক্রমশ কৃষক ও তাঁদের সমর্থক, অন্যান্য সাংস্কৃতিক ও গণআন্দোলনের কর্মীরা নিয়ত আসা-যাওয়া শুরু করলে যে মেলবন্ধন তৈরি হবে, তা অতীব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
যেভাবে কৃষি আইনকে সামনে রেখে বিজেপিবিরোধী আরও একটি মঞ্চ প্রস্তুত হয়ে উঠছে, তা অতীব তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে।
শুধু কলকাতাতেই নয়, বীরভূমের রামপুরহাটেও কৃষি আইনের বিরোধী লাগাতার ধর্নামঞ্চ শুরু হয়েছে বাংলা সাংস্কৃতিক মঞ্চের উদ্যোগে। সেখানে গরুর গাড়ি করে গ্রামান্তর থেকে কৃষকরা প্রতিদিন পৌঁছে যাচ্ছেন ধর্নামঞ্চে। বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চের সংগঠক সামিরুল ইসলাম এই ধর্না নিয়ে অতীব আশাবাদী। তাঁর প্রত্যয়, রামপুরহাট এক আরম্ভ মাত্র। বাংলার দিকে দিকে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়বে। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, কৃষি আইন প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত এই ধর্না প্রত্যাহৃত হবে না।
মানুষের সম্মিলিত সংহতি, প্রতিরোধ এবং হাত ধরে থাকা ছাড়া এই কালো রাত্রির সুকঠিন অর্গল ভাঙ্গার আর কোন পন্থা আমাদের সামনেই। ইতিহাস এভাবেই এগোয়।
পন্থা আছে।
1 কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষিনীতির বিরুদ্ধে কোলকাতার বা রামপুরহাটের অনশনের বড়়়জোর প্রতীকী মূল্য।
চারমাস সময় আছে। গ্রামবাংলায় পাড়ায় পাড়ায় ছোট ছোট বৈঠক করে চাষিদের বোঝাতে হবে কেন এই আন্দোলন কেবল ধনী কৃষকদের স্বার্থে নয়, বরং সমগ্র কৃষি ও কৃষকদের দেশি বিদেশি বড় পুঁজির আক্রমণ থেকে বাঁচার ও খাদ্য সুরক্ষার লড়াই। তবে আগামী নির্বাচনে বিজেপিকে ঠেকানোর একটা সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।
2 কোলকাতা ও শিল্পাঞ্চলে নতুন পাশ হওয়া চারটে শ্রম আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন দরকার। আমরা ঘুমুচ্ছি।
সম্পূর্ণ সমর্থন রইলো !!এই সরকার।..কেন্দ্রে এবং রাজ্যে ।..কোনো সঠিক আন্দোলন কে গুরুত্ত্ব দেবেনা !!!এরা ভোট চায় ।..ক্ষমতা চায় ।..মানুষের ভালো চায় না !!টোপ দিয়ে ভোট চায় ।..এই দেব ।..সেই দেবো ।..কিন্তু দেশ কে যাঁরা খাদ্য যোগান ।..এই সব নেতা দের যারা পেট ভরান ।..তাদের জন্য এই সরকার গুলো কিছুই করেন না !!!তাই ছড়িয়ে পড়ুক এই আগুন ।..আরো দাবানল সৃষ্টি হোক !!ঝলসে দেয়া হোক এই অপদার্থ নেতা দের ।..!!সাথে রইলাম !!লাল সেলাম !!!