আইন পাশ হচ্ছে আইনসভায়, দ্রুত ও আলোচনাহীন। নতুন আইন কার্যকর হচ্ছে। নাগরিকরা যথারীতি, সে আইন পালনে বাধ্য। গণতন্ত্রের, চালু গণতন্ত্রের নিয়ম এমনই। সারা বিশ্বে এরকমটাই স্বীকৃত, মান্য। সিরিয়াস৯-র এবারের বিষয় আইনের শাসন। এই সংখ্যায় অতিমারী পর্যায়ে আইনের শাসন নিয়ে লিখেছেন সুজাত ভদ্র; উত্তর পূর্ব ভারতে আইনের শাসন বলতে ঠিক কী বোঝায়, সে নিয়ে লিখেছেন পার্থপ্রতিম মৈত্র। এ ছাড়া রয়েছে ভারতে আইনের শাসনের সাম্প্রদায়িক চেহারা নিয়ে একটি আলোচনা, এবং আইনের শাসনের দার্শনিক ও প্রায়োগিক দিককে সমস্যায়িত করে একটি লেখাও থাকল এবারের সংখ্যায়।
ভারত এখনও পর্যন্ত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে স্বীকৃত। সাংবিধানিকভাবে। এখানে আইন ও তার প্রয়োগ, ধর্মনিরপেক্ষ হবার কথা। কথা তো বটে, কিন্তু প্রায়োগিক ক্ষেত্রে কী দেখা যাচ্ছে! কোন মনোভঙ্গি প্রকাশিত হয়ে পড়ছে বারংবার, তার কিছু প্রামাণ্য উদাহরণ সহযোগে এই লেখাটি তৈরি।যা নাই ভারতে, তা নাই ভারতে। এই ধারণাটা প্রাচীন, তবে বহমান। মননে। বহু কাল যাবৎ চলে আসা এই আপ্তবাক্যটিতে প্রথম ভারত মানে মহাভারত। সে ধারণার কথা এখন বলা হল না অবশ্য। বলা হল, ভারত নামের ধারণার কথা, যেখানে আরবি নামধারীরা বর্গির চেয়েও বেশি লুঠেরা, নির্মম, অত্যাচারী। এই ভারতে হিন্দু ছাড়া সকলেই বহিরাগত। বহিরাগত, সুতরাং সন্দেহের চোখে দেখতে হয় তাঁদের, এবং এমনটাই হবে। এই ধারণা সাধারণ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ নিরন্তর চলে আসছে, আসবেও। আর্যরা বহিরাগত কি না, সে নিয়ে বিতর্ক-প্রতর্ক চললেও, সমাজজীবনে তার তেমন প্রভাব পড়ে না। কিন্তু মোসলা মানেই শয়তান, বা অন্তত তার সম্ভাব্য সহচর, এই প্রবল প্রতাপান্বিত ধারণাটির প্রভাব সমাজজীবনের সর্বস্তরে বিদ্যমান। প্রায়োগিক জীবনেও।
গৌরী লঙ্কেশ হত্যকাণ্ডের তদন্তে বারংবার উঠে এসেছে হিন্দু সন্ত্রাসবাদী সংগঠন, তাদের নাম-পরিচয়। দেখা গিয়েছে, বেআইনি অস্ত্র প্রশিক্ষণ শিবির থেকে সবই চলত। ঠিক যেমন সন্ত্রাসবাদী অন্য সব সংবাদ-কাহিনিতে জানা যায়, তেমন ভাবেই অজস্র মোবাইল ফোন, সিম কার্ড নিয়ে একপাক্ষিক যোগাযোগের বন্দোবস্তও থাকত এখানে। সেসব একটু পুরনো সংবাদমাধ্যম ঘাঁটলেই পাওয়া যাবে।
আরও পড়ুন, আইনের শাসন শেষত কতটা কার্যকর হতে পারে?
কিন্তু সেসব খুব প্রচারিত হয় না, বা, সেসব ঘটনাবলী সম্পর্কে খুব একটা অবহিত থাকেন না দেশের মানুষ। থাকতে দেওয়া হয় না। একজন প্রাক্তন গোয়েন্দাপ্রধান, যাঁকে টেলিভিশন চ্যানেলে ডাকা হয়, তিনি প্রকাশ্যে যখন বলতে পারেন, হিন্দুরা সন্ত্রাসবাদী হতে পারে না, তখন বোঝা যায়, এই মগজধোলাই দীর্ঘদিনের পরিকল্পিত। এর রাজনৈতিক দিক অস্বীকার করে লাভ নেই। এ বিধি দীর্ঘদিনের, এখন নির্লজ্জ জলহাওয়া পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের আলোচনা আইন নিয়ে আবদ্ধ, এবারে। আমরা দেখব, ভারতে আইনের শাসন যে নিরপেক্ষ বলে প্রচারিত, তার ফাঁকির জায়গাগুলো। দেখাব, যে সাম্প্রদায়িক মনন আইনের শাসনে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা নিচ্ছে। আমরা চোখ রাখছি একটি সাক্ষাৎকারের দিকে।
আরও পড়ুন, পার্থপ্রতিম মৈত্রের উত্তরপূর্ব ভারতে আইনের শাসন নিয়ে লেখা
২০১৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি হায়দরাবাদের জোড়া বিস্ফোরণের পর দিন। উচ্চপদস্থ নিরাপত্তা আধিকারিকদের ব্যস্তসমস্ত হয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। পুরো সাক্ষাৎকারের সময় জুড়ে ভদ্রলোক অসম্ভব ভদ্রতার সঙ্গে বোঝাতে থাকলেন কীভাবে সংবাদমাধ্যম এবং জনতার চাপে বিভিন্ন সরকারি দপ্তর একাধিক ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বাধ্য হয়। ইতিমধ্যে সঞ্চালক একটি বিতর্কিত প্রশ্ন করে ফেললেন “তাহলে এই ভারতীয় মুজাহিদিনের ব্যাপারটা কী?”
তাঁর অত্যুৎসাহী চোখ জ্বলে উঠল যেন। “আমি ভাবছিলাম কখন এই প্রশ্নটা আপনারা করবেন। আসলে এই নিয়ে আমার একটা তত্ত্ব রয়েছে”, অবসরপ্রাপ্ত “র”(RAW) প্রধানের এ ব্যাপারে কোনও তত্ত্ব থাকবে না, তা কী করে হয়?
আমরা বাস করি সংস্কারাবদ্ধ এক ব্যবস্থার কথা, যেখানে মুসলমানরা শুধু সহজ লক্ষ্যবস্তুই নয়, প্রশ্নহীনভাবেই তারা সম্ভাব্য অপরাধী হিসেবে পরিচিত, মান্যও।
“আই এম চক্রের মূল উৎস অনেক গভীর, অতল, এবং প্রাচীন”। সঞ্চালক মহাশয় তালে তাল মেলাতে থাকলেন, হয়ত খানিকটা মজা দেখার জন্যই - “কত প্রাচীন? স্বাধীনতা? দেশ ভাগ? দেশ ভাগ পূর্ববর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি?”
টেলিভিশনের অ্যাংকরদের এখন কাজ, লড়িয়ে দেওয়া, চাগিয়ে দেওয়া। মোরগ লড়াইয়ের মত কিছু মানুষ পায়ে ছুরি বেঁধে ঘুরতে থাকে, সব পক্ষকে উসকে দেওয়ার রেফারিং যে যত ভাল পারেন, তিনিই তত পরিচিত মুখ। এমনকি টেলিভিশন চ্যানেলেরও মুখ। প্রসঙ্গত, টেলিভিশন অ্যাংকর অর্ণব গোস্বামীর বিরুদ্ধে টিআরপি সংক্রান্ত যে মামলা দায়ের হয়েছে, তা রদের আবেদনের শুনানিতে ১৯.১০.২০২০ তারিখে বম্বে হাইকোর্টে সওয়ালের সময়ে অর্ণবের আইনজীবী সালভে বলেন, তাঁর মক্কেলের বিরুদ্ধে মুম্বইয়ের পুলিশ কমিশনার সাংবাদিক সম্মেলনে অভিযোগ করেছেন। বিপরীত পক্ষের কৌঁশুলি কপিল সিব্বল মনে করিয়ে দেন, অভিযোগ আনা হয়েছিল রিপাবলিক টিভির বিরুদ্ধে। সালভে বলেন, “উনিই রিপাবলিক টিভি” (সূত্র- লাইভ ল)।
অ্যাংকররা, ফলে এই দায়িত্বই পালন করে থাকেন। এবং সামান্যতম ইঙ্গিত ঝাঁপিয়ে ধরে ফেলেন অংশগ্রহণকারীরা। এক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হল না।
“ওহ হো, তার চেয়ে অনেক অনেক আগে। এখন সেসব বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হয়”। স্বগতোক্তি সম্পূর্ণ না করতে পারার আক্ষেপ উনি রাখতে চাইলেন না। গলার স্বর নামালেন। একটু ভয়মিশ্রিত রহস্যজনক ভঙ্গিতে শেষমেশ বলেই ফেললেন “আব্রাহামিক(অর্থাৎ মোহামেডান) রীতিনীতি, বুঝলেন কিনা”। নিজের বলা কথায় যেন নিজেরই শরীরে এক শিহরন অনুভব করতে পারলেন - রক্ত যেন গরম হয়ে উঠল তাঁর। “আব্রাহামিক ধর্মের সাথে প্রাচ্য ধর্মের কোনও মিল নেই মশাই। ইতিহাস লক্ষ্য করুন, ওদের ইতিহাসই ওদের প্রমাণ। ওই ইতিহাসভিত্তিক ধর্মাচরণ আমাদের হিন্দুদের মধ্যে নেই”।
এখানেই শেষ হয়নি। দেশের সাত তারা বা নয় তারা বা এগারো তারা প্রিমিয়াম গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিকাল উইংয়ের প্রাক্তন প্রধান বলে ওঠেন দুটি বাক্য। “জানেন তো, ইসলামে কিন্তু জিহাদ একটি ধার্মিক কর্তব্য, বাধ্যবাধকতা।” আর, “হিন্দু হিংসাত্মক হতেই পারে না”।
আমরা বৈধতাকে চিনতে পারি। একে কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে ভুল করার অবকাশ নেই। নেই যে, তা একবার দেখে নেওয়া যাক।
২০১৩ সালে, ভারতের তদানীন্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল কুমার শিণ্ডে কংগ্রেসের চিন্তন শিবিরে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ শিবিরের মাধ্যমে গেরুয়া সন্ত্রাসবাদ ছড়াচ্ছে আরএসএস, তাঁর কাছে এমন খবর রয়েছে। এর পরেই, সংবাদ চ্যানেলগুলিতে গেরুয়া সন্ত্রাস শব্দবন্ধের যাথার্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করা হয়। বলা হতে থাকে, ইসলামি সন্ত্রাসকে কেন সবুজ সন্ত্রাস বলে বর্ণনা করা হবে না!
আরও পড়ুন, অতিমারী ও রাষ্ট্রের শাসক চোখ নিয়ে সুজাত ভদ্রের লেখা
মুম্বইয়ের প্রাক্তন পুলিশ আধিকারিক এম এন সিং, ১৯৯৩ সালের “ব্ল্যাক ফ্রাইডে” বিস্ফোরণের তদন্তের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক ছিলেন। তাঁর মতে, গেরুয়া সন্ত্রাসবাদ “রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত” একটি শব্দবন্ধ। তাঁর বক্তব্য “জিহাদি সন্ত্রাসবাদের অভিযোগের বিরুদ্ধাচরণ করার জন্যই এই গেরুয়া সন্ত্রাস শব্দের সৃষ্টি হয়েছে।” তাঁর মতে, “গেরুয়া সন্ত্রাসবাদ বলে কিছু হয় না। হিন্দু আস্তিক্যবোধে (পুলিশ সাহেব pantheon শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন বলে খবরে প্রকাশ) এরকম কিছুর অস্তিত্ব নেই।”
আইনের প্রয়োগ যাঁদের মাধ্যমে ঘটে থাকে, আইন শৃঙ্খলার প্রায়োগিক বিশ্লেষণ যাঁদের মাধ্যমে চারিত ও চালিত হয়, তাঁদের এ মত পূর্বধারণা কতদূর অনাসৃষ্টি আনতে পারে, তা সহজে অনুমেয় নয় আর। এ রকম পূর্ব ধারণা কেবল সম্প্রদায়ক্ষেত্রেই বিন্যস্ত নেই। কিন্তু সে প্রসঙ্গে অন্য সময়ে আসা যাবে। আমরা একবার বাটলা হাউস সংঘর্ষের দিকে নজর দিতে পারি। বাটলা হাউজে ২০০৮ সালে পুলিশ হামলা চালায়। জানা গিয়েছে তাদের কাছে খবর ছিল, ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন জঙ্গিরা ওই বাড়িতে লুকিয়ে রয়েছে। পুলিশ সেখানে হামলা চালায় এবং সংঘর্ষে একাধিক ‘জঙ্গি’ নিহত হয়। সংঘর্ষে আহত এক পুলিশ কর্মী, এম সি শর্মা পরে মারা যান। এই মামলার রায় দিতে গিয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত স্তম্ভ আদালত যে রায় দিয়েছিল, তার একটি অংশ, তর্জমা করলে এরকম হচ্ছে-
সারা দিল্লির অগণিত মানুষকে সিংহহৃদয় (ইনস্পেক্টর এম সি শর্মা) মানুষটির মৃত্যুতে বিলাপ করতে, চোখের জল ফেলতে দেখা গিয়েছে। সারা দেশের বুদ্ধিজীবীরা আহত, তাঁরা বিপন্নবোধ করছেন। এ থেকেই প্রমাণিত ওদিনের ঘটনা গোটা দেশের যৌথ চেতনায় কতটা আঘাত দিয়েছে। এ বিষয়টিও অপরাধীর আরও বিরুদ্ধে গিয়েছে।
অতিরিক্ত দায়রা বিচারক রাজেন্দ্র কুমার শাস্ত্রীর দেওয়া এই রায়ে স্পষ্ট যে, আইন নয়, জনমত, জনগণের সেন্টিমেন্ট, ইত্যাদি বিষয় রায়ে ছাপ ফেলেছে। এরকমটা ঘটার কথা নয়। ঘটার কথা নয় বলেই, রূপ কানওয়ার মামলায় সমস্ত অভিযুক্ত ছাড়া পেয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৮৭ সালে রাজস্থানের দেওরালায় স্বামীর চিতায় সতী হন রূপ কানওয়ার। প্রথমে এ ঘটনায় অভিযুক্ত ৪৫ জনকে মুক্তি দেওয়া হয়, এবং পরবর্তীতে, ২০০৪ সালে মুক্তি পেয়ে যান আরও ১১ জন। প্রথম ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করার মত যথেষ্ট আইন ছিল না, এবং পরবর্তী ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ঠিক মত দাঁড়ায়নি বলে মনে করেছেন বিচারক। এ কথার উল্লেখ একেবারে অপ্রাসঙ্গিক হবে না হয়ত, যে, এই ঘটনায় অভিযুক্তদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছিলেন ভারতীয় জনতা পার্টির পদাধিকারী।
বাটলা হাউজের রায় জনগণের মন খারাপের দ্বারা যে ভাবে প্রভাবিত হয়েছে বলে স্বয়ং বিচারক জানাচ্ছেন, রূপ কানোয়ারের ক্ষেত্রে তেমনটা ঘটেনি। রূপ কানোয়ার ঘটার পর সারা দেশ জুড়ে বুদ্ধিজীবীরা প্রতিবাদী হয়েছিলেন, বিভিন্ন ফোরাম গঠিত হয়েছিল এই রায়ের বিরুদ্ধে, গড়ে উঠেছিল তীব্র জনমত।
ভারতে আইনের শাসন আপাতত কাদের বিরুদ্ধে ও কাদের তরফদারিতে রয়েছে, উল্লিখিত ঘটনাক্রমের মাধ্যমে তার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। হিন্দু মাত্রই এই দেশের একমাত্র সঠিক এবং স্বাভাবিক নাগরিক - এই ধারণা আজ সমগ্র দেশে এক রকম পৌরাণিক গাথায় রূপান্তরিত করিয়ে দেবার প্রয়াস অনেকটাই সফল হতে চলেছে, যেখানে পি এন ওকের তেজো মহালয়ার গাঁজাখুরি শাহজাহানের তাজমহলের চেয়ে অনেক মানুষের চোখে বেশি বিশ্বাসযোগ্য। এ দেশে মহৎ স্থাপত্যকে গুঁড়িয়ে দেওয়া কিছু মানুষ কর্ম বলে বিবেচনা করেন, আদালত সে ঘটনায় দোষী খুঁজে পায় না, অন্যদিকে কাল্পনিক মহাকাব্য স্থান পায় লক্ষ্মীর আসনের নিত্যকর্ম পদ্ধতির পাশে। হিন্দুর পুজোকে এদেশে সামাজিক উৎসব আখ্যা দিয়ে দেওয়া হয়, ধর্মীয় আচারকে সামাজিক নাম দিয়ে তাতে মেতে ওঠেন লিবারাল, সেকুলার, মায় নাস্তিক বলে দাবি করা লিবারেলরা।
আমরা একটু আগে বৈধতার কথা বলেছিলাম।