বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে সিরাজগঞ্জ জেলা সদরে বছর চারেক আগে আমি একটি রেস্তোরাঁ খুলি। ফাস্ট ফুড, মিনি চাইনিজের পাশাপাশি বাঙালি খাবারের ব্যবস্থাও আছে। মাঝবয়সী বাঙালি সিঙ্গেল উইমেনের পক্ষে একা এরকম একটি দোকান চালানো সহজ কথা নয়। তবে এর আগে ঢাকাতেও আমি একাই নিজের একটি ছোট্ট কনফেকশনারি চালিয়েছি দীর্ঘদিন, সে অভিজ্ঞতাই সম্বল। বাবা-মা দুজনের বাড়িই সিরাজগঞ্জে। আত্মীয়-স্বজনরাও অনেকে আছেন। এখানে আমাদের একটি দীর্ঘ পারিবারিক পরিচিতি আছে, তাই উটকো ঝামেলা পোহাতে হয় না।
সাংসারে আমি আর অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ মা, দুটি মাত্র প্রাণী। আমার ভাইবোনরা সবাই যে যার পেশায় ব্যস্ত, সকলেই ঢাকায় থাকেন। ভোরে আমি যখন দোকানের সব খাবার তৈরি করে বেরিয়ে যাই, তখন মাকে দেখাশোনার জন্য প্রথম নার্স আসে। বিকালে আসে দ্বিতীয় নার্স, সে রাত নয়টা পর্যন্ত থাকে। আমি বাসায় ফিরলে তবে তার ছুটি। বয়সের সাথে সাথে আমার মা স্মৃতি শক্তি পুরোপুরি হারিয়েছেন, এছাড়া এমনিতে তার কোনো অসুখ নেই। মা নিজের সব কাজ নিজেই করতে পারেন। তবু তার বাথরুম, গোসল, আহার, ঘুম ইত্যাদিতে সব সময় একজন পাশে থাকা চাই। নার্স দুজনই কলেজের ছাত্রী, নার্সিং কোর্স করে পার্ট টাইম ডিউটি করছে। দুজনেই মাকে খুব যত্ন করে। আর আমি বাসা-দোকানের রান্নাবান্না, গৃহকর্ম ইত্যাদি সব একাই সামলাই। আর কোনো কাজের লোক বা কর্মচারী নেই, অনেকটা ওয়ান(উই)ম্যান আর্মির মতোন।
পড়ুন, শুধু কি লকডাউনের জন্যই সাংবাদিক ছাঁটাই?
বলতে দ্বিধা নেই, আমার রেস্তোরাঁর ডেকোরেশন এই মফস্বলের ছোট্ট শহরের মধ্যে বোধ হয় সবচেয়ে সেরা। ইউরোপিয় ধাঁচে সব করার চেষ্টা করেছি। কাউন্টার, চেয়ারটেবিল, কাঠের পার্টিশন দেওয়া কিচেন- সব কিছু একদম ঝাঁ চকচকে, আধুনিক। ডেকোরেশনের পেছনেই অনেক টাকা বেরিয়ে গেছে। দোকানটিতে এক সঙ্গে ২০ জন বসতে পারেন।
ভালই চলছিল সব। দোকানের আশেপাশে কলেজ-স্কুল-অফিস আছে। ছাত্রছাত্রীরা বার্গার, কফি, কোল্ড ড্রিংক্স, ক্যাটবেরি পছন্দ করে। অফিস থেকে লাঞ্চের অর্ডারও পেতে থাকি। কয়েকটি অফিস মিটিং কাম লাঞ্চ আমার দোকানেই হয়। মাঝে মাঝে ছোটখাটো বার্থ ডে পার্টিও হতে থাকে রেস্তোরাঁয়। অর্ডার মতো আগে থেকে সব গুছিয়ে রেখে সব কাজ একাই সামলাই। কাস্টমাররাও আমার খাবার, ব্যবহার ইত্যাদিতে খুশি। আস্তে আস্তে দোকানের সুনাম ছড়াতে থাকে যমুনা পাড়ের ছোট শহরটিতে।
মাঝে কোভিড-১৯ করোনা ভাইরাসের মহামারী যেন বিশাল এক থাবায় স্তব্ধ করে দিল সব। গত ২৫ মার্চ প্রথম দফায় কড়াকড়ির লকডাউনের সময় থেকেই দোকানে তালা ঝুলাতে হয়। এরপর দফায় দফায় লকডাউনের মেয়াদ বেড়েছে। আবার “স্বাস্থ্যবিধি মেনে” দফায় দফায় লকডাউন শিথিল হতে হতে এখন পুরো বাংলাদেশ জুড়ে সব কিছুই যেন আগের মতো চলছে।
ভাইরাসে মৃত্যু ও সংক্রমণ থেমে নেই বলে টিভির সংবাদে দেখি। প্রতিদিন গড়ে ২৫ থেকে ৪০ জন করে করোনায় মারা যাচ্ছেন। মোট মৃত্যুর সংখ্যা সাড়ে তিন হাজার ছাড়িয়েছে। আক্রান্ত হয়ে হাজার হাজার মানুষ হাসপাতালে ছটফট করছেন। মোট সংক্রমনের সংখ্যা প্রায় পৌনে তিন লাখ। আবার সুস্থ হয়েছেন প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার। তবে বেসরকারি হিসেবে কোভিড-১৯ এ মৃত্যু ও সংক্রমণের সংখ্যা অনেক বেশি।
পড়ুন, কেমন করে টিকে আছেন প্রাইভেট টিউটররা?
আবার নূন্যতম স্বাস্থ্যবিধি দূরে থাক, অধিকাংশই মাস্ক ব্যবহারে আগ্রহী নন, এ-ও টিভির সংবাদে দেখি। তবে এর মধ্যে ব্যবসা-চাকরি সব ক্ষেত্রে সব সম্ভাবনা যেন ধসে গেছে। লাখ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। সেপ্টেম্বরের আগে স্কুল-কলেজ খোলার সম্ভাবনা নেই বলে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন।
মাঝে জুন-জুলাই মাসের অতি বর্ষন, উজানের ঢাল আর বন্যা এসে যেন মরার ওপর খাড়ার ঘা দিয়ে গেছে। দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় ডুবেছে নদী পাড়ের গ্রাম, বাড়িঘর, ফসলের ক্ষেত, রাস্তাঘাট। আবার বন্যার পানি হ্রাস পেলে দেখা দিয়েছে নদী ভাঙন। মানুষের ঘরে ঘরে হাহাকার। দোকান-পাট, হাট-বাজার-মার্কেট ইত্যাদি সব খুলে গেলেও মানুষের হাতে টাকা নেই, তাই বিক্রি বাট্টা অর্ধেকও এখন আর নেই। ছোট ছোট ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, চাকরিজীবী অনেকেই কাজ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছেন।
করোনাকালের শুরু থেকে গত চার মাস ঘরবন্দি হয়ে আছি। নার্স দুজনকে ছাড়িয়ে দিয়েছি। দোকান খুলে মাছি তাড়ানোর ঝুঁকি নিইনি। তাছাড়া মা বয়স্ক মানুষ, তাঁর সংক্রমণের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, এ বিষয়ে আপস চলে না। এ এক গুরু দায়িত্বভার। রান্নাবান্না, মার দেখাশোনা একাই করছি।
পড়ুন: মহামারী আর লকডাউনে টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রির হাল
ভাইবোনদের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা হয়। টিভি দেখা, গান শোনা, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে চ্যাটিং ইত্যাদিতে সময় চলে যায়। মার পেনশনের কিছু টাকা আছে। সঞ্চয়ের কিছু টাকাও আছে। ভাইবোনরাও কিছু খরচপাতি দেয়। এই দিয়ে কোনো রকমে চালিয়ে নিচ্ছি। রেস্তোরাঁর দোকানভাড়া সাত হাজার টাকা। করোনাকালে মার্কেট কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে এখন বন্ধ দোকানের জন্য চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা করে ভাড়া গুনি।
কেউ কি বলতে পারেন, কবে করোনার টিকা আবিষ্কার হবে? কবে এই টিকা বাংলাদেশ পাবে? কবে বা ফুরাবে এই দুঃসময়? জানি না, কবে স্বপ্নের রেস্তোরাঁটি আবার খুলতে পারবো! নতুন করে শুরু করতে হবে সব।…
(অনুলিখন : বিপ্লব রহমান)
পড়ে কেমন মনখারাপ হয়ে গেল। সত্যিই কত ছোট বড় স্বপ্ন এভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন... নিশ্চয়ই দিন বদলাবে এরকম ভাবতে ইচ্ছে করে।