আমাদের এই ঘটনা কলকাতার। গত ২৩ জুন সকালে আমার husband-এর করোনা পরীক্ষা হয়, ওইদিন বিকেলেই হসপিটাল থেকে ফোন করে জানানো হয় ওর শরীরে করোনা ভাইরাস রয়েছে। এরপর থেকে শুরু হয় আমাদের লড়াই। আর এই লড়াই শুধু সুস্থ হয়ে ওঠার লড়াই নয়, এই লড়াইয়ের বেশিরভাগটাই সমাজকে শিক্ষিত করার লড়াই। রিপোর্ট পাওয়ার পর থেকে কী কী ঘটেছিলো এক এক করে বলছি -
১. আমরা যে ফ্ল্যাটে থাকি সেখানকার কমিটিতে ফোন করে আমরা নিজেরাই জানাই যে রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে, তাই আজ থেকে আমরা আর বাড়ির বাইরে যাবো না। সকলকে যেন এই কথা জানিয়ে দেওয়া হয়।
২. পরদিন সরকার থেকে আমাদের কাছে ফোন আসার কথা ছিল। কিন্তু সেদিন কোনও ফোন আসেনি।
৩. পরদিন দুপুর ১২টা অবধি অপেক্ষা করেও ফোন না আসায় আমরা নানাভাবে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করার প্রক্রিয়া শুরু করি। প্রায় বিকেল ৫টা নাগাদ সঠিক দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগও হয়। ওরা বলে পরদিন বাড়িতে লোক পাঠাবে। কিন্তু ইতিমধ্যে আমাদের পাড়ায় শুরু হয়ে যায় গন্ডগোল। কারণ আমি আমার ৫তলার ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিলাম। এক মহিলা, ফ্ল্যাটেরই আবাসিক, আমাকে রাস্তা থেকে আঙ্গুল নাচিয়ে বলে 'এই মহূর্তে ঘরে যান, পাড়ায় আপনার জন্য ভাইরাস ছড়াচ্ছে।' এরপর আশেপাশের বাড়ি, ফ্ল্যাট থেকে নানারকম অপ্রীতিকর মন্তব্য আমার কানে আসতে শুরু করে, যেমন আমরা নাকি উপর থেকে রাস্তায় থুতু ফেলছি, আমরা করোনা হওয়ার পরও বাড়িতে লুকিয়ে বসে আছি ইত্যাদি। ওইদিন বিকেলেই পাড়ার মুদিখানার দোকানকে আমি যখন কয়েকটা জিনিস আমার ঘরের বাইরে রেখে যেতে বলি, তখন তারা আমার মুখের উপর ফোন কেটে দেয়। এরপর আমার বরের এক বন্ধু এসে জিনিস এবং প্রয়োজনীও ওষুধ আমাকে কিনে দিয়ে যায়। যদিও সেই কারণেও তাকে কথা শুনতে হয়েছিল।
৪. এর পরদিন স্বাস্থ্য কর্মীরা এলেন। আমি সব রিপোর্ট ওদের দেখলাম। ওরা ছবি তুলে, আমার বরকে পর্যবেক্ষণ করে বাড়িতেই থাকার অনুমতি দিয়ে গেল। কারণ উপসর্গ তেমন কিছু ছিলোনা, বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা সম্ভব ছিল। আর তাছাড়া আমরা যে ফ্ল্যাটে থাকি, সেখানে দুটো আলাদা ঘর এবং ঘর লাগোয়া বাথরুমও রয়েছে। আর বাড়িতে শুধু আমরা দুজনই থাকি।
কিন্তু বিকেলে পাশের পাড়ায় মানে আমার বরের বাড়ির পাড়া থেকে খবর এলো, সেখানে নাকি লোকের মোবাইলে মোবাইলে আমার বরের করোনা রিপোর্ট ঘুরছে। সবাই ওকে নিয়েই আলোচনা করছে। আসলে ওই পাড়ায় আমার শ্বশুরবাড়ি, ওখানে আমার অসুস্থ শাশুড়ি থাকেন আমার ভাসুরের পরিবারের সাথে। আর আমরা শাশুড়ি অসুস্থ বলে ওনাকে এই খবরটা আমরা দিইনি। কিন্তু লোকে যেভাবে বলাবলি শুরু করলো তাতে আমরা তখন বাড়ি বসে চিন্তায় অস্থির। তারমধ্যে আমার ফ্ল্যাটের লোক আর পাড়ার লোকের থেকে তো বাজে বাজে মন্তব্য শুনছিলামই অবিরাম।
৫. অবশেষে চারদিন পর সকালে অনেক কষ্টে যোগাযোগ করলাম আমাদের এলাকার পৌরমাতার সঙ্গে। তিনি এসে আমার সব কথা শুনলেন মন দিয়ে। তারপর তার মধ্যস্ততায় বর্তমানে ফ্ল্যাটে আমরা একটু শান্তিতে আছি। যদিও আমার শ্বশুরবাড়ির পাড়ার অবস্থা বেশ খারাপ। ওখানে কোনও মুদিখানা ওদের মাল দিচ্ছে না, এমনকি এলাকার লোক পর্যন্ত ওদের সঙ্গে কথা বলছে না, দেখলেই পালিয়ে যাচ্ছে বা লুকিয়ে পড়ছে।
৬. এছাড়াও আজ ৬দিন হয়ে গেছে, সরকার থেকে এখনও কেউ গাড়ি নিয়ে sanitization করতে আমাদের এপার্টমেন্টে আসেনি। এমনকি গত ৬দিন ধরে আমার ফ্ল্যাটের বাইরে ময়লার স্তুপ জমে আছে, ময়লা যে নেয় সে আমাদের ফ্ল্যাটে আসছে না করোনা হয়েছে বলে। অন্যরা তাদের বাড়ির ময়লা বাইরে গিয়ে ফেলে দিয়ে আসতে পারছে, কিন্তু আমাদের তো সেই উপায়ও নেই।
রোগ নির্ণয়ের পর, এতগুলো দিন কেটে গেছে। এই কদিনে আমি এতরকম ঝামেলায় পড়েছি যে মাঝেমাঝে বুঝতেই পারি না বাড়িতে অসুস্থ রোগির দিকে নজর দেব, নাকি লোকের কথার জবাব দেব। তার উপর শ্বশুরবাড়ির দিক থেকে এক একদিন এক একরকম খবর। একদিন যেমন ওই পাড়ায় কারা যেন রটিয়েছিল - আমার ভাসুরকে এম্বুলেন্স এসে তুলে নিয়ে গেছে। আমার বরের এক বন্ধুর থেকে খবর পেয়ে আমরা ভাসুরের সঙ্গে যোগাযোগ করি, ও শুনে তো অবাক।
এমনকি এই সময়ই বুঝলাম অনেক কাছের মানুষও কাছের নয়। একসময় যাদের পাশে আমরা সবরকম ভাবে থাকার চেষ্টা করেছি, আজ তারা একটাবার ফোনে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করছে না, তোমাদের কি লাগবে বলো, দিয়ে আসছি। এমনকি এদের মধ্যে কিছু মানুষ আমার শ্বশুরবাড়ির পূর্বপরিচিত হলেও, এই খবর শোনার পর থেকে তাদের খোঁজ পর্যন্ত নেয়নি। কিন্তু মজার কথা হলো তারা জানে, এইসময় ডাক্তার আমার বরকে ভালো ভালো খাবার খেতে বলেছে, আর আমার পক্ষে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সেসব কেনা সম্ভব নয়। আর ওদিকে আমার শ্বশুরবাড়িতে একটা ২বছরের শিশু আর আমার অসুস্থ শাশুড়িকে নিয়ে আমার ভাসুর হিমশিম খাচ্ছে।
সব কিছু দেখে শুনে বারবার মনে হচ্ছে আমাদের লড়াইটা বোধহয় রোগের সঙ্গে নয়, আমাদের মনের মধ্যে জমে থাকা অশিক্ষার অন্ধকারের সঙ্গেই।
তবে সবটাই যে খারাপ এমনটা বলতে পারিনা। যারা সত্যিই বোঝে এবং সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। আমার এবং আমার বরের অনেক কাছের বন্ধু এবং আত্মীয়ই এই খারাপ সময় আমাদের পাশে সবসময় থাকছে এবং ছাতার মতো আমাদের সমস্ত ঝামেলা থেকে রক্ষাও করছে। আমার পাশের ফ্ল্যাটের পরিবার, যাদের সবচেয়ে সমস্যা হওয়ার কথা তারা কিন্তু সব জেনেও সবার বিরুদ্ধে গিয়ে আমাদের পাশে থেকেছেন এই সময়টায়।
করোনা থেকে বাঁচা সম্ভব কিন্তু সামাজিক হেনস্থা থেকে বাঁচা অসম্ভব। কি অদ্ভুত ব্যাপার! ভয় পাই অসুখকে নয়, অসুখের কারণে উদ্ভূত সামজিক ঘৃণা কে।
Amader o Eki obostha..joto na rog nie duschinta tar Cheye besi roger theke udvutu samajik osikkha theke..it is so called Indian society
, সত্যি নিজেদের কে আমরা সময় সময় ঠিক চিনতে পারি না।