যাদবপুর, যাদবপুর, যাদবপুর….কান ঝালাপালা করছে… যেন পৃথিবীর আর কোথাও আমরা হেনস্তা করি না…. যেন আমাদের হাতে রক্ত লেগে নেই!
আমার ছাদে গিয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে….না-আ-আ-আ।
এই হেনস্তা প্রতিনিয়ত, প্রতি মূহূর্তে হয়ে চলেছে। বিভিন্ন ফর্মে। আর তার ফলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে কত কত জীবন। স্বপ্নদীপ মরে গেছে। সবাই মরে না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে কিছু বিশাল না শুকোনো ক্ষত নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
ৱ্যাগিং আসলে ক্ষমতার ভাষা, জোর ফলানোর ভাষা। সে ভাষা কোথায় নেই? আমরা “অপর”কে সম্মান দিতে জানি? জানলে আভিজাত্যের প্রতিমূর্তি জয়া বচ্চন ফিল্মফেয়ারের মঞ্চে ঋতুপর্ণর হাতে বটুয়া ধরাতেন না। জানলে শিক্ষক থেকে অফিসের বস অব্দি আমরা সবাই আমাদের অধস্তনদের সঙ্গে ক্ষমতার ভাষা ব্যবহার করতাম না। আমাদের স্কুলে-কলেজে শারীরিক শাস্তি বন্ধ করার জন্য আইন আনতে হত না।
*
নিজের কথা বলি।
আজ থেকে ২৫ বছর আগে যখন হোস্টেলে ভর্তি হই, তখনই জানতাম যে আমি “মেয়েলি”। সত্যি বলতে কি, স্কুলে কখনও কোনও সমস্যা হয়নি, কিন্তু পাড়া-প্রতিবেশী বুঝিয়ে দিয়েছিল যে আমাকে নিয়ে মজা করা চলে, “লেডিস” বলে ডাকা যেতে পারে। যতই গম্ভীরভাবে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করতাম না কেন যে ওটা “লেডিস” হবে না, লেডি হবে, প্রতিবার ওই ডাকে, ভেতরে রক্তক্ষরণ হত। তাই যখন বয়েজ হোস্টেলে পা রাখি, তখনই ভয়ে ছিলাম যে এবার হয়তো দিনরাতের নরকযন্ত্রণার মুখোমুখি হতে হবে।
মজার ব্যপারটা হল এই যে আমার ওপর সেই আক্রমণ কোনও সিনিয়রের থেকে আসেনি, এসেছিল আমার সহপাঠীদের কাছ থেকে। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে এসেছিল আমার রুমমেটের কাছ থেকে।
হঠাৎ একদিন সকালে আবিষ্কার করলাম যে আমার নাম হয়ে গেছে “সখী”। রুমে, ক্লাসে, মেসে সব জায়গায় আমাকে সেই নামে ডাকা শুরু হল। আর তার সাথে নানা অশ্লীল ইয়ার্কি। একটু উদাহরণ দিয়ে বলি বরং।
“এই সখী, তোর ওটা দাঁড়ায়?”
“হ্যা হ্যা, দাঁড়াবে কি, নেই তো।”
“আরে জানিস তো সখী বসে মোতে।”
“উফফ্, তোকে দেখলেই আমারটা খাড়া হয়ে যায়। একটু নেড়ে দিবি?”
“অ্যাই তুই ক্লাসে আমার পাশে বসবি না। ওটা সারাক্ষণ খাড়া হয়ে থাকে, পড়ানোয় মন দিতে পারি না।”
পুজোর আগে জমানো টাকা দিয়ে দিদির জন্য শাড়ি কিনলাম। রুমে এসে সেই শাড়ি ভাঁজ করে ব্যাগে ঢোকালাম। আমার রুমমেটের সামনেই। পরের দিন মেসে ব্রেকফাস্চ করতে বসেছি, আমার রুমমেট সবাইকে বলল যে আমি না কি আগের দিন রুমে শাড়ি পরে বসেছিলাম, ও হঠাৎ করে এসে দেখে ফেলেছে।
এই সমস্ত “নির্দোষ” ইয়ার্কিগুলো কেমন লাগত সেটা বোঝানোর ক্ষমতা আমার ভাষার নেই। শুধু এটুকুই বলা যে আমারই মত “মেয়েলি” আরেকজন খুব কাছের বন্ধু না হয়ে গেলে আমিও হয় তো তিনতলার বারান্দা থেকে কোনওদিন লাফ দিতাম। হ্যাঁ, আমার রুমটা তিনতলাতেই ছিল।
সেই বন্ধুটিকে নিয়েও জলঘালা কম হয়নি। আমার নাম ছিল সখী, ওর নাম হয়ে গেল “মাগী”। আমরা কখনও একসাথে রুমে থাকলে লোকজন জানলা দিয়ে দেখত আমরা লেসবো-সেক্স করছি কি না।
এই পুরো হ্যারাসমেন্ট থেকে বাঁচতে, আরও বেশি পুরুষ হয়ে উঠতে, সবার সাথে মিশে যেতে শুরু করলাম মদ ও সিগারেট, যা এখনও চলছে। এমনকি একজন গার্লফ্রেন্ডও বানিয়ে ফেললাম। তবুও “সখী” ডাক ঘুচল না।
এই পুরো ঘটনাটা ঘটাত মূলত একজন কি দুজন, কিন্তু বাকিরা সবাই ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। পুরো হোস্টেলে শুধু একজন ছিল যে আমাকে প্রোটেক্ট করার চেষ্টা করত। আরেকজন ছিল সে জেনেরালি এইসব সিচ্যুয়েশনে উঠে চলে যেত, বা হাল্কা করে বলত যে “কী যে করিস না তোরা বাঁ… থাম না।” সেই সময় এইটুকুকেই অনেক মহার্ঘ্য মনে হত। আর একজনকেও দেখিনি এই খেলায় অংশগ্রহণ না করতে। তাদের অনেকের সঙ্গে হয়তো এখনও যোগাযোগ আছে, আমিও ঘটনাগুলো প্রায় ভুলেই গেছি, কিন্তু এদের কখনো মন থেকে ক্ষমা করতে পারব না।
আজ আমি প্রতিষ্ঠিত, ওপেনলি গে। সত্যি বলতে কি, আজ আমায় মেয়েলি বললেও আমার আর কিছু যায় আসে না। তবু এখানে নাম দিচ্ছি না, কেন না ওই দিনগুলোর কথা মনে এলে এখনও ট্রমা হয়। এই লেখাটা সম্পর্কে আলোচনা এখানেই থামাতে চাই, সঙ্গে নিয়ে চলতে চাই না।
তাই আজ যখন ফেসবুক জুড়ে দেখি, সব্বাই পোতিবাদ করছে, তখন বেদম হাসি পায়। এই সব প্রতিবাদী লোকজন কালকেই আবার কোনও মেয়েলি ছেলেকে নিয়ে ঠাট্টা করবে, হয়ত ঊলঙ্গ করে নাচাবে না, কিন্তু মুখ টিপে হাসবে।
সত্যি সত্যি যদি শতাংশের হিসেবে এতজন “পোতিবাদী” থাকত তাহলে স্বপ্নদীপকে মরতে হত না।