মাদ্রাজ IIT’থেকে প্রকাশিত ছাত্র সমাজের কণ্ঠস্বর ‘The Fifth Estate’ পত্রিকায়, IIT’তে পাঠরত এক ছাত্রের ব্যক্তিগত জীবনের প্রকাশ। এ কাহিনি, স্বীকৃতির কাহিনি।
নমস্কার, আপনারা কেউ আমাকে চেনেন না। এমনকি, যাঁরা আমার আশেপাশে থাকেন, তাঁরাও আমাকে ঠিক মতন জানেন না। কারণ, আমার একটি গুপ্ত বৈশিষ্ট্য আছে। এমন একটি বৈশিষ্ট্য, যা আমি দীর্ঘকাল ধরে নিজের মধ্যে দাবিয়ে রেখেছি; আমার এমন একটি অপ্রকাশিত পরিচয়, যা আমি প্রকাশ করতে চাই। আমি প্রকাশ করতে চাই আমার সত্তাকে, স্বীকার করতে না। নিজের প্রকৃত পরিচয়কে স্বীকার করবার কথা জানালে, আমার নিজেকে অপরাধীর মতন শোনাবে। দীর্ঘকাল ধরে আমার গভীরে আটকে রাখা আমার প্রকৃত পরিচয়কে আমি মুক্ত করতে চাই, এবং সেই কারণে সবার প্রথমে আমার নিজেকে, নিজের কাছে মুক্ত হতে হবে। সুতরাং, আমার আসল পরিচয় হল-
আমি সমকামী।
হ্যাঁ, আপনারা ঠিক পড়েছেন, আমি একজন সমকামী। আপনারা যা ইচ্ছা বলতে পারেন আপনার সেই সব বন্ধুদের যারা প্রচলিত সামাজিক কাঠামোর বাইরে ছিটকে গিয়ে তথাকথিত স্বাভাবিক সামাজিক চরিত্রের পরিবর্তে, ভিন্ন রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে – টুইলাইট দেখা উচিৎ নয়; দুর্গন্ধযুক্ত অশ্লীলতার সীমা পার করা উচিৎ নয়; ইত্যাদি। কিন্তু আমি, খোলা-মনে মুক্ত চিন্তায়ে, দ্বিমত পোষণ করে প্রকাশ করছি – আমি সমকামী। প্রকৃত অর্থে, “যে ব্যক্তি শারীরিক দিক দিয়ে নিজের সমলিঙ্গের ব্যক্তিদের প্রতি আকৃষ্ট হয়”।
হ্যাঁ, IIT মাদ্রাজে সমকামীরা আছে। বলা বাহুল্য, প্রত্যেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই আছে, প্রত্যেক স্থানে সমকামীরা আছে। বিস্ময়ের কিছু নেই, প্রকাশ না করলে আপনারা আমাদের আপনাদের মতই স্বাভাবিক মনে করেন। কিন্তু আমরা আপনাদের ছদ্মবেশে মন্দ কাজ করে বেড়ানো ছদ্মবেশী, তাই নয় কি? এবং আমরা খুবই চতুর।
সমকামিতার গম্ভীর রূপটা কলেজে, হাসি-ঠাট্টার বহিঃপ্রকাশ ব্যতীত আর কিছুই না। তুমি যাকে-তাকে গে বলে মজা করো, তুমি বলো তোমার কোন বন্ধু সমকামী হলে তাতে তোমার কিছু আসে-যায় না, কারণ তুমি, ওহঃ, খুউব মুক্তমনা, যুক্তিবাদী, শিক্ষিত আধুনিক, তুমি তোমার কোন বন্ধুকে অন্য কোন পুরুষের সাথে জড়িয়ে হালকা মজা-মস্করা করলে (যদিও আজকাল প্রায় আমাদের সাধারণ কথাতর্বায় সমকামিতা নিয়ে আলোচনা আপনাআপনিই চলে আসে) কিন্তু গভীরে তুমি জানো সে সমকামী নয়। তারপর কুড়ি বছর পার করে যখন রিইউনিয়ানে দেখা হয়, তখন তুমি তার স্ত্রীর কাছে গিয়ে হাসতে হাসতে মজা করে বললে, তার বর একজন সমকামী।
আমি আমাদের দেশের গর্ব IITর কথাই বলেছি।
সমকামিতার ধারণাটা খুবই জটিল, এমনকি আমাদের কাছেও। এটা একটা ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হতে পারে। আবার কখনো মনে হয় তোমাকে এমন এক অপরাধের অপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করা হল, যে অপরাধ তুমি কখনো করোই নি; আর এর পর থেকেই তোমার আশেপাশের লোকজন তোমাকে দেখেও অদেখার ভান করে চলেছে, এড়িয়ে চলেছে। ঈশ্বর তোমাকে এক গুপ্ত বৈশিষ্ট্য দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, এই লুকোনো সত্তাকে কীভাবে সারা জীবন আটকে রাখা যাবে, তার কোন সুনির্দিষ্ট বিধান নেই। তুমি মনে করো সমকামিতা পাপ, কারণ সংস্কৃতিবান আধুনিক ভারতের প্রাচীন রীতিনীতি তোমাকে তাই বলছে। এই রকম অবস্থায় ইন্টারনেটটাই তোমার একমাত্র বন্ধু যেখানে হাজার একটা ফোরামে বিভিন্ন লোক তোমার সমর্থনে, সমকামিতার সমর্থনে দিন রাত্রি ডিবেট করে চলেছে কিন্তু দুর্ভাগ্য, কোন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যাক্তিদের কাছ থেকে এইরূপ কোন সমর্থন পাওয়া যায় না। আমার মনে আছে, একবার আমি আমার এই ‘অসুস্থতা’ সম্পর্কে প্রচণ্ড ভাবে মানসিক দিক দিয়ে ভেঙে পড়ে এক খ্রিস্টান ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে মেইল করি, ভেবেছিলাম, তাঁরা আমাকে কোন যুক্তিপূর্ণ আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান বলবেন। আমি কি উত্তর পেলাম – ধর্মগ্রন্থ থেকে তুলে দেওয়া হাজার একটা কোট-আনকোট ধর্মীয় বচন। আমাকে বাধ্য করা হল স্বীকার করতে যে আমি দোষী এবং, আমার অপরাধের জন্য আমাকে ক্ষমা চাইতে বলা হল। তখন আমার তেরো বছর বয়েস। যে অপরাধ আমি কখনও করিনি, সেই অপরাধের গ্লানি, লজ্জা, হীনমান্যতা আমাকে নিজের মধ্যে কুঁকড়ে দিল, বিষমকামী ব্যক্তিরা নিজেদের ভাগ্যবান মানুন, এই গ্লানির তাপ আপনাদের কখনো ভোগ করতে হবে না। অনেক সময় লেগেছিল আমার (সম্ভবত প্রায় তিন বছর) এই গ্লানি, হীনমান্যতা কাটিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক মনে করতে। আর যখন আমি নিজেকে সাধারণ স্বাভাবিক মানতে পারলাম এক অকল্পনীয় অভূতপূর্ব আনন্দ পেয়েছিলাম। অবশ্যই সাময়িক সময়ের জন্য এক অপূর্ব আনন্দ।
এটা সেই সময়ের কথা যখন আমারা সবাই দিন-রাত্রি এক করে JEE’র জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হ্যাঁ, সেই দুটি কঠিন বছর, বিষমকামীরাও হয়তো এই সময় এমন এক দুশ্চিন্তায়ে ভোগে যার জন্য কাউকে দোষারোপ করা যায় না। এই রকম পরিস্থিতিকে বলা যেতে পারে কি, কোন ব্যাতিক্রম বিষয়ের দুশ্চিন্তা নির্দিষ্ট কোন কিছুর উপর নির্ভর করে না।
এই সময়ে আমি এক বিষমকামীর প্রেমে পড়ি (আপনারা কি বুঝতে পারলেন শুনতে কতটা খারাপ লাগে যখন একটা গোটা ‘সাধারণ মানুষকে’ শুধুমাত্র তার যৌনতার উপর নির্ভর করে পরিচয় দেওয়া হয়)। সে যখনই আমাকে ত্রিকোণমিতির প্রশ্ন নিয়ে ফোন করত, আমার সঠিক উত্তর জানা না থাকলেও তিরবেগে ছুটে যেতাম ওর সাথে কথা বলতে। একমাসের ভিতরে এক ভয়ংকর পরীক্ষা থাকা সত্ত্বেও, এক বিষমকামী পুরুষ কী করে আমার সাথে এক প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলবে, তার চিন্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট করেছি। তার পর, একদম শেষে, নিজের কাছে স্বীকার করলাম, হ্যাঁ আমি আরও ভালো পরীক্ষা দিতে পারতাম।
এরপর আসলাম IITতে, ওহো, দুঃখিত, IITতে যুক্ত হলাম। ‘উত্তেজনা’ শব্দটি খুবই তুচ্ছ হবে যদি আমি IITতে যুক্ত হওয়ার এই কৃতিত্ব এবং একটি উন্নত মেধাযুক্ত জীবনের আশা – এ সকল অনুভূতির বিবরণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহার করি। তোমার চারপাশে উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব ভরা লোকজন। প্রতিনিয়ত প্ররোচনামূলক লেকচার তোমাকে মনে করিয়ে দেয় এক অপূর্ব আকর্ষণীয় ভবিষ্যৎ তোমার সম্মুখে। তা সত্ত্বেও, বাস্তব বেশিদিন চাপা থাকে না। আমি মোটেও বলতে চাই না আমি আমারই ক্লাসে কীরূপ নিস্তেজ আশাহীন উদাহরণ পেয়েছি, সেটা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। এখানে এমন কেউ নেই যে নিজেকে সবার সামনে, প্রকাশ্যে সমকামী হিসাবে পরিচয় দিয়েছে। এমনকি, IITর মতন প্রতিষ্ঠান যেখানে পাঁচ হাজার কিশোর সমেত বুদ্ধিজীবীদের চাঁদের হাট, সেখানে LGBT সম্পর্কে কোন আলোচনা-পরামর্শ হয় না। এখানে GCU এমন একটা হাইপ দেখানো গ্রুপ যারা শুধু মাত্র নিজেদের ব্যস্ত রাখতে LGBTকে ‘কর্তব্যের প্রতি তাদের অবস্থান’-এর অংশ হিসাবে বেছেছে। যেহেতু সমকামী সম্পর্ক বর্ণনার ক্ষেত্রে এটা যথেষ্ট নয়, এখানে অনেক সিনিয়াররা আছে যারা তোমাকে বিভিন্ন ভাবে লিড করে থাকে, যার ভিতর দিয়ে তুমি সমাজের চাপা দেওয়া অব্যক্ত দিক গুলি সম্পর্কে জানতে পারবে, বিশেষ ভাবে সমকামী ঘৃণা সম্পর্কে – সমকামীদের প্রতি সমধর্মিতার ক্ষেত্রে অত্যন্ত আবশ্যক দিক। ঘটোনাচক্রে GCUএর এক প্রতিনিধি আত্মসন্তুষ্টির জন্য প্রচার করে, “আমরা এখানে একটি সুস্থ সৌভ্রাতৃত্বমূলক পরিবেশ গঠন করতে চাই, Gays can clear off”। উপস্থিত শ্রোতাদের ভিতর থেকে সাংঘাতিক প্রশংসা আসে। আমার তরফ থেকেও।
আমার বিল্ডিংয়ের স্টুডেন্টরা ভণ্ড ছাড়া কিছুই না, তারা হায় হায় করে চিৎকার করে বলে, ‘ডুড, ঐ ছেলে গুলোকে দেখো, হাত ধরে যাচ্ছে, ইয়্যাক...’ কিন্তু বিপরীত দিক দিয়ে সমকামী মেয়েদের ক্ষেত্রে তাদের এই প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না, আহ, – IIT এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যারা বিশ্বায়িত দুনিয়ায়, ভবিষ্যৎ লিডারের জন্মস্থান হিসাবে নিজেদের দাবি করে থাকে, কিন্তু উল্লেখযোগ্যভাবে এটি বাদবাকি ভারতের মতোই। তবে সমকামিতার প্রতি ভারতকে কিন্তু কৃতজ্ঞ হওয়া দরকার। আমরাই প্রথম যারা কোন একটা বিষয়ে আলোচনা করবার ক্ষেত্রে সব ধর্মীয় নেতাদের এক আসনে বসাতে পেরেছি।
জয়রাম রমেশ বলেছিলেন, IIT হয়তো তোমাকে ভালো ইঞ্জিনিয়ারিং শেখাতে পারবে না, কিন্তু তোমাকে স্বাতন্ত্র, স্বাবলম্বন এবং স্বাধীন চিন্তাশীল ব্যক্তি হতে শেখাবে। এক বছরেরও কম সময় লেগেছিল আমার ধারণা, “হ্যাঁ, আমি এক বঞ্চিত নিঃসঙ্গ সমকামী, IIT আমাকে স্বীকৃতি দেবে”, থেকে “আমি একজন সমকামী এবং আমি অস্তিত্বহীন নই”-তে পালটাতে।
আমি বুঝতে পারছিলাম এখনই সময়। পৌরাণিক গ্রন্থে থাকা স্বর্গীয় আকাশবাণীর মতন, আমার ভিতর থেকে আসা একটা অকল্পনীয় তীক্ষ্ণ আওয়াজ আমি শুনতে পাচ্ছিলাম, আমি শুনতে পাচ্ছিলাম আমার অন্তরাত্মা চিৎকার করে আমকে বলছে – আমি বেরিয়ে আসতে চাই, আমি বেরিয়ে আসতে চাই এই ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকা জীবন থেকে। আমি এই দ্বিমুখী জীবন আর সহ্য করতে পারছিলাম না – আমার পরিবারকে জানাতে হয়ছিল, আমার প্রকৃত পরিচয় জানানোর জন্য আমাকে প্রায় লক্ষাধিকবার রিহার্সাল নিতে হয়। আমার বোন – মেডিসিন নিয়ে পড়ছে। আমি ভেবেছিলাম সে হয়তো আমাকে বুঝতে পারবে। এক রাতে আমি ওকে ফোন করি আর নিজের সব বক্তব্য ওর সামনে তুলে ধরি। ও সাংঘাতিক আঘাত পায়, আমাকে ধমক দিয়ে বলল IIT আমার মাথা খাচ্ছে। সেই সঙ্গে আমি উপদেশ পেলাম এ ব্যাপারে আর কোন কথা বলতে না, না কাউকে জানাতে। দুর্ভাগ্য, শিক্ষিত লোকদের কাছেও মাঝেমধ্যে যুক্তি পার পেয়ে ওঠে না। ধর্মীয় বিশ্বাসই আমাকে সেদিন শেষ উত্তর দেয়, যা তুমি বিশ্বাস করো বা না করো কিছু আসে যায়ে না। আবার খোলসের ভিতর, নিঃসঙ্গ কচ্ছপ, এটাই তোমার আসল জায়গা। যখনই তুমি তোমার আত্মার কথা স্পষ্ট শুনতে পারো, সে চিৎকার করে বলছে তুমি সমকামী; তোমার ভিতর আপনাআপনি একটা পরিবর্তন ঘটে।
বছরের পর বছর তুমি টিন ম্যাগাজিন পড়ে গেছো এই আশায় যদি কিছু একটা পরিবর্তন হয়, রাতের পর রাত জেগে ভগবানের কাছে বৃথা কান্নাকাটি করে গেছো যাতে উনি তোমাকে বিষমকামী বানিয়ে দেন, তুমি সমকামী, তোমার জন্য তোমার বাবা-মাকে সমাজের কাছে কী রূপ অপদস্থ হতে হবে তার আতঙ্ক; নিষ্ঠুর ভাবে ভাঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়া তাদের সব চাইতে সুখের স্বপ্ন যে তাঁরা তাদের একমাত্র ছেলের সন্তানের সাথে খেলা করছে, তার ব্যথা; তোমাকে ভিতর থেকে শক্ত করে তোলে। কিন্তু আমি, আবারো চেষ্টা করলাম, সহজ সরল ভাবে।
তবে এবার আমাকে বেশি ভয় পেতে হয়নি। আমি, আমার এক কাছের বান্ধবীকে জানিয়েছিলাম, আমার সৌভাগ্য, ও আমাকে বুঝেছিল। ও বলেছিল, ও সবসময় আমার পাশে থাকবে। আমি কে, কী, তাতে কিছু আসে যায় না। আমি সেদিন ওকে যে ভাবে ভালবেসেছিলাম, কোন পুরুষ কোন নারীকে কোন দিনও সেভাবে ভালবাসতে পারবে না।
আমি বেশ সাহসী হয়ে উঠছিলাম, কিছু একটা করে নিজেকে প্রকাশ করবার পদক্ষেপ নিতে শুরু করছিলাম। ‘Desperate Housewives’ দেখার সময় আমি আর আগের মতন জানলা-দরজা বন্ধ করতাম না। এমনকি এক রাত, আমি আমার মা’র সাথে আলোচনা করেছিলাম হিন্দুরা কতটা নারী-বিদ্বেষী হয় যখন তারা সাবরিমালা মন্দিরে মেয়েদের ঢুকতে দেয় না। আমি বোধহয় আমার সীমানা পেরিয়ে যাই, মা আমাকে বলেছিলেন, “তোমার দৃষ্টিভঙ্গি প্রচণ্ড উগ্র। এরপর কী? এবার কি তুমি আমাকে বলতে চাও যে তুমি গে?” ধরা পড়েও ধরা পড়িনি, আমি হঠাৎ চমকে গিয়ে বোকার মতন একটা সাধারণ ব্যাপার হিসাবে উড়িয়ে দিয়ে আমাদের প্রতিবেশীর প্রশংসা শুরু করে আলোচনাটাকে সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে দিয়েছিলাম। আমাদের প্রতিবেশী কতো ভালো, অফিস যাওয়ার সময় মা’কে লিফট দিয়েছে।
সেই পরীক্ষাটা খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়, মনে হয় যেন জীবন পপকর্ন হাতে থিয়েটারে বসে আমাকে মেপে চলেছে। আমার বাবা-মা, আমাকে জীবন দিয়েছেন, নিঃশর্ত ভালোবেসেছেন। তাদের অধিকার আছে জানার, আর আমার কর্তব্য তাঁদের বলার। এক রাত, আমি তাঁদের একসাথে বসিয়ে বললাম, আমি তোমাদের কিছু বলতে চাই। আমি তাঁদের বলেছিলাম তাঁদের সাথে আগের মতন তাস খেলাটা আমি খুব মিস করি। তাঁরা হাসতে হাসতে এক প্যাকেট তাস নিয়ে এসে আমার সাথে বসে পড়েন। খেলাতে আমার মনোযোগ ছিল না, বোকার মতন জোকস বলে যাচ্ছিলাম যে IITর স্টুডেন্টরা কত খারাপ রামি খেলে। আমাদের খেলা শেষ হল, বাবা JEEএর রেজাল্টের জন্য আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। উনি হাসলেন, শুতে চলে গেলেন।
আমার মা আর আমার মধ্যে সম্পর্ক। সবসময় সন্তানদের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে চলা একজন অভিভাবক। আমার মধ্যে কিছু একটা পরিবর্তন দেখে উনি জানতে চাইলেন আমার কী হয়েছে। আমি সব ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছিলাম, বললাম আমার একটা প্রবলেম আছে, আর IIT থেকে বেরিয়ে আমার জীবন ওতটা মধুর হবে না যতটা উনি আশা করেছিলেন। আমার মাথায়ে রক্ত চড়ে গেছিল। উনি আমাকে সব কিছু পরিস্কার করে খুলে বলতে বললেন, যাতে উনি আমাকে ‘সাহায্য’ করতে পারেন। আমি বললাম, ওঁর পক্ষে তা সম্ভব নয়। মা আমাকে অনুরোধ করে বললেন উনি জানতে চান কীসের দুশ্চিন্তা তাঁর সন্তানকে কুরে কুরে খাচ্ছে। এইবার আমি মাকে জানালাম। সব কথা খুলে বললাম। কিছুক্ষণ নিজের মাকে তুমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখলে, কিন্তু যখন, নিজের সন্তানকে লালন-পালন করতে কোথায়ে উনি ভুল করেছেন যে তাঁর ছেলের এই ভয়ংকর ‘রোগ’ দেখা দিলো এবং, IITতে এমন কী হয়েছে যে তাঁর এই ‘ভালো ছেলে’টা যার স্কুলে সবসময় পারফেক্ট র্যা ঙ্ক হত আজ সে এই ভাবে কথা বলছে – এই সমস্ত কথা চিন্তা করে উনি ফেটে পড়লেন, তখন মনে হচ্ছিল একটা আস্ত পাথরের মতন জড় পদার্থ হয়ে গেলে বোধহয় বেঁচে যাবে। আমি জানালাম উনি যখনই বলবেন আমি ওঁকে ওঁর সমস্ত প্রয়োজনীয় সময় দেবো। এমনকি আমি ওঁর সাথে ডাক্তারের কাছে যেতেও রাজি হলাম, যাতে উনি বুঝতে পারেন আমি সম্পূর্ণ ভাবে সুস্থ। মা সব প্রয়োজনীয় কাজ করে রেখেছিলেন। উনি নিজেই বাবাকে জানান(ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আমার বলার প্রয়োজন হয় নি)। মা কয়েক জন ডাক্তারকে ফোন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নেন।
আমরা ডাক্তারের অফিস গিয়েছিলাম। একজন অ্যানড্রোলজিস্টের অফিস। ‘কী! অ্যানড্রোলজিস্ট?’। আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল ধৈর্য নিয়ে সহযোগিতা করা, তাই আমি কোন প্রতিবাদ করিনি। একটা ঠাণ্ডা স্রোত আমার শিরদাঁড়া দিয়ে নেমে গেল। আমারা ডাক্তারের অফিসে ঢুকলাম। আমার বাবা মা ডাক্তারের সাথে কথা বললেন। তাঁরা জানালেন আমার সমন্ধে জেনে তাঁরা কতটা আঘাত পেয়েছেন, দুঃখ পেয়েছেন। তাঁরা আলোচনা করলেন ইন্টারনেট কী ভাবে সমাজটাকে দুষিত করছে, আমাকে সুস্থ করবার জন্য তাঁরা কতটা চিন্তিত, তাঁরা ডাক্তারকে জানালেন আমাকে সুস্থ করবার জন্য কতো আশা নিয়ে তাঁর কাছে এসছেন। ডাক্তার হেসে বললেন, “আজকাল এই সব ননসেন্স ব্যাপার স্যাপার বাচ্চাদের সামনে খুব তুলে ধরা হয়। বাচ্চারা মনে করে এটা একটা ফ্যাশান। কলি যুগ, আমি বলছি আপনাদের, কলি যুগ”। ডাক্তার আমকে ইশারা করে ভিতরে যেতে বললেন। আমি গেলাম। উনি ভিতরে আসলেন। একটা প্রচণ্ড অস্বস্তিকর অশ্লীল কাজ উনি করলেন। আমি শুধু ভাবলেশহীন ভাবে দেখতে থাকলাম। আসলে ওটা ছিল শারীরিক পরীক্ষা করবার একটা পদ্ধতি। উনি পরিক্ষা করলেন আমার পুরুষাঙ্গে, পুরুষত্বে কোন দোষ আছে কি না। আমি পাশ করলাম; আর আমার এই শারীরিক পরীক্ষায় পাশ হওয়াতে উনি সিদ্ধান্তে আসলেন আমার রোগটি মানসিক। উনি বেরিয়ে এসে আমার বাবা-মাকে জানালেন, “আপনাদের ছেলে সম্পূর্ণ সুস্থ! চিন্তা করবার কোন কারণ নেই। প্রথম ধাপে পাশ করে গেছে, পরেরগুলোতে নিশ্চয় সফলতা পাবে। ওকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যান। খুব বুদ্ধিমান ছেলে, দেখুন... ও নিজেই নিজেকে পালটাতে চায়”। আমি সম্পূর্ণ চুপ ছিলাম, কয়েক মুহূর্ত আগে নগ্ন হয়ে পরীক্ষা দেবার ফলে যে একটা আঘাত পেয়েছিলাম। সমস্ত দিন একটাও কথা বলতে পারিনি। পর দিন সকালে, নিজেকে যতটা সম্ভব শান্ত করে আমি জানালাম, আমাকে শহরের সব চাইতে ভাল সাইকিয়াট্রিস্টেরের কাছে নিয়ে যেতে, সব থেকে ভাল সাইকিয়াট্রিস্ট। আমারা বেশ একটা ঝকঝকে, স্টাইলিশ ক্লিনিকে গিয়েছিলাম, আমি খুশিই ছিলাম। হ্যাঁ, ক্লিনিকটা দেখে কিছুক্ষণের জন্য খুশি ছিলাম। তিনটে সেশন। আমার তিনটে ঘণ্টা নিজের সমন্ধে বেস্ট আলোচনা করবার, আমার তিনটে ঘণ্টা আমার ভিন্ন ক্রোমোজোম বিশ্লেষণ করবার, কী কারণে যখন দশ বছরের ছিলাম সেই সময় থেকে আমি সার্টলেস সালমানের ছবি জোগাড় করতাম, কেন আগেকার দিনে সমাজ লেফটিদের শয়তান বলত কিন্তু পরবর্তীকালে তাদের ঐ ভ্রান্ত ধারণা ভাঙে। উনি আমার সব বক্তব্যে সম্মতি জানালেন, “হ্যাঁ, সব সত্যি, তবে তোমাকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তোমার বাবা মা যা বলছেন, তা শোনো”। উনি ওনার বক্তব্য শেষ করলেন। তিন হাজার টাকা আমার বাবা খরচা করলেন ভারতের সব চাইতে বেস্ট সাইক্রাট্রিস্টের সাথে আলোচনা করে, কিন্তু আমারা কী সিদ্ধান্তে আসলাম? আমার বেশি ইন্টারনেট না করে পড়াশোনায় মন দেওয়া উচিত।
এখন আমি কোন কিছু কেয়ার করি না। আমার কর্ম ক্ষেত্রে কিংবা অন্য কিছুতে আমার গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত সঠিক কি না, তা বিচার করবার জন্য অন্য কারুর প্রয়োজন আমি অনুভব করি না। IITতে আমার বন্ধুরা যারা সব সময় আমার যৌনতা নিয়ে প্রকাশ্যে সন্দেহ করত তবুও আমি যাদের বিশ্বাস করতাম, তাদের সবাইকে আমি মেইল করি। তারা আমাকে খুব সাপোর্ট করেছে। এর পর আমি আরও কিছু লোকের সামনে নিজেকে প্রকাশ করলাম, তার পর আরও কিছু লোকের সামনে। আমি খুব মিশ্র প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। কেউ কেউ আমার কথা অবিশ্বাস করেছেন, কেউ বা আমার বক্তব্যকে সম্মান জানিয়েছেন, আমাকে অপমান করেছেন আবার কেউ প্রচণ্ড চমকে গেছেন। হ্যাঁ, IITতে হোমোফোবিক আছে, কিন্তু সব থেকে যেটা প্রয়োজন IITতে অনেক উচ্চমনের ব্যক্তিরা আছেন, তারা আমাকে আশা দিয়েছে। আমি যা ভেবেছিলাম, IIT সেই রকম নয়, কিন্তু সম্পূর্ণ পারফেক্ট বলে কিছু কি পাওয়া যায়? আমি বাস্তব, শেষমেশে ছাত্র সমাজের কণ্ঠ হিসাবে আমার গল্প স্বাধীনতা পেয়েছে। আমি, আমার ক্লাসে কিছু বন্ধুদের পেয়েছি যারা গে-দের ভাল দিক গুলো চিন্তা করে গে হওয়া কতো ভালো তা আমাকে বলে। আমি অনেক প্রোফেসার পেয়েছি যারা আমার কাছে সমকামীদের প্রতি তাঁদের সাপোর্ট প্রকাশ করেছেন। এ সব কিছুর ভিতর দিয়ে আমি দিনের শেষে বিছানায় যাই, জানি আমি এবার নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবো। যদিও আমি অনেক অনুশোচনা, লজ্জা, ডিপ্রেশানের ভিতর দিয়ে গেছি। মেডিক্যাল পরীক্ষা দিয়েছি, আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ছি, সামাজিক বাধানিষেধ পেয়েছি। কিন্তু যখন আমার গল্পটা কতটা ‘প্রেরণাদায়ক’ জানিয়ে আমি আবারও মেইল পাই, তখন আমি অনুভব করি একটা সময় আসবে যখন কোন নতুন সমকামী নিজের প্রকৃত পরিচয় দিতে কখনোই বিব্রত বোধ করবে না, সে কাঁদবে না বরং লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে টিভি সিরিয়ালের কোন নতুন হিরোর উপর তার ক্রাশের কথা সে তার রুম মেট’দের কাছে গল্প করবে।
আমি অনুভব করি এই রকম একটা ভবিষ্যত আসবে।
অনুবাদঃ মৌমিতা ঘোষ
লেখাটি গুরুচণ্ডা৯ প্রকাশিত 'আমার যৌনতা' সংকলনের দ্বিতীয় সংস্করণে অন্তর্ভুক্ত।