কল্পনা চাকমা |
জ্বলি ন' উধিম কিত্তেই! যিয়ান পরানে কয় সিনে গরিবে বযত্তান বানেবে বিরানভূমি ঝারান বানেবে মরুভূমি গাভুর বেলরে সাঝ সরয মিলেরে ভাচ।
রুখে দাঁড়াব না কেন! --কবিতা চাকমা। |
যতবারই দূর পাহাড়ে যাই, ততবারই মনে পড়ে হারিয়ে যাওয়া পাহাড়ি মেয়ে কল্পনা চাকমার কথা। আজ থেকে ঠিক ১৪ বছর আগে, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন বাংলাদেশের এক কোনে রাঙামাটির দুর্গম বাঘাইছড়ির নিউ লাইল্যাঘোনা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে অপহৃত হন তিনি। কল্পনা চাকমা ছিলেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদিকা। ...
আমি তখন দৈনিক আজকের কাগজের ক্ষুদে রিপোর্টার। এক সন্ধ্যায় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) নেতা সঞ্চয় চাকমা (পরে পার্বত্য শান্তিচুক্তি বিরোধী ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট -- ইউপিডিএফ'র দলছুট নেতা, এখন প্রবাসী) আমাকে টেলিফোনে খবর দেন, বিপ্লব, আমাদের একটি মেয়ে রাঙামাটি থেকে হারিয়ে গেছে। আমি বিষয়টি পরিস্কার করে জানতে চাই, হারিয়ে গেছে মানে? সঞ্চয় বলেন, সেনা বাহিনী অস্ত্রের মুখে তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেছে। ...
সঙ্গত কারণেই আমি ঘটনাটি তাকে বিস্তারিত টেলিফোনে না বলার অনুরোধ করি। ঐ রাতেই হাজির হই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সের ছাত্র সঞ্চয় চাকমার জগন্নাথ হলের দণি বাড়ির ৩২৪ নম্বর কক্ষে। ঐ কক্ষটি চারজন ছাত্রের জন্য বরাদ্দ হলেও গোটা দশেক পাহাড়ি ছাত্র সেখানে বাস করতেন। আমি, সঞ্চয় ও পিসিপির আরো কয়েকজন মিলে কল্পনা চাকমা অপহরণের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি। আমি পিসিপি নেতাদের জানাই, খবরটি পত্রিকায় ব্যাপকভাবে প্রকাশ করা দরকার। কারণ এই একটি অপহরণ সংবাদের মধ্যদিয়েই সে সময়ের অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের বহু গণহত্যা, গণধর্ষণ, গুমখুন, অপহরণসহ নানা মানবাধিকার লংঘনের খবর ফাঁস করা সম্ভব।
সঞ্চয় আমাকে জানান, পিসিপির পক্ষ থেকে শিগগিরই একটি দল ঘটনাস্থলে যাচ্ছে। এই দলটি সরেজমিনে খোঁজ-খবর নিয়ে জানবে, কল্পনা চাকমা এখন কোথায়? আমি তাকে অনুরোধ করি, এই দলে আমাকে অন্তর্ভূক্ত করার জন্য। তিনি রাজী হন। ঐ আলাপে তিনি আরো জানান, সরেজমিনে এই অপহরণ সংবাদ সংগ্রহ করার জন্য আমি যেন তৈরি থাকি। শিগগিরই আমাকে খবর দেওয়া হবে।
এই ফাঁকে জানিয়ে রাখি, পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের (২ ডিসেম্বর, ১৯৯৭) আগে সে সময় পাহাড়ের এই সব মারাত্নক মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা প্রায়ই গণমাধ্যমে প্রকাশ হতো না। সেনা বাহিনী রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান -- পার্বত্যাঞ্চলের এই তিনটি জেলার সাংবাদিকতা তো বটেই, প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, উন্নয়ন, জন-জীবনও নিয়ন্ত্রণ করতো। তাই স্থানীয়দের পক্ষে এসব তথ্য-সংবাদ প্রকাশ করা প্রায়ই সম্ভব হতো না।
তখন পাহাড়ের সঙ্গে সমতলের যোগাযোগ ব্যবস্থাও ছিল খুব নাজুক। একে পাহাড়ের পথ-ঘাট দুর্গম, তার উপর অ্যানালগ টেলিফোনের যুগ চলছে। উপজেলা পর্যায়ে এ সব ফোন মাসের পর মাস বিকল থাকে। মোবাইল ফোনের সুবিধা পাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। এছাড়া যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা সঙ্কেÄও প্রায় পাহাড়ের এখানে সেখানে সেনা বাহিনীর সঙ্গে সাবেক গেরিলা গ্রুপ শান্তিবাহিনীর চলছে সশস্ত্র লড়াই। সব মিলিয়ে পাহাড়-যাত্রা ছিল ব্যাপক ঝুঁকিপূর্ণ।
এর পরেও পিসিপি ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তির বরাত দিয়ে জাতীয় দৈনিকগুলোতে কল্পনা চাকমা "নিখোঁজ' হওয়া সংক্রান্ত কিছু টুকরো খবর প্রকাশ হয়েছিল।
এরই মধ্যে ঘটে যায় আরেক দু:খজনক ঘটনা। কল্পনাকে উদ্ধারের দাবিতে ২৭ জুন পিসিপি তিন পার্বত্য জেলায় হরতালের ডাক দেয়। হরতাল চলার সময় বাঘাইছড়িতে পিসিপির মিছিলে নিরাপত্তা বাহিনী গুলি চালালে নিহত হন পিসিপির রূপম, সুকেশ, মনতোষসহ চারজন ছাত্রকর্মী। সংবাদপত্রে এই খবরটিও ছোট আকারে প্রকাশ হয়।
জুলাইয়ের প্রথমার্ধে সঞ্চয় চাকমা আমাকে খবর দেন, আমার যাত্রার দিনক্ষণ ঠিক করা হয়েছে। ঢাবির জগন্নাথ হলে সাক্ষাতের পর আমার গাইড ঠিক করা হয় দিলীপ কুমার চাকমা নামে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অনার্সের ছাত্রকে। দিলীপও পিসিপি কর্মী, তার গ্রামের বাড়ি বাঘাইছড়ির কাচালং নদীর পাড়ে, কল্পনাদের বাড়ির কাছেই। এ কারণে সে ঐ এলাকার পথ-ঘাট খুব ভালো জানে।
এক ভোরে দিলীপসহ আরো কয়েকজন পিসিপি কর্মীর সঙ্গে আমি যাত্রা শুরু করি। তখন ঢাকার সঙ্গে তিন পার্বত্য জেলার একমাত্র সরাসরি যাত্রীবাহি যোগাযোগের মাধ্যম ছিল লক্কড়-ঝক্কড় "ডলফিন পরিবহন'। কিন্তু আমরা পাহাড়ের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার স্বার্থে ডলফিন পরিবহন এড়িয়ে চলি। গুলিস্থান থেকে মিনিবাস ধরে ফেনি পর্যন্ত পৌঁছাই। এরপর আবারো "পার্বতী পরিবহন' এর মিনিবাস ধরে খাগড়াছড়ি। সেখানে থেকে চাঁদের গাড়ি (ওভারলোডেড ভাড়ার জীপ) ধরে দীঘিনালা হয়ে বাঘাইছড়ি বাজার।
এরপর দীর্ঘ পথ হেঁটে হেঁটে আমরা পৌঁছাই স্থানীয় একটি কিয়াং ঘরে (বৌদ্ধ মন্দির)। দুপুর গড়াতে শুরু করেছে ততক্ষণে। কিয়াং-এর কয়েকজন ভান্তে আমাদের কল্পনাদের এলাকা সর্ম্পকে খোঁজ-খবর দেন। পিসিপিকর্মীরা তাদের কাছে বারবার জানতে চাইছিলেন, সেখানে যাওয়াটা কতটুকু নিরাপদ? কারণ তাদের সবটুকু উদ্বেগ ঘিরে রাখে ঢাকা থেকে আসা সাংবাদিকটিকে ঘিরেই।
ভান্তেরা আমাদের আশ্বস্ত করেন, ২৭ জুনের সংঘাতের পর কল্পনাদের এলাকা এখন শান্ত। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে কল্পনাদের গ্রামে বেশীক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। প্রয়োজনীয় খোঁজ-খবর নিতে বড়জোর দু-এক ঘন্টা কাটানো যেতে পারে।
এ সময় সেখানে এসে হাজির হন এক অতি বৃদ্ধা সন্ন্যাসী। সকলে তাকে "সাধু মা' বলে ডাকেন। তাঁর উচ্চারণে ফুটে ওঠে আদি চাকমা ভাষার বোল। তিনি ভেবেছিলেন, আমরা বোধহয় কল্পনা চাকমার উদ্ধারকারী দল। করজোড়ে কপালে প্রণাম ঠেকিয়ে তিনি বলেন, তোমরাই বুঝি ভগবান!
ঐ কিয়াং ঘরেই মাদুর পেতে আমরা চাকমা ব্যঞ্জনে সেরে নেই দুপুরের খাবার। খানিকটা বিশ্রাম নিয়েই আমরা আবার হাঁটতে শুরু করি। শেষ বিকেলের রোদে আমরা পৌঁছাই রূপকারী গ্রামে। সেখানে রূপালি প্রাথমিক বিদ্যালযের মাঠের এক কোনে মঞ্চ নির্মাণ করে পিসিপি শোকসভার আয়োজন করেছে। মঞ্চের পেছনে সদ্য নির্মিত চারটি কালো রঙের স্মৃতিস্তম্ভ মনে করিয়ে দেয় কল্পনা চাকমাকে উদ্ধারের দাবিতে চারজন তরুণের জীবনদানের কথা।
শোকসভাকে ঘিরে কয়েকটি গ্রামের আদিবাসী নারী-পুরুষ-শিশু ভীড় জমান। পুরো স্কুল মাঠ যখন কানায় কানায় পূর্ণ, তখন মঞ্চে উঠে কল্পনা চাকমাকে নিয়ে লেখা গান ধরেন স্কুল শিক্ষক ব্রহ্মকুমার (লালফা) চাকমা। এবার সমবেশে ওঠে শব্দহীন কান্নার রোল। মঞ্চে পিসিপির ছেলেমেয়েরা বক্তৃতা দিতে গিয়ে বার বার খেই হারিয়ে ফেলেন, কান্নায় তাদের গলা বুজে আসতে চায়।
তথ্য-সাংবাদিকতার পেশাগত কাজে অনেক আগেই প্রত্যদর্শন হয়েছে লোগাং (১০ এপ্রিল ১৯৯২, খাগড়াছড়ি) ও নান্যাচর গণহত্যা (১৭ নভেম্বর ১৯৯৩, রাঙামাটি) বা ত্রিপুরার একাধিক শরণার্থী শিবির (১৯৯৬-১৯৯৭)। এ সব নিজস্ব অভিজ্ঞতায় এমন বোবা কান্না দেখা হয়েছে বারংবার। এরপরেও ঐ শোকার্ত জনতার কান্নাটুকু আমায় ঘিরে রাখে, ঝাপসা হয়ে আসতে চায় চশমার কাঁচ। ....
স্মৃতির মিনারে পুষ্পার্ঘ্য দেওয়ার পর আবার আমরা হাঁটতে থাকি ফ্যাকাশে সন্ধায়। একজন পাহাড়ির বাড়িতে সামান্য কিছু ভাত-তরকারি খেয়ে শুরু হয় ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ভেতরেই টর্চের আলোয় পথ চলা। লম্বা সরু সারিতে আমরা পাহাড়, জলকাদা ভেঙে চলি। আমার সামনে পাহাড়ি ছাত্রছাত্রীদের একটি অংশ। পেছনে হেঁটে আসে তাদেরই আরেক অংশ। একবার শুধু একটি বিষধর পাহাড়ি সাপ পথ আগলে দাঁড়ায়। টর্চের আলোতে সাপটিকে দেখে সবাই দ্রুত সতর্ক হয়ে ওঠেন। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে দেখি স্কুল-কলেজের ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা কি অসীম সাহসের সঙ্গে পা থেকে স্যান্ডেল খুলে নিয়ে সাপটিকে তাড়ায়। সাপটিকে মেরে ফেলা না ফেলা নিয়েও তাদের মধ্যে সামান্য মতবিরোধ হয়। পরে আবারো মাইলের পর মাইল পাহাড় ভেঙে বৃষ্টিতে ভিজে পিচ্ছিল দুর্গম পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে আছাড় খেতে খেতে এক সময় আমরা পৌঁছাই কল্পনাদের বাড়ি।
এক চিলতে উঠোন ঘিরে ছোট একটি কুঁড়েঘর, অভাবের চিহ্ন সর্বত্র প্রকট। ঘুটঘুটে অন্ধকারে হ্যারিকেন আর টর্চ হাতে পুরো গ্রাম ভেঙে পরে আগত বাহিনীকে দেখতে। কথা হয় কল্পনার জুম (পাহাড়ে ঢালে বিশেষ ধরণের চাষাবাদ) চাষী দুই ভাইয়ের সঙ্গে। তখনো পুরো পরিবারটির আতংক কাটেনি। নিরাপত্তার জন্য বৃদ্ধ মা বাঁধুনী চাকমাসহ তাদের রাত কাটছে অন্যের বাড়িতে।
তারা দুজন অর্নগল চাকমায় বর্ণনা করেন কিভাবে জাতীয় নির্বাচনের ভোটের রাতে লাইল্যাঘোনা সেনা ক্যাম্পের লেফটেনেন্ট ফেরদৌস তার দলবল নিয়ে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যায় তাদের আদরের ছোটবোন কল্পনাকে। এক ভাই বেশ কিছুদূর সন্ত্রাসীদের অনুসরণ করলে তাকে মেরে ফেলার জন্য ব্রাশ ফায়ারও করে ওরা। প্রাণ বাঁচাতে কাচালং নদীতে ঝাঁপিয়ে পরে জীবন রক্ষা হয় তার। কিন্তু এরপর আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি তাদের বোনের। থানায় এ সংক্রান্ত অপহরণের মামলা দিতে গেলেও পুলিশ মামলা নেয়নি।
কল্পনাদের বাড়ি উঠানেই কথা হয় নানান বয়সী গ্রামের মানুষের সঙ্গে; এমন কি সাদা পোষাকের একজন শান্তিবাহিনীর গেরিলা ক্যাডারের সঙ্গেও। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কল্পনা চাকমা অপহরণ সংক্রান্ত খবরের মূল্যায়ন। তিনি তখন অস্পষ্ট অন্ধকারের ভেতর স্পষ্ট চোখে চোখে রেখে আমাকে বলেছিলেন, আমরা আমাদের নিজস্ব অনুসন্ধান চালাচ্ছি। পাহাড়ে বরাবরই নির্যাতন-নিপীড়ন চলছে। কল্পনা চাকমা অপহরণ সেই ঘৃণ্য রাজনীতিরই একটি অংশ। ...
সেদিন কল্পনার মা বাঁধুনী চাকমার দেখা মেলেনি। তবে আরো কিছুদিন পরে বৃদ্ধা মা চোখ মুছতে মুছতে বলেছিলেন, তার একমাত্র মেয়ে অপহরণের পর এই অপহরণকে নিয়ে হেলিকপ্টার-রাজনীতির কথা। তিনি বলেছিলেন, ঢাকা থেকে সেনা হেলিকপ্টারে করে কিভাবে কথিত মানবাধিকার সংস্থার নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সর্ম্পক বিভাগের অধ্যাপক, জানিপপ নামে একটি এনজিও প্রধান) সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের গ্রামে আসেন। তারা তাকে বার বার চাপ দিচ্ছিলেন, কল্পনা চাকমাকে শান্তিবাহিনী অপহরণ করেছে, কিন্তু এখন শান্তিবাহিনীই এই অপহরণের দায় চাপিয়ে দিচ্ছে সেনা বাহিনীর ওপর -- এমন একটি স্বীকারোক্তি দেওয়ার জন্য। কিন্তু নিজের মেয়েকে নিয়ে এমন মিথ্যে রাজনৈতিক প্রচারে তিনি কিছুতেই রাজী হননি। এ নিয়ে তাকে নানা হুমকি-ধামকি দেওয়া হচ্ছে। ...
পরে বাঘাইছড়ির ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা, রাঙামাটি পুলিশ সুপার, সেনা কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসকের ভাষ্যসহ দৈনিক আজকের কাগজে কল্পনা চাকমা অপহরণের ওপরে যে কয়েকটি প্রতিবেদন লিখেছিলাম, এর একটির সূচনা কথা ছিল: রক্তের ধারা পেছনে যায় না! ...
আজ এতোদিন পরে যখনই কল্পনা চাকমা অপহরণ, সেনাবাহিনীর (২৪ ডিভিশন, পদাতিক) পক্ষ থেকে কল্পনার সন্ধান দাতাকে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা, তাকে নিয়ে করা দেশি-বিদেশী অসংখ্য সংবাদ, কলাম ও ব্লগ, মিছিল, মিটিং, মানববন্ধন, নারী সংগঠনগুলো আন্দোলন ও পরে তাদের দীর্ঘ বিস্মৃতি, বিচারপতি আব্দুল জলিলের নেতৃত্বাধীন সরকারি তদন্ত কমিটি ও হিমাগারে বন্দী তার তদন্ত রিপোর্টের কথা ভাবি -- তখন বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করি, গত ১৪ বছর ধরে ধরে কল্পনা অপহরণের মতো এতো বড় মানবাধিকার লংঘনের দায় বাংলাদেশ নামক কথিত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বহন করে চলছে! তার পাহাড়ি বন্ধুরা সহকর্মী হারানোর বেদনা বহন করে চলেছেন ঐ ১৪ টি বছর ধরেই। ...
অন্যদিকে প্রশ্ন জাগে, আমরা যারা নিজেদের শুভ বুদ্ধির মানুষ বলে দাবি করি, সেই সব সংখ্যাগুরু বাঙালিদের মনের গহীনে কি দেড় যুগের পুরনো এই কাঁটাটি কোনই রক্তক্ষরণ করে না? কোথায় আজ কল্পনা চাকমা?
--- * মূল লেখা: ০৯ জুন ২০১০, কালের কণ্ঠ
আপডেট: কল্পনা চাকমা অপহরণ :: ১৪ বছর পর পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদন
হিল উইমেন্স ফেডারেশন নেত্রী কল্পনা চাকমা অপহরণের ১৪ বছর পর পুলিশ এ মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন রাঙামাটি জেলা ও দায়রা জজ আদালতে দাখিল করেছে। বাঘাইছড়ি থানার পুলিশের প্রতিবেদনে কল্পনা চাকমা অপহরণের জন্য "একদল বন্দুকধারী' সন্ত্রাসীকে দায়ী করা হলেও তারা কারা, সে বিষয়ে উল্লেখ নেই। কল্পনা চাকমার পরিবার ও পাহাড়ি নেতা-নেত্রীরা এ প্রতিবেদনের ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে বাঘাইছড়ি থানার ওসি নাঈম উদ্দীন কালের কণ্ঠকে জানান, কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য গত ২১ মে রাঙামাটি জেলা ও দায়রা জজ আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। বিষয়টি এখন আদালতের বিবেচনাধীন।
ঐ মামলায় সুনির্দিষ্ট আসামিদের বিরুদ্ধে কেন অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেওয়া হয়নি, তা জানতে চাইলে ওসি নাঈম উদ্দীন বলেন, "১৯৯৬ সালে কল্পনা চাকমার অপহরণের পর বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন হয়। তারা অপহৃতার কোনো সন্ধান পায়নি। এমনকি কে বা কারা তাঁকে অপহরণ করেছে, কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদনে তাও উল্লেখ করা হয়নি। এ কারণে আমরা এ মামলার চার্জশিট দিতে পারিনি। মামলাটির নিষ্পত্তি চেয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছি।'
কল্পনা চাকমার বড় ভাই ও মামলার বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা অপহরণের জন্য একটি বিশেষ মহলকে দায়ী করেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, মামলায় সুনির্দিষ্টভাবে সন্ত্রাসীদের নাম উল্লেখ রয়েছে। এতে আসামিদের নামও উল্লেখ করা হয়েছে। সে সময় বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে দেওয়া অভিযোগপত্রেও একই কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ আসামিদের রক্ষা করার জন্য তাদের নাম বাদ দিয়েই চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে।
কালিন্দী চাকমা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, "এত বড় একটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার বিচার ১৪ বছরেও হলো না। আজও আমার ছোট বোন কল্পনার সন্ধান কেউ দিতে পারল না! '
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও কল্পনা চাকমার সহযোদ্ধা ইলিরা দেওয়ান কালের কণ্ঠকে বলেন, "প্রায় দেড় দশক পর কল্পনা অপহরণ মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেশ এবং এতে কোনো আসামির নাম উল্লেখ না করার ঘটনা লজ্জাজনক। কল্পনার একজন সহযোদ্ধা হিসেবে আমি এ প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করছি।'
ইলিরা আরো বলেন, কল্পনাকে অপহরণের সঙ্গে স্থানীয় একটি বিশেষ মহল জড়িত ছিল। সে সময় থানার পুলিশ মামলা নিতে গড়িমসি করে। পরে ত্ৎকালীন সরকার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কিন্তু এ কমিটির প্রতিবেদন আজও প্রকাশিত হয়নি।
ইলিরা মনে করেন, কল্পনা অপহরণ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত হলে পার্বত্য শান্তিচুক্তি সম্পাদনের পর পাহাড়ে নারী নির্যাতনের ঘটনা অনেক কমে যেত।
আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং কালের কণ্ঠকে বলেন, কল্পনা অপহরণের বিষয়ে কোনো আসামিকে অভিযুক্ত না করে পুলিশের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদন মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ ঘটনায় আবারও প্রমাণিত হলো, এ দেশে আদিবাসীরা কত অসহায়।
তিনি বলেন, আদিবাসীরা যখনই আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, ভূমি অধিকার তথা মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার আন্দোলন করেছে, তখনই তাদের এ ধরনের অপহরণ, হত্যা, গুম ও নানা নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। কল্পনা চাকমা অপহরণের পুন:তদন্ত ও দোষীদের বিচার দাবি করেন সঞ্জীব দ্রং।
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমাকে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন গভীর রাতে রাঙামাটির বাঘাইছড়ির দুর্গম নিউ লাইল্ল্যাঘোনা গ্রামের বাড়ি থেকে একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী অপহরণ করে। কল্পনাকে উদ্ধারের দাবিতে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ঐ বছর ২৭ জুন পার্বত্য চট্টগ্রামে হরতালের ডাক দেয়। হরতাল চলাকালে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের মিছিলে নিরাপত্তা বাহিনী গুলি চালালে রূপম, সুকেশ, মনতোষ সহ চার ছাত্রকর্মী নিহত হন। এ ঘটনার পর পাহাড়ি সংগঠনগুলো লাগাতার কর্মসূচি পালন করতে থাকে। সেনাবাহিনীর ২৪ ডিভিশন কল্পনা চাকমার সন্ধানদাতার জন্য ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে পাহাড়ে লিফলেট বিলি করে।
কল্পনার মা বাঁধুনী চাকমা ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে তাঁর মেয়ের অপহরণের জন্য একটি "বিশেষ মহলকে' দায়ী করেন। সে সময় তিনি এ অপহরণের সঙ্গে সাবেক গেরিলা গ্রুপ শান্তিবাহিনীর সম্পৃক্ততার কথাও অস্বীকার করেন। পরে সরকার বিচারপতি আবদুল জলিলের নেতৃত্ব গঠন করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিশন। প্রায় এক মাস তদন্ত শেষে কমিশন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। তবে এ প্রতিবেদন আজও প্রকাশিত হয়নি।
এদিকে কল্পনার সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশনসহ পাহাড়ি সংগঠনগুলো ১৪ বছর ধরে কল্পনা চাকমা উদ্ধার, অপহরণের বিচার এবং তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশের দাবি জানিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও রাজধানীতে সভা, সমাবেশ, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে।
--
২৫ আগস্ট, দৈনিক কালের কণ্ঠ, প্রথম পাতায় প্রকাশিত
আলোকচিত্র : আন্তর্জাল থেকে লেখক কর্তৃক সংগৃহীত