
বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গনে বেশ কদিন ধরেই লেখক, উপন্যাসিক শওকত আলিকে নিয়ে চলছিল শঙ্কা আশঙ্কার আলোচনা। খবর ছিল যে নিজের বাড়ি 'বিরতি ভিলা'র চিলেকোঠা থেকে তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে চিকিৎসার জন্যে। দু'হাজার সতেরোর শেষ থেকেই তিনি হাসপাতালবাসী। অবস্থা খুব সুবিধার নয়। নানাবিধ বার্ধক্যজনিত অসুখে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি। এতটাই অসুস্থ যে রাষ্ট্র এবং সমাজে শ্রেণীবৈষম্যের বিপরীতে সোচ্চার সাম্যবাদী মানুষটি তাঁর যাপিত জীবনে আর প্রাণ বহন করতে পারছেন না।
এইবার তিনি তাঁর অভিজ্ঞ আর প্রাজ্ঞ হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন মৃত্যুর দিকে। খানিক বিরতি নিয়েছেন মাত্র, পৃথিবীকে শেষ বিদায়টুকু বলে নিঃসীম শূন্যতায় তার পদযাত্রা শুরু করার। আর সেটুকু সাঙ্গ করেই চলে গেলেন আমার অতি প্রিয় উপন্যাস 'দক্ষিণায়নের দিন' সহ কুলায় কালস্রোত, পূর্বরাত্রি পুর্বদিন, প্রদোষে প্রাকৃতজন, যাত্রা, পিঙ্গল আকাশের মত আরও অনেক উপন্যাস এবং উন্মূল বাসনা , শোনো হে লখিন্দর, উত্তরের খেপ, নাঢ়াই এর মত অসংখ্য গল্পের রত্নগর্বিত জনক।
চলে যাওয়ার মত বয়েস তাঁর হয়েছিল। আর এভাবেই তো চলে যেতে হয় সবাইকে। যেমন চলে যেতে হয়েছিল শ্যামাঙ্গকে। আর মৃত্যু তো বহুবারই তার লেখায় আঁকা হয়েছে অনিন্দ্য গৌরব আর অনিন্দিত সাহসের সাথে। তবুও তাঁর এই অসুস্থতার সময় শ্রদ্ধায়, আবেগে অনেকেই সভয়ে উচ্চারণ করেছিলেন, হয়ত প্রাকৃতজনের বিদায় আসন্ন। পিঙ্গল আকাশ জুড়ে তাই মৃত্যু মেয়ের এই হাতছানি। বছর বছর ধরে সে মেয়ে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে বাংলা সাহিত্যের একের পর একজন রাজকুমারদের। যারা একসময় বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গনকে অসংখ্য মণিমুক্তো ছড়িয়ে সমৃদ্ধ করে তুলেছিলেন, সেই উর্বীরুহরা একে একে পাড়ি দিচ্ছেন না ফেরার দেশে।
তিনিও গেলেন। পঁচিশ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার দিনের শুরুতে সমস্ত কোলাহল থেকে নিজেকে বন্ধন মুক্ত করলেন তিনি। চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমার প্রিয় উপন্যাস 'দক্ষিণায়নের দিন'-এর উপন্যাসিক কমরেড শওকত আলি মেয়ের হাতে হাত রেখে চলে গেলেন অন্য পৃথিবীতে। খবরটি স্তব্ধ করে দিয়েছিল আমাকে। যদিও অপ্রত্যাশিত ছিল না তেমন। মানব কুলের জন্যে পূর্ণতর বয়সে এরকম মৃত্যু সে তো প্রকৃতির দান। কিন্তু যে মানুষটি চলে গেলেন, তিনি বাংলা সাহিত্যের পাঠককুলের জন্যে রেখে গেলেন এক বিপুল দাক্ষিণ্য। অপরিসীম সাহিত্য সম্ভার। আর অশেষ শ্রদ্ধায় চিরস্মরণীয় এক আদর্শপাঠ।
সাহিত্যকর্মের সাথে তিনি তাঁর রাজনৈতিক আদর্শকে মিলিয়ে নিয়েছিলেন একাত্মভাবে। তাই তাঁর প্রতিটা উপন্যাস বা গল্পের শেষে এক নতুন পৃথিবী গড়ার প্রত্যয় কখনও সবল অথবা প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকে। উন্মুখ পাঠক সহজেই খুঁজে নিতে পারে তাঁর মন আশ্রিত গন্তব্য অথবা উত্তর। এখানেই তিনি অনন্য একজন সার্থক উপন্যাসিক এবং সফল গল্পকার। সীমাহীন অসম্ভবের পাড়ে পাঠককে একা ফেলে তিনি কিছুতেই চলে আসেন নি। তিনি মানুষকে ভালোবেসেছিলেন মানব মর্ম থেকে। মানুষের জন্যেই তো মানুষ! এই যে মানবকুল কোটি কোটি বছর উজিয়ে এসেছে সে কেবল মানবিক ভালোবাসার পরম্পরা মেনেই। এক জীবনেই মানুষের সব অর্জন শেষ হয়ে যায় না। কিছু থাকে যা তার উত্তর পুরুষকে বহন করে নিয়ে চলতে হয় অনাগত আগামীদের জন্যে।
তাই তো তাঁর গল্পের নায়িকা অশঙ্ক উচ্চারণে বলতে পারে, "এখানে আমি হেঁটেছিলাম- তুইও হাঁটিস এখান দিয়ে; এখানে দাঁড়িয়ে আমি মিছিল দেখেছিলাম- তুইও দেখিস এইখানে দাঁড়িয়ে, এখানে সেজানের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল এখানে,এই গাছতলায়-এখানে তুইও দাঁড়াস। আর এই যে রাস্তাটা,এই রাস্তায় সেজান মিছিল নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল-তুইও এই রাস্তা দিয়ে মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাস,হ্যাঁরে পারবি তো?" কী পবিত্র প্রত্যয়, অকলুষিত স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষার নির্ভীক পরম্পরা। শিউরে ওঠে মন, রোমকুপে বেজে যায় সাহসি দুন্দুভি। মনে পড়ে যায় ম্যাক্সিম গোর্কির 'মা' উপন্যাসের নিলভনা ভ্লাসভকে। ট্রেনের কামরায় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে, পুলিশি নির্যাতনে মৃতপ্রায় রক্তাক্ত মা নিলভনা দমে যাননি ভয়ে। বিপ্লবী সন্তান পাভেল ভ্লাসভের বক্তৃতাকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে দিতে নির্ভীক মা নিলভনা বলেছিলেন, ভাল মানুষের সন্তানেরা, একবার জাগো...। উপন্যাসিক শওকত আলির উপন্যাস, দক্ষিণায়নের দিন এর নায়িকা রাখী যেন ঠিক এভাবেই আলোর পথ চিনিয়ে দিচ্ছিলেন তার ভবিষ্যৎ অনাগত সন্তানকে, খোকা পারবি তো?
দেশভাগের ক্ষত বহন করে ১৯৫২ সালে, সদ্য তরুণ শওকত আলি জন্মস্থান ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুরের রায়গঞ্জ থেকে সপরিবারে চলে এসেছিলেন এদেশে। জন্মভূমির আকাশ, মাটি, জল ছেড়ে আসার যন্ত্রণা তিনি মিশিয়ে নিয়েছিলেন জীবনের সাথে। শিক্ষিকা মা আর কম্যুনিস্ট পিতার কাছ থেকে যে মন তিনি পেয়েছিলেন তাতে সাম্যবাদের স্বপ্ন ছিল। ছিল তীব্র শ্রেণীসংগ্রামের অবসান শেষে একটি শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থার সকাতর কর্মময়তা। ফলে তিনিও হয়ে ওঠেছিলেন একজন কম্যুনিস্ট। তাঁর অধিকাংশ লেখায় তাই মূর্ত হয়ে ওঠে মুষ্টিবদ্ধ হাতের তরাস। বাতাসে আন্দোলিত হয়, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার বিশুদ্ধ দাবি। সর্বস্তরের পাঠক পড়তে পড়তে থমকে যায়। এ যেন তারই কাহিনি। কিংবা এ কাহিনি তো অজানা নয়। পড়া শেষে তাই পাঠকের মনেও ভাসে সেই ছায়া। সেই শব্দ আকাঙ্ক্ষার অনুরণন। কয়েক মুহূর্তের জন্যে হলেও মনের ভেতর ফুটে ওঠে অসৎ, লোভী, চক্ষুলজ্জাহীন 'ঠিকেদারি সোসাইটি'-র বিরুদ্ধে সুতীব্র ঘৃণা। যদিও পরমুহূর্তে সেই প্রতিবাদী পাঠককেই আবার মেনে নিতে গণতন্ত্রের মাৎস্যন্যায়কে। কে কবে দেখেছে যে রাষ্ট্র তথা সমাজের শ্রেণীবৈষম্য রোধে গণতন্ত্র একটি সঠিক শাসনব্যবস্থা!
ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিতে গণতন্ত্র এক শ্রেণীর মানুষের হাতে অর্থ, বিত্ত, ভোগ, বিলাস, আরও আরও চাই-এর অনিবৃত্ত ক্ষুধাপূরণের এক উত্তম উপায় মাত্র। লেখক শওকত আলি নিপুণ কারিগরের মত সেই উদ্গ্রতার রূপ তুলে ধরেছেন তাঁর লেখায়। আজকের বাংলাদেশে আমরা দেখি লেখক, সাহিত্যিক, কবি, শিল্পীরাও চরম ভোগবাদী। গ্লাসের পার্টনার হয়ে লেখক, কবি, সাহিত্যিকরাও রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, সরকারী কর্মকর্তা, বুর্জোয়া বেশ্যাদের পদলেহী মধুসঞ্চারক হয়ে উঠেছে। গণতন্ত্রের মাৎস্যন্যায় কি নয় আজকের বাংলাদেশ?
টাকা, টাকা, টাকা, আরও চাই টাকা, তা যে করেই হোক। ডাইনে তাকালে, বাঁয়ে সেখানেও, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী ঘুষ খাচ্ছে, প্রশ্ন ফাঁসে জড়িয়ে যাচ্ছে, চিকিৎসক রুগী ফেলে টাকার হিসাব কষছে, মড়া ফেলে রাখছে আইসিইউতে, লাশ আটকে রাখছে টাকা দিতে না পারায়, পুলিশ সেনাবাহিনী দুর্নীতিবাজ, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক সাপে নেউল আবার দালাল গোছের, নারীর অসন্মান অমানবিক পর্যায়ে, শিশু হত্যা, নির্যাতন বেপরোয়া বেশুমার। বিচক্ষণ লেখক অত্যন্ত সচেতন ভাবেই এই সমাজকেই বলেছিলেন 'ঠিকেদারী সোসাইটি'। তিনি তার পূর্বরাত্রি পূর্বদিন বইতে বলেছিলেন, "... ভাবখানা এরকম যে নতুন কিছু হোক, শহর হোক, আধুনিকও হোক কিন্তু সবই থাকবে আমাদের হাতে। সেজন্যে মিলাদ মহফিলে আমরাই টুপি মাথায় ওয়াজে সামিল হবো, আবার নাটকেও সাজ-পোশাক পরে রঙ মেখে আমরাই অভিনয় করবো। মুসলিম লীগ আমরা হবো, আমরাই আওয়ামী লীগ করবো আবার আমরাই জামাতে ইসলামীও করবো"।
১৯৭৮ সালে প্রকাশিত বইটিতে বাংলাদেশের কী অকাট্য ভবিষ্যৎচিত্র এঁকে গেছেন তিনি। শিল্পের সাথে, সন্তানের সাথে, মাতৃভূমির সাথে অসততা করলে বেশি ক্ষেত্রেই তা শুভ হয়ে ওঠে না। সাতচল্লিশে দেশভাগ হয়ে পাকিস্তান হয়েছিল, মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই বলে, একাত্তরে ওই মুসলমান ভাইরাই যুদ্ধ, খুন, হত্যা ধর্ষণ করে গেছে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের। তখন ভ্রাতৃত্ব উধাও হয়ে জেগে ওঠেছিল ক্ষমতার ভাইরূপি সাঁইরা। কেন? কেবলমাত্র কায়েমি স্বার্থ প্রতিষ্ঠার কারণে।
আর স্বাধীন বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ক্ষমতায় থাবা বসাচ্ছে সেইসব সুবিধাবাদী ধনিকশ্রেণীর লোকজনরা। সম্পত্তি কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে ধনী ব্যবসায়ী আর রাজনীতিবিদদের হাতে। প্রাকৃতজন বা নিম্নবর্গের মানুষদের স্থান এখন এখানে কোথায়? কতটুকু ভাগ্য বদলে ফেলতে পেরেছে বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক শিক্ষা চিকিৎসা বঞ্চিত অতি সাধারণ মানুষরা? গরীব থেকেই যাচ্ছে আর ধনী আরো ধনী হচ্ছে। উপন্যাসিক, গল্পকার শওকত আলি এই বঞ্চিত, গরীব, খেটে খাওয়া মানুষদের নিয়েই তাঁর সাহিত্যকর্ম নিশ্চিত করেছেন। তিনি প্রাকৃতজনদের জীবন থেকে প্রদোষের অভিশাপ মুছে নতুন প্র আনতে চেয়েছিলেন।
তাঁর মৃত্যু অপ্রত্যাশিত না হলেও আমাদের কাছে, আমার কাছে গভীর বেদনার। অপরিসীম শ্রদ্ধা জানাই, শওকত আলি, হে প্রিয় সাহিত্যিক। বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে আপনি থাকবেন, সগৌরবে এবং অনমিত মর্যাদায়।
দ | unkwn.***.*** | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৬:২২85227
h | unkwn.***.*** | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৮:৫৬85228
রুখসানা কাজল | unkwn.***.*** | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১০:১৩85229
pi | unkwn.***.*** | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৮:৫২85230
দ | unkwn.***.*** | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৯:২৮85231
সিকি | unkwn.***.*** | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৯:৩১85232
অ | unkwn.***.*** | ০৬ মার্চ ২০১৮ ০১:০০85234
বিপ্লব রহমান | unkwn.***.*** | ০৬ মার্চ ২০১৮ ০২:৫১85233
বিপ্লব রহমান | unkwn.***.*** | ০৬ মার্চ ২০১৮ ০৫:০০85235
অ | unkwn.***.*** | ০৭ মার্চ ২০১৮ ০৪:২০85236