দুটো, কি তিনটে মেয়েবেলা মুখোমুখি, পিঠোপিঠি।
একটা মেয়েবেলা আমার পূর্ব নারীদের। আমার মায়ের, আমার দিদিমার। অন্য মেয়েবেলা আমার। তৃতীয় মেয়েবেলা আমার মেয়ের।
স্পষ্ট করে দেখতে পাই সবকটিকেই। কেননা কোথাও কোন বিভ্রান্তি নেই, কোন ঝাপসা সেন্টিমেন্টের পর্দা ঝোলানো নেই। কোথাও নেই কোন বাধা, এই সব মেয়ে জীবনের দিকে তাকানোর। সবটাই যেন খুব দ্রুত ঘটে গেল। কিন্তু যুগ পাল্টানোর এই দিনকালে, একের পর এক প্রজন্মে কী বিশাল সব পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে যে, সেটা দেখে আশ্চর্য হওয়ার সুযোগ ও আমরা পেলাম না।
মায়ের মেয়েবেলা ও দিদার মেয়েবেলার এক দিক থেকে তফাত ছিল না হয়ত। কারণ তখনো মূলত ভাবা হত মেয়েদের জন্ম সংসার করার জন্য। সুগৃহিণী, সু মাতা হতে গেলে অল্প বিস্তর শিক্ষাও চাই বইকি। তাই পড়াশুনো। গান শেখা, ছবি আঁকা শেখা। কবিতা লিখলে তাও গোপন খাতায়। কোনকিছুই পেশাগতভাবে করার কোন চাপ ছিল না সমাজের। বরং উল্টো চাপ। এখন গান শিখছ কিন্তু বিয়ের পর গান রাখতে পারবে না।
মা ও দিদার মেয়েবেলার মূল তফাত ছিল এই যে, আমার দিদার মেয়েবেলা বাবা মায়ের স্নেহক্রোড়ে, বাংলাদেশের ঢাকা শহরে এক নি শ্চিন্ত ভাবে কেটেছিল, আর মায়ের শৈশবে দেশভাগের প্রবল অনিশ্চিতি , ও বাংলা থেকে সপরিবারে চলে আসার বেদনা ছিল। মায়ের যখন বারো তেরো বছর বয়স তখন দেশভাগ ও স্বাধীনতা এল। সেই সময়ে মায়েদের কলকাতায় বাসাবাড়ি বা ভাড়াবাড়ির জীবন শুরু। অসংখ্য ভাইবোন নিয়ে মায়েদের এক বিপুল আনন্দ ধাম ছিল শৈশবে। মা ছিল গাছকোমর করে ডুরেপার ধনেখালি পরা, ডাকাবুকো এক দিদি, সবার লিডার। উত্তর কলকাতার রাজাবাজার অঞ্চলে, মায়েদের শৈশবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আঁচ ছিল, আবার একইসঙ্গে ছিল গান, ছাতে ম্যারাপ বেঁধে নাটক, দোলের দিনে হারমোনিয়াম বের করে গান বাজনা, জন্মদিনে ব্রাহ্ম ঢঙে তোমারি গেহে গাওয়া, ভোর বেলা বাবার সঙ্গে ছাতে উঠে জবাকুসুমসঙ্কাশম বলা, ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ের বান্ধবীদের সঙ্গে আম কুড়নো আর বাড়ি থেকে তেল নুন নিয়ে গিয়ে টিফিন বেলায় তা মেখে খাওয়া। রাজাবাজারের বাড়িতে ছেচল্লিশের দাঙ্গার রাতে মায়ের স্মৃতিতে স্পষ্ট ছিল সব পরিবার এক সঙ্গে হয়ে ছাতে বসে ভয়ে কাঁপার কথা। ইঁট পাথর কেরোসিন জমিয়ে রাখার কথা। গলির মুখের ঘরে মুসলমান দারোয়ানজির দরদ আর সাহসের সঙ্গে মুসলিম দাঙ্গাকারীদের হটিয়ে দিয়ে , সারা পাড়ার হিন্দু বাসিন্দাদেরকে বাঁচাবার কথা।
দিদা ছিলেন মেম ইশকুল ইডেন স্কুলে পড়া, অর্গ্যান বাজিয়ে গান গাইতে শেখা, গা ঢাকা ফ্রিল দেওয়া পুরু কাপড়ের ঘরে তৈরি ফ্রক পরা মেয়ে, ইংরেজি আর ফরাসি শিখেছিলেন ইশকুলে। বাংলা আর সংস্কৃতও। আর এই চারটি ভাষা তাকে কখনো ছেড়ে যায়নি। ১৯০৩ সালের ভারতবর্ষে আলো আরো আলো চেয়েছে যে শিক্ষিত বাঙালিকুল, তাদেরই প্রতিভূ ইনি। নিজের শৈশবের অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছলতার আরাম ছেড়ে, অনায়াসে তাঁর যৌবনে ভাঙ্গা ভারতের কলকাতা শহরে এসে বাসাবাড়িতে আট সন্তানকে মানুষ করার পাশাপাশি অগণিত আত্মীয় কুটুম্ব বান্ধবকে নিয়ে চলেছেন, শাড়ি কেটে পর্দা বানিয়েছেন, বড় হাঁড়িতে রান্না চাপিয়েছেন, তবু শেষ বেলায় খাবার সময়ে হয়ত অন্য কোন জ্ঞাতিভাই-দেওর এসে ধুলোপায়ে হাজির হয়েছে । ও বাংলা থেকে উৎখাত মানুষের ভিড় দাদুর কাছে লেগেই থাকত।
২
মায়ের জন্ম ১৯৩৫। আমার মায়েরা কলেজ যেতেন, প্রেসিডেন্সিতে অঙ্ক ক্লাসে, মেয়েরা দল বেঁধে ঢুকতেন। সংখ্যালঘু মেয়েরা স্যারের সঙ্গে ঢুকতেন, স্যারের সঙ্গে বেরোতেন। ছেলেরা তাঁদের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলত। কেউ কেউ দুষ্টুমি করে মৌরি লজেন্স রেখে আসত কাঠের টেবিলে, আঁচল দিয়ে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে রাগি রাগি কঠোর মুখে মায়েরা সে টেবিলে বসতেন। ছেলেদের উচিত শিক্ষা দিতেন।
আমার এক মামা, যাঁর জন্ম ১৯৪২ এ, তিনি কিন্তু পরিবারের প্রথম প্রেম করে বিয়ে করা ছেলে। তার ওপর আবার বেজাতে। মানে, মামা কায়স্থ কিন্তু মামি ব্রাহ্মণ ছিলেন। সে প্রেমের কাহিনি গল্পের বইয়ের মত। বন্ধুর বোনের সংগে প্রেম করেছিলেন মামা। আমাদের ছোট্টবেলায় কিন্তু, স্পষ্ট মনে আছে, সে খবর আমরা প্রায় গুড়গুড়ে বয়স থেকেই জানতাম। মায়েদের আলোচনা থেকেই জেনেছিলাম নিশ্চিত। অর্থাৎ, প্রেমের গল্প শোনার অভ্যাস সে সময়েও শিশুদের ছিল, এখনকার শিশুদেরই শুধু দোষ দেওয়া হয় যে তারা সব জেনে ফেলেছে!
তো সেই মামু মামির অভ্যাস ছিল গঙ্গার ধারে যাওয়া, দোতলা বাসের সামনের সিটে বসা, ট্রামে চেপে ঘুরতে থাকা। ট্রামই এক মাত্র যান যা ডিপো থেকে ডিপো গিয়ে আবার রওনা হয়ে যায়। এ এক অনন্ত গোলাকৃতি পথ। ট্রামের সামান্য কয়েক পয়সা ভাড়া দিয়েই এভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা কলকাতার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত যাওয়া যায়, ট্রামের সিটে বসে বসে। কেউ নামিয়ে দেয়না।
তাছাড়া ছিল চায়ের দোকান। হামেশাই যা বাংলা সিনেমার উপাদান। কত না ছবিতে দেখা গেল সেই কাটলেট চপ সাজানো, কাঁটাচামচ দেওয়া সাদা চিনেমাটির প্লেট, নুন মরিচের ডিবে আর লাল পর্দা ঢাকা চায়ের কেবিনের ছোট্ট ঘর। সেযুগে, নস্টালজিয়ার নিয়ম মেনে, ছেলে ও মেয়ে মুখোমুখি বসিবার আয়োজন সেটাই। সেটাই আসল উন্মেষস্থল রোম্যান্স এর।
এই সব চা দোকানে বাঙালি ছেলেমেয়েরা বসবে। রমাপদ চৌধুরীর গল্পের ছেলেমেয়েরা বন্ধুত্ব থেকে প্রেমের দিকে যেতে যেতে নিজেদের, আজকের ভাষায় এক্সপ্লোর করবে। সুধীর মৈত্রর আঁকা ছবির মত সেই সব লম্বা বিনুনি শাড়ি পরিহিতা মেয়েরা আসবে, আর ছেলেদের গায়ে একটা আঙুল ছোঁয়ালেই অগ্ন্যুৎপাত হবে ছেলেটির ভেতরে।
এইসব সময়ে কাকা মেসো পিশেমশাইরা থাকতেন ঝোপেঝাড়ে বাসে ট্রামে। কোন পারিবারিক পরিচয় থাকলেই, ছেলেটি বা মেয়েটির সম্বন্ধে বাড়ি বয়ে দিয়ে আসতেন খবর। ছেলেটিকে কোন মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখা গেছে। “তোমার মাইয়াডারে দ্যাখলাম য্যান! ট্রামে বইস্যা কার না কার বাড়ির পোলার সঙ্গে কথা কয়!”
অর্থাৎ এই সময়ের ছেলেমেয়েদের ভেতরে চাপা সন্ত্রাসের মত এই বুঝি কেউ দেখে ফেলল ব্যাপারটা কাজ করত। আনুষঙ্গিক হল সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে তুমুল চোপা, যার নাম আমাদের প্রজন্মে এসে হবে ঝাড়।
৩
এর পর এল আমার প্রজন্ম।
আমার মেয়েবেলায় ছিল সরকারি ইশকুলের ঘেরাটোপ, রেডিওর আশা ভোঁসলে, রাহুল দেব বর্মণ বা সলিল চৌধুরীর সুরে মশগুল দিনগুলি বিকেলগুলি। সন্ধের লোডশেডিং এ মুছে রাখা কাচের ডুম পরিয়ে হারিকেনের শিখা উঁচু করে বিবর্ণ নীরস ইতিহাস ভূগোল পড়ার দিনকাল। আমাদের প্রজন্মের মেয়েরা অনেকেই জানতাম, নিজেকে তৈরি করতে হবে, চাকরির জন্য, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য, কেউ বাধ্য করবে না আমায় কিন্তু আমাকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পেতেই হবে। এমন অনেক মেয়ে, সংখ্যাটা বেশি। কিন্তু অনেকেই শেষ পর্যন্ত চাকরি জলাঞ্জলি দিয়ে গৃহবধূ হয়েছে বা স্বেচ্ছায়। বড় সংসারের হালও ধরেছে। সে অন্য প্রসংগ।
আমার মেয়েবেলায় ছিল রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময়ে পাড়ার ছেলেদের ছোট ছোট মন্তব্যের তুবড়ি উড়ে এসে ফেটে পড়া কানের ওপরে। আমি নকশাল আন্দোলনের পাশাপাশি বেড়ে উঠছি। তরুণের স্বপ্ন তখন বিপ্লব, নয়ত গাঁজাচরস। তরুণের স্বপ্ন তখন প্রেম করা, ভিক্টোরিয়ায় বা গঙ্গার পাড়ে। কিন্তু দ্রুত পালটাচ্ছেও দিনকাল। কলেজ বেলায় ক্যান্টিনে বাম, অতিবাম রাজনীতি চোখে ঘোর লাগাচ্ছে যেমন, প্রচুর ইংরেজি বই পড়া, ইংরেজি গান শোনা আমাদের মনন হেঁটে দেখতে শিখছে পৃথিবীকে, শঙ্খ ঘোষের কবিতায় অথবা মহীনের ঘোড়াগুলির গানে।
আমার মেয়েবেলায় খুব বেশি স্বাধীনতা ছিল না, “মেয়েসন্তান” বলে বাড়ির বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে মায়ের প্রজন্ম নানা প্রশ্ন তুলত কিন্তু সেই আমিই কলেজ গেছি ভিড় বাসে প্রায় ঝুলতে ঝুলতে।
আমরা কলেজে পড়ছি যখন, রোজ রাত আট টায় কি সাতটায় বাড়ি ফিরে গল্প দিতাম জ্যামের। একটাও মা বিশ্বাস করতেন না। একবার কলেজ স্ট্রিটে বৃষ্টি হয়ে জল জমল। ভবানীপুরে সত্যি জ্যামে আটকে নটায় ফিরে মাকে বিশ্বাসই করাতে পারিনি, ভবানীপুরে একটুও বৃষ্টি হয়নি সেদিন।
আমাদের প্রজন্মে আমরা প্রেসিডেন্সির ক্যান্টিনে ছেলেদের পাশে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসতাম, এ ওর কাঁধে হাত রাখতাম, যেন তাতেই নিজেদের বিদ্রোহ ঘোষিত হত। রাত করে আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফেরার কারণে বাড়িতে বকা জুটত ঠিকই। তবু সেসময়েও শরীরী দূরত্ব থেকেই গেছিল, ভাংচুর করতে চেয়েও ভাঙতে কি সত্যি পেরেছিলাম শরীরী পবিত্রতার ধারণাকে?
এসব তথাকথিত দুষ্টূমির সঙ্গে মাখা সন্দেশের মত ছিল আমাদের প্রেম। প্রেমে পড়া, প্রেম করা। এক তরফা প্রেম তখনো প্রচুর। কয়েকটা ঠিকঠাক লেগে গেলে দু তরফা হত। তার আবার নিয়ম ছিল। অলিখিত। তিন মাস ঘুরলে একটা চুমু।
তখনো জীবনের প্রথম চুমু খাওয়ার জায়গা ছাতের ধার, ট্যাঙ্কের পেছনদিক। কিন্তু তার চেয়েও বেশি আসছে মেয়েবন্ধু ছেলেবন্ধুদের মেলামেশা। অ্যাসেক্সুয়ালের ভেতর যৌনতার চোরাটান, তবু যেন লুপ্ত নাশপাতির মত নির্বীজ ও নিষ্পাপ। ক্যান্টিনের বেঞ্চি ভাগাভাগি করে গায়ে গা ঠেকিয়ে বসার পর্ব। কিন্তু শরীরী নয় তবু। এক আধখানা কেচ্ছাকাহিনি ঘোরে বাতাসে। অমুককে অমুকের সংগে সন্ধে অব্দি কলেজের পেছনে জলের ট্যাংকের ওপরে দেখা যায় (যাকে ডিরোজিওর কবর বলে ডাকতাম আমরা)। তমুক অমুকের হোস্টেলে ঢুকে বিছানায় সেঁধিয়েছে। ‘শোয়া’ শব্দ কীভাবে জানি তখন থেকে আমাদের জবানিতে একটি সংকীর্ণতর অর্থে ব্যবহৃত হতে থাকবে।
আমরা জানব নানারকমের বন্ধুত্ব, রঙ পালটানো হবে তারও। কিছু কিছু সম্পর্ককে প্রান্তিক সম্পর্ক নাম দিয়ে দাগিয়ে দেব। কিছু সম্পর্ক ফ্লপ, কিছু ঢপ। সরস্বতী পুজোর শ্যাম্পু চুল, হলদে শাড়ির সঙ্গে হলদে পাঞ্জাবির চোখে চোখে কথা। পুজো প্যান্ডেলে অঞ্জলি দিতে গিয়ে তাকাতাকি।
বারান্দা বা ছাত থেকে ফেলা চিরকুট। অথবা কালো হোঁতকা টেলিফোনে ফোঁশ ফোঁশ নিঃশ্বাস ফেলা… এই হল পূর্ব রাগ। তারপর কোচিং ক্লাস থেকে সঙ্গ ধরা প্রেম, রবীন্দ্রসদন নন্দন থেকে পাশাপাশি বসা প্রেম, থার্টি সিক্স চৌরঙ্গি লেনের সেই প্রাইভেসি খোঁজা প্রেমে পালটে গেছে। বন্ধুর ফাঁকা বাড়ি বা নিজেদের ফাঁকা বাড়িতে ‘প্রেম করা’ ইন থিং হয়েছে।
তবে ততদিনে বোধ হয় ওই না ছোঁয়া, না ধরা, রোমান্স আর কলকাতায় নেই। জায়গাবদল করে চলে গেছে শ্রীরামপুরে, চন্দননগরে। ফুচকাওয়ালারা সেসব রোমান্স জানবে। জানবে সাইকেল স্ট্যান্ডরা।
ততদিনে আমাদের সব ভালবাসার গল্প বইতে ঢুকে গিয়েছে। সিনেমায় ঢুকে গিয়েছে। আর
৪
কাট টু ২০০০ । আমার মেয়ের জন্ম। আমার মেয়ের মেয়েবেলা, সত্যিই অনেকটা পরিবর্তিত পটভূমি। ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে এখন এক সন্তানের, বড় জোর দুই সন্তানের বেড়ে ওঠা, ঠেলাঠেলি নেই কিন্তু চাপ? চাপ কমল কই। এখন কেরিয়ার তৈরির চাপ। যেমন মেয়ের তেমন ছেলের। ভাল পড়াশুনো করবে, তবে ত ভাল চাকরি পাবে। এখন শিশুরা একসঙ্গে বসে গল্প করে, কার ঘরে এসি আছে। কার গাড়ি, কার বাড়িতে কী কী গ্যাজেট। দু আড়াই বছর থেকে হাতে আসে ফোন, আইপড, কম্পিউটার। বাবা মা গর্বিত মুখে বলেন, আমার মেয়ে কত্তো স্মার্ট, ট্যাব হাতে নিয়েই দেখ কেমন অ্যাপ খুলে খেলতে বসে গেছে।
ঘরে ঘরে বিলাস বাহুল্য, গাড়িতে চাপার অভিজ্ঞতা তার বাসে ট্রামে চাপার অভিজ্ঞতার চেয়ে বেশি। সব সময় আড়াল ও সুরক্ষায় সে ঘোরে ফেরে, অন্তত স্কুল জীবনে। কেন, কারণ খবর কাগজে ত ক্রমশই বেড়ে চলেছে অসংখ্য লাঞ্ছনা আর ধর্ষণের ইতিবৃত্ত। অথচ আমার মেয়ে কলেজে যেতে শুরু করেই বাসে ট্রামে অটোতে চাপছে, এখন তার সাবলীলতা বেড়েছে। যদিও খবর কাগজ এখনো ধর্ষণ সংবাদে ভরপুর।
আমার মেয়ের জন্ম ১৯৯১ এর পর। তাই ভারতের অর্থনীতিতে ইতিমধ্যে বিদেশি পুঁজি, খোলাবাজারের আলো হাওয়া, সব এসে গিয়েছে দশ বছর আগেই। প্রত্যাশার চাপ বাড়ছে। মেয়েরা চাইছে যা যা মানুষে চায়। সাফল্য, ধনদৌলত, আরাম। আর এই চাওয়ার মধ্যে মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে বাজার অর্থনীতির অন্য চাপ। সুন্দর হতে হবে, দেখনধারী হতে হবে। সব কাজে এগিয়ে থাকতে হবে। পুরুষের ভোগ্য হবার অসংখ্য হাতছানি, পাশাপাশি নিজের জীবনের রাশ নিজের হাতে নেওয়া। এই স্ববিরোধের মধ্যে মেয়েবেলা গড়ে উঠছে।
সে বড় হচ্ছে কার্টুন নেটওয়ার্ক দেখে। আর কদিন পরেই শুরু করছে ডিজনি চ্যানেলে কিশোর কিশোরীর প্রেম দৃশ্য দেখতে। হিন্দি আর ইংরিজি ছবিতে যৌনতা দেখে দেখে সেসব বছর দশেকের মধ্যে নিজেদের শিরায় শিরায় ঢুকিয়ে নিচ্ছে সে। এই জীবনযাপনে ডিজিটাল ছবির একমাত্র মূল্য। ফেসবুক আসবে এর পর, ওয়াটস্যাপ আসবে। নিজেদের সেলফি তুলে বন্ধুদের পাঠানোর এক মাত্র ধর্মীয় বোধ হবে। বাধ্যতামূলক ভাবে শরীর এবং শরীর এদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হবে। তাই, বারো, তেরো, চোদ্দর মধ্যে বি এফ, জি এফ, ( বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ডের ছোট আকার) এদের লব্জতে এসে পড়বে।
আমার মেয়ের মেয়েবেলায় আছে, ছোট টপ, ছোট হাফপ্যান্ট বা শর্টস পরিধানের, বা সাঁতার, ইয়োগা, ক্যারাটে শেখার স্বচ্ছলতা, ডিজিটালের কল্যাণে গুগলের চাবি টিপে জীবনের সব রহস্য জেনে ফেলবার স্বাধীনতা।
এসে গিয়েছে অন্য এক প্রজন্ম । যে প্রজন্মে ছেলেরা আর মেয়েরা একসঙ্গে বসে ব্লু ফিল্ম দেখে।
ডিজিটাল ডিভাইডের আগের সব প্রেমকে মনে হবে আজ সিপিয়া রঙএ আঁকা। আমার বারো বছরের মেয়ে যখন ডি ডি এল জে (দিলওয়ালে দুলহনিয়া ইত্যাদি ইত্যাদি)তে, শাহরুখের সঙ্গে রাত কাটানো নিয়ে কাজলের জড়তার গপ্পো দেখে হেসে ফেলে বলবে, মা, নব্বই সালের পরেও এরকম গাধার মত বোকা বোকা প্রেমের গল্প বানান হত? তখন বুঝি ডিজিটাল ডিভাইডের পরবর্তী প্রজন্মরা কেবল টিভির তেয়াত্তর চ্যানেল, বে ওয়াচ, কার্টুনের যৌনতা, সব প্যাকেজ করা অবস্থায় অডিও ভিসুয়ালি পেয়ে গিয়েছে, তাই অদের কাছে প্রেম=যৌনতার সমীকরণে কোন আধো আধো কথা নেই। বাধো বাধো ভাব নেই।
এখন আমাদের ১৮তে যা যা হত, সেগুলো ১৩ তে হয়। ১৫ বরাবর এসে ছেলেমেয়েরা এক্সপ্লোর করে ফেলে চুম্বন-আলিঙ্গন আদি আমাদের ডিকশনারির অসভ্য শব্দ। আমাদের অশ্লীলের সংজ্ঞাগুলো সব পাল্টে গিয়ে এখন জলভাত হয়ে গেছে ছবির যুগে। যাবতীয় চিত্রায়ণে বিস্ময়বোধ হাওয়া। কেউ আর অবাক হয় না কোনকিছুতে।
কী কী নেই, তা ওরা বলবে।