এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  পর্যালোচনা (রিভিউ)  বই

  • একাল সেকাল কল্পকাল ছড়াছড়ি - ভাল লাগার মত একটা বই

    Argha Bagchi লেখকের গ্রাহক হোন
    পর্যালোচনা (রিভিউ) | বই | ২১ জানুয়ারি ২০২৫ | ১৩৮ বার পঠিত
  • 'একাল সেকাল কল্পকাল ছড়াছড়ি' অমল সান্যাল রচিত, কবির নকশা অনুসরণে গৌতম চট্টোপাধ্যায় চিত্রিত। প্রকাশক ডিক্‌টাম ২০২২। 

    ডিক্‌টাম-থীমা-র ছড়াসাহিত্য সিরিজে ইতিপূর্বে আমরা পেয়েছি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের অনুবাদ 'মাক্স ও মোরিৎস এবং আরো চিত্রকথা', অনুরাধা রায়ের 'ছড়াগুলো একটু কড়া', দীপংকর দাশগুপ্তের 'চমকে দেখি আরে', এবং অর্ঘ-র অনুবাদ 'বাঙালের লিয়র দর্শন'।
     
    সমকালীন ছড়াসাহিত্য সিরিজে ২০২২-এর সংযোজন এই বইটি। প্রতি ছড়া ৬টাকা হিসেবে ৩৫টার দাম হয় ২১০টাকা। আবার ১০৩ পাতার বই হিসেবে ২টাকা দরে দাম হয় ২০৬টাকা। প্রকাশক দাম ছেপেছেন মাত্র দুশো টাকা। তারপরেও বইমেলার ছাড়, কলেজস্ট্রিটের ছাড়, বিশেষ ছাড় ইত্যাদি ইত্যাদি তো আছেই। সুতরাং পাঠকের পকেট মার যাবে না। 

    ছড়াকার অমল সান্যাল ভূতপূর্ব অর্থনীতিবিদ বলেই আগেভাগে হিসেবের দিকটা কষে রাখতে ইচ্ছে হল। 'একাল সেকাল কল্পকাল ছড়াছড়ি' কেবল ছড়ার আরেকখানা বই নয়, বলা যায় এ হল অমলবাবুর দীর্ঘ পরিশীলিত জীবনের অভিজ্ঞতার নির্য্যাস। এক অনন্য সময়ের দলিল। ছড়াসাহিত্য মানেই যে কিছু হালকা চালের অন্ত্যমিলে শব্দের জাগলিং নয়, ছড়ার ধারণক্ষমতা যে সামাজিক ইতিহাসের সাক্ষ্যমতে তার চেয়ে অনেক বেশি, জেনেও ভুলে যাওয়া বা আগে না ভাবা সেই কথাগুলো কেমন যেন নিজের অজান্তেই মনে ভেসে ওঠে, এই বইয়ের ছড়াগুলি পড়তে পড়তে।

    সমগ্র বইটি বেশ কিছু বিভাগে ভাগ করা, একেবারেই সাধারণ সে বিভাজন, না থাকলেও খুব একটা ক্ষতি-বৃদ্ধি হত না। প্রতিটি ছড়াতেই বিধৃত আমাদের মনের ওপর পরিবেশ ও সমাজের বিভিন্ন ঘটনার রেখাপাতের প্রতিচ্ছবি। কেবল শেষ ছড়াটা ছাড়া। শেষ ছড়ার কথায় আলাদা করে ফিরে আসতেই হবে, বাংলা সাহিত্যের এক অমর সৃষ্টি হয়ে তার বেঁচে থাকা উচিত বলে। প্রথম যে ছড়াটা মনে চমক দিয়ে গেল তা হল পোচের জন্মকথা, 'একটি পুরাতাত্ত্বিক অনুমান'। এরকমই উর্বর কল্পনায় ভরা অ্যাস্ট্রোহোমাস, বা খোক্কসগড়ের ট্রিপ অ্যাডভাইস। কিন্তু ঠিক তার পরেই 'পদ্মপাতায় জল' এক ঝাপটায় পাঠককে নিয়ে যায় সেই উত্তাল নকশাল আমলে, 'ঝকমকিয়ে উঠত যেন সকাল বেলার সূর্য সব, / ছুট লাগাল মরণপানে, গলায় সারেগামার রব'। আবার 'জাতিস্মর ঠাকুরদা'-র বিপদে পড়া, কল্পনা ও বাস্তবে, আহা, অতীব সরেস। ইচ্ছে করে যেন পুরো ছড়াটাই উদ্ধৃতিচিহ্নে ভরে এখানে তুলে দিই। "আমরা যারা ইয়ং ছিলাম, দেখেই লাফাই উল্লাসে, / চেঁচিয়ে উঠি 'উঙ্গ্‌ হর্‌ ডিম্‌, হাঙ্গাভাতুর্‌ ডুল্‌ হাসে'।"

    প্রবীণ সংসারে দৈনন্দিন টানাপোড়েন, একঘেয়েমি, রঙ্গরসিকতা অমলবাবু ছড়ার জাদুতে তুলে এনেছেন অসামান্য দক্ষতায়। 'দাদু, দিদা, টিভি', 'দাদুর জন্মদিন', 'ডান্ডাগুলি আর ক্রিকেট' ছড়াগুলিতে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। তার পর আমরা জানতে পারি গোপা দেবীর কথা। চাঁদনী রাতে দয়িতের গানের গুঁতোয় দেরাদুনে পালিয়ে গিয়ে জীবন কাটানো 'গোপা দেবী ভাবছেন'। ভৌতিক, আধিভৌতিক, মোবাইলিক, ফেসবৌকিক জগতের প্রভূত কথা এই বইয়ের পাতায় পাতায় আস্তানা গেড়েছে। 'ভুলোর মাঠ', 'চাঁদগায় ভূত চতুর্দশী' ইত্যাদি তার সাক্ষ্য দেবে। দুঃখ বা বিষণ্নতাময় ছড়া রয়েছে মিলিয়ে মিশিয়ে, তবে তারা মোটেও রসহানিকর নয়, বরং সমসময়ের ঐতিহাসিক দলিল। যেমন, 'ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী', 'বটুকেশ্বর প্রসাদ', 'নতুন দিদা', বা 'মায়ের হিরণ মামা'।

    কল্পবিজ্ঞান, বিজ্ঞানভিত্তিক প্রাকৃত ব্যাখ্যা ও তাতে সকলের বোঝার সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে যে গল্প তিনি ফেঁদেছেন 'সুবিনয়ের দাদু'-র মুখে, সেটা পড়ে আমার বহু বছর আগে পড়া আরেকটা বইয়ের লেখার স্টাইল মনে পড়ে গেল। এই ছড়ায় তিনি 'কবিতার রস' দিয়ে বিগ ব্যাং ও ব্ল্যাক হোল-এর গল্প শোনাচ্ছেন, আর সেই বইয়ে শুনিয়েছিলেন 'টাকা-পয়সার জন্মকথা'। হ্যাঁ, সেই অসাধারণ বইটাও অমল সান্যালেরই লেখা, এখন আর লাইব্রেরি ছাড়া কোথাও পাওয়া যায় বলে জানি না। কিন্তু অসাধারণ সেই বই পাঠের স্মৃতি, একবার যে পড়েছে সে সহজে ভুলতে পারবে না। অমল সান্যাল নিজের লেখা, তার সাথে নিজের আঁকা দিয়ে যে জগত তৈরি করে তাতে বসবাস করেন, তাকেই বোধহয় মনীষীরা স্বর্গ বলে বন্দনা করেন, আর সামান্য কিছু পূণ্যাত্মাই সেই স্বর্গ দর্শনের অনুমতি পান।

    বইটির প্রতি ছড়া ধরে ধরে আলোচনা করতে গেলে আরেকটা মহাভারত রচনা করতে হয়। তার চেয়ে শেষ লেখাটার কথা বলে শেষ করি। শেষের ছড়াটা ছড়া নয়, দর্শনের মন্ত্র। যেন উপনিষদ থেকে উঠে আসা জীবনের ব্যাখ্যা। জীবনের প্রতিটি অধ্যায় এত সুন্দর করে তিনটি স্তবকে বিধৃত করতে বাংলা ভাষায় এর আগে কেউ পারেন নি, এবং ছড়ার ফর্মে যে তা সম্ভব তেমন পারদর্শিতাও কেউ দেখাননি। এর তুলনা হতে পারে কেবল "অসতো মা সদ্গময়ঃ..." ইত্যাদি শ্লোকের সাথে। অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বের দিকে, অন্ধকার থেকে আলোর দিকে, মর্ত্য থেকে অমর্ত্যের দিকে জীবনের যাত্রা তিন স্তবকে পূর্ণতা পেয়েছে। লোভ সম্বরণে অপটু আমি পাঠকের জন্য পুরোটাই তুলে দিচ্ছি। বইটা সংগ্রহে না রাখলে বাংলার পাঠককুল যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কেননা, সুকুমার রায়ের মতই, এ বই একবার পড়ে রেখে দেওয়া সম্ভব নয়।

    "সারাটা দিন কাটল বসে আলোর দিকে পিছন ক'রে
    সামনে শুধু নিজের ছায়াই দেখে গেলাম প্রহর ভ'রে।
    সামনে আমার যত দেখা,
    বুঝিনি তা ছায়ায় মাখা,
    আমার ছায়ায় রং মিশিয়ে আমিই সে সব নিচ্ছি গড়ে।

    এখন আমার ভুল ভেঙেছে, মুখ ফেরালাম আলোর পানে,
    কিন্তু এখন সূর্য পাটে, ডুববে কখন কেই বা জানে!
    দেখব তবু দু চোখ ভরে,
    আলোয় যে রং নৃত্য করে,
    বাকি প্রহর আঁকব ছবি ওই রঙেরই তুলির টানে।

    দিনের আলোর অহমিকা সাঁঝের বেলায় যাবে টুটে,
    সুজ্যি ডুবে নামবে আঁধার, তারার কুঁড়ি উঠবে ফুটে,
    দেখব তখন দু-চোখ মেলে,
    নিশার কোলে কী রং খেলে,
    আলোয় যে রং যায় না দেখা সারাটা দিন মাথা কুটে।"
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন