এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ছোটগল্পঃ এক সেনানী মায়ের গল্প

    Sagarmay Mandal লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৩ মে ২০২৫ | ১৪১ বার পঠিত
  • এক সেনানী মায়ের গল্প
    সাগরময় মণ্ডল
    এম বি বি এস পাশ করার পর দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবে বলে ইন্দ্রাণী ভারতীয় সেনাবাহিনীর সর্ট সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় বসেছিল। প্রাথমিক ভাবে এটি দশ বছরের সার্ভিস। পরে পার্মানেন্ট হয়ে যাওয়া যায়। রেজাল্ট বেরোলে দেখা যায় ইন্দ্রাণী সেই পরীক্ষায় পাশ করেছে। ইন্দ্রাণী তো খুশিই কারণ সে তার পছন্দের কাজ করতে পারবে। তার বাবা, আবসর প্রাপ্ত সৈনিক এবং মাও যারপর নাই আনন্দিত। ইন্দ্রাণী তার বাবার কাছে শোনা নানা দুঃসাহসিক অভিযানের সাক্ষী হতে পারবে। বাবাই তো তার হিরো। শুনেছে চাকরিতে জয়েন করার পরে উনপঞ্চাশ সপ্তাহের ট্রেনিং হবে তারপর পোস্টিং। খবরটা জানার পরে সে এতই উত্তেজিত যে পারলে আজকেই জয়েন করে।
    যা হোক, সময় মতো চিঠি আসে। ইন্দ্রাণী জয়েন করে এবং ট্রেনিং শুরু হয়। ট্রেনিং চলাকালীন ইন্দ্রাণী তার এক সহকর্মী পলাশের প্রেমে পড়ে। তারা দুজনেই দুজনের বাড়িতে খবরটা জানায়। কোন বাড়ি থেকে কোন আপত্তি আসে নি। ছেলে মেয়ে বড় হয়েছে দেশের কাজ করবে। তাদের ভালোমন্দ তারা ছাড়া আর কে বেশি বুঝবে? তাই কোন সমস্যায় তাদের পড়তে হয় নি। ট্রেনিং শেষ করে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ট্রেনিং এক জায়গায় হলেও তাদের পোস্টিং কিন্তু এক জায়গায় হোল না। নিয়ম আছে এক জায়গায় পোস্টিং দেওয়া সম্ভব হলে ব্যবস্থা করা। কিন্তু কোন কারনে সেটা হয়ে ওঠে নি কর্তৃপক্ষের। এনিয়ে ইন্দ্রাণীর অনেক অভিযোগ আছে, তবে তা মনের মধ্যে। কেন অভিযোগ জানাবে? সে তো দেশের কাজে যোগ দিয়েছে। যেখানে পোস্টিং দেবে, মেনে নিতে হবে। স্বামীকে নিয়ে নিরিবিলিতে সংসার করতে চাইলে সে তো কোলকাতার কোন হাসপাতাল বা নার্সিং হোমে চাকরি করতে পারতো।
    ছুটি পেলে দুজনেই বাড়ি আসে। তখন এক সঙ্গে থাকা যায়। হৈ হৈ করে কয়েকটা দিন কেটে যায়। তারপর আবার যে কে সেই। নিজের নিজের জায়গায় চলে যাওয়া। পলাশ খুব কেয়ারিং হাজবান্ড। সবসময় ইন্দ্রাণীর খবর রাখে। এইতো ইন্দ্রাণী যখন প্রথম মা হোল, তখন লম্বা ছুটি নিয়ে পলাশ সবসময় তার পাশে থেকেছে। দ্বিতীয় বারে সে লম্বা ছুটি পায় নি তবে প্যাটারনিটি লিভের পুরো সময়টা সে ইন্দ্রানীকে দিয়েছে। এমনি করেই চলছিল প্রায় ছ বছর। এখন ইন্দ্রাণীর ছেলের বয়স তিন বছর আর মেয়ের বয়স ন’ মাস।
    এবার একটা সুখবর এলো। তাদের স্বামী স্ত্রী দুজনের পোস্টিং এক জায়গায় হয়েছে। তবে একটু  রিমোট লোকেশনে, লামডিং এ। আসামের হজোই  জেলার একটি শহর। উত্তর পূর্ব সীমান্ত রেলওয়ের একটি স্টেশনও আছে সেখানে। এখান  থেকে বদরপুরের রাস্তা, সেটা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ রাস্তার সম্মান পেয়েছে। লামডিং রেল পথে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলাকেও জুড়ে রেখেছে। পাহাড়ের কোলে এ হেন স্থানে  এক সঙ্গে থাকতে পারলে বেশ ভালোই হয়। এখানে জয়েন করার পরে ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। হাসপাতালে যায় একসঙ্গে। কর্মরত এবং পেনসনভোগী সৈনিকদের চিকিৎসা করতে করতে দিনগুলো বেশ কেটে যায়। এই তো কয়েকদিন হোল, দুজন প্রাক্তন সৈনিক এসেছিলেন চিকিৎসা করাতে। তাদের সঙ্গে আলাপ হতেই ইন্দ্রাণী জানতে পারলো, তারা তার বাবার সঙ্গে কাজ করেছে। বাবাকে তারা খুব ভালো চেনে এবং জানে। রাতে ফোন করে বাবাকে বলতে বাবাও খুব সহজেই তাদেরকে চিনতে পারে এবং বলে একদিন লামডিং গিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করে আসবে।
    দেখতে দেখতে বছর খানেক কেটে গেল। সুখের তারটাও একটু বেসুরো বাজলো। পলাশের আবার ট্রান্সফারের অর্ডার এসে গেল। আরুনাচলের এক প্রত্যন্ত এলাকায়। চীনের বর্ডার, খুবই স্পরশকাতর জায়গা। ছুটি পাওয়া যায় না। লামডিং এ অনেকদিন আছে বলে ইন্দ্রাণী সব ম্যানেজ করে নিয়ে চলতে পারে। সংসার, ছেলের স্কুল, হাসপাতাল কোথাও কোন অসুবিধা হয় না। মেয়ের জন্য আয়া আছে। পলাশ অবশ্য সুযোগ পেলেই চলে আসে। কদিন হোল বাবা মা এসেছে। মেয়ের কাছে কিছুদিন থেকে যাবে, এরকমই পরিকল্পনা। যত দিন বাবা মা থাকে, ততদিন ইন্দ্রাণীর একটু হলেও সুবিধা। নিশ্চিন্ত মনে হাসপাতালে সময় দিতে পারে। মেয়ের আয়া এলো কি এলো না, তাতে কিছু যায় আসে না। মা বাবা ঠিক সামলে নেয়। আর বাবার তো বেশ মজা। পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে  আড্ডা শেষ হয়েই চায় না। মা মাঝে মাঝে বিরক্তি প্রকাশ করলেও, ইন্দ্রাণী কিছু বলে না। ভাবে এই তো কদিনের জন্য এখানে এসেছে। বাড়ি ফিরে গেলে তো সেই আমি আর তুমি, তুমি আর আমি। দুদিন পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মেরে মনটাকে একটু চাঙ্গা করে নিলে ক্ষতি কি।
    হঠাৎ খবর এলো কার্গিলে জঙ্গি অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তার সঙ্গে পাকিস্থানী ফৌজের সীমান্তবর্তী এলাকায় লাগাতার গোলাগুলি বর্ষণ পরিস্থিতিকে বেশ জটিল করে তুলেছে। সে কোন সময় যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। সবাইকে এলার্ট করে দিয়েছে। কেউ ছুটি নিতে পারবে না। যে কোন সময় যে কাউকে যেকোনো স্থানে মুভ করতে হতে পারে। ইন্দ্রাণী একটু ভয় পায়। যদি তাকে এখনি মুভ করতে হয়, তাহলে বাচ্চাদুটোর কি ব্যবস্থা করবে? খুব চিন্তায় পরে যায়।
    একদিন সত্যি সত্যি যুদ্ধ শুরু হোল। ইন্দ্রাণীর আশঙ্কাকে সত্যি করে একটা মেইল এলো। তাতে নির্দেশ দেওয়া আছে লামডিং থেকে একটা মেডিক্যাল ইউনিট মুভ করবে। প্রয়োজনীয় ওষুধ, একুইপমেন্ট সব যেন প্যাক করে রাখা হয়। ট্রেনের ব্যবস্থা হয়ে গেলে জানানো হবে।  কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল বড় বড় ট্রাঙ্ক নিয়ে সেনাবাহিনীর লোকজন হাজির। ইন্দ্রাণী সেগুলো বুঝে নিল। ওষুধপত্র, যন্ত্রপাতি কি কি আছে আর কি কি নিতে হবে তার একটা লিস্ট করে নিয়ে সেগুলোকে ট্রাঙ্কে ভরে সিল করার জন্য হাসপাতালের অন্যান্য কর্মচারীদেরকে নির্দেশ দিল। মিলিটারি কাজ। ঘড়ির কাঁটা ধরে চলতে শুরু করলো। ইন্দ্রাণীর মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লেগেছে। অর্ডারে কোথাও লেখা নেই তাকে যেতে হবে কি না। হয়তো ছোট বাচ্চা আছে বলে তাকে ছাড় দিয়েছে। তাই যেন হয় ঠাকুর। এই বলে সে ঠাকুরের কাছে মনে মনে প্রার্থনা করলো। কোয়ার্টারে ফিরে এসে বাবাকে সব বলল। বাবাকে একটু চিন্তিত দেখাল, কিন্তু কিছু প্রকাশ করল না। সে অনেক পোড় খাওয়া লোক। সেনাবাহিনীর হালচাল তিনি ভালোই জানেন।
    পরের দিন সকালে হাসপাতালে পৌছতেই অফিসের ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের শব্দ শুনেই ইন্দ্রাণীর বুকটা ক্ষণিকের জন্য কেঁপে উঠলো। সাহস করে ফোনটা ধরতেই ওপার থেকে কমান্ডিং অফিসারের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।
    -ইন্দ্রাণী ?
    -হ্যাঁ স্যার, বলুন।
    -আই এয়াম সরি তো সে, আপনার ওখান থেকে যে ইউনিট মুভ করবে, তার সাথে আপনাকেও মুভ করতে হবে। আমি আপনাকে আগেই জানিয়ে রাখলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে অর্ডার এসে যাবে। আর হ্যাঁ, খুব সম্ভবত আগামীকাল সকাল আটটায় রেল আমাদেরকে রেক দেবে। তৈরি হয়ে থাকবেন।
    ফোন কেটে গেল। খবরটা শুনে ইন্দ্রাণীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। এতক্ষণ জানতো, তার ইউনিট মুভ করলেও সে এখানেই থাকবে। কিন্তু তা হচ্ছে না। তাহলে এখন সে কি করবে? ওই দুটো ছোট ছোট বাচ্চাকে নিয়ে সে কিভাবে একদিনের নোটিশে সব ছেড়ে ছুড়ে অজানার উদ্দেশ্যে পারি দেবে। অজানার উদ্দেশ্যে এইজন্য যে মুভ করতে হবে সেটা ঠিক, কিন্তু কোথায় যেতে হবে সেটা জানানো হয় নি। ট্রেনে ওঠার পর জানতে পারবে কোথায় নামতে হবে, তারপর জায়গা দেখে ক্যাম্প বসাতে হবে। গাড়ি, আম্বুলেন্স, ওয়ারলেস সেট, ওটির যন্ত্রপাতি, বেড সব নিয়ে যেতে হবে। সে এগুলো দেখবে, না নিজের ঘরের জিনিসপত্র গুছোবে। পলাশও আসতে পারবে না, তাকেও ছুটি দেবে না। বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা মা বেড়াতে এসেছে। সে কি করবে ভেবে কূল পায় না। এতক্ষণ যে উদ্যমে প্যাকিং এর  কাজ তদারকি করছিল, সেটা করতে আর ইচ্ছে হোল না। বাকিদের হাতে কাজের ভার দিয়ে সে কোয়ার্টারে ফিরে গেল। তার থমথমে চিন্তাগ্রস্ত মুখ দেখে বাবা বললেন
    -তোকেও মুভ করতে হবে, এই তো।
    -হ্যাঁ, এইমাত্র জানালো। কাল সকালেই যেতে হবে।
    -ঠিক আছে যাবি। এতো চিন্তা করছিস কেন?
    -চিন্তা করবো না? তোমরা আছো, ছেলেমেয়ে দুটো আছে, আমি সব ফেলে কি করে যাবো।
    -ও নিয়ে ভাবিস না। তোর ইউনিট এর মুভ করার খবর পাওয়ার পর তোর মা আর আমি আলোচনা করেছি, ওরা তোকেও মুভ করতে বলবে। আমরা কাল সকালের ট্রেনে দাদুভাই আর দিদিভাইকে নিয়ে কোলকাতায় চলে যাবো। তুই যতদিন না ফিরে আসছিস, ততদিন ওরা আমাদের কাছে থাকবে।
    -বাবা। ইন্দ্রাণী বাবাকে জড়িয়ে ধরে।
    -এতো সৈনিকের জীবনের নিত্যদিনের ঘটনা রে মা। কখন কোথায় আছি, কত দিন আছি কেউ জানে না। অর্ডার হোল তো চলো। তুই চিন্তা করিস না। ওদের কোন আসুবিধা হবে না।
    ইন্দ্রাণী যেন অকূলে কূল পেল। সে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সে জিজ্ঞেস করলো
    -তোমাদের তো রিজার্ভেশন নাই, যাবে কি করে?
    -তাও ভাবে রেখেছি। তোর ইউনিট থেকে দুজন ইউনিফর্ম পড়া হাবিলদার পাঠিয়ে দিবি, দেখবি ওরা জেনারেল কম্পারমেন্টে ঠিক দুটো জায়গা করে দিতে পারবে। আর কোন কথা নয়। যা, তুই তোর লাগেজ গুছিয়ে নে। মিলিটারি মেজাজে বাবা বলে উঠলো।
    -ইয়েস বস।
    ইন্দ্রাণী একটু হাসল। তারপর বাবা মেয়ে মিলে ইন্দ্রাণীর সংসারের সব জিনিস প্যাক করে ফেলল। মা বাচ্চা দুটোকে সামলে রাখল। বাচ্চাদের খাবার দুধের কৌটো, জলের বোতল আরও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আলাদা একটা ব্যাগে রাখা হোল। ওই ব্যাগটা বাবা মার সঙ্গে যাবে। ঠিক হোল আগামীকাল সকাল পাঁচটার কামরূপ এক্সপ্রেসে বাবা মা বাচ্চাদুটোকে নিয়ে কোলকাতায় ফিরবে। আর আটটার ট্রেনে ইন্দ্রাণী তার ইউনিট সহ মুভ করবে। রাত্রে খাওয়া দাওয়া সেরে ইন্দ্রাণী বাচ্চাদুটোকে সঙ্গে নিয়ে শুয়ে পড়লো। নিয়ম মতো বাচ্চারা ঘুমিয়েও পড়লো। কিন্তু ইন্দ্রাণী কিছুতেই ঘুমতে পারছে না। তার ভিতরে কোথায় যেন একটা আস্বস্তি হচ্ছে। তার মাতৃত্ব ভাব তাকে বারবার অপরাধী ঠাওরাচ্ছে। সে নিজের কাজের দোহাই দিয়ে ছোট ছোট বাচ্চা দুটোকে মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করছে। যুদ্ধের ডিউটি করে হয়তো তার শর্ট সার্ভিস পার্মানেন্ট হবে। কিন্তু সে তো সন্তানকে মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করার বিনিময়ে! কিন্তু তার কিই  বাঁ করার আছে। সে বারবার উঠে বসে বাচ্চাদের মুখ দুটো দেখছে। আদর করছে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কপালে চুমু খাচ্ছে, আঙ্গুল নিয়ে খেলা করছে। বারবার আদর করছে, তবু কিছুতেই মনের আশ মিটছে না। কত শত দুর্ভাবনা মাথায় উঁকি দিচ্ছে। আচ্ছা, যদি যুদ্ধের সময় গোলাগুলি এসে তাদের ক্যাম্পে পড়ে, যদি তার ভালো মন্দ কিছু হয়ে যায়! তার বাচ্চার কি হবে? মাথাটা ভার ভার মনে হচ্ছে, সে একটা মাথা ধরার ওষুধ খেল, যদি একটু রিলিফ পাওয়া যায়। এবার সে বাচ্চা দুটোকে দুপাশে নিয়ে দুহাতে তাদেরকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো। দুশ্চিন্তার মধ্যে কখন দুচোখের পাতা এক হয়েছিল কে জানে। একটা দুঃস্বপ্ন তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। সে দেখছে তার চারিদিকে জল। বন্যার স্রোতে সে ভেসে যাচ্ছে। ছেলে মেয়ে দুটো তার হাত ছেড়ে দিয়ে কোথায় যেন ভেসে গেল। সে ভয় পেয়ে উঠে বসলো। ছেলে মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখল, তারা ঘুমোচ্ছে। সে বোতল থেকে এক ঢোক জল খেল। ঘড়ির দিকে তাকাল, সাড়ে তিনটে বাজে। মা বাবা ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। বাথরুমে আলো জ্বলছে। তারা রেডি হচ্ছে। তাকেও রেডি হতে হবে, বাচ্চাদেরকেও রেডি করে দিতে হবে। সে ধরমরিয়ে উঠে পড়লো। ওয়াশ রুমে গিয়ে একেবারে স্নান সেরে বেরিয়ে এলো। ছেলেকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে, তাকে ওয়াশ রুম থেকে ঘুড়িয়ে এনে, ব্রাশ করিয়ে জামা প্যান্ট পাল্টে দিল। জুতো পরিয়ে দিল। ছোটটা তখনও ঘুমোচ্ছে। ইচ্ছে করলো ঘুম থেকে তুলে একটু আদর করে। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে যদি, মাকে না ছাড়ে! তার থেকে থাক, ওকে ঘুমন্ত অবস্থায় ট্রেনে তুলে দেবে। সে মেয়ের ডায়াপার পাল্টে দিল, জামা কাপড় পাল্টে দিল, মোজা পড়িয়ে দিল।
    দরজা খুলে বাইরে গিয়ে দেখে বাবা মা রেডি হয়ে গেছে। সে তাড়াতাড়ি কিচেনে গিয়ে বাচ্চাদের দুধ তৈরি করে দিল। তিনজনের জন্য চা করে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসলো। দিদা নাতিকে দুধ খাইয়ে দিতে দিতে মেয়েকে প্রশ্ন করলো
    -কাল রাতে ঘুমোস নি? চোখের কনে কালি পড়ে গেছে।
    ইন্দ্রাণী কোন কথা বলে না। অনেক কষ্টে সে নিজেকে সামলে রেখেছে। কথা বলতে গেলেই সে কেঁদে ফেলবে।
    মা বুঝতে পারে। বলে,
    -চল বেরিয়ে পড়ি। ট্রেন রাইট টাইম এ আসছে। আর হ্যাঁ তোর অফিসের লোক দুজন আগেই এসে গেছে। ওরা বাইরে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। তোর বাবা লাগেজ গাড়িতে তুলে দিয়েছে। তুই ছেলের হাত ধরে নিয়ে চল আমি মেয়েকে কোলে করে নিয়ে আসছি।
    -না মা। ওকে আমিই কোলে করে নিয়ে যাবো। জানি না আর কোন দিন..।
    -ছিঃ, বেরোবার সময় অমন অলুক্ষনে কথা বলতে নেই। যা, মেয়েকে নিয়ে আয়। আমি দাদুভাইকে নিয়ে এগোচ্ছি।
    ইন্দ্রাণী মন্ত্রমুগদ্ধের মতো বেডরুমে গিয়ে ঘুমন্ত মেয়েকে আদর করে কোলে তুলে নিল। মেয়ে একবার চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে নিয়ে আবার মায়ের কোলে মাথা রেখে দিল। ইন্দ্রাণীর পা আর সরছে না। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়লো। হঠাৎ সে ডান হাতে তান অনুভব করে। সে দেখে তার ছেলে হাত ধরে টানছে। মেয়েকে কোলে নিয়ে ছেলের হাত ধরে সে বাড়ির বাইরে এলো। বাবা আগে থেকেই গাড়িতে বসেছিল। সবাই আসতে গাড়ি ছেড়ে দিল।
    কয়েক মিনিটের মধ্যে তারা স্টেশনে পৌঁছে গেল। ট্রেন তখনও আসে নি। তবে খবর হয়ে গেছে। তারা লাগেজ নিয়ে প্লাটফর্মের শেষের দিকে, যেখানে জেনারেল কম্পারটমেন্ট পড়ে সেখান্‌ গিয়ে দাঁড়ালো। ট্রেন হর্ন বাজিয়ে স্টেশনে ঢুকতেই হাবিলদার দুজন দ্রুত জেনারেল কম্পারটমেন্টে উঠে গেল। ট্রেন ফাঁকা ছিল। তারা জানালার ধারে দুটো সিটও পেয়ে গেল। সেখানে বাবা মা কে বসিয়ে তারা লাগেজগুলো ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে নেমে গেল। ইন্দ্রাণী তার ঘুমন্ত মেয়েকে কোলে নিয়ে ধীর পদক্ষেপে ট্রেনে উঠলো। দেখল ছেলে দাদুর সঙ্গে কথা বলছে, জানালার ধারে দাঁড়িয়ে এটা কি, সেটা কি জিজ্ঞেস করছে। ইন্দ্রাণী মেয়েকে কোলে নিয়ে ছেলের মাথায় হাত দিয়ে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মা বলল
    -কিরে ট্রেন ছেড়ে দেবে তো। এবার মেয়েটাকে আমার কোলে দে।
    মায়ের কথাগুলো ইন্দ্রাণীর বুকে এমন বাজলো যে মনে হোল কেউ তার আত্মাটাকে বুকের ভিতর থেকে টেনে বের করে নিতে চাইছে। সে ধীরে ধীরে মেয়েকে মায়ের কোলে শুইয়ে দিয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। ছেলেকে বলল
    -দুষ্টুমি করিস না। দাদুদিদার কথা শুনিস। আমি তোর জন্য অনেক অনেক চকলেট নিতে আসবো।
    মাকে বলল
    -মা, মেয়ে যদি ঘুম থেকে উঠে মা কোথায় জানতে চাই বোল তার মা হাসপাতালে গেছে, ফেরার সময়…
    আর বলতে পারে না। মুখে শাড়ির আচলের কাপড় মুখে গুঁজে ছেলের মাথায় আর একবার হাত বুলিয়ে ট্রেন থেকে দৌড়ে নেমে গেল। প্লাটফর্মে গিয়ে জানালায় মুখ রেখে মাকে বুঝিয়ে দেয়, কোন ব্যাগে কি আছে, বাচ্চারা কখন কি খাবে। কথা বলতে বলতে ট্রেন হর্ন বাজিয়ে গড়াতে শুরু করলো। ইন্দ্রাণী ট্রেনের জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে মেয়ে এক্ষুনি ঘুম থেকে উঠে কচি কচি হাত দুটো জানালা দিয়ে বাড়িয়ে দিয়ে তার মাকে ডাকবে। ট্রেন ধীরে ধীরে প্লাটফর্ম ছাড়িয়ে চলে গেল। হৃদয়ের আপত্য স্নেহের লাভা উদ্গিরনের মুখের উপরে পাথর চাপা দিয়ে সেনানী মা বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ছেড়ে যাওয়া ট্রেনের দিকে। সমষ্টির প্রয়োজনে ব্যক্তির আয়োজন হার মেনে নিল।
    -ম্যাডাম, চলিয়ে। হামারা ট্রেন ভি আ গয়া।
    ইন্দ্রাণী সম্বিত ফিরে পেয়ে উত্তর দিল
    -হ্যাঁ, চলিয়ে। বহুত কাম করনা বাকি হ্যায়।
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ranjan Roy | ১৩ মে ২০২৫ ১৫:৩১731323
  • ভাল লেগেছে, কিন্ত কেমন যেন অসমাপ্ত লাগছে। আগের লেখাগুলোর মতন  নয়।
  • Shubhasish | 2405:201:8016:5805:6a9d:dd5c:630f:***:*** | ১৩ মে ২০২৫ ১৭:৩৯731324
  • বেশ  ভালো ই  লিখছেন I যেখানে থেমেছেন সেটাই ভালো আর বেশি এগোলে পরিণতি ভালো খারাপ যাই হোক ভালো লাগত না I কিছু জিনিস এর অপূর্ণতা ই পূর্ণতা দেয় বলে আমার মনে হয় I 
  • r2h | 134.238.***.*** | ১৩ মে ২০২৫ ১৭:৪৯731325
  • এই গল্পতে বেশ কিছু খুঁটিনাটি ডিটেল পড়ে মনে হল লেখক হয় ঐ পেশা বা অঞ্চলের জীবনের সঙ্গে পরিচিত, অথবা খুঁটিয়ে জেনেছেন, তাই একটা ছোট তথ্য - কার্গিল যুদ্ধের সময় কিন্তু আগরতলা রেলপথে যুক্ত ছিল না।
    এতে গল্পের কিছু আসে যায় না, তবে অনেক ডিটেল আছে বলে, চোখে পড়ায় বললাম!

    যুদ্ধে যাঁরা জড়িয়ে পড়েন, তাঁদের টানাপোড়েনের গল্প সুন্দর এসেছে।

    কিছুটা সরে গিয়ে, আমার মনে হয় যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত গৌরব, না চাইলেও এসে পড়ে, দেশের সেবা, দেশ রক্ষা -ইত্যাদি। মনে হয়, কোন আন্তর্জাতিক আইন করে অস্ত্র তৈরি বন্ধ করে দিতে পারলে কী হত।

    এই প্রসঙ্গে, এক্কেবারে এই গল্পটারই মত, যুদ্ধে যাওয়া নিয়ে একটা অতি পরিচিত কবিতাঃ
     
    The Send-Off
    Wifred Owen

    Down the close, darkening lanes they sang their way
    To the siding-shed,
    And lined the train with faces grimly gay.
     
    Their breasts were stuck all white with wreath and spray
    As men's are, dead.
     
    Dull porters watched them, and a casual tramp
    Stood staring hard,
    Sorry to miss them from the upland camp.
    Then, unmoved, signals nodded, and a lamp
    Winked to the guard.
     
    So secretly, like wrongs hushed-up, they went.
    They were not ours:
    We never heard to which front these were sent.
     
    Nor there if they yet mock what women meant
    Who gave them flowers.
     
    Shall they return to beatings of great bells
    In wild trainloads?
    A few, a few, too few for drums and yells,
    May creep back, silent, to still village wells
    Up half-known roads.
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে মতামত দিন