
তখনো আমাদের বাড়িতে ঈদ মানে খুশি ছিল। ঘরের মেইন দরোজাগুলোতে কাগজের ফুলে সাজানো হত। টেবিলে থাকত আসল ফুল। বড় পর্দার উপর ঝুলিয়ে দেওয়া হত বেতের তৈরি শিকল। দু একটা জরিরমালা। বাপি তার সর্বোচ্চ শিল্পপ্রীতি থেকে ঘর সাজাত আমাদের সবাইকে নিয়ে। মা রান্নার বই হাতে ঈদের আগে থেকেই বাছাই করতে বসত কোন রান্নাটা করবে । মাঝে মাঝে বাপিও যোগ দিয়ে মাকে জানাত, একটু ব্যতিক্রমি করো রাবি। একই রান্না সবার বাসায়। মা দীর্ঘ আলোচনায় বসে নতুন কিছু রান্নার রেসিপি খুঁজে বের করে ফেলত। আর সেই রান্না খেতে আমরা স্বপ্নের ভেতরেও জিভ চেটে নিতাম।
ঈদের জামা জুতো নিয়ে আমি কখনো ভাবিই নি। জানতাম ওগুলো হয়েই আছে। মাথার উপর দু দুটো মহা ইস্টাইলিশ দিদি। দিভাই একটা বানালে আপুলি আরেকটা বানিয়ে রাখবে। আর মা তো আছেই। মার দেওয়া জামা হবে, লাল, লালচে, না হয় কমলা, হলুদ মানে সবসময় এই রঙ। তার কালো মেয়েটা যেনো সবার ভেতর হারিয়ে না যায় । আরো ছোট থাকতে দিভাই আপুলির বান্ধবিরা এলে আমি নতুন জামা উচু করে মাঝে মাঝেই হাঁটতাম । আমার লেস লাগানো নতুন প্যান্ট গেস্টদের দেখানোর জন্যে। উঁচু না করলে দেখবে কি করে !
সে বয়সে আমি শুধু ঈদটাই বুঝতাম । ধর্ম নিয়ে আমাদের বাসায় কখনো কোনদিন বাড়াবাড়ি হয়নি। না মা , না আমার বাপি। বাসায় যেকোনো সময় যেকোন হিন্দু খৃস্টান ছেলেমেয়েরা এসে খেয়ে যেত। থাকার জায়গা নেই এমন কেউ কেউ সামনের ঘরে দু একদিনের জন্যে থেকেও যেত। ভেতর বাড়ি থেকে খাবার দিয়ে আসত রেনুদি বা হেমদি। কতদিন জানালা বেয়ে উঠে দেখেছি বিছানার উপর আসনপিঁড়ি হয়ে বসে পইতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মন্ত্র পড়ছে কেউ কেউ। শুধু আমাদের বাড়ি নয়। শহরের কয়েকটি বাড়ি ছাড়া অধিকাংশ বাড়িতে এরকম দৃশ্য ছিল। পুজোয় জামা শাড়ি পাঠাত। ঈদে মাও শাড়ি কিনত আত্মীয়দের সাথে বান্ধবী বৌদিদের জন্যে। আমাদের শহর এক আশ্চর্য মায়াবী শহর ছিল। ঈদ কুরাবানীতে হিন্দু বন্ধু, প্রতিবেশীদের কথা ভেবে খাসি জবাই করা হত। শহরের প্রায় সবাই এই অলিখিত নিয়ম মেনে চলত। থাকত আলাদা হাড়ি কড়াই। সামান্য সন্দেহ বা অবিশ্বাস ছিল না কারো ভেতর। আর খাওয়া দাওয়া শেষে গল্প, আড্ডা, গান কবিতা এমনকি অনায়াস গল্পের মত উঠে আসত ইসলাম ধর্মের কোনো কোনো মানুষের কথার পাশে সনাতন হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন দেবদেবীর কাহিনী বা প্রিয় যীশু খ্রিস্টের কথা।
বাড়িতে বটি ছিল তিনটা। ফল কাটার বটির কাঠ ছিল রঙিন। তরকারী কাটাকুটি আর মাছের বটি একদম আলাদা ছিল। মাকে দেখেছি মাঝে মাঝেই বটি দুটোকে নিয়ে ইঁদারার পাড়ে ফেলে ভালো করে ধুয়ে নিতে । অন্যের ধোয়া কিছুতেই পছন্দ হত না মহিলার। ঈদ এলে এগুলো দ্বিজবর কাকুর কামারশালায় পাঠিয়ে ঝকঝকে করে আনা হত। দ্বিজবরকাকু নাটক করত। নিজেই বটি দিয়ে যেত আর যাওয়ার সময় হাঁক দিত, কয়ডা নারকেল পাড়ি নি গেলাম ও বউদি। তোমাদের বউমা বলি দিয়েছে।
ঈদের সকালে লালটালি আর এসব্যাস্টাস টিনের রান্না ঘরের বারান্দায় হইচই লেগে যেত। আমি আর ভাইয়া পেস্তা, কাজু, কিসমিশ, দারচিনি খাওয়ার লোভে ঘুরঘুর করতাম। এগুলো কাঁচা খেতেই যত মজা। রান্নার পর থুথু। কয়েক রকমের সুবাসিত রঙিন সেমাই জর্দা আর নানা রকম ফল কেটে বড় থালায় বিরাট বিরাট পাতার জালি দিয়ে ঢেকে রাখা হত। মাছি ছিল আমার মা বাপির ঘোষিত শত্রু। ট্রে ভর্তি খাবার ড্রয়িং রুমে যেত আর খাওয়া শেষে সাথে সাথে এঁটো ধুয়ে ফেলা হত।
সকালের দিকে বাপির বন্ধুরা চলে আসত নামাজ পড়ে। তাদের সাথে আসত নিতাই কাকু, কেশব কাকু, বরুন চাচা, বাংলার প্রফেসর মহেন্দ্রকাকু, কাকিমা, কাশিশ্বর কাকু। সোনার চশমা চোখে, ধোপদুরস্ত পরিপাটী পোশাক, মৃদুভাষী, ক্ষীরোদ সাহা আমার মা বাপির প্রিয় মানুষ ছিলেন। পরবর্তি সময়ে এই কাকুর ছেলে আর আমার আপুলি বিয়ে করায় শহরে প্রায় দাঙ্গা লেগে গেছিল। সে অন্য গল্প। বাপির বন্ধুরা এলে মাকে একবার তখন রান্না ছেড়ে আসতেই হত। পাতলা কাঁচের গ্লাসে নতুন রেসিপির কোনো শরবত নিয়ে মা আসত । তখন অন্য মার মত লাগত মাকে। কি মিষ্টি, সুন্দর।
তবে সব চে মজা হত দূর্যোধনদাদু যখন আসতেন তখন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে দাদুর পায়ে গুলি লেগেছিল। লাঠি নিয়ে হাঁটতেন। দাদু ছিলেন বাপির বাবার বন্ধু। বাপিকে সন্তানের মত ভালোবাসতেন। দাদুর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে মা সেমাই আর ক্ষীরের পায়েস খুব যত্ন করে দাদুর সামনে নিচু টেবিলে রেখে দিত। দাদু ক্ষীর সরিয়ে রেখে সেমাই খেতে খেতে চাটাম চাটাম শব্দ করত আনন্দে। ততক্ষনে মা জোড়া পান বানিয়ে পিরিচে রেখে দিত। একসাথে দুটো পান মুখে দিয়ে দাদু আমাদের সাথে নিয়ে বাপির বাগান দেখতে উঠে যেত।
দলবেঁধে আসত দিভাই আপুলি দাদুর বন্ধুরা । কে হিন্দু কে মুসলিম এরকম অনেককেই আমি সত্যি জানতাম না। ওদিকে রান্নাঘরে তখন মা ক্ষেপে গেছে। অসম্ভব। আমি কারো জাত নষ্ট করতে দিতে পারব না। টিকিয়া কিছুতেই মা দেবে না। আর এরা খাবেই। শেষ পর্যন্ত মিথ্যে বলে তবে টিকিয়া বের করা হত। আমি আর ভাইয়া ঘুরঘুর করতাম সেলামি নেওয়ার জন্যে। ব্যাগ ভরে টাকা পয়সা নিয়ে আমরা ছুটে যেতাম আইসক্রিমের দোকানে। তখন নতুন নতুন আইসক্রিম আসছে মার্কেটে। বিরতিহীন খেয়ে যেতাম আমরা ছোটরা। জিভ ভারি হয়ে কথা আটকে যেত। অইদিন গরিবদের ছেলেমেয়েরাও আইসক্রিম কিনতে আসত। তারাও সস্তা কাপড়ের নতুন জামাকাপড় পরে আনন্দ করত। কিন্তু এত আনন্দের ভেতরেও খারাপ লাগত যখন দেখতাম এই ঈদের দিনেও কেউ ভিক্ষে করছে বা ছেঁড়াফাটা পুরান জামা পরে মুখ কালো করে এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের শহরে হামবড়ামি করত যারা তাদের কেউ কেউ এদের তাড়িয়ে দিত। কেউ কেউ আবার দুষ্টুমি করে আমাদের বাড়ি দেখিয়ে দিত। মা যতটা পারত দিত। বাপি মাকে শিখিয়েছিল, দিও কিঞ্চিত না করে বঞ্চিত। আমরা তো অই হামবড়ামি টাইপের ধনীলোক ছিলাম না। ওদের গেট বন্ধ থাকত, শবে বরাত, ঈদ , কুরবানির দিনগুলোতে। গরীবরা কিছু না পেয়ে কত কি যে অভিশাপ দিত। শেষবারের মত বলত, আল্লাহ বিচার করবিনে, একদিন আমাগের মত ভিক্ষে করতি হবিনে ওগের। এই ধনসম্পদ কিছুই থাকপি নানে তহন। আল্লাহ কিন্তু ওদের ছাপ্পড় ফুঁড়ে দিয়েছে, দিয়েই গেছে। গরীব আরো গরীব হয়েছে। আমি আর ভাইয়া এগুলো ভালো করে দেখে টেখে ঠিক করেছিলাম, কাউকে মুখে কিছু বলব না। সুযোগ পেলে মেরে দেবো।
অনেক বছর পরে সেই শহরে গিয়ে আমি পুরনো সেই আমেজ সেই ভালোবাসাকে কিছুটা হলেও খুঁজে পেয়েছি। যদিও হিন্দু পাড়াগুলো ফাঁকা। বেশিরভাগ হিন্দুরাই চলে গেছে দেশ ছেড়ে। যারা আছে ভাইবোনের মত , বন্ধুর মত ঈদের সকালে ফোন করেছে, উইশ করেছে হ্যাপি ঈদ। কিন্তু এই কি নিয়তি ? একটি স্বাধীন সার্বভৌম ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে নিরাপত্তাহীনতার সমূহ সম্ভাবনায় শঙ্কিত হয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে রাষ্ট্রের বৈধ নাগরিক হিন্দু সম্প্রদায়।
আমি এসেছি জেনে সাত মাইল বাস, টেম্পু চড়ে দেখতে এসেছিলেন আমার স্যার। স্যারের ছেলেমেয়ে সবাই ইন্ডিয়া থাকে। এবার উনিও চলে যাচ্ছেন। বার বার বলছিলেন দিন ভালো নয়। আসছে দিন ভালো নয়। ওপারে মুসলিম মার খাচ্ছে, এপারে হিন্দু। দিন খারাপ, বড় খারাপ দিন আসছে রে কাজল। ঠিক এরকম কথা বলেই আমাদের খুব কাছের এক বন্ধু পরিবারসহ চলে গেছে কানাডা। প্রতি ঈদে সুভাষদার জন্যে টিকিয়া বানিয়ে বক্স করে দিতে হত। আর ছোট্ট পাপ্পু ডাইনিং টেবিল ছেড়ে উঠতেই চাইত না। পোলাউয়ের গন্ধে ওর নাকি খালি ক্ষুধা পেয়ে যেত। কি যে মিষ্টি করে বলত, মামি মামি আর একটা রোষ্ট কি হবে? পাপ্পু খুব ঈদ মিস করে। ঈদ এলে আমার ছেলেকে কানাডা থেকেই হুমকি দেয়, আমি নেই তাই খুব খাচ্ছিস তাই না ?
রঘুনাথপুরের বুড়িরথানে বসে মনে হচ্ছিল আমরা ক্রমশ মুসলিম আর হিন্দু হয়ে যাচ্ছি। মানুষ থাকছি না।
দ | unkwn.***.*** | ০২ জুলাই ২০১৭ ০৪:৩৮82906
বিপ্লব রহমান | unkwn.***.*** | ০২ জুলাই ২০১৭ ০৬:৩৬82907
Reshmi | unkwn.***.*** | ০৩ জুলাই ২০১৭ ০১:০৮82909
প্রতিভা | unkwn.***.*** | ০৩ জুলাই ২০১৭ ০১:৫২82910
Zoya basu | unkwn.***.*** | ০৩ জুলাই ২০১৭ ০২:২২82911
মুহাম্মাদ সাদেকুজ্জামান শরীফ | unkwn.***.*** | ০৩ জুলাই ২০১৭ ০৩:৩৬82912
Sushobhan Bhattacharya | unkwn.***.*** | ০৩ জুলাই ২০১৭ ০৩:৪০82913
Sushobhan Bhattacharya | unkwn.***.*** | ০৩ জুলাই ২০১৭ ০৩:৪৩82914
অভিষেক | unkwn.***.*** | ০৩ জুলাই ২০১৭ ০৩:৫২82915
দীপেন ভট্টাচার্য | unkwn.***.*** | ০৩ জুলাই ২০১৭ ০৫:৩৪82916
utpal | unkwn.***.*** | ০৩ জুলাই ২০১৭ ০৮:০১82908
জিজি | unkwn.***.*** | ২৪ জুলাই ২০১৭ ০৫:২০82917
π | unkwn.***.*** | ১৫ জুন ২০১৮ ০৬:২৩82918
Sumit Roy | unkwn.***.*** | ১৭ জুন ২০১৮ ১১:৪৯82919