১.
‘এত কি চিন্তা করতেসো বুজি! তোমার এতটুকুন মাইয়ারে দিয়া কি আমি কাম করামু? রান্দাবাড়া, মাজাঘষার আলাদা লোক আছে আমার!’ শেফালি বেগমের কালো মেঘে ঢাকা মুখটার দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে রেখা।
শেফালি রেখার দূর সম্পর্কের চাচাতো বোন। ঈদের ছুটিতে গ্রামে আসার পর একদিন খেতে খেতে মায়ের কাছেই শুনেছিল শেফালির কথা, বয়সে বছর পাঁচেকের বড় এই বোনটির না কি খুবই খারাপ যাচ্ছে দিনকাল! কিছুদিন আগে আলুর ব্যবসায় বিস্তর লস গুনে যখন মাথায় হাত দিয়ে বসেছে, তখনই আবার খবর এসেছে স্বামীর জটিল রোগটির কথা! জমি তো বেচতে হবেই, পাশাপাশি বসেও থাকতে হবে ম্যালা দিন! ইন্ডিয়ার চেন্নাই ছাড়া না কি গতি নাই!
শেফালি বেগমের মুখে উদ্বেগের থাবাটা ক্রমেই বিস্তৃত হতে দেখে এক পর্যায়ে মাথায় হাত বুলোতে শুরু করে রেখা, ‘আমার বাচ্চা আর তোমার বাচ্চা কি আলাদা! তোমার মিনু আমার জায়ানের সঙ্গে এক লগে খাইবো, দাইবো, খেলবো, বেড়াইবো।‘
রেখা ঢাকায় থাকে, স্বামী একটি বড় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির প্রডাকশান ম্যানেজার। উন্নত বাসা, সিকিউরিটির চোখ সর্বত্র, বাসায় সাহায্যকারী লোকেরও নেই অভাব। তারপরো এক ফোঁটা চোখ বোঁজা আর দম নেয়ার অবকাশ নেই রেখার! ওর কেবলি মনে হয় এই বুঝি ছেলেটাকে কেউ ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে গেল! অথবা, এই বুঝি সে কোন অ্যাকসিডেন্ট করল!
হঠাৎ দূরে একটা খিলখিল উঠে, আর শেফালি ও রেখার দুজনেরই চোখ দৌঁড় পাড়তে শুরু করে। শেফালিদের উঠোনটা ছোট, কিন্তু সেখানেই একটা প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে গেছে, মিনু দু’বছরের বড় হলেও তাকে বেগ পেতে হচ্ছে জায়ানের সাথে পাল্লা দিতে! যখন মিনু হেরে গিয়েও জড়িয়ে ধরে জায়ানকে, শেফালির থমথমে মুখটা দিয়ে আচমকাই ঘোর বর্ষা নামে, আর রেখার হাতটা ধরে সে বলে উঠে, ‘দেইখা রাখিস!‘
২.
সপ্তাহ খানেক পর বিকেলে ঘুমের ঘোরটা হঠাৎই কেটে যায় রেখার। ঢাকায় ফেরার পর থেকেই ঘুমটা বেশ করে পাঁকিয়ে ধরছে। কিন্তু আজ একটা পরিচিত কণ্ঠের চিৎকার তাকে বিছানা থেকে উঠিয়ে বারান্দায় নিয়ে ফেলে। গ্রিলের ফাঁক গলে চোখে পড়ে, মিনু মাথা দুলিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে বাড়ির সামনের লনে, আর জায়ান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কয় রাউন্ড হল, তার হিসেব কষছে।
‘ওই তো আমারে কইল সাইকেলে উঠতে।’ কথাগুলো যখন মিনু বলছিল, ওর চোখে ভয়-ডরের ছিঁটেফোঁটাও ছিল না।
সেদিনই রাতে জায়ান যখন হোম টিউটরের কাছে পড়া করছিল, মিনুকে ড্রইয়িং রুমে ডেকে নিয়েছিল রেখা। ,
‘জায়ান বললেও, তুই আর কখনো উঠবি না। জায়ানের বাবা জানলে কিন্তু খুব রাগ করবে।‘ খুব মোলায়েম করে বলে রেখা।
‘কিন্তু হে যে আমারে খেলার লাইগা ডাকে হারাদিন!’ এখনো কোন অভিমান বা বেদনা নেই মিনুর কন্ঠে।
‘অবশ্যই খেলবি তুই, তবে তোর খেলাটা হবে অন্য রকম। যখন জায়ান খেলতে থাকবে, তখন ওর উপর থেকে এক মুহূর্তের জন্যও চোখ সরাবি না। পড়ে টড়ে গেলে বা বাইরের লোকের হাত থেকে কিছু খেলে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে খবর দিবি। ‘ বলেই উঠে যায় রেখা, পাশের বাড়ির ভাবির সাথে কোরাল মাছের একটা নতুন মেন্যু নিয়ে আলোচনা করার কথা।
এদিকে মিনু এই নতুন ধরণের খেলাটার মানে উদ্ধারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অনেক ভেবে সে এক সময় বের করতে পারে ব্যাপারটা। গ্রামের বাড়িতে ছোটাছুটির সময় তার মা যখন তাকে চোখে চোখে রাখতো, তখন বুঝি এই খেলাটাই খেলত! সে এখন শহরে মায়ের সেই খেলাটাই খেলবে তাহলে!
হঠাৎ তার মাকে খুব মনে পড়ে! আর মাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে খেলার ময়দানটা ছেড়ে দিয়ে!
(সমাপ্ত)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।