বর্তমান বাঙালী মুসলিম সমাজের সংকীর্ণ চিন্তা ও পশ্চাদগামিতা নিয়ে আলোচনা করলেন রেজাউল করিম। দুর্ভাগ্যজনক হলেও বর্তমান মুসলিম সমাজ নিয়ে এই আলোচনা অনেকাংশে সত্য। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছেন, তাঁরা আমাদের নমস্য। তবে ব্যতিক্রম নিয়মকেই প্রতিপন্ন করে।
আধুনিক শিক্ষা ও চিন্তাকে আশ্রয় করে মুসলিম সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে, ধর্মগুরুর বেশধারী ভণ্ডদের কথা শুনলে চলবে না! সংকীর্ণ চিন্তা নয়, উদার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
এছাড়া আর অন্য কোনো পথ নেই।
-------------------------------------------------------------------
প্রায় ৪৫ বছর ধরে গ্রাম ছাড়া হলেও ঈদের (ঈদ-উল-ফিতর) ছুটিতে বাড়ী আসি। বাবা-মা যতদিন ছিলেন নিয়মিত ছিলাম, এখনো সুযোগ পেলেই চলে আসি। আমরা আমাদের কম বয়সে যে বাঙালী মুসলিম দেখেছি তারা দরিদ্র ছিল কিন্তু উদারতার কোন অভাব দেখিনি। ওয়াহাবী ইসলামকে তারা যে নিজেদের জীবনচর্যায় ব্রাত্য করেছিলেন তাই নয়, তাদের থেকে সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা এত বেশি ছিল যে, তাদের বাড়ীতে খাওয়া-দাওয়া বা বিবাহ ইত্যাদি প্রায় নিষিদ্ধ ছিল বললেই হয়। তারপর সৌদি পুঁজির আস্ফালন আর মোল্লাতন্ত্রের প্রতি সরকারী আনুকূল্যের ত্র্যহস্পর্শে সেই সহজিয়া মুসলিম, যারা নিজেদের প্রাচীন সংস্কৃতি অক্ষুন্ন রেখেও মুসলিম ছিলেন, আরবীয় আধিপত্যবাদ ও পুঁজির অঙ্গুলিহেলনে হিন্দু-বৌদ্ধ সংস্কৃতি তারা লোপ পেতে দেননি। বাড়ীতে দেখেছি একটি ভাতের কনিকা মাটিতে পড়লেও “মা-লক্ষীর” অবমাননা বলে মনে করা হত, বইকে নমস্কার করা হত, গোবর ছড়া দিয়ে ঘরদোর, উঠোন নিকানো হত। বিয়েতে কন্যাদান, কালরাত, অষ্টমঙ্গলা হত। জামাইষষ্ঠীর তত্ত্ব যেত।
চল্লিশ বছরে বাঙালীর সেই সংস্কৃতি ধ্বংস করে আরবীয় সংস্কৃতির দাস হতে দেখলাম। ঈশ্বরকে আজকাল আর মসজিদ ছাড়া পাওয়া যায় না, সমস্ত দীনদুনিয়ার মালিক এখন শুধু মুসলমানদের ঈশ্বরে পরিণত হয়েছে। তার সাথে যুগপৎ রীতি সর্বস্ব নিষ্প্রান ধর্মীয় আচার আর অর্থের দাপাদাপি শুরু হয়েছে। ঈশ্বরের লোকাল এজেন্টরা তাঁর নামে টাকা আদায় করছে আর চেঁচিয়ে মাইকে তার প্রচার চলছে। আমরা যে ইসলাম দেখেছি আমাদের অল্পবয়সে সেখানে “ডান হাতে দান করলে বাম হাত তার খোঁজ” পেত না।
মসজিদ আগেও ছিল। সেখানে চাকচিক্য ছিল না। ইসলামের পয়গম্বর বলেছেনঃ মসজিদের চাকচিক্য কেয়ামতের লক্ষণ। সে যে আসন্ন, তা বলতে হাত গোনার দরকার নেই। এক সময়ে মুসলিম সমাজের যারা নেতৃত্ব দিতেন তারা সমাজের সর্বস্তরে আদৃত ছিলেন, তারা দরিদ্র কিন্তু শিক্ষিত ছিলেন। কপটতা তাদের থেকে বহুযোজন দূরে থাকত। এখন সমাজের যারা মাথা হয়ে উঠেছেন তারা রাজনৈতিক কর্মী বা দলের প্রতিনিধি- কি শিক্ষায় কি চরিত্রবলে তারা সমাজকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন না। এর অবশ্যম্ভাবী বিষময় ফল হল ওয়াহাবী সংস্কৃতিতে দীক্ষা।
শিক্ষা যে চেতনা আনে তার প্রাথমিক শর্ত হল নিষ্প্রাণ ধর্মান্ধতার উর্ধে উঠে মনুষ্যত্বকে প্রতিষ্ঠা করা। যুগের পরিবর্তনে নতুন ধর্মমত আসে। অনেকে তাকে গ্রহণ করেন। কিন্তু, নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি অক্ষুন্ন রেখে ধর্মের পরিবর্তন হয়। ইসলাম যখন হেজাজের বাইরে ছড়িয়ে পড়ে তখন পারসিকরা এমনকি আরবী ভাষায় কোরান পড়তে অস্বীকৃত হয়েছিল। বস্তুতঃ মুসলিমরা যাঁদের আরবী বীর ভেবে নাম জপ করেন যথা সোহরাব-রুস্তম ইত্যাদি- তারা কেউ আরবী নয়, মুসলিমও নয়। তারা বস্তুত, অগ্নিপূজক পারসিক। স্বয়ং নবী সাইরাসের ন্যায়পরায়ণতার প্রভূত প্রশংসা করেছেন, প্রশংসা করেছেন ভারতীয় আয়ুর্বিজ্ঞানের।
যে কথাটি দিয়ে শুরু করেছিলাম সেখানে ফিরে যাই- ধর্ম তার নিজের জায়গায় থাক। কিন্তু, আরবের অন্ধ অনুকরণ সাম্রাজ্যবাদী চেতনা, তার সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। পোষাক-আশাক, খাদ্যাভাষের সাথেও ধর্মের হোন সম্পর্ক নেই। বাঙালী ও মুসলমান এই দুইটির সমাবেশ একটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠী যা আরবীয় ইসলামের থেকে বহু ভাবে আলাদা- যেখানে হিন্দু যোগীদের ঈশ্বর সাধনার সাথে সুফী মিস্টিসিজমের মিশ্রণে নতুন সহজিয়া মতবাদ তৈরী হয়েছে।
একটি মাত্র বই নয়, অনেক বই পড়তে হবে। ঈশ্বরকে লাভ করতে হলে, অনুভব করতে হলে তার বিজ্ঞানকে আঁকড়ে ধরতে হবে। বিজ্ঞানকে আয়ত্ব করতে পারলেই ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানো যাবে। ঈশ্বরকে ভয় নয়, তাঁকে ভালবাসতে হবে। নবী আল্লাহকে “রফিকে আলা” বা মহান বন্ধু বলে সম্বোধন করেছিলেন। অশিক্ষিত ধর্মের ষাঁড়েদের শিক্ষায় নয়, শিক্ষায় সমৃদ্ধ হয়ে, রীতিসর্বস্ব ধর্মের বিষ থেকে নিজেদের রক্ষা করে নির্জনে তাকে সাধনা করতে হবে। নিজের বাঙালীত্ব সম্পর্কে আলী সাহেব (ঠাট্টা করে) বলতেন- বাঙালী মাত্রেই মহান কারণ নামের শেষে আলী আছে। আমি সেই মত সাদরে খুব গম্ভীরভাবে গ্রহণ করেছি। একজন উদার,শিক্ষিত,সহিষ্ণু বাঙালীর চেয়ে বড় বিশেষণ আর কি আছে। রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বড় দরবেশ তো দেখিনা।