"আচ্ছা অ্যাপোলোর মহেশ গোয়েংকা কোনদিন আপনাকে টাচ করে দেখেছেন?" একটা হাসিখুশি উচ্ছল তরুণ ডাক্তার প্রশ্নটা করেই ফেল্লো। যদিও সে নাকি অ্যাসোসিয়েট প্রফেসার। "কেন টাচ করবেন না ? উনিই তো আমার এণ্ডোস্কোপি করলেন।"
" না না ওরকম নয়, এমনিতে একটু পেটে হাত দিয়ে পরীক্ষা করলেন, স্প্লিনটা কত বড় দেখলেন, ফাইব্রোসিস কতটা, এসওএল আছে কিনা, জল আছে কিনা এসব দেখলেন? দেখেন নি তো? আমি জানেন,একটা পেশেন্টও দেখিনি যাকে উনি ছুঁয়ে দেখেছেন"। আমি আর ভয়ের চোটে বল্লাম না যে সেদিনও (সিডেটিভ ছাড়া আমি এণ্ডোস্কাপি নিতে পারিনা) সময়মত সিডেটিভ দেওয়া হয়নি কেন, আর যদি হয়নি তবে তাঁকে ডেকে দু মিনিট সময় নষ্ট করার মানে কি বলে নার্স মেয়েটিকে বিস্তর গালিগালাজ করার ফাঁকে ডক্টর গোয়েংকা উইদাউট সিডেটিভ এফেক্ট নলটা পুশ করে দিলেন আমার গলায়। বেচারা নার্স তখনও বিস্তর চেষ্টা করে চলেছেন হাতে সূঁচ ফোটানোর। এণ্ডোস্কোপি শেষ এবং সিডেটিভ এফেক্ট শুরু একই সঙ্গে সম্পন্ন হয়ে গেল।
অল্প বয়সী ডাক্তারটিকে তার সতীর্থরা বকতে শুরু করলো চুপ করানোর জন্য। আমার মনে পড়লো ইসরোর টেলিমেডিসিন প্রকল্পের প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার পর দিলীপ ঘোষ স্যার বলেছিলেন “তুমি একটু অভিজিতের সঙ্গে কথা বলো। ওর কী সমস্ত রিজারভেশন আছে এই বিষয়ে।” অভিজিত চৌধুরী প্রস্তাব ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বল্লো, “ধুর ডাক্তার যদি রুগীর শরীর ছুঁয়েই না দেখে, তাদের মধ্যে যদি একটা টাচিং বণ্ডেজ তৈরী না হয়, তবে সেটা ডাক্তারী নয়। রুগী কাৎরাচ্ছে পাঁচশো মাইল দূরে, আর ডাক্তার এখানে বসে পাঁচটা রিপোর্ট দেখে বিধান দিল কী করিতে হইবে? রিপোর্ট আর কাগজ দেখে উকিল, ডাক্তার দেখে রুগী।”
সকাল ঠিক সাতটায় খোকনদা এসে ডাকবেন। "টয়লেট যাবেন তো। ডেটল দিন।" এরা জানে আমি ইমিউনো-কম্প্রোমাইজড। ফলে আমার জন্য এক বালতি জলে ডেটল ঢেলে টয়লেটটা ধুয়ে দেয়। আমি বেরুলেই বলবে এবার স্নানটা করে নিন। কষকষে গরম জল করেছি। যত বলি আমার ঠাণ্ডা লেগে যাবে, শুনবে না। চান করে রোদে পিঠ দিয়ে বসে থাকবেন। আটটায় রাও-দা (দিনের অ্যাটেণ্ডেন্ট) আসবেন। ফাইল আসবে। একটু পরে ডক্টর শুভায়ন, বা ডক্টর দেবজ্যোতি বা ডক্টর বৌধায়নের মতো কেউ আসবেন। খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করবেন কী অসুবিধে। পালস প্রেশার মাপবেন, টেস্ট থাকলে ব্লাড নেবেন। তারপর পাশের ঘরে। দশটা সাড়ে দশটায় ডক্টর বিভূতি সাহা আসবেন সঙ্গে দশ-পনেরো জন ডাক্তার। বলবেন “শুনুন আপনাকে এখানে আটকে রাখার কোন ইচ্ছে আমাদের নেই। শুয়ে পরুন।” আবার এক প্রস্থ পরীক্ষা। তারপর শুরু হবে টিমের মধ্যে আলোচনা। পয়েন্ট ফাইভ না ওয়ান পয়েন্ট ফাইভ। টেনশন রিলিজার দেওয়া হবে কি হবে না। অ্যালডাক্টন চালু রাখা হবে না। কি হবে ডোজ। মাঝে মাঝে আমিও পারটিসিপেট করতাম নন-ক্লিনিকাল ডিসকাশনে।
ফাইনালি ঠিক হলো যেহেতু আমার ক্রিয়েটিনিন কম তাই ইন্টারভেনাস লাইপোজোমাল অফো-বি শুরু করা হোক। প্রতিদিন পাঁচটা করে ভাইল এর ডোজ, ড্রিপের সঙ্গে। প্রতিটা ভাইলের দাম পাঁচ হাজারের টাকার ওপর। হসপিটাল ডিসকাউন্ট ধরে আমরা পেতাম আঠাশশো টাকায়। যেহেতু এত কস্টলি ওষুধ সিস্টেমে থাকেনা, তাই কিনতে হবে। মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিল সবার। ভাগ্যিস আমি তখন প্রায় দেখতে পাইনা। বাকীদের তখন পাগল পাগল অবস্থা। ডক্টর সাহা তখনও আশ্বাস দিয়ে বলছেন ঠিক আছে দেখাই যাক না। প্রথম দিনের ওষুধটা তো কিনুন। সেইমত ডোজ শুরু হলো ডিসেম্বরের বারো তারিখে, চোদ্দটা ডোজ কমপ্লিট করার লক্ষ্যে। দ্বিতীয় দিন থেকেই সিস্টেমে চলে এল ওষুধ, ঠিক কার বা কাদের অতি সক্রিয় উদ্যোগে তা আমি জানলেও প্রকাশ্যে জানাতে পারবো না কেননা বারণ আছে। তারাও সরকারি বৃত্তেরই মানুষ। এখনও কিছু মানুষ গোপনে সহযোগিতায় বিশ্বাসী, যখন প্রচারের লাইমলাইটে আসার জন্য অনেকাংশের জিভলালা ঝরতেই থাকে অহর্নিশ।
আলোচনায় ফিরি। মধ্যবিত্ত মানুষ এত সুযোগ সুবিধা থাকা সত্বেও সরকারি হাসপাতালের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলেন কেন? আমি কেন এড়িয়ে চলতাম? আমার কারণগুলিকে এইভাবে চিহ্নিত করতে পারি।
১. আমাদের চিকিৎসা অভ্যাস। প্রাথমিকভাবে পাড়ার পরিচিত ডাক্তারের কাছে যাওয়া। তিনি সারাতে না পারলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের খোঁজ করা। মানে নিজস্ব পরিচিতি সুত্রে যিনি বিশেষজ্ঞ। এবার তিনি কোথায় কোথায় বসেন খোঁজ করা। নিজের সুবিধা এবং সামর্থ অনুযায়ী অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে তাঁকে দেখানো। সরকারি সিস্টেমে এটা সম্ভব নয়। ওপিডিতে যে ডাক্তার থাকে তাকেই দেখাতে হয়। তাঁর মনে হলে তবে সেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে যাওয়ার ছাড়পত্র পেলেন।
২. সরকারি ব্যবস্থাপনায় অবিশ্বাস। সাধারণ ধারণায় দু টাকায় যে চিকিৎসা হয়না তাও চালু করা হয়েছে শুধু মাত্র ভোটের অংক মেলানোর জন্য। শুধু জেলা নয় অন্য রাজ্য থেকেও লোক চলে আসছে। বিহার থেকে ঝাড়খণ্ড থেকে। ফলে অপরিচ্ছন্নতার ভয়। সংক্রমনের ভয়।
৩. যে অর্থনেতিক শ্রেণী-অসাম্যের অবস্থান থেকে উচ্চবিত্তেরা পোকামাকড়সম দৃষ্টিতে দেখে মধ্যবিত্তকে, আমরাও সেই একই দর্শন ও অবস্থান-লালসা বুকের গভীরে লালন করে চলি। নিম্নবিত্তদের সঙ্গে একই সারিতে দীর্ঘ কিউ, তাদের গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ডাক্তার দেখানোর জন্য অপেক্ষা, এসবই একটা মেন্টাল বেরিয়ার তেরী করে। সরকারি হাসপাতালকে আমাদের প্রাথমিক চয়েসের বাইরে রাখে।
৪. প্রিভিলেজড ক্লাস সুপার স্পেশালিটি হসপিটাল ছাড়া অন্য কিছু ধর্তব্যের মধ্যেই আনেনা। ভাবতে পারেন কোনও মন্ত্রী-সান্ত্রী-উজির-নাজির আর.জি.কর. বা এন.আর.এস বা মেডিকাল কলেজে ভর্তি হচ্ছেন। আমি প্রথম যেবার সল্টলেক আমরি তে অ্যাডমিশন নিই তখন আমার মাথার ওপর ডিলাক্স স্যুইটে অধিষ্ঠান করছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। আর বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর তো কোনদিনই বেলভিউ ছাড়া কিছু পছন্দ নয়। মধ্যবিত্ত সমাজের চিরকালীন স্বভাব হচ্ছে উচ্চবিত্তকে অনুসরণ ও অনুকরণ করা। তাই কুঁজোর চিৎ হয়ে শুতে সাধ জাগে। এভাবেই তারা গণ্ডি পেরিয়ে যায়, পেরোতেই থাকে, যতক্ষণ না উলঙ্গ জীবন বা মৃত্যু তাকে নির্বাচন করছে।
৫. হাসপাতালের নিচু তলার কর্মীদের দোর্দণ্ড প্রতাপ। কোন কাজ করতেই টাকা ছাড়া এদের নড়ানো যায় না। প্রফেশ্যনাল অ্যাটিটিউড নেই বলে, কর্মদক্ষতা-কর্মসংস্কৃতি নেই বলে, সেই কাজগুলোও এরা সঠিক ভাবে করেনা। টয়লেটগুলি ব্যবহার অযোগ্য। ঘরগুলি নোংরা, ইত্যাদি প্রভৃতি....
আমার সমস্যা হলো ইদানীং সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়া অন্যত্র লেখার সংস্থান নেই। সোশ্যাল মিডিয়ার সমস্যা হলো যারা এই লেখাটি পড়বে (যদি পড়ে), তাদের এই লেখাটির প্রয়োজন নেই। আজ অবস্থার ফেরে আমায় ট্রপিকালে ভর্তি হতে হচ্ছে। কে জানে কাল অবস্থা পাল্টালে আমিও হয়তো উল্টো গাইবো। এসবই অবস্থানগত দৃষ্টিভঙ্গী। শ্রেণী-দর্শন। বেসরকারি হাসপাতালে এই সব কিছুর জন্যই মূল্য ধরা থাকে (আগের কিস্তিতেই লিখেছি, তাই আলাদা করে চাইতে হয়না)।
ফলে প্রথম চারটি অনীহা নিয়ে আলোচনা করে কোনও লাভ নেই। শুধু এটুকু বলবো যে এইসবই আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাপ্রসূত যা কিনা সরকারি হাসপাতালের বিচক্ষণতা, কার্যকারিতা, এবং নিম্নবিত্ত হিতকারীতাকেই প্রমাণ করে। আমি শুধু পঞ্চম পয়েন্টটি নিয়েই আলোচনা করতে পারি। এই পয়েন্টের বাস্তব অভিযোগগুলি মিথ্যা নয় আবার সত্যও নয়। ট্রপিকালে অন্তত দশ-পনেরোটি বড় ফ্লেক্সে বড় বড় হরফে পরিষ্কার লেখা আছে যে “এই হাসপাতালের প্রতিটি পরিষেবা এমনকি ওষুধ পর্যন্ত বিনামূল্যে দেওয়া হয়। কেউ যদি কারও কাছে টাকা চায় তবে তা অবিলম্বে কর্তৃপক্ষের নজরে আনুন।” কেউ আনেনা। কেননা আমরা অনৈতিক এবং আইন-বহির্ভূত সুবিধে নেবার জন্য লালায়িত।সবাই যা পায় আমি তার চাইতে বেশি চাই। সন্ধ্যে ছয়টা অবধি ভিজিটিং আওয়ার্স হ’লে, আমি সাতটার সময় গেটকিপারের হাতে ত্রিশ টাকা গুঁজে দিয়ে ঢুকে পড়ি। অ্যাটেনডেন্টের হাতে এক দেড়শো টাকা ধরিয়ে আমি সার্বজনীনতার বাইরে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করি। আমি দুই টাকার টিকিটে লাইন না দিয়ে মাত্র পঞ্চাশ টাকা খরচ করে সবার আগে নিজের ঢুকে পরার ব্যবস্থা পাকা করি। দুটো ভিজিটিং কার্ডে চারজন একসঙ্গে না ঢুকলে আমার তৃপ্তি হয় না। সবাই যা যা পায়না আমাকে তাই পেতে হবে। আমার পেশেন্ট যতই ভীড় হোকনা কেন, মেঝেতে বা স্ট্রেচারে শোবেনা, বেড চাই। তাই আমি বকশিস দিই (আসলে ঘুষ দিই), তারপর বলি টাকা ছাড়া এদের নড়ানো যায় না। মেদিনীপুরের সেই ডার্মাটোলজির পেশেন্ট বা ঝাড়খণ্ডের টিবি রোগী ট্রাক ড্রাইভারের কাছে এরা তো টাকা চায়না। এরা টাকা চায় এবং আমরা টাকা দিই এর মধ্যে কোনটা আগে? ডিম আগে, না মুরগী আগে?
বাকী রইলো অপরিচ্ছন্ন ঘর আর অব্যবহারযোগ্য টয়লেটের গল্প। তো মিশন নির্মল বাংলা, আর স্বচ্ছ ভারত অভিযানে তো কোটি কোটি টাকা উড়ছে।শুধু শৌচাগার বানানোর ক্যাম্পেন করতে। যাদের বাড়িতে শৌচাগারই নেই, তারা আপার-স্ট্রাটার ক্লিন টয়লেট ইউসেজটা শিখবে কোত্থেকে। আর ঠিকঠাক টয়লেট ব্যবহার করতে পারেনা বলে গ্রাম্য পেশেন্টকে রাস্তায় শুইয়ে মেরে ফেলাটাও সামাজিকভাবে রিস্কি হয়ে যায়। ফলে দুটো সমান্তরাল ট্র্যাক কোনওদিনই মিলে যাবেনা। এমনই চলতে থাকবে।