আজ দুর্বারের অফিসে খুব আনন্দ দেখে এলাম। পূজার পারমিশন মিলে গেছে। কলকাতা পুলিশ "আসান"(aasan) প্রজেক্ট খুলে বিজ্ঞাপন মেরে অনলাইন পুজা পারমিশন বিলুচ্ছে দেদার। শুধু যৌনকর্মীদের ওই দিন কটাও প্যাঁচা-অন্ধকারে মুখ ঢেকে রাখবার নিদান। কি সব উৎপটাং অলম্বুষে অজুহাত! বলে কিনা রাস্তা আটকালে পাবলিকের অসোয়াস্তি। তোয়ালে-চাপা মন্ত্রীমশাইরা সেই আদ্যিকাল থেকে রাস্তা আটকে পুজোআচ্চা করেন, কি ভক্তি কি ভক্তি! পাবলিক খুশিতে আরো বেশি বেশি ভোট দেয়। যার পূজার জলুস যত বেশি তার ততো ভোট। সেটা হল গিয়ে পাবলিকের আনন্দের ব্যবস্থা। আর এরা করতে চাইলে কেবল হুড়কো আর হুজ্জুতি!
অথচ দ্যাখো, সুকুমারী ভট্টাচার্য প্রাচীনতম সাহিত্য ঘেঁটে দেখালেন গণিকাবৃত্তি বুড়ো বটগাছের মতোই ঝুরিনামানো ঝুরঝুর পুরোনো। ঋগবেদ অব্দি এই অশুচিতা থেকে দূরে থাকতে পারেনি। বিবাহগন্ডীর বাইরে পুরুষ নারীর সম্বন্ধ ঘটলে তারা হতো 'জার' ও জারিণী। তবে এক্কেবারে কোন সময় থেকে জারিণীরা স্বৈরিণী হল,আর জারের অসম্মানে পিতৃতান্ত্রিক প্রলেপ পড়ল তা বলা মুশকিল বটে, কিন্ত সুকুমারী থেকে কলনতাই এব্যাপারে একমত যে সমাজে বিবাহ আর পরিবার প্রতিষ্ঠিত হবার সঙ্গে নারীর স্বাতন্ত্র্য হারানো জড়িয়ে আছে আষ্টেপৃষ্ঠে, আর ঠিক ওই সময়টা থেকেই শুরু এই এই শোষণের লালা মাখানো প্রথার, এই বিচিত্র বৃত্তির। কৌমার্য রক্ষা করবে পিতা, যৌবনে স্বামী আর বার্ধক্যে পুত্র। এই তিন রক্ষণাবেক্ষণের বাইরে মূল্য দিয়ে যাকে পাওয়া যাবে সেইই গণিকা।
তবে প্রাচীন সোনাগাছির অবস্থা অনেক ভালো ছিল। সেখানে তখন "জনপদকল্যাণীদের" ভিড়। সবাইকার না হলেও অনেকেরই তখন শুধু রূপে নয়, শিক্ষাদীক্ষা, প্রতিপত্তিতে বেশ রবরবা। রাষ্ট্র শিক্ষার ব্যয়বহন করত, রাজস্ব আদায় করত,কৌটিল্য তার জন্য বার্ধক্যে কিছু ভাতার ব্যবস্থাও রেখেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব আর অধিকার দুইই তার ছিলো।
আজকের জনপদকল্যাণীদের জন্য সবই পালটে গেছে --আইনকানুন, প্রতিপার্শ্ব, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী সবই তার এমন প্রতিকূল যে গালভরা যৌনকর্মী শব্দের বিরোধিতায় হেসে লুটিয়ে পড়ে অনেক নীলমণি মিত্র স্ট্রিটের অনেক মেয়ে,
অ দিদি, বে*শ্যেকে বে*শ্যে বললে তার সম্মান যায় নাকি!
এইখানে, ঠিক এইখানে তার নাড়ীর ওপর হাত রাখে দুর্বার মহিলা সমণ্বয় সমিতি। আলেকজান্দ্রা কলন্তাই যখন দেহোপজীবিনীর সংজ্ঞা দেন এই বলে যে সে এমন এক ব্যক্তি যে অন্যদের ওপর বেঁচে থাকে, যার শক্তি যৌথতার জন্য ব্যবহৃত হয় না, যে "শ্রমপরিত্যাগকারী", তখন তার সামনে যে বিষয়গুলি অনুপস্থিত থেকে যায় তা হল হিউম্যান ট্র্যাফিকিং, রাজনৈতিক মদত আর ব্যক্তিস্বাধীনতার চূড়ান্তকরণ। হ্যাঁ, তার কথা ঠিক, শুধু উঁচু হিলের জুতোর জন্য এই পেশায় যায় কিছু মেয়ে, কিন্তু সংখ্যায় তারা নগণ্য। গতকালের TOI তে খবর আছে পুণে থেকে উদ্ধার করা এক বাঙালি মেয়ের হাসপাতালে শুয়েও যে আরো চারজনকে উদ্ধার করার কাজে সার্থক হয়েছে একটি এন জি ও র সহায়তায়। একজন বাংলাদেশি মাইনর। কাজ দেবে বলে নিয়ে গিয়ে যে ব্রথেলে বিক্রি করা হয়েছিল তার মালিক এক শিবসেনা নেতা। ভয়ে পুলিশ প্রথমদিকে নিকম্মা হাবভাব করছিল। পরে যাই হোক সাহায্যও করে।
কলনতাই বিশ্বাস করতেন না এই মেয়েরা জন্মই নিয়েছেন দুর্নীতিগ্রস্ত মন এবং যৌন অস্বাভাবিকতা নিয়ে। বরং অসহায়তা এবং শোষণের বিরুদ্ধতায় কিছু কার্যকরী আইন প্রণয়নের খসড়া তার মাথায় ছিল। আমাদের এই একাত্তুরে দেশেও কি সর্বনাশা আইনকানুন ! খদ্দেরকে ঘরে নিয়ে যাও, কিন্তু রাস্তায় ছলাকলা করো না, কপাটের আড়ালে তুমি পণ্য হতে পারো, কিন্তু ক্রেতার উইন্ডোশপিং নৈব নৈব চ। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। জোড়াসাঁকো অব্দি অপুষ্টিতে ভোগা মেয়েরা চড়া রঙ মেখে দাঁড়িয়ে থাকে, সম্ভাব্য কাস্টমারের সঙ্গে হাঁটার রেস লাগায়, হাঁটতে হাঁটতেই বোঝাতে থাকে কি ভাবে সে রঙিন করে দিতে পারে কালো রাত। পুলিশও টপাটপ গাড়িতে তোলে, রাস্তায় বাণিজ্য হচ্ছিল ! কৌটিল্য-কর চালু আছে, শুধু সব অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
এইখানে ডঃ স্মরজিৎ জানা আর দুর্বারের কৃতিত্ব। তারা অসাধারণ কাজ করে চলেছেন এই নারীদের জন্য। অনেক এগিয়ে যাওয়া, নাকি পিছিয়ে পড়া পৃথিবীতে তারা এই মেয়েদের শ্রমকে শ্রম বলে চিহ্নিত করেছেন, শোষণ থেকে বাঁচাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেন, চিকিৎসা করেন, অসাধারণ একটি পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশ হবার সঙ্গে সঙ্গে চলে এন্টি হিউম্যান ট্র্যাফিকিং কাজকম্ম, আর সামান্য সামাজিক মর্যাদা ফিরিয়ে দেবার কঠিন লড়াই। অন্য সবের বিস্তারিত কথা আবার হবে, কিন্তু টানা দু বছর প্রশাসন ও গরিষ্ঠ জনমতের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে এই সর্বজনীন পূজাপ্রাপ্তি।
কেন নয় তার কিছু ফিরিস্তি তো শুরুতেই দিয়েছি, তবে কোন পুলিশের পার্মানেন্ট টুপি পরা মাথা থেকে এইটে বেরিয়েছিল জানি না, বলে কিনা পাড়া ছেড়ে দিনমানে মন্ডপে পুজোর যোগাড় করতে দেখলে পাবলিক রাস্তায় ভিড় করে দাঁড়াবে আর ট্রাফিকজ্যাম লেগে যাবে। এতো হাসি পেল শুনে। অন্ধকারে চুপি চুপি রগড় নিতে গিয়ে কলকাত্তাইয়া পাবলিকের এই অবস্থা ! আলোয় দেখলে চিনতে পারে কিনা তাই বুঝতে একেবারে রথের মেলা লাগিয়ে দেবে!
তা দিক। দু বছর ধরে লড়াই করে আজ দুর্বার জয় ছিনিয়ে এনেছে। চাঁদার উৎপাত, মাইকের চিৎকার, উধাও পাবলিক ট্রান্সপোর্ট, অকথ্য ভিড় আর বেলেল্লাপনাকে যদি আনন্দ বলে ভাবতে হয় তো যে চাইবে তাকেই সে আনন্দের ভাগ দিতে হবে। সেবেলা শুচিবাই দেখালে চলবে না। ওরা অনুকম্পার তোয়াক্কা করেনা, স্বীকৃত সামাজিক আনন্দের ভাগ চায়, তাও নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী। না দিয়ে যাবে কোথায় !
তাই আজ চিকিৎসার খবর নিতে আসা মলিন শাড়ি মাঝবয়েসির কোলবসা চোখে স্বপ্নের ঝিলিক ফুটে ওঠা দেখলাম। বাজনা বাদ্যি নিয়ে কলাবৌ স্নানে যাচ্ছেন,কিশোর ভাইটি দিদির আগে আগে কাঁসর ঘন্টা বাজাচ্ছে আর লাফাচ্ছে। দিদি পেছন থেকে হাঁক দেয়,
-- ভাইটু, ঘাটের সিঁড়িতে সামলেএএএএএ...
হোক সে পাচার হবার আগে, এই পুজোয় নীলমণি মিত্র স্ট্রিট থেকে গঙ্গার দূরত্ব এক আঁজলা !