Mother’s Day. দিনটাকে ভোলার কোন উপায় নেই। সর্বত্র মাতৃত্বের জয়গান। আর মাতৃবন্দনা। আমার কিন্তু এই দিনটাতে মাকে মনে কম পড়ে। তার থেকে বেশি মনে পড়ে নিজের সন্তানটিকে। মাতৃত্বের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না প্রথম সন্তান-জন্মের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত। তবু সে এল। মেয়ে জন্মানর ঘণ্টাখানেক পরে যখন প্রথম কোলে দিল শিশুটিকে, আর আমার পরম ল্যাদখোর কন্যা একবার একটু অ্যাঁ করে মৃদু শব্দ করেই নির্ভয়ে চোখ বন্ধ করে আমার বুকে মাথা রাখলেন, একটা অনুভূতি এল মন ছেয়ে। এই শিশুটি তার আগামী কয়েক মাসের জীবন ধারণের জন্য পুরোপুরি আমার উপর নির্ভরশীল। একে দেখভাল করে টিকিয়ে রাখা আমার দায়িত্ব। এ আমার। এই ‘আমার’ বোধ থেকে জন্ম নিল ভালোবাসা। এই কি মাতৃত্ব?
বেশ মেতে উঠলাম শিশুপালন-পুতুলখেলা নিয়ে। অবশ্য মেয়াদ বেশি দিনের নয়। মোটে তো তিনমাস মাতৃত্ব ছুটি তখন। অফিসে যেতে হবে। এবার খোঁজ শুরু হল ধাত্রী-মার। এবং ভাবনাটা মাথায় এল তখনই। তাহলে এই যে শিশুটির খাওয়া-দাওয়া-ওষুধ-ভ্যাকসিনেশন বা মাঝরাতে কেঁদে উঠলে নিজের ঘুমের মায়া ত্যাগ করে তাকে দুলিয়ে দুলিয়ে ঘুম পাড়ান এগুলো দায়িত্ব হতে পারে, কিন্তু এর সঙ্গে সত্যিই কি মাতৃত্ব জড়িয়ে আছে? নাকি এই দায়িত্ব অন্য যে কেউ নিতে পারে?
পরবর্তী সময়ে প্রমাণিত হল, মা ছাড়াও অন্যরা এ দায়িত্ব বেশ নিতে পারে। কোলের শিশুটিকে নামিয়ে রেখে যখন দেশান্তরে যেতে হয়, তখনও মায়ের কোল ছেড়ে মাসির আদরে শিশুটি ভালোই থাকে। এরপরে স্কুলে ভরতির পালা। এদিক-ওদিক স্কুলে স্কুলে ঘুরে যে জ্ঞানটা পেলাম, সেটা হল মায়েরা চাকরী করলে সেই সন্তানেরা মানুষ হয় না। অতএব কোন কোন স্কুল চাকরী করা মায়েদের সন্তান ভর্তি করে না। কেউ বা ইন্টারভ্যুতে মায়ের ডিউটি-আওয়ারস শুনলে সেই যে চোখ মাথায় তোলে, শিশুটি দরজা দিয়ে বেরনর আগে আর সে চোখ নিচে নামে না। প্রশ্ন শুনলাম, how do you expect your daughter to grow up, if you do not give her time? উত্তরটা জানা ছিল। কারণ আমি নিজে চাকরী-করা মায়ের মেয়ে। যদিও সত্যির খাতিরে বলতেই হয় আমার মায়ের অফিসিয়াল ডিউটি আওয়ারস আমার থেকে অনেক কম ছিল, কিন্তু সাংসারিক কাজের ঘণ্টা যে মায়ের অন্তহীন ছিল! সে খবরে কারোর প্রয়োজন নেই। কিন্তু মোদ্দা কথা বুঝলাম, আমার মত ট্যাঁরা মা, যে সন্তানের স্কুলে ভর্তির মত মহান কাজের জন্য নিজের তুশ্চু চাকরী ছাড়তে রাজি না, সে রকম মা থাকাটাই স্কুলে ভর্তির জন্যে বিপদ।
সব বাধা বিঘ্ন কাটিয়ে শিশুটি স্কুলে ভর্তি হল। এই বার পড়াশুনার পর্ব। দেখা গেল, ইস্কুলে মজার নিয়ম। বাড়িতে বই-খাতা দেয় না। কার বেশি মজা হল শিশুটির না শিশুটির মার তা বোঝা গেল না। বাড়িতে পড়াশুনার পাট নেই। শিশুটি নিজের মনে খেলা করে, গল্পের বই পড়ে। ব্যস মায়ের যে সর্বসম্মত দায়িত্ব, হোমটাস্ক করান, তার থেকে মায়ের ছুটি। আর একটু বড় হতে দেখা গেল, মায়ের থেকে মেয়ে বেশি জানে। পুত্র ( পুত্রীও নিশ্চয় হিসেবে ধরা যাবে) –এর কাছে পরাজয় সব সময় কাম্য বলে আমি তাকে শেখানর দায়িয়্ব থেকে রিটায়ার করলাম। একটু চেষ্টা করেছিলাম তার extra-curricular activity র দায়িত্ব নিয়ে তার আত্মিক উন্নতি করানর। কিন্তু কাজের বেলায় দেখা গেল, কন্যার একটু বড় হয়েই আমার দুনিয়া থেকে সরে পড়ছেন। তার আর আমার জীবন-দর্শন অনেকটা রেল-লাইনের মতই - পুরো সমান্তরাল, কোথাও কোন বিন্দুতে মেলে না। সেটা যে আমার বিশেষ খারাপ লাগলো তাও না। কে বলেছে আমার মেয়েকে আমার মতোই হতে হবে? কিন্ত আসল কথা যেটা, মায়ের ছাঁচে সন্তান তৈরি করাটা যদি মাতৃত্বের অনুসঙ্গ হয়, তাহলে আমার জীবনে আমি সেও দেখি নি।
যাই হোক, শিশুটির স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে খাওয়া, নাচের স্কুল, গানের ক্লাস, রাত্তিরের ঘুম - সবই বেশ মায়ের অনুপস্থিতিতে চলতে থাকল। এবং সেজন্য মায়ের মনে বিন্দুমাত্র অপরাধবোধও হল না। সন্তানের হোমটাস্কের খবর রাখার থেকে নিজের নতুন কি কি শিখতে হবে সেটার খবর রাখাটা আমার কাছে জরুরী মনে হয় চিরকালই। এই সব দেখেশুনে শিশুটি কেমন নিজের মনেই দায়িত্বশীল হয়ে গেল।
শুধু একটা মাত্র জায়গায় আমি মা হিসেবে চোখ রেখেছিলাম। সেটা হল সন্তানের শৈশবটি abuse-free রাখতে। তবে এটাও ভাবি এটা তো বাড়ির যে কোন দায়িত্বশীল মানুষ-ই ভাবেন। তার জন্যে বিশেষ করে মা-কেই লাগবে কেন? আমি কি আমার পরিবাব্রের অন্য শিশুদের সম্বন্ধেও ঠিক একই রকম ভাবি না? তাহলে মাতৃত্ব অতিরিক্ত কি?
তাহলে বাবা বা মা’র সম্পর্ক পুরোটাই একটা সামাজিক- গঠন যাতে করে এক বা দু জন মানুষের উপর পুরো দায়িত্ব দিয়ে তাদের বলা যে তোমাদের জন্যে যে শিশুটির আজ জন্ম হল, তার ভাল-মন্দ সব কিছুর জন্য তোমরাই accountable? পিঠে খেলে পিঠের ফোঁড়ও গুনতে হবে, এটাই নিয়ম। এখানেই আমার সব গুলিয়ে যায়। দায়িত্ব বুঝি, “আমার বাড়ি”, “আমার গাড়ি” এদের মত “আমার সন্তান” এর মধ্যে যে অহংবোধ আছে তাও বুঝি, এবং সেই অহংবোধসঞ্জাত ভালবাসাও বুঝি, নিজের প্রোজেক্টটিকে তিল তিল করে সবার থেকে সেরা করে গড়ে তোলার মধ্যে যে প্রতিযোগিতা মুলক মনোভাব থাকে তাও বুঝি। যদি সফলতা আসে, তাহলে যে অসীম মানসিক তৃপ্তি পাওয়া যায়, সেটাও বুঝি। শুধু বুঝি না, এই যে আনন্দ, এতো আরও অনেক অন্য কাজেও মেলে। অন্তত যে সব কাজের সঙ্গে আমার নিজের মনের যোগ আছে, সেখানেই মেলে। তাহলে এই সর্বস্তরে গৌরবান্বিত মাতৃত্ব “আমিত্ব আর দায়িত্বের” বাইরে কি?
প্রশ্নটার উত্তর খুঁজছি সারা জীবন ধরে। অফিসেরর টয়লেটে যখন মেয়েরা জ্বলজ্বলে মুখে তার ক্ষুদে সন্তানটি কত দুষ্টু হয়েছে তার গল্প করে, তখন মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করি সেই দীপ্ত মুখের সঙ্গে ব্যাচেলার বন্ধুটির নতুন কেনা গাড়ির গল্প বলার মুখের কোন তফাত আছে কিনা। ক্যান্টিনে যখন মায়েরা সন্তানের পড়াশোনার সমস্যার আলোচনায় মগ্ন থাকেন, তখন দেখি, ওমা! এতো পুরো একটু আগের প্রোজেক্ট মিটিং-এর টুকরো ছবি।
ফিরে আসি ওই শিশুটির কথায়। আজ সে পুরো লেডি। মায়ের থেকে অনেক দূরে হোস্টেলে তার বাস। আঠারো বছর ধরে বাধ্যতামূলক একত্র বাসের পরে সে আমার নাড়িনক্ষত্র চেনে হাড়ে হাড়ে। জানে কিসে আমার আনন্দ, কিসে বেদনা। আমিও তারটা কিছুটা জানি বৈকি! তাই যে কোন ছোটবড় হর্ষে-বিষাদে এক তরফ থেকে অন্য তরফে ফোন যায়, শুনছিস / শুনছো ... মতামত বিনিময় হয়। এই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলা সখ্যতা, এই বুঝি মাতৃত্ব!