এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • একদিন এক চায়ের ঠেকে

    Somnath mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ২১ জানুয়ারি ২০২৫ | ২৭৫ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • একদিন এক চায়ের ঠেকে
    সোমনাথ মুখোপাধ্যায়

    রবিবার। আজ সাতসকালেই দোকান খুলেছে মণি। দোকান
    বলতে তেমন বিরাট কিছু নয়, সামান্য এক চায়ের দোকান। তবে একেবারে সদর রাস্তার ওপরে হ‌ওয়ায় বিক্রি বাট্টা নেহাত কম নয়। এখন আর বাপের আমলের মতো কয়লার উনুনের পাট নেই। কমার্শিয়াল সিলিন্ডারে চলা গ্যাসস্টোভে টগবগিয়ে জল গরম হচ্ছে প্রায় সমস্ত দিন।
    এ তল্লাটের ভোল বিলকুল বদলে গেছে এই কয়েক বছরের মধ্যে। হাতের নাগালে থাকা একতলা,দু তলা বাড়িগুলোর প্রায় সবকটাকেই একেবারে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে পরপর মাথা তুলেছে হাই- রাইজ বিল্ডিং। লোকজনের আনাগোনা অনেক বেড়েছে। বেড়েছে মণির চায়ের খদ্দের। এ তল্লাটের হোমরা চোমরা মাতব্বরদের অনেকেরই আনাগোনা তার ছোট্ট দোকানে। খদ্দেরদের আলোচনা থেকেই মণি গোটা দুনিয়াকে হাতের মুঠোয় দেখতে পায়। সে খালি শুনে যায়, টিপ্পনী করার মধ্যে যায়না।
    ঘড়িতে এখন মাত্র সোয়া সাতটা বাজে। দোকানের সামনে রাখা তিন তিনটে বেঞ্চ চা পায়ীদের ভিড়ে একেবারে জমজমাট। ভিড় দেখলে ভরে ওঠে মণির মন। স্বাভাবিক।
    – “মণি চা দে।আর সব গেল কোথায়?”- কিঙ্করের প্রশ্ন। কিঙ্কর
    সান্যাল এই অঞ্চলের বহুদিনের বাসিন্দা, পেশায় চার্টার্ড এ্যাকাউন্টেট । পেশাগত ওজনের সাথে জন্যই হয়তো কিঙ্করের চেহারার মধ্যে একটা ভারিক্কি ভাব আছে, সবাই বেশ সম্ভ্রম করে তাকে। গোটা এলাকায় একমাত্র তাদের বাড়িটাই ফেলে আসা সময়ের স্মৃতি হয়ে টিকে রয়েছে মাথা উঁচু রেখে । এইসব কথার মধ্যেই একদল চা বিস্কুটের পয়সা মিটিয়ে আসর ছেড়ে চলে যায়। অন্য আরেক দল এসে ভিড় করে। মণি বলে জোয়ার ভাটার খেলা।

    আজ মন্টাই চায়ের আসরে তার ছেলেকে নিয়ে এসেছে। মন্টাই এই অঞ্চলের উঠতি প্রোমোটার। ছেলে রনির বছর পাঁচেক বয়স। তাকে দেখে কিঙ্কর বলে ওঠে – “জ্যেঠু, বিস্কুট খাবে?” মণি একটা ক্রিম বিস্কুটের প্যাকেট এগিয়ে দেয়। ইতিমধ্যে পিন্টু,গাবু, শশাঙ্ক এসে যোগ দিয়েছে প্রভাতী চায়ের আড্ডায়। আড্ডা ছাড়া বাঙালি বাঁচে?
    – “তা, মন্টাই! ছেলেটাকে এবছর পাঠশালায় দিবিনা? কোথায় দিবি ঠিক করেছিস্ ?” কিঙ্করের প্রশ্ন।
    – “ও সব দাদা রিঙ্কু ঠিক করবে। আমি খালি পয়সা ঠেকিয়ে খালাস। রনি তো এখন পাড়ার একটা স্কুলে যায়। কি যেন নাম তোর স্কুলের বাবা ?” মন্টাই ছেলেকে জিজ্ঞেস করে।
    জোড়া বিস্কুটের ক্রিম চাটতে চাটতে রনি আধো গলায় বলে–
    “ড্যাডি, চাপ্পিঙ্ প্যারো ইংলিশ মিডিয়াম ইস্কুল।”

    কিঙ্কর উত্তর শুনে হেসে ফেলে, তারপর বলে– “ ওহ্ ! বুঝেছি। Chirping Sparrow English Medium School , মানে ও পাড়ার কালোমাণিক ঘোষের বাড়ির একতলায় যেটা নতুন হয়েছে?”
    গাবু উত্তর দেয় – “হ্যাঁ হ্যাঁ, ওটাই। কালো কাকার ছোট মেয়ে বুল্টি কোন্ এক স্কুল চেইনের ফ্র্যাঞ্চাইজি নিয়ে স্কুলটা খুলেছে। বুল্টিইতো ওখানকার প্রিন্সিপাল।”

    চায়ের গ্লাসে লম্বা চুমুক দিয়ে কিঙ্কর বলে – “তা, হঠাৎ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে কেন? তোমার বাড়ির কেউ কস্মিনকালেও ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে গেছে বলে তো আমার জানা নেই মন্টাই বাবু !”

    কিঙ্করের কথা বলার ভঙ্গিতে এমন একটা নাটকীয়তা ছিল যে ছোট্ট রনি পর্যন্ত ফিক্ করে করে হেসে ফেলে। একটু বিব্রত কন্ঠে মন্টাই বলে – “কি যে বলনা কিঙ্কর দা! এখন কেউ তোমার ওই বিদ্যাভারতী, চপলা স্মৃতি বিদ্যাপীঠের মতো ইস্কুলে ছেলেপিলেদের পড়তে পাঠায় নাকি? এইতো পিন্টু,গাবু ওদের জিজ্ঞাসা করো, সবাই এই এক কথাই বলবে। কিরে পিন্টু , গাবু! তোরা কিছু বল । বেফালতু সাতসকালে আমি কেস্ খাই কেন?”

    পিন্টু এবার নড়েচড়ে ওঠে। গলা বাগিয়ে বলে, – “কিঙ্করদা, এই কথাটা কিন্তু মন্টাই খুব ভুল বলে নি। লাখ চল্লিশের ফ্ল্যাটে থেকে,কেউ ছেলেমেয়েদের ওই সরকারি বা আধাসরকারি বেঙ্গলি মিডিয়াম স্কুলে পাঠায়? বুঝলে দাদা,এসব স্কুলের কেতাই আলাদা! অবশ্য তার জন্য খরচা আছে।”

    “এই তো ! রনির পেছনে এখন‌ই আমার হাজার দশেক টাকা মাস পিছু খরচা করতে হয়। তিন সেট্ ড্রেস । তার ওপর আজ
    ম্যাঙ্গো ডে , কাল ব্যানানা ডে । আর এর - ওর হ্যাপি বার্থডে তো লেগেই আছে। এযুগে বিণা খরচে ছেলেপুলে মানুষ হবে ভেবেছো?”-- মন্টাই উত্তর দেয়।

    কিছু না বললে আসর মিইয়ে যায়, তাই হাতে ধরা চায়ের গ্লাসে আলতো চুমুক দিতে দিতে গাবু বলে – “ এককালে সরকারি বা আধাসরকারি স্কুল গুলোতে পড়াশোনার পরিবেশটা ছিল, এখন নেই। ঐ সব স্কুলে পড়াশোনা কিচ্ছু হয়না। একটা সেন্ট্রাল সুপারভিশন না থাকলে চলে ? টিচার, স্টুডেন্ট কে কখন আসছে যাচ্ছে তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। ইনফ্রাস্ট্রাকচার সেই মান্ধাতা আমলের। পাবলিক স্কুলের ছেলেপুলেরা সব আন্ স্মার্ট। ওসব স্কুল এখন হাভাতে ঘরের ছেলেমেয়েদের আখড়া হয়ে গেছে। না না কিঙ্কর দা এই ব্যাপারটায় কিন্তু আমি তোমার সঙ্গে একমত হতে পারলাম না। Motai has taken the right decision.”

    শশাঙ্ক এতোক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে সবার কথা শুনছিল। কিঙ্কর তাঁকে বলে – “ কিরে! কিছু বলবিনা? যতদূর জানি,তোর ছেলে পাপাইতো বিদ্যাভারতী স্কুলেই পড়ছে। তার মানে একটা আধাসরকারি স্কুলে, যেখানে এখনও বাংলাতেই পঠনপাঠনের কাজ চলে। বোর্ড পরীক্ষায় এদের ফলাফল এখনোতো শুনেছি খুব ভালো। মাধ্যমিকে রেঙ্ক করে টরে! সেখানে পড়াশোনা হয়না?”

    শশাঙ্ক বুঝতে পারে যে এই মুহূর্তে তাঁর একটু কোণঠাসা অবস্থা। পাঁচ জনের মধ্যে তিনজন‌ই প্রাইভেট স্কুলের পক্ষে, অথচ তার‌ও কিছু বলার আছে। শশাঙ্ক শুরু করে একটু নরম সুরে – “এই যুগটা হলো প্রচারের যুগ। সেদিন সকালে বিছানায় শুয়ে শুয়ে খবরের কাগজটা খুলতেই ভেতর থেকে একটা বিজ্ঞাপনী কাগজ খসে পড়লো। হাতে তুলে নিয়ে দেখি এক নির্মিয়মান স্কুলের প্রচারপত্র। এখন থেকেই ঢাক পেটানো শুরু হয়ে গেছে। তা সেখানে যেসব সম্ভাব্য সুযোগ সুবিধার কথা বলা হয়েছে সেগুলো আদৌ ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দিতে কাজে লাগে বলে আমার জানা ছিল না। সেন্ট্রালি এ সি। আর খরচের যা বহর তা আমার মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে মেটানো সাধ্যাতীত। আমার মনে হয় একটা সমান্তরাল অপপ্রচারের জন্য আজ সরকার পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন দুয়ো রাণীর দশা।”

    “ শশাঙ্ক দা, বাবা মা হিসেবে আমাদের তো একটা রেসপনসিবিলিটি আছে নিজের ছেলেমেয়েদের ভালো শিক্ষার ব্যবস্থা করা, সেখানে খরচের বিষয়টা কখনোই বাধা হতে পারে না। আমাদের তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।এটাই বাস্তব।” পিন্টুর কথা থেকে বোঝা যায় যে সে আলোচনায় বেশ জমে গেছে।

    মণি বুঝতে পারে সবাই যখন আলোচনায় মশগুল তখন কারোরই আরেক প্রস্থ চা বিস্কুটে আপত্তি থাকবে না। সে একটু মজা করেই বলে – “বল এখন পেনাল্টি বক্সের ভেতরে।
    এমন অবস্থায় চা ছাড়া চলে? দেবো নাকি?”

    “দেবে, তবে আর একটু সময়ের পর। আমি আগে কয়েকটা কাজের কথা সেরে নিই। তুমি তৈরি থাকো।” – কিঙ্করের কথা বলার এমন ইঙ্গিত মণির খুব চেনা। সে অন্যান্য খদ্দেরদের সামলাতে থাকে কান দুটোকে বিলকুল খাড়া রেখে।

    “তোদের প্রত্যেকের কথায় যুক্তি আছে। এই সব যুক্তিকে আমি কখনোই নস্যাৎ করতে পারিনা। আর তাছাড়া দু’শো বছরের কাছাকাছি সময় যারা ইংরেজদের অধীনস্থ ছিল তাঁদের পক্ষে টম, ডিক, হ্যারি হয়ে ওঠার স্বপ্নে মজে থাকাটাই স্বাভাবিক । এখনও আমরা স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরেও সেই ভাবনাটাকে বুকে আগলে রেখেছি । দেখ্ আমি তোদের একটা গল্প বলি। কেননা যে বিষয়টি নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করছি তা কিন্তু মোটেই নতুন বিষয় নয়। কোন্ স্কুল বেশি ভালো, প্রাইভেট না পাবলিক তা নিয়ে আগেও বিতর্ক হয়েছে, এখনও হচ্ছে, আগামীদিনেও হয়তো হবে। অবশ্য আগামী দিনে ‘কোট- আনকোট’ হাভাতে ঘরের ছেলেমেয়েদের আখড়া সরকারি বা পাবলিক স্কুলের অস্তিত্ব থাকবে কিনা সেটা বড়ো প্রশ্ন। এই বিষয়ে আমিও যে আজকাল খুব ভাবি তা মোটেই নয়। আসলে সেদিন এক মাস্টারমশাই এসেছিলেন আমার অফিসে। আলাপের অবকাশে তিনিই আবার নতুন করে ভাবনাটাকে চাগিয়ে দিলেন বলতে পারিস্।”

    “তা যাই হোক,গল্পটা আগে শোন্। অবশ্য এটাকে তোরা গল্প বলে মানবি কিনা সেটা অন্য প্রশ্ন। তবে আমার মনে হয় এটা গল্প‌ই। এই রাস্তা ধরে খানিকটা এগিয়ে গেলে একটা বড়ো তেঁতুল গাছ ছিল মনে আছে?”-- শশাঙ্কের প্রশ্নে সকলেই ঘাড় নাড়ে। “হ্যাঁ, ঐ শরৎ ডাক্তারের চেম্বারে ঢোকার গলির ঠিক আগে।” চায়ের চিনি ঘট্ ঘট্ করে মেলাতে মেলাতে মণি উত্তর দেয়।

    “ঐ গাছের তলায় এক প্রবীণ দম্পতি খুব ভালো চপ বিক্রি করতেন মনে আছে? মাত্র এক টাকায় নানান ধরনের চপ- আলুর চপ, বেগুনি, পেঁয়াজি এইসব আর কি! দুপুরের টিফিনের সময় থেকে রাত আটটা অবধি চলতো বিক্রি বাট্টা। আশেপাশের বাড়ির লোকজন থেকে শুরু করে, দোকানের কর্মচারীরা, ঐ তল্লাটের যত রিক্সাওয়ালা, স্কুল ছুটির পর বাড়ির পথে পা বাড়ানো ছেলেমেয়েরা সকলেই ছিল বুড়িমার এক টাকার তেলেভাজার খদ্দের। কিন্তু চিরকাল তো আর সমান যায়না। বুড়িমার তেলেভাজার দোকানের‌ও অমন সুখ কপালে স‌ইলো না।”
    সকলে সমস্বরে চিৎকার করে উঠল – “কেন? বুড়িমার কী হলো?”

    “এখন‌ই তো গল্প শুরু। বুড়িমার তেলেভাজার দোকানের ঠিক উল্টো দিকে ছিল এক লালাজির মুদি দোকান। সে মনে মনে ভাবল এতো ভালো ম‌ওকা। বুড়িমার রমরমা দেখে সে তার মুদি দোকানের পাশেই একটা ঘর নিয়ে এক তেলেভাজার দোকান খুলে বসলো। তারপর ঘোষণা করলো সে তাঁর দাদাজির স্মৃতিতে বিণা পয়সায় সকলকে চপ খাওয়াবে। ব্যস্, লোকজন সবাই বুড়িমার দোকান ছেড়ে লালার দোকানে ভিড় করলো। বুড়িমা আর কি করে? লড়াইয়ে টিকে থাকতে না পেরে দোকান বন্ধ করে গাছতলা ছেড়ে চলে গেল নীরবে।কেউ তাঁর খোঁজ‌ও নিলনা।”
    বিস্কুটের ক্রিম চাটতে চাটতে রনি প্রশ্ন করে- “তাপ্পর কী হলো জেথু ?”

    “এদিকে লালাজি একদিন করলো কি ! তাঁর দোকানের সামনে এক ঢাউস সাইজের বোর্ডের মধ্যে লিখে দিল – আজ থেকে প্রতিটি চপের দাম ধার্য করা হলো ৫্ টাকা। লোকজন একটু গাইগুই করলো বটে , কিন্তু মেনেও নিল অনেকে। আরও কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার ঘোষণা করা হলো – আজ থেকে আরও ভালো চপের জন্য দাম ধার্য করা হলো ১০্ টাকা। এবার অনেকেই বেঁকে বসলো এভাবে দাম বাড়িয়ে দেবার জন্য। সবাই আবার ছুটলো বুড়িমার খোঁজে। কিন্তু কোথায় বুড়িমা ? তাঁর দোকানের আলো নিভে গেছে। এখন সবাই বাধ্য লালাজির দোকানের চপ খেতে।”

    কিঙ্করের গল্প শেষ হতেই মণি গরম চায়ের গ্লাস এগিয়ে দেয়। একটা আয়েসি চুমুক দিয়ে কিঙ্কর বলে - “কী বুঝলে ভাইসব?” শশাঙ্ক বেশ উত্তেজিত হয়ে বলে – “কিঙ্কর দা , এতো দারুন গল্প। আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তুর সঙ্গে একেবারে খাপে খাপে মিলে গেল। আসলে সরকার চাইছে না সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থাপনাটা টিকে থাকুক।আর তাই শিক্ষাভূমে আজ কর্পোরেট হাউজ আর বিজনেস হাউসগুলোর এমন উপস্থিতি। এতো বেশ রোমাঞ্চকর ব্যাপার!”

    “একদম তাই। সবকিছু বিক্রি করে দেবার নেশায় মশগুল হয়ে থাকা একটা প্রশাসনের এ হচ্ছে এক নতুন কীর্তি। এই দেখনা আমাদের ভাইপো রনিকে। হাতে একটা বিস্কুটের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়েছে মণি ও সব ভুলে কেমন একটার পর একটা বিস্কুটের জোড় খুলে ক্রিম চেটেপুটে খাচ্ছে। এদেশে প্রাইভেটাইজেশনের হাল ও তেমন। সমাজবিজ্ঞানীরা সবকিছুকে কুক্ষিগত করার এই আগ্রাসী কর্পোরেট প্রবণতার নাম দিয়েছেন Mcdonaldization ।”

    “ম্যাকডোনাল্ড তো শুনেছি ফাস্টফুড জাতীয় খাবার বিক্রির একটা আন্তর্জাতিক চেইন। তারসঙ্গে স্কুলের সম্পর্ক কী ?” মণি প্রশ্ন করে।
    কিঙ্কর হেসে বলে – “তুইও তো মানুষ হয়ে গেলি রে মণি! যাক্ আর চিন্তা নেই। আসলে কি জানিস,বড়ো বড়ো কর্পোরেট হাউজগুলো সব রাতারাতি বিদ্যা ব্যবসায় পুঁজি খাটাতে শুরু করেছে। যে কাজটা সরকারের করার কথা দেশের সমস্ত শিশুর জন্য আদর্শায়িত শিক্ষার ব্যবস্থা করা তা এখন এঁদের হাতে চলে যাবার মুখে। বেসরকারিকরণ করা হয় কয়েকটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে যেমন দক্ষতা, পরিষেবার প্রমিতকরণ, ব্র্যান্ডের প্রতি লোকজনের আস্থা অর্জন করা এবং পরিষেবায় ভোগবাদী দর্শনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা। একটা স্কুল বা উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন ভাবনার সঞ্চালন‌ই তথাকথিত ম্যাকডোনাল্ডাইজেশনের একমাত্র লক্ষ্য। সরকার এখন হাত গুটিয়ে নিতে ব্যস্ত। আর তারজন্য নিজেদের প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাপনাকে ক্রমাগত সমালোচনার মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এই যে খানিক আগে গাবু বলছিল সরকারি স্কুলগুলোতে একদম পড়াশোনা হয়না, সব ফাঁকিবাজিতে ভরে গেছে, এই কথার সত্যতা যাচাই না করেই আমরা তাকে মান্যতা দিয়েছি । একজনের মুখের কথা দশজনের কথা হয়ে গেলেই তাকে গুরুত্ব দেয়া শুরু হয়। আমরা আমাদের এতোদিনের চেনা ব্যবস্থাপনা থেকে একটু একটু করে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি । ফলে একদিন তা অন্ধকারে ডুবে যায়। বি এস এন এলের অবস্থাটা কি হলো দেখলিনা? অমন একটা লাভজনক সরকারি প্রতিষ্ঠান উঠে যায়! ফেলে আসা দেড় কি দু দশকের প্রবণতা লক্ষ কর , কি অবিশ্বাস্য গতিতে গজিয়ে উঠেছে স্কুল! সব ব্যক্তিগত মালিকানার বাণিজ্যিক দৃষ্টিতে পরিচালিত স্কুল। সরকারি হিসেবেই বলা হচ্ছে যে এইমুহুর্তে দেশের ৩৫% স্কুল প্রাইভেট নিয়ন্ত্রিত। এটা আগামীদিনে আরও বাড়বে।”

    পিন্টু বলে ওঠে – “আমাদের, মানে গার্ডিয়ানদের,কি অধিকার নেই ভালোভাবে ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দেবার?”

    “আছে,আলবৎ আছে। কিন্তু ভালোভাবে শিক্ষা দেওয়া মানেতো কলের যান্ত্রিক শিক্ষায় ছেলেমেয়েদের ঠেলে দেওয়া নয়। ধর মণি চায়ে চিনি কম দিয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা কী করবো? মণিকে আর একটু চিনি দিতে বলবো , না মণির দোকান ছেড়ে খুঁজতে বের হবো কোথায় চায়ে বেশি চিনি দেওয়া হয় ? সমাজের একটা দায়বদ্ধতার জায়গা আছে। আমরা কেউ এগিয়ে এসে আমাদের এতো দিনের চেনা প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশে দাঁড়াই নি। ফলে এগুলো সব শুকিয়ে যাচ্ছে। মহামারীর সময় দেখলি না প্রাইভেট স্কুলগুলোতে ফিস্ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে কেমন ক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠেছিল দিকে দিকে। ঘটি বাটি চাঁটি করে সব বড়ো বড়ো হাউজের স্কুলে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করবো, আর যেই স্ক্রু টাইট করবে অমনি গোঙাতে থাকবো। আমার মনে হয় এটা এক ধরনের ভণ্ডামি, দ্বিচারিতা। এইযে প্রমিতকরণের কথা বলছে তা কোন্ অবস্থার সাপেক্ষে ? সবাইকে এক‌ই ফর্মায় ফেলে মানুষ তৈরি করা সম্ভব? এটা শুধু ছাত্রছাত্রীদের নয়, দেশের পক্ষেও একটা বিপজ্জনক প্রবণতা।” কিঙ্করের গলায় উত্তেজনা ঝরে পড়ে।
    কথায় কথায় বেলা বাড়ে। ঘড়ির কাঁটা নয় ছুঁইছুঁই হতেই সবাই বাজারে যাবার জন্য উতলা হয়ে পড়েছে। না হলে হোম ফ্রন্টে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। একথা মালুম হতেই কিঙ্কর হাঁক পাড়ে – “মণি আমাদের কতো হলো?”

    মন্টাই মুখ কাচুমাচু করে বলে – “থাকনা কিঙ্করদা,ওটা আমিই আজকে দিচ্ছি।” সবাই বাজারের পথ ধরে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সাথী সেনগুপ্ত | 2405:201:801f:33:de7d:7500:e54a:***:*** | ২২ জানুয়ারি ২০২৫ ০৮:০৯540771
  • চমৎকার আলোচনা।
  • রাজীব দাশ | 202.142.***.*** | ২২ জানুয়ারি ২০২৫ ১১:৪৫540776
  • অনেকগল্প মন জমা থাকে এই চা দোকানে।...অনেক মানুষ চেনাজায় ।..দারুন লাগলো ।..বাস্তব এর একটা শুন্য স্থান EI বিজ্ঞাপন নির্ভর দুনিয়া 
  • পৌলমী | 2405:201:8000:b11b:dd53:7dc:d94d:***:*** | ২২ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:৫৭540777
  • এক প্রভাতী গল্প ভেবে লেখাটা পড়া শুরু করেছিলাম শেষ করলাম সম্পূর্ণ এক অন্যরকম অনুভূতি নিয়ে। চরিত্রগুলো সব খুব চেনা, আশেপাশে থাকা। বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলোর অন্তর্জলি যাত্রার আয়োজন আমরাই করেছি । নতুন স্কুল চেইন ব্যবস্থা প্রসারিত বাণিজ্যের‌ই অঙ্গ। খুব ভালো লাগলো লেখাটা।
  • রবীন্দ্রনাথ পাখিরা। | 103.17.***.*** | ২২ জানুয়ারি ২০২৫ ১৫:১৫540778
  • প্রত্যেক দিন‌ই এই চক্রান্ত ঘনীভূত হচ্ছে। দুনিয়াটা অল্প কয়েকটি মানুষের হাতে চলে যাবে। প্রতিরোধ কোথায়?
  • সৌমেন রায় | 202.142.***.*** | ২৩ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:৪২540784
  • একদম সত্য গল্প। সবচেয়ে ক্ষতি হবে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের। ধীরে ধীরে দুটি শ্রেণি গড়ে  উঠছে - প্রভু ও দাস! কারো হেলদোল নেই।
  • Kaushik Guha | 2401:4900:707a:fa84:21f4:6517:8004:***:*** | ২৫ জানুয়ারি ২০২৫ ০৯:১৫540799
  • Sotti i bhebe dekte hobe. Amrao to bangla medium wb board ei porechi. 
  • sourav sinha | ২৬ জানুয়ারি ২০২৫ ০৬:৩৫540809
  • ঠিক বলেছেন কিঙ্করদা ।
  • sourav sinha | ২৬ জানুয়ারি ২০২৫ ০৬:৪১540810
  • দশ টার মধ্যে নয় জন ভালো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, আইএএস অফিসার বেশিরভাগ  vernacular language এ পড়েছেন।
  • Somnath mukhopadhyay | ২৬ জানুয়ারি ২০২৫ ০৭:১৬540811
  • সাতসকালেই এমন প্রত্যয়ী মন্তব্য দেখে মনটা বেশ চনমনে হয়ে উঠলো। কিঙ্কর সান্যাল এখানে এক হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাস ও বোধের প্রতীক। সে ভাবেই তিনি নতুন করে আমাদের সচেতন করতে চেয়েছেন। কতটা সফল হয়েছেন, তার উত্তর অবশ্য সৌরভ বাবুর মতো পাঠকেরাই দিতে পারবেন। আমি সৌরভ বাবুর মতো আরো অনেকের মতামতের জন্য অপেক্ষা করবো।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন