ইয়ে চান্দ কা রোশন চেহরা
কাশ্মীর উপত্যকার মেয়েদের গাত্রবর্ণ এবং চেহারা নিয়ে আপামর ভারতবাসীর ফেটিশের প্রথম প্রকাশ কি ১৯৬৪ সালের ব্লকবাস্টার ফিল্মটি যার নামে এই প্রবন্ধের নাম ? নাকি তপ্তকাঞ্চন ত্বক ও আর্যসুলভ দেহবৈশিষ্টের প্রতি আকর্ষণের জন্য দায়ী হিন্দুকুশ পেরিয়ে উচ্চনাসা উন্নতমেধা আর্যদের কাল্পনিক অভিবাসন ( আধুনিক ইতিহাস ক্রমশই এই 'সত্য' যে নিছকই কল্পনাপ্রসূত সেই মতের স্বপক্ষে ঝুঁকে পড়ছে) এবং পরে তিনশ বছরের গোরা উপনিবেশ এবং নিষ্ঠুর শাসন ?
কারণ যাইই হোক না কেন, ফিরান এবং পুটস (phyran and poots) পরিহিতা চম্পা ওরফে শর্মিলা ঠাকুরের ডাললেকে নৌকাবিহার করতে করতে মূল ভূখন্ডের অধিবাসী রাজীব কাম শাম্মি কাপুরের সঙ্গে প্রেম করছেন এই দৃশ্য ভারতীয় পুরুষের চিত্তে যে গণ উন্মাদনার সৃষ্টি করেছিল তার তলানি এতোকাল পরেও কতো পুরু সরের মতো জমে আছে তা মালুম হলো ৩৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে নাড়াচাড়া হবার পর। দিনের পর দিন গুগল সার্চের একেবারে একনম্বরে রয়েছে কাশ্মিরী মেয়েরা। তাদের সৌন্দর্য এবং ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপ তাদের কতটা সহজলভ্য করে দিল তাই নিয়ে প্রবল চর্চা এবং রসিকতার জোয়ার ! বাঙালি, পাঞ্জাবী, মারাঠি, মদ্রদেশী কেউই এই ব্যাপারে পিছিয়ে নেই। টুইটারও রসের ভিয়েনের মতো টইটম্বুর। গোটা দেশ হামলে পড়েছে কাশ্মীরের জামাই হবে বলে। এই দেশে একমাত্র বিধর্মীপ্রধান ভূখণ্ডের মেয়েদের নিয়ে ঘেন্নাটেন্না কেটে গিয়ে এক চমৎকার শান্তিকল্যাণ মানসিকতা ! বিজেপি নেতারা অব্দি সভায় সভায় ক্যাডারদের উৎসাহ দিতে লাগলেন কাশ্মিরী মেয়েদের বিয়ে করতে। আরএসএস যেন হাতে গোময় গোচনা নিয়ে হাস্যমুখে সদাই প্রস্তুত। দোষ কাটিয়ে নিলেই হবে।
এই সোরগোলে মানুষ ভুলে গেল জিজ্ঞাসা করতে যাদের নিয়ে এই সোরগোল তারা কেমন আছে। এই হাসিঠাট্টায় যোগ দেওয়ার চটুলতা বা তাদের হাস্যকর করে তোলার জন্য চাপা রাগ ঘেন্না অবজ্ঞা, কী অনুভব করছে কাশ্মীরের মেয়েরা ? তাদের রুপোর কারুকাজ করা হেডগিয়ার, যার দেশজ নাম কাসাবা তার ঝলমলে ভাব কী অটুট, নাকি চোখের জলে তা মলিন সে খবরটুকু নেবার সৌজন্য আছে কি আমাদের ? ৩৭০ অনুচ্ছেদ বজায় রাখা অথবা খারিজ করা, কী এলো গেলো উপত্যকার নারীদের জীবনে? প্রবল নিপীড়ন এবং সন্ত্রাসের আবহে কেমন আছেন এই মেয়েরা ? ৩৫এ অনুচ্ছেদে কতোটুকু মিথ, কতোটুকু সত্যি ? নারীমুক্তির ধারণা কাশ্মীরে কোনরকম অর্থবহ কিনা? এসবের উত্তর খোঁজার দায় এড়িয়ে আমরা শুধু শিকারা-চালিত রোমান্সে ডুবে থাকতে চাই। নিজেরই একটি অঙ্গরাজ্যের মহিলাদের সম্বন্ধে এই মনোভাব শুধু লজ্জারই নয়, তিরস্কারের যোগ্যও। তবে তিরস্কারের মূল দায় যাদের ছিল সেই সরকার বাহাদুরই যখন সকল নাটের গুরু, এবং সরকার গঠনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা যে দলের তাদেরই মধ্যে যখন এ ব্যাপারে বাঁধভাঙা উচ্ছাস তখন এই প্রতিক্রিয়াই স্বাভাবিক।
দিওয়ানা হুয়া বাদল
কী এই ৩৭০ অনুচ্ছেদ যার বিলোপ ভারতীয় পুরুষের 'বক্ষমাঝে চিত্ত আত্মহারা' করে দিলো। এ নিয়ে এতো বহুল চর্চার পর বিশদে বলার আর কিছু নেই। সংক্ষেপে বলা যেতে পারে ভারতীয় সংবিধানে জম্মু কাশ্মীরের জন্য যে সমস্ত বিশেষ ব্যবস্থার অনুমোদন ছিল বিজেপি সরকার নাকি একজাতি একপ্রাণ একতা মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে সেসব খারিজ করে দিয়েছে। হোক না তা ভারতভুক্তির সময় অবশ্যপালনীয় রূপে মান্যতা পাওয়া চুক্তির অঙ্গ বা পরবর্তীতে সংবিধানের অপরিহার্য অংশ। এই দেশের অন্য বেশ কিছু রাজ্যও অন্যান্য বিশেষ ব্যবস্থাভোগী, তাদের গায়ে অবশ্য আঁচটি পড়েনি। কাশ্মিরীদের টাইট দেওয়া গেছে এই আনন্দে মত্ত মূল ভূখণ্ডের অধিকাংশ অধিবাসীরা বেশি আনন্দিত ৩৫এ অনুচ্ছেদের বিলুপ্তিতে। বিশেষ করে এই ধারা মোতাবেক জম্মু কাশ্মীরের পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট হবার ক্ষেত্রে যে সমস্ত বিধিনিষেধ ছিলো এখন থেকে তা আর রইল না। আগে নিয়ম ছিল কোন কাশ্মীর ললনাকে বিয়ে করলেও স্বামীটি পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট হতে পারবে না। পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট খেতাব না পেলে জমিজমাও কেনা যাবে না। এখন অর্ধেক রাজত্বসহ রাজকন্যা প্রাপ্তির হাতছানি। অন্যান্য রাজ্যের ক্ষেত্রে জমিজমা বা জামাই স্ট্যাটাস নিয়ে সাধারণ মানসে উদাসীনতার পেছনে বোধহয় ধর্মীয় গোঁড়ামি ছাড়াও কাজ করেছে আর একটি কারণ।
সাধারণভাবে সেসব রাজ্যের মহিলাকুল কাশ্মীরী কন্যার মতো অতো সুদর্শনা গৌরী নন।
তবে কি উপত্যকার মহিলাদের একমাত্র পরিচায়ক তার রূপ ? আভ্যন্তরীণ সমাজে এবং রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপটে তাদের অবস্থান, সমস্যা, ব্যথাবেদনা এসব নিয়ে আমরা ঐ যাকে বলে 'ব্লিস্ফুলি ইগনোরান্ট' বা সুন্দরভাবে অজ্ঞই রয়ে যাব ?
কাশ্মিরি মেয়েরা, যেমন এ দেশের অন্যান্য অঙ্গ রাজ্যের মেয়েরা, অনেক ব্যাপারে এগিয়ে রয়েছেন, আবার কোন ব্যাপারে একটু পিছিয়েই বা। 2011সালের সেন্সাসে কাশ্মীরে মেয়েদের শতকরা ৫৮.০১ জন সাক্ষর। সূচকে বিহার রাজস্থান আসাম মধ্যপ্রদেশের থেকে ওপরে এই অবস্থান, আবার অবশ্যই কেরালা মিজোরাম পশ্চিমবঙ্গ থেকে নীচে। চাইল্ড সেক্স রেশিও ৮৬২/১০০০। এডাল্ট সেক্স রেশিও ৮৯২/১০০০। হরিয়ানার থেকে দুটোতেই বহুগুণ এগিয়ে। NCRBর রিপোর্ট অনুযায়ী অপরাধের পরিসংখ্যানে জম্মু কাশ্মীর রয়েছে অনেক পেছনে। তার মাথার ওপরে দিল্লি হরিয়ানা রাজস্থান মধ্যপ্রদেশ মহারাষ্ট্র গুজরাত তো বটেই তামিলনাড়ু তেলেঙ্গানা এমনকি ঝাড়খন্ড পশ্চিমবঙ্গও রয়েছে। তাও এই হিসেব ১৯৮৯ থেকে লাগাতার সন্ত্রাসবাদ ও রাষ্ট্রিক নিপীড়নের বিপরীতে থেকে।
মেয়েদের বিরুদ্ধে অপরাধও উপত্যকায় তুলনায় কম। পণের জন্য যে নারীহনন তাতে সবচেয়ে পিছিয়ে কাশ্মীর উপত্যকা। সবচেয়ে এগিয়ে নিউ দিল্লি উত্তরপ্রদেশ বিহার। অনার কিলিং এর ম্যাপে গোবলয়ের রমরমা। জম্মু-কাশ্মীর সেখানে কোথাও নেই। কাশ্মিরি মেয়েকে ডাইনি অপবাদে পুড়ে মরতে হয়েছে এইরকম জানা নেই । এমনকি ১৫-১৯ বছুরে কিশোরীর মাতৃত্বের হার সারা দেশে ৭.৯ %হলেও উপত্যকায় তা মাত্র ২.৯% । শিশু অপুষ্টির হার সারা দেশে ৩৫.৮%,কাশ্মীরে ১৬.৬%। খুবই উল্লেখযোগ্য ব্যাপার যে সরকারি তথ্য অনুযায়ী পরিবার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার লক্ষে এই রাজ্য জাতীয় গড়ের থেকে এগিয়ে। জাতীয় গড় ৫৩.৫%, জম্মু-কাশ্মীর ৫৭.৩%।
তবে কাশ্মীর তো সত্যিই কোন ভূস্বর্গ নয়, যতই মনোহরা হোক তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। তাই বাকী ভারতের মতো এখানে ধর্ষণ, অপহরণ আছে, গার্হস্থ হিংসা আছে, মেয়েদের ওপর মৌলবাদীদের রক্তচক্ষু আছে। প্রথম দুটি আইটেমে সামরিক বাহিনীর অবদান আছে। কিন্তু যা নেই, যে ব্যাপক অত্যাচারগুলো কাশ্মিরী মেয়েকে সইতে হয়না সেগুলো তাকে দিতে পারবে তো তাকে বিবাহেচ্ছু এই পুরুষসিংহের দল ?
এ কথা তো অনস্বীকার্য যে, যে কোন পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় দুর্বিপাকে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হন মেয়েরা। সন্তান স্বজন পরিজনের নির্মম হেনস্থা অথবা নিধন, নিজেদের শরীরকে পিতৃতান্ত্রিকতার যুদ্ধক্ষেত্র রূপে ব্যবহৃত হতে দেখা, মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা সবই কাশ্মীর কন্যাদের সইতে হয়েছে, আজ অব্দি হচ্ছেও। ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপের পর বাইরের জগতের সঙ্গে পুরোপুরি বিচ্ছিন্নতা তাদের জীবন আরো কঠিন করে তুলেছে। দূর দেশে পাঠরত বা চাকুরিজীবী স্বামী সন্তানের খবর নেই। ঘরের বাইরে বেরোলে নানা লাঞ্জনা এমনকি ধর্ষণের ভয়। কোন সাধারণ রমণীর ঘরে তিনমাসের সাংসারিক যোগান মজুত থাকে? বৃদ্ধ বৃদ্ধা কেউ ঘরে থাকলে সামরিক বাহিনীর অত্যাচারের ভয়ে পুরুষশূন্য এলাকায় মেয়েরাই একমাত্র ভরসা। নিজে গর্ভবতী হলে নিরাপদ প্রসবের কোন আশা নেই। গ্রামীণ কাশ্মীরে অবরোধের ফলে হেলথ সার্ভিস ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। নিজের কাজকর্ম শিকেয় তুলে নাবালক সন্তানের স্কুল লাগাতার বন্ধ থাকায় তার পরিচর্যার ভারও কাশ্মিরি মেয়ের কাঁধে। সন্তান যাতে পেলেট গানের শিকার না হয় সেই দুশ্চিন্তা, কিশোরী কন্যার ওপর নেমে আসা আসন্ন বিপদ, এইসব প্রবল সামাজিক চাপ এবং নিরাপত্তাহীনতা উপত্যকার মহিলাদেরকে শারীরিক মানসিকভাবে অসুস্থ করে তুলছে।
অথচ ৩৭০ অনুচ্ছেদ, বিশেষ করে ৩৫এ অনুচ্ছেদ বিলোপের কারণ হিসেবে নাটের গুরুরা উল্লেখ করছে কাশ্মীরের মেয়েদের সমানাধিকার, নারী মুক্তির আশু ব্যবস্থা। এ এক অদ্ভূত আইরণি। যাদের নিমিত্তে ব্যবস্থা তারাই যদি বৃহত্তর গাড্ডায় পড়েন তাহলে কুমীর গুরুমশাই ও ছাত্র শেয়ালছানার গল্প মনে পড়ে যায় না ?
এখন দেখা যাক সত্যি সত্যি এই বদান্যতা এ হেন দুর্জনে সাজে কিনা।
৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলুপ্তকারীরা এই কাজের প্রত্যক্ষ সুফল বলে যা যা দাবী করছেন নারীমুক্তি ছাড়াও তার সংখ্যা অনেক। কিন্তু আসল ব্যাপার হল এই যে তার মধ্যে অনেকগুলিই কাশ্মীরের মানুষ এযাবতকাল ভোগ করে এসেছেন। করণ থাপার অধ্যাপক মুস্তাফার যে ইন্টারভিউ নিয়েছেন তা থেকে দু একটি উদাহরণ ব্যাপারটিকে প্রাঞ্জল করবে।
শিক্ষামন্ত্রী বলে বসলেন ৩৭০ অনুচ্ছেদ উত্তর সময়ে কাশ্মিরীরা রাইট টু এডুকেশন ভোগ করতে পারবেন। ঘটনা হলো যে রাইট টু এডুকেশন ভারতরাষ্ট্র সংবিধানভুক্ত করেছে অনেক পরে। উল্টোদিকে প্রায় অন্তর্ভুক্তির সময় থেকেই কাশ্মীরে শিক্ষার অধিকার বলবৎ রয়েছে। সেটাও একেবারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা অব্দি, আমাদের মতো চোদ্দ বছর পর্যন্ত নয় কেবল।
সেকুলার এবং সোশালিস্ট শব্দের ব্যবহার কাশ্মীরি সংবিধানে শুরু হয় অনেক আগে, একেবারে গোড়া থেকেই। ভারতীয় সংবিধানে শব্দদুটির অন্তর্ভুক্তি হয় অনেক পরে।
ঠিক তেমনই মেয়েদের ভালো হবে বলে যা যা বলা হচ্ছে তাদের পুরো তাৎপর্য এখনই বোঝা যাচ্ছে না। যেমন তিন তালাক বিল। এটির কারণে কাশ্মিরী মহিলার বৈবাহিক জীবনে একেবারে বিপ্লব ঘটে যাবে তা এখনই নিশ্চয় ক'রে বলা মুশকিল। আসলে ২০০৭ সালের আগে কাশ্মীরে শরিয়তি আইন চালু ছিল না। শ্রী প্রতাপ জম্মু এন্ড কাশ্মীর লজ কনসোলিডেশন এক্ট অনুযায়ী উপত্যকার বিচারব্যবস্থা চালানো হতো। সেখানে পরিষ্কার বলা আছে যদি কোনো ক্ষেত্রে চালু বিচারধারা ও প্রচলিত রীতিনীতি বা প্রথার মধ্যে বিরোধ উপস্থিত হয় তাহলে প্রাধান্য পাবে দ্বিতীয়টি অর্থাৎ সামাজিক রীতি। এই কারণে ২০০৭ সালের পরও শরিয়তি আইন উপত্যকার মুসলমানদের একমাত্র মান্য ছিল না, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিলো আবহমানকাল ধরে প্রয়োগ হয়ে আসা রীতি বা প্রথা(custom)। ফলে মৌখিক তিন তালাকের ব্যবস্থা(যদিও কোরানসম্মত পূর্ণাঙ্গ তালাক ব্যবস্থা এখনও দেশে বলবৎ আছে) কাশ্মিরীদের কাছে এতোদিন কতটা গ্রাহ্য ছিল সে সম্বন্ধে পূর্ণাঙ্গ তথ্য না পাওয়া অব্দি নারীমুক্তির ঢাক বাজিয়ে লাভ নেই।
শরিয়তি আইন যে কাশ্মিরীরা সবসময় মেনে চলতো না তার আরো একটি প্রমাণ দেওয়া যেতে পারে। এই আইনে সম্পত্তি ভাগের ক্ষেত্রে বিবাহিত অবিবাহিত কন্যার মধ্যে কোন ফারাক করা হয় না। কাশ্মিরীরা এই তফাতে অভ্যস্ত। দফতরেখানানাশিন হলো বিবাহিত কন্যা। আর দফতরেখানাবিরুণ অবিবাহিতা। প্রথমজন যদি বাবার সঙ্গে বসবাস করে সে পুত্রের সমান অংশ পাবে। তার স্বামী কিন্তু কিছু পাবে না। এটি কাশ্মিরী প্রথা। দত্তক নেওয়া শরিয়তে নিষিদ্ধ। কাশ্মিরী প্রথায় মান্য। মুসলিম বিবাহে দেশের কোথাও রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক নয়। কাশ্মীরে এতোদিন তা বাধ্যতামূলক ছিল। এখন কী হবে জানা নেই।
আর একটি মিথকে খুব তোল্লাই দিচ্ছে ৩৫এ অনুচ্ছেদের বিলুপ্তি। তা হলো, কোন কাশ্মিরি মহিলা যদি অকাশ্মিরি পুরুষকে বিয়ে করেন তাহলে সন্তানসমেত তিনি পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবেন। আসল ব্যাপারটি হলো ঐ অকাশ্মিরি পুরুষটি কোন ভাবেই স্ত্রীর পৈত্রিক সম্পত্তির ভাগ পাবেন না। স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীটি কিন্তু বাবার সম্পত্তির অংশীদার হতে পারবেন। নারীমুক্তির পথে এই আইন যদি বিরাট কাঁটাই হবে, তাহলে প্রথা অনুযায়ী নারীটির অধিকার অক্ষুণ্ন রইল কিভাবে ? আসলে একা নারীকে আমরা পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গণ্য করিনা। ল্যান্ডাবাচ্চা, স্বামী সমেত ভোগ না করলে সে অধিকার যেন অধিকারই নয়। কিন্তু ভূ-সামাজিক পরিবর্তন আটকাবার জন্য এই ব্যবস্থা দেশের আরো কয়েকটি স্পর্শকাতর রাজ্যে এখনো বলবৎ আছে। সেগুলিতে নারীমুক্তির কী হবে ? বরং নিছক চুক্তি ও বিশ্বাসভঙ্গের গা-জোয়ারিকে নারীর নির্বাণলাভের দ্যোতক বলে চালানোর চেষ্টা তো না করাই ভালো মনে হয়। এমনিতেই, দ্যাখ শালাদের কেমন টাইট দিলাম ব্যাপারটাই তো লোকে এন্তার খেয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে আর অন্য মশলার দরকার আছে কি ?
কভি না কভি কিসিসে না কিসিসে দিল লাগানা পড়েগা।
এতোক্ষণ পাঠক নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন এই প্রবন্ধের সব ক'টি সাব টাইটেল কাশ্মীর কি কলি সিনেমায় ব্যবহৃত গানগুলির প্রথম লাইন। তবে এই লাইনটি একটু বিশেষ। কারণ ঐ 'লাগানা পড়েগা' কথাটায় একটা গায়ের জোরের আভাস আছে। বিনা অনুমতিতে দিল লাগানা অর্থাৎ প্রেম শুরু করবার সজোর ঘোষণা আছে। এটাই পিতৃতন্ত্রের সাধারণ মনোভাব নারীর প্রতি। সে নারী যদি হয় দেশের একমাত্র মুসলমান প্রধান ভূখন্ডের অর্থাৎ বিধর্মী এবং সুন্দরী তাহলে এই সবল ঘোষণা অন্যতর অর্থ পরিগ্রহণ করে। বলপ্রয়োগকে জায়েজ ঘোষণা করে। যেমন হয়েছিল কুনান পোশপোরা গ্রামে।
কী ঘটেছিলো সেই রাতে কুপওয়ারা জেলার এই জনবিরল গ্রামদুটিতে ? অভিযোগ করা হয়েছে, কাছাকাছি কোথাও সন্ত্রাসীরা গুলি চালালে রাতের বেলা রাজপুতানা রেজিমেন্টের সামরিক উর্দিধারীরা তল্লাসির নামে ঘিরে ফেলে গোটা গ্রাম। সাধারণ আবালবৃদ্ধবনিতাকে ঘেরাও করে রেখে চালানো হয় নির্বিচার ধর্ষণ। বৃদ্ধা থেকে বালিকা প্রায় একশ কাশ্মিরী নারী এই লালসার শিকার হয়। পরবর্তীতে মেয়েরা স্বাভাবিক ট্যাবু ঝেড়ে বার বার অভিযোগ করা সত্ত্বেও সৈন্যবাহিনীর অস্বীকার করাকেই চূড়ান্ত বলে মেনে নেওয়া হয় এবং এই অভিযোগকে পাকিস্তানি ষড়যন্ত্র তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয়।
তবে সেই কালো রাতকে ভোলেনি যমজ গ্রাম কুনান পোশপোরা। ২৪ বছর পরে ঐ রাত ভোর হবার পর যারা বড় হয়ে উঠেছে এমন নির্যাতিত ৫ জন নারীর নিরন্তর চেষ্টা ও সাহসের ফলে লিপিবদ্ধ হয়েছে সেই অমানবিক অপমানের কাহিনী। বার বার নিজেদের নির্যাতনের পুঙখানুপুঙখ বিবরণ তারা দিয়ে গেছেন বৃহত্তর স্বার্থে । বই হয়ে বেরিয়েছে গোটা ঘটনা। ডু ইউ রিমেম্বার কুনান পোশপোরা এখন বিশ্বখ্যাত এক তথ্যভিত্তিক গ্রন্থের নাম। ১৯৯১ সালেই মহানুভব ভারত সরকার মামলা ডিসমিস করে দিলেও ৫০ জন নির্যাতিতার পি এল আইয়ের ভিত্তিতে ২০১৩ সালে কুপওয়ারার এক জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট পুনর্বার তদন্তের আদেশ দেন। সেই কেস হাইকোর্টে যায় এবং প্রত্যেক নির্যাতিতাকে দু লক্ষ টাকা ক'রে ক্ষতিপূরণ দেবার কথা বলা হয়। রাজ্য সরকার এবং আর্মি সুপ্রিম কোর্ট থেকে স্টে অর্ডার নিয়ে আসে। এটি ২০১৬ সালের ঘটনা। তারপর তিন বছর ধরে কেসটি সুপ্রিম কোর্টের রেজেস্ট্রিতে পড়ে রয়েছে, কিন্তু হিয়ারিংয়ের জন্য লিস্টেড হয়নি।
ভারতীয় আইন ও বিচারব্যবস্থা কাশ্মীরী জনগণকে চিরকালই হতাশ করেছে। তার মধ্যেই কাশ্মীরী মহিলাদের এই বীরত্বপূর্ণ কাহিনী তাদের লড়াকু মানসিকতার দ্যোতক।
টুইটার ফেসবুক গরম করা বিবাহেচ্ছুদের তাই একটি বহুস্তরীয় সতর্কবার্তা -- খাবি কী রে পাগলা, ঝাঁজে মরে যাবি তো !
সবার শেষে ভাবি একটি কাল্পনিক বিবাহসম্বন্ধ চলছে। পাত্র ধরা যাক গুজরাতি, কন্যা কাশ্মীরী। কথাবার্তা কিছুদূর না এগোতেই দুপক্ষেরই হাতে এলো মানবোন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। সেটিকে মাঝখানে রেখে দুপক্ষেরই চোখ ছানাবড়া --
গুজরাত | জম্মু-কাশ্মীর | |
৬৯ | আয়ুকাল(সম্ভাব্য) | ৭৪ |
৪৪ | শিশুমৃত্যু( হাজারপ্রতি) | ৩৮ |
৫০% | সম্পূর্ণ শিশু টিকাকরণ | ৭৫ % |
৭৫ % |
১৫-১৯ বছরের মেয়েদের স্কুলে যাবার হার |
৮৭% |
২৭ % | নারীদের অপুষ্টির হার | ১২% |
১১৬ টাকা | গ্রামীণ মজুরি | ২০৯ টাকা |
( তথ্যসূত্র - ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে- ৪)
৪২০০০ বা তারও বেশি খুন হওয়া মানুষের রক্তনদী কাশ্মীর উপত্যকায় না বইয়ে দিলে, ছলেবলে কৌশলে মতলব হাসিল না করলে এই বিবাহসম্বন্ধ কোনো পরিণতির দিকে যাবে বলে সাধারণ বুদ্ধির কারো মনে হয় ?
অলমিতিবিস্তরেণ।