বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ নারীকে দুইটা ঘরে দেখে অভ্যস্ত। শোয়ার ঘর আর রান্না ঘর। নারী পুরুষ নির্বিশেষে মোটামুটি এই নীতিতে অটল বলা চলে। এর বাহিরে নারীকে যেখানেই দেখা যাক তাকে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, পদে পদে প্রমাণ করে যেতে হয় সে ওই স্থানের জন্য উপযুক্ত। বাংলাদেশ বললাম কিন্তু আসলে পুরো পৃথিবী জুড়েই খুব একটা ব্যতিক্রম দেখা যায় না। উন্নতির শিখরে যারা তারাও কতটুকু মূল্যায়ন করে নারীকে? কিন্তু তাদের হিসেব পরে,ভারতীয় উপমহাদেশের হিসেবে নারীর অবস্থা যে বর্তমান আধুনিক সময়েও করুণ, তা বোধ করি সকলেই কমবেশি জানি। বাংলাদেশ দীর্ঘ দিন ধরে নারী দ্বারা শাসিত হয়ে আসছে। দেশের প্রধান দুই নেত্রী নারী। কিন্তু এতেও নারীর অবস্থানের খুব একটা পার্থক্য তৈরি হয়নি। কিন্তু নারীর অবস্থানের যে একেবারেই পার্থক্য হয়নি তাও ঠিক বলা যায় না। যতটুকু হয়েছে তা নারীর অদম্য আগ্রহে, অবিশ্বাস্য রকমের সংগ্রামের মনোভাবের কারণে। চাকরি ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ সহ সকল ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৮ সালের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বৈশ্বিক প্রতিবেদনে নারী-পুরুষের সমতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্যের স্বীকৃতি মিলেছে। ১৪৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৮তম। এটি দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে। বাংলাদেশের পরে রয়েছে শ্রীলঙ্কা, এর অবস্থান ১০০তম। নেপাল ১০৫, ভারত ১০৮, মালদ্বীপ ১১৩, ভুটান ১২২ ও পাকিস্তান ১৪৮তম অবস্থান পেয়েছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের তুলনায় রীতিমত ঈর্ষনীয় সাফল্য বলা চলে একে। অন্যদিকে খেলাধুলায়ও নারী নিয়ে এসেছে বেশ কিছু দুর্দান্ত সাফল্য। তো, নারীর এই অগ্রগতির পথে নতুন এক মাইল ফলক যোগ হল এই কিছুদিন আগে। মিরোনা খাতুন নামে এক উজ্জ্বল মশালের দেখা পেয়েছে বাংলাদেশ। পুরুষদের পেশাদার ফুটবল দলের প্রধান কোচের দায়িত্ব পেয়েছেন মিরোনা খাতুন। বহির্বিশ্বে এমন নজির দেখা গেলেও ভারতীয় উপমহাদেশে এই দৃষ্টান্ত এটাই প্রথম।বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন লিগে ঢাকা সিটি এএফসি ক্লাবের প্রধান কোচ হিসেবে নিয়োগ পেয়ে দেশের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে গেছেন মিরোনা। কোন প্রকার দয়া বা কারো করুণায় এই দায়িত্ব পাননি মিরোনা। এএফসি বি লাইসেন্স প্রাপ্ত কোচ তিনি।কোচিংয়ের যাবতীয় শর্ত মেনেই মিরোনাকে দেওয়া হয়েছে ঢাকা সিটির দায়িত্ব। নিজে ছিলেন দীর্ঘদিন জাতীয় দলের খেলোয়াড়।জাতীয় দল থেকে অবসর নিয়ে নৌ বাহিনীতে এথলেট হিসেবে খেলেছেন কিছুদিন। তারপরেই করেন এএফসি বি লাইসেন্সের কোর্স। ফলাফল পেশাদার গোটা একটা ফুটবল দলের প্রধান কোচ এখন তিনি। মিরোনার অবশ্য এখানেই থেমে যাওয়ার ইচ্ছা নাই, এ লাইসেন্স কোর্স সম্পন্ন করার ইচ্ছাও তার আছে। কিন্তু আপাতত যে ইতিহাস তৈরি করলেন তার তুলনা সম্ভবত অন্য কিছুই আর হয় না। মিরোনার নাম বললে আরেকজনের নামও বলা দরকার এখানে। ডালিয়া আক্তার। যিনি গত বছর ঢাকা জেলা পুরুষ হ্যান্ডবল দলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পান। গত বছর জাতীয় হ্যান্ডবল লীগে ঢাকা তার অধীনে পঞ্চম হয়েছে।। প্রথম মিশনে বেশ ভাল সাফল্যই বলা চলে একে। মিরোনার মতই কোচিং কোর্স সম্পন্ন করে আরও বড় দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত ডালিয়া আক্তার। ফুটবল-ক্রিকেট-হ্যান্ডবল খেলেছেন ডালিয়া আক্তার, জাতীয় মহিলা হ্যান্ডবল দলের অধিনায়ক তিনি।ছিলেন নারী ফুটবল দলের অধিনায়ক। চোটের কারনে ফুটবল ছেড়ে দিলেও আছেন হ্যান্ডবল নিয়েই। খেলার পাশাপাশি কোচিং নিয়ে স্বপ্ন দেখেন তিনি। কোচ মানে শিক্ষক। শিক্ষক নারী না পুরুষ তা আসলে বিবেচ্য হওয়া উচিত না। কিন্তু আমাদের এখানে হয়। তাই এত দিনে মিরোনা পেশাদার ফুটবল দলের কোচ হয়ে ইতিহাস করে। কোচদের যা কাজ তা একজন নারীর না পারার কোন কারো নাই। ইউরোপ আমেরিকায় হরহামেশা দেখা যায় এমন নজির। তাঁরা আর যাই করুক কাজ কে কাজ হিসেবে মেনে নিতে জানে। মিরোনার সামনে প্রথম বড় চ্যালেঞ্জ দলের সাফল্য না, তার দলের পুরুষ সদস্যরা তাকে মেনে নিয়ে, তাকে শিক্ষক মেনে, গুরু মেনে তার অধীনে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে প্রশিক্ষণ করাটাই প্রথম বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীকে ওই অবস্থানে মেনে নেওয়াটাই প্রধান কঠিন কাজ। একজন নারীর পুরুষদের পেশাদার ফুটবল দলের প্রধান কোচ হওয়া কে ইতিহাস বলা হচ্ছে। মিরোনাকে ইতিহাস সৃষ্টিকারী হিসেবে বলা হচ্ছে সব জায়গায়। একটুও কিন্তু বাড়িয়ে বলা হচ্ছে না। যে দেশে প্রাপ্তবয়স্ক নারীকে একা বাড়ির বাইরে যেতে হলে সদ্য ফিডার ছাড়া ছেলে কে সাথে দেওয়া হয় একজন ছেলে মানুষ সঙ্গে থাকা দরকার যুক্তিতে, যেখানে কিছুদিন আগেও রাস্তায় মিছিল হয়েছে নারীদের খেলাধুলা করা বন্ধ করতে হবে, হারাম বলে দেওয়া হয়েছে, যেখানে নারীর খেলোয়াড়দের মা বাবাকে প্রতিনিয়ত শুনতে হয় - “এরা কী মরবে না? জাহান্নামের ভয় কী এদের নাই?” যেখানে নারীরা চরম বৈষম্যের শিকার হয় পদে পদে, যেখানে ছেলেদের ম্যাচ ফির তুলনায় মেয়েদের ম্যাচ ফির কথা উল্লেখ্য করতেও লজ্জা হয়, যেখানে একই খেলা খেলে ছেলেদের মাসিক বেতন আর মেয়েদের মাসিক বেতনের তুলনা আকাশ আর পাতাল বললেও কম বলা হয়, সেই দেশে মিরোনা খাতুনের এই অর্জন কে ইতিহাস বলা ছাড়া অন্য কিছু বললে কম বলা হবে। মিরোনার এই অর্জন এক কথায় নতুন এক মাইলফলক। সময় সম্ভবত সমাগত। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের সময় এসে গেছে। নারী তায় আবার বাঙ্গালী নারী বলে যে অবহেলার শিকার নারী যুগের পর যুগ হয়ে এসেছে তা পরিবর্তনের সময় এসে গেছে। পুরুষ দলের আগে নারী ক্রিকেট দল প্রথম কোন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট জিতে ইতিমধ্যে দেশের ইতিহাসে পুরুষের আগে অবস্থান নিয়ে নিয়েছে। ক্রিকেটে পুরুষকেই বরং এখন প্রমাণ করতে হবে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট জিতে। নারীরা এখন পুরুষের দল সামলাচ্ছে। দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কর্মক্ষেত্রের সকল মাধ্যমে। এখন সম্ভবত সময় হয়েছে নারীকে নারীর প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়ার। নারী শুধু মাংস না, নারী শুধু নির্দিষ্ট কাজের জন্য না, নারী শুধু সন্তান পালনের জন্য না, রান্নাবান্না করে জীবন পার করে দেওয়ার জন্য বরং নারীর বিচরণ হবে সকল স্তরে, সকল ক্ষেত্রে। মিরোনার দৃষ্টান্ত হাজার হাজার মিরোনা তৈরির পথ কর দিবে এমন আশা এখন করাই যায়। আশা করাই যায় এখন নারীর আদেশ মেনে নিয়ে ফুটবল মাঠ হোক বা যুদ্ধক্ষেত্র, পুরুষ ঝাঁপিয়ে পড়বে নির্দ্বিধায়। আশা করাই যায় শুধু নারী বলে মিরোনা বা ডালিয়াকে কোনদিন অবহেলার শিকার হতে হবে না আর। তাদের যোগ্যতা যেন নারী না পুরুষ এই মাপকাঠিতে মাপা না হয় কোন দিন। কামনা করি মিরোনা খাতুন বা ডালিয়া আক্তাররা বাংলাদেশের মাটিতে সম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে, স্বপ্ন দেখিয়ে যাবে আগামী প্রজন্ম কে।