আমরা কারো সুখ বুঝাতে, আনন্দ বুঝাতে বলি রঙ লাগছে তোমার? রঙ কে খুশি হিসেবে আনন্দ হিসেবে ধরে নেই আমরা।ঈদ অর্থ আনন্দ আর এই আনন্দও কেউ আমরা রঙের মত করে ব্যবহার করি। আমরা বছরের যে কোন সময় কারো খুব আনন্দ দেখলে বলে উঠি, কী, ঈদ লাগছে? ঈদ আসে আর আমাদের এখানে ঈদ লাগে। ঈদ মনে লাগে, মননে লাগে, শরীরে লাগে, চোখে লাগে, মুখে লাগে।
গত বছর গুরু থেকেই ঈদের ছবি চেয়েছিল।ঈদ সংক্রান্ত আমার একটা লেখার সাথে গুরুর সাইটে দেওয়ার জন্য। আমি এমন ধারার বিপদে আগে কখনও পড়িনি। ঈদের ছবি কিভাবে দিব? ঈদ প্রধান উৎসব বাংলাদেশের, সারা দেশ ছয় সাত দিন ধরে ঈদ উৎযাপন করছে কিন্তু ঈদের ছবি কিভাবে দেই? ঈদের নামাজের ছবি? (আমি শেষে ঈদের নামাজের ছবিই পাঠিয়ে ছিলাম), ঈদের নামাজকে ঈদ বলতে আমি রাজি না কোনমতেই। নামাজ ঈদের প্রধান একটা অংশ কিন্তু শুধু ঈদের নামাজই ঈদ না। তাহলে কী? মানুষজন ঘুরে বেড়াচ্ছে? নতুন জামা পরছে? সরকারি ভবন গুলোতে রঙ্গিন বাতি লাগাচ্ছে? ঈদ আসার আগে বিপণি বিতান গুলোতে আলোকসজ্জা করছে তা কী ঈদ হিসেবে পরিচিত করা যাবে? কোনটাই তো মনে হয় না অথচ ঈদ আমার এবং আমাদের সমস্ত অস্তিত্ব জুড়েই লাগে। হিন্দু মুসলমান সবাই এক সাথে ঈদ উৎযাপন করে এখানে। কিন্তু আসলে করে কী? পূজার রঙটা দেখা যায়, পূজা মণ্ডপ ঘুরলেই পূজা বুঝা যায়, পূজাটা দেখা যায়। ঈদ দেখা যায় না, পুরোটাই মনের ভিতরের ব্যাপার। একারণেই আমাদের আনন্দ যেমন লাগে তেমনই ঈদ লাগে।
ঈদের পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে আমার কাছে সেরা লাগে হচ্ছে ঈদের বাড়ি ফেরা। ঈদের দুই একদিন আগে কেউ যদি মফস্বল কোন শহরের বাসস্ট্যান্ডের দিকে খেয়াল করে তাহলে দেখতে পাবে ঘরে ফেরা কিছু মানুষের মুখ। এই মুখ গুলো ভ্রমণের ধকলে ক্লান্ত। সাথে কয়েকটা ব্যাগ, আণ্ডা বাচ্চা নিয়ে বিধ্বস্ত একেকজন। বাস থেকে নেমে রিক্সা নিলো হয়ত, ব্যাগ নিয়ে গুছিয়ে রিক্সায় বসার পরে রিক্সা ছেড়ে দেওয়ার অল্প কিছুক্ষণ পরে এই যাত্রীদের যে চেহারা হয় তা আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য। ক্লান্ত কিন্তু কী একটা আলাদা আনন্দ, আলাদা সুখানুভূতি খেলা করে যায় একেকজনের চেহারায়। হয়ত ঢাকায় থেকে পড়াশোনা করে কোন তরুণী, একটা ব্যাগ নিয়ে রিক্সায় ক্লান্ত চেহারা নিয়ে যখন বাড়ির দিকে যেতে থাকে তখন তার মনের অনুভূতি ব্যাখ্যা করে এমন কেউ কী আছে? বাড়ির কাছাকাছি আসতেই পরিচিত মুখেরা খোঁজ খবর নিতে শুরু করে ডাক দিয়ে। ক্লান্ত একেকজন একটুও বিরক্ত না হয়ে জবাব দিয়ে যায়। আহা! বাড়ি ফেরার মত আর কী আছে সুখের?
তাই আমরা বাড়ি ফিরি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফিরি। তিনগুণ চার গুণ বাড়তি ভাড়া দিয়ে বাড়ি ফিরি। ট্রেনের ছাদে করে বাড়ি ফিরি। লঞ্চের ছাদে করে ফিরি।আচ্ছা, বাড়ি ফেরাকেই ঈদ বললে কী খুব ভুল বলা হবে? সম্ভবত না। অন্য কোন দেশে এমন করে কেউ উৎসব উৎযাপন করে কিনা আমার জানা নেই। সবার জন্য যানবাহনের সুষ্ঠ ব্যবস্থা এখনো আমার দেশ করে উঠতে পারেনি। যা আছে তা দিয়ে সারা বছর চলে যায় কিন্তু একসাথে হুট করে সবাই বাড়ি মুখী হলে হয় বিপদ। শুরু হয় অদ্ভুত উদ্ভট উপায়ে বাড়ি ফেরা। কেউ বাসের ছাদে, কেউ ট্রেনের ছাদে, দাঁড়িয়ে, সিট না পেয়ে মোড়ায় বসে তিন গুণ চার গুণ বেশি ভাড়া দিয়ে ছুটে চলে বাড়ির দিকে। ঢাকা শহর কেন্দ্রিক সমস্ত কিছু হওয়াতে সকলেই থাকে রাজধানীতে, আর ঈদের ছুটিতে ছুটে ঢাকার বাইরে।
বাড়ি ফেরার সাথে সাথেই আছে আবার ফিরে যাওয়ার টান। এই টানে প্রেম নাই, এই টান জীবনের তাগিদে। মানুষ আবার ফিরে যার যার কর্মস্থলে। ফেরার সময়টায় আবহ সঙ্গীতের ব্যবস্থা যদি প্রকৃতিতে থাকত তাহলে সর্বক্ষণ করুন সুরে তা বেজে যেত। মানুষ শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায় না, এ বোধহয় মানুষের জিনের ভিতরেই আছে। চেনা পরিবেশ, চেনা রাস্তা, চেনা মুখগুলো ফেলে শুধু মাত্র জীবনের তাগিদে চলে যাওয়া এ বড় নির্মম। কিন্তু তবুও মানুষ আসে এবং আবার ছুটে যায়। তিনশ টাকার ভাড়া হাজার টাকা দিচ্ছে শুধু প্রিয় মানুষদের সাথে ঈদ করবে বলে। ঈদের আনুষ্ঠানিকতা যেহেতু ঈদের দিন সকালে ঈদের নামাজের মাধ্যমেই শেষ হয়ে যায়, তাই এরপর যা থাকে তা হচ্ছে ওই প্রিয় মুখ গুলোর সাথে সময় কাটান। খাবার, আড্ডা, ঘুম আবার খাবার আবার আড্ডা আবার ঘুম! ঈদের ছুটির বৃহৎ অংশ কেটে যায় এমন করেই।তারপর আবার সেই বাড়তি ভাড়া গুনে ফিরে যাওয়া।
রোজার ঈদের অন্য আরেকটা বড় অবদান হচ্ছে ঈদুল ফিতরে সামর্থ্যবান সকলকে ফিতরা দিতে হয়। সরকার থেকে আগেই জানায় দেওয়া হয় এ বছর কত করে ফিতরা। যারা সামর্থ্যবান তাদের সকলেই তা ঈদের নামাজের আগে গরিবদের মাঝে বিলিয়ে শেষ করতে হয়। এটা যাকাত না, এটা অল্প কিছু টাকা যা মাথা পিছু প্রতিজনকে দিতে হবে। যেমন এবার সর্বনিম্ন ফিতরা ধরা হয়েছে ৭০ টাকা। মুসলমান সকলকে এই ফিতরা আদায় করতে হবে যদি আপনি ফিতরা নেওয়ার মত না হোন। এই টাকাটা খুব খুব উপকারে লাগে গরীবদের। বাড়ির ফিতরা একজন কে দিয়ে দিলে সে বেশ কিছু টাকা পায় যা একজন অভাবগ্রস্তের জন্য খুব উপকারী। ইদানীং অনেক গুলো সংগঠন ফিতরার টাকা যোগার করে গরীব অভাবগ্রস্তদের জন্য তাদের প্রত্যাশার চেয়ে ভাল কিছু করে দিচ্ছে। যা আমার কাছে ঈদের যে কোন আনন্দের চেয়ে বেশি কিছু মনে হয়। ঈদ উপলক্ষে যদি গরীব দুখীরা একটু স্বস্তি পায়, যদি এর জন্য তাদের পাতে একটু ভাল খাবার জোটে তাহলে এরচেয়ে ভাল আর কী হতে পারে?
কোথাও যদি কোন একজন অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিও এই ঈদে দুই মুঠো ভাল খাবার খেতে না পারে, যদি এই ঈদেও কেউ আধপেটা হয়ে থাকে তাহলে বুঝতে হবে আমাদের ঈদ পালন সঠিক ভাবে হয়নি, আমরা নিজেদের জন্যই শুধু মেতে ছিলাম। মনে প্রাণে আশা করি হয়ত কোথাও কেউই এবার অভুক্ত অবস্থায় ঈদের দিন পার করেনি। প্রত্যন্ত অঞ্চলে, দুঃস্থ কোন ভূমিহীন কৃষকের কিংবা আরও করুণ অবস্থার কেউ, যার একেবারেই কিছু নেই সেও এই ঈদে ভাতের সাথে মাংস আর একটু সেমাই খেয়ে ঈদ পার করেছে এমন আমি আশা করি না, এমন আমি বিশ্বাস করি।
সবাই কে ঈদের শুভেচ্ছা। ঈদ মুবারক।