এই পোড়া সময়ে ঈদও এসে গেল। এদিকে আজকে মৃত্যুর সংখ্যাও লাফ দিয়েছে বাংলাদেশ। আজকে রিপোর্ট বলছে গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছে ২৮ জন! মোট মারা গেছে প্রায় ৫০০ জন। এমন সময় ঈদের দিন আসলে আমার কী করা উচিত তা আমি বুঝে উঠতে পারছি না। আমি কী বরাবরের মত সকালে উঠেই গোসল করব? ঈদগাহে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হব? সেমাই, পায়েস খেয়ে, বাড়ির সবাইকে নিয়ে, আশেপাশের লোকজনকে ডাকাডাকি করে রউনা হব ঈদগাহে? কিন্তু ঈদগাহে তো নামাজই হবে না! মসজিদে নামাজ পড়তে বলছে প্রশাসন থেকে। মসজিদেই যাওয়া কী নিরাপদ এখন? ঈদের আগের রাতে আমাকে ভাবতে হচ্ছে মসজিদে যাওয়া নিরাপদ কিনা! আমি চিন্তা করছি ঈদের নামাজ তো ওয়াজিব, ফরজ না, না গেলে কী হবে? এমন কোনদিন ভাবিনি, আজ ভাবতে হচ্ছে, এরচেয়ে বড় দুঃসংবাদ কী হতে পারে?
প্রতিবার ঈদের আগে জমজমাট ঈদের বাজার বসে। কাপড় ব্যবসায়ীরা বলে তারা সারা বছরের বিক্রি করে দুই ঈদে। বাকি সময় শুধু কোনমতে চলে যায়। সেই ঈদ বাজার নিস্তব্দ। বাজার খুলে দেওয়া হয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম গ্রাম থেকে মানুষ হুমড়ি খেয়ে কাপড় কিনেছে। যারা একটু সচেতন তারা কেউই যায়নি। কিন্তু যখন টিভিতে আড়ঙের শো রুমে উপচে পড়া ভিড় দেখি তখন আবার দিশা পাই না। এরা অসচেতন? নির্বোধ না মানুষই না? জানা নাই উত্তর। আমি আমার পরিবারের কথা জানি। আমার কাছাকাছি আছে ৬/৭ বছরের ভাইস্তা, ভাগ্নে, কেউই জিদ করেনি নতুন কাপড়ের জন্য। ওরা হয়ত আমাদের দেখেই কিছু বুঝতে পেরেছে, যার কারনে নতুন কাপড়ের জন্য আবদার করেনি। আমার শহরেই দুইটা লক্ষ্মী ভাগ্নি আছে। প্রতিবার রোজায় কয়েক রোজা যাওয়ার পর ওদের বাসায় যাওয়া মাত্র ওদের নতুন কাপড়ের বাহার দেখতে হত আমার। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। এই দুই ঢঙ্গি একের পর এক নতুন কাপড় দেখাত আর বলত এই কয়টাই ওদের জামা, ওদের আসলে কোন জামা নাই, এই জন্য এবার একটু বেশী কেনা হয়েছে! আমি মেনে নিতাম। আমি ওদের মাঝে ঈদের নতুন মানে খুঁজে পেতাম। নতুন অর্থ খুঁজে পেতাম। আমার ভাল লাগত। আমাকে আশ্চর্য করে এরা দুই বোন এবার ঈদে কোন নতুন জামা নিবে না বলে দিল! ওরা দুই বোন ঈদে নতুন জামা নিবে না এই কথা ওদের মুখ থেকে না শুনলে হয়ত আমার জীবনেও বিশ্বাস হত না। কিন্তু আমি শুনলাম এবং বিশ্বাস করলাম। খুব আশ্চর্য হয়েও মনে হল এ কেমন ঈদ এসে হাজির হল? এমন হবে কেন? বাচ্চারা যদি ঈদের আনন্দ না করে তাহলে ঈদের আর থাকল কী? ঈদ এলে তো আর আকাশে ঈদ লেখা ভেসে উঠে না। এই বাচ্চারা যখন নতুন কাপড় পরে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায় তখন ঈদ লাগে, ধুপ করে সালাম করে সালামি চায় তখন ঈদ হয়, প্রতি বাড়িতেই খাওয়া দিবে, অত খাওয়া অসম্ভব জেনেও ওরা প্রতি বাড়িতেই যাবে এবং আর খেতে পারব না বলেও খাবে, খেয়ে বের হয়েই আর খাওয়া যাবে না, এখন যেখানে যাব সেখানে কিচ্ছু খাব না, শুধু দেখে করেই চলে আসব! বলতে বলতে যে বাড়িতে যায় সেখানেও যখন খাওয়া হাজির হয় তখন ওদের করুণ এসে ঈদ এসে হাজির হয়। ঘণ্টা হিসেবে রিকশা ভাড়া করে পুরো শহর চক্কর দেওয়াতেই ঈদ। এখন এরা যদি চুপ করে বাসায় বসে থাকে তাহলে একে কীভাবে ঈদ বলি? ঈদগাহে যাওয়া হবে না, কোলাকুলি করব না একে অপরের সাথে! আর শাওয়াল মাসের চাঁদ উঠেছে বলে আমাকে বলতে হবে ঈদ এসে গেছে!
কিন্তু আমাদের মানে আমাদের বাড়ির জন্য এতটুকুতেই থেমে থাকেনি দুঃসময়। বাচ্চারা ঈদের নতুন কাপড় পেল না বা ঈদের দিন ঘুরে বেড়াতে পারল না ধরনের সৌখিন চিন্তা মাটি হয়ে গেল এরপরের সংবাদে। আমার খালা করোনা পজেটিভ হয়ে গেলেন! ঠিক ঈদের একদিন আগে রিপোর্ট পাওয়া গেল। যা এত দিন ছিল দূর দূরান্তের খবর, তা একদিন আমাদের দেশের খবর হল, আমরা ভাবলাম আমাদের তো কিছু না! আমাদের জেলায় এলো, আমাদের পাড়ায় রোগী পাওয়া গেল, আমরা নিশ্চিত আমাদের কিছু হবে না! কই থেকে পেলাম সাহস? এখন বুঝি, এগুলাকে সাহস বলে না, বলে বোকামি, বোকার স্বর্গে ছিলাম আমরা। এখন দেখি আমাদেরও হতে পারে! বজ্রাহত হলাম শুনে যে আমার খালা করোনা পজেটিভ! ডাক্তার নার্সরা আসলে করোনায় আক্রান্ত হয় না, সরকারের টাকা পাওয়ার জন্য ওরা করোনা রোগী সেজে বসে থাকে, এই তত্ত্ব দুইদিন আগে আমরাই বিলি বণ্টন করেছি। এখন এই খবর তেতো ওষুধের মত গিলতে হচ্ছে আমাদের! কারন আমার খালা পেশায় নার্স। সিনিয়র নার্স। লিবিয়ায় চাকরি করে এসেছেন। কীভাবে দুর্যোগকালীন সময়ে জীবন নিয়ে লিবিয়া থেকে ফিরেছেন সেই গল্প আমরা শুনছি উনার মুখ থেকে। এখন আমরা অধীর হয়ে অপেক্ষা করছি এই দুঃস্বপ্নের গল্প শোনার জন্য, সুস্থ হয়ে একদিন আমাদেরকে উনার আরেক সাহসী গল্প বলবে আমাদের আর আমরা শুনব।
ক্রীতদাসের হাসিতে শওকত উসমান লিখেছেন হাসি হচ্ছে মানুষের আত্মার প্রতিধ্বনি। তিনি বলেছেন হাসি আসার জন্য নানান উপাদান লাগে। একটা উপাদান না থাকলে হাসি আসে না মানুষের। সব আছে, নিরাপত্তা নেই, হাসি আসবে না। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে বাগদাদের খলিফা হারুন অর রসিদ থাকলে দেখতে পেতেন আমরা জাহান্নামের আগুনে বসিয়া পুষ্পের হাসি দেওয়া শিখে গেছি। আমরা অতি দ্রুত অভিযোজিত হয়ে গেছি এই পরিস্থিতির সাথে। আমরা শুধু নিজে বাঁচছি না, জীবন দিয়ে অন্যকে বাঁচাতে এগিয়ে যাচ্ছি। ভয়কে উড়িয়ে দিয়ে মানুষের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে মানুষ। দুর্যোগকালীন সময়ে মানুষের চরিত্রের আসল রূপ বের হয়ে আসে। করোনা আমাদেরকে অনেক চোর বদমাশকে যেমন চিনিয়ে দিয়েছে, তেমনি মানুষের মাঝে ঈশ্বরের রূপ দেখানোর সৌভাগ্যও করে দিয়েছে। মানুষ কত অল্পে তুষ্ট হয় আর বেঁচে থাকতে কত অল্প লাগে আমরা তা এখন জানি। আমরা এতদিন যা জটিল করে তুলেছিলাম তা যে খুব সহজেই করা সম্ভব তা শিখে গেছি আমরা।
একদিন আমাদের এই শিক্ষা সফর শেষ হবে। আমরা নতুন করে নতুন ভাবে ঈদ পালন করব। আমাদের এই শিক্ষা আজীবন আমরা বহন করে চলব। এখন যেমন একে অপরে পাশে এসে দাঁড়াচ্ছি, অন্যের বিপদকে নিজের বিপদ বলে মনে করছি, সব স্বাভাবিক হয়ে গেলেও যেন আমাদের এই শিক্ষা থাকে। শিক্ষা থাকুক মাস্ক চলে যাক, হাত মেলানোর অধিকার ফেরত আসুক, ঈদের দিন প্রাণ খুলে আনন্দ করার পরিবেশ ফিরে আসুক আসুক। আমরা চাই ছোট্ট খুকির মাথায় হাত বুলাতে, চাই না হাত বুলিয়েই হাত জীবাণুনাশক দিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে। আমি চাই ঈদের দিন আমার ভাগ্নিরা খুব করে ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা পাক, কোন উৎকট ভাইরাস যেন ওদের জন্য বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। আমি ওদের দিকে তাকালেই ঈদ দেখতে চাই। মামা, আজকে কত যে মজা করলাম বলে ওদের সারা দিনের ঘুরে বেড়ানোর ফিরিস্তি শুনতে চাই। আমি এবারে মত পচা ঈদ চাই না আর।
হুমম,
এমন পচা ঈদ আর চাই না।