ছোটবেলায় হঠাৎ মাথায় প্রশ্ন আসছিল সব প্রতিমার মুখ দক্ষিণমুখী হয় কেন? সমবয়সী যাকে জিজ্ঞাস করেছিলাম সে উত্তর দিয়েছিল এটা নিয়ম, তোদের যেমন নামাজ পড়তে হয় পশ্চিমমুখী হয়ে এটাও তেমন। ওর জ্ঞান বিতরেণ শেষ হলো না, বলল খ্রিস্টানরা প্রার্থনা করে পুবমুখী হয়ে আর বৌদ্ধরা উত্তর। আমি মেনে গেছিলাম। ভাবছিলাম ঠিকই তো আছে, চার ধর্ম চারটা দিক। ছোটবেলাটা ভাল ছিল, আমার পশ্চিম দিক পেয়ে আমি খুশি ছিলাম আর অন্যরাও যে ঠিকঠিক একটা দিক পেয়ে গেছে তা ভেবেও স্বস্তি পেয়েছিলাম। বড় হলাম আর শিখলাম সব দিকই আমার, অন্যের জন্য কোন ছাড় নেই। আর সব ভুয়া আমরাই শুধু সঠিক। জানলাম দুর্গা পূজার সময় আমি যে আনন্দে মেতে উঠতাম তা না জায়েজ, বিলকুল হারাম। আমরা সাচ্চা মুসলমান হয়ে উঠলাম দিনে দিনে।
তবে ছোটবেলাটা আমাদের আসলেই রঙ্গিন ছিল। সপ্তাহখানেক স্কুল ছুটি তো আনন্দ বড়িয়ে দিতই। সঙ্গে ছিল মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে ঘুরে বেরানোর মজা। সারা শহর যেন মেলা বসে যেত পূজার সময়। ডুগডুগি টাইপ একটা গাড়ি পাওয়া যেত মেলায়। ডগ ডগ করে শব্দ হত গাড়ি টানলে।দুর্গা পূজার সাথে এই শব্দটাও কেমন যেন মিশে গেছে মনের মাঝে। দুর্গা পূজা গেছে আর আমরা এই গাড়ি কিনি নাই এমন মনে হয় হয় নাই কোন বার। আর চিনির হাতি ঘোড়া পাওয়া যেত পূজার মেলায়। আমরা বলতাম এগুলাকে সাজ। এই সাজ কেনা হত অনেক গুলো, তারপর সকাল বিকাল ফিনিশ করা শুধু। ঝলমলে আলোক সজ্জা আমাদের ছোট মাথা ঘুরিয়ে দিত। কয়টা দিন আমাদের কেটে যেত স্বপ্নের মত। না, সেই সময় কেউ আমাদের বলে নাই এই শিরকি কাজ করা যাবে না। কেউ নিষেধ করেনি আমাদের পূজার আনন্দে মেতে উঠতে। আমার যে বোন এখন তার দুই বাচ্চা নিয়ে প্রতিটা মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে সে একদিন আমাদের নিয়েও ঘুরত। তখন আমাদের কে কেউ এই অপরাধে অপরাধী করেনি কিন্তু এখন করে। সমাজে আর যাই হোক, ধর্মীয় শিক্ষকের তো আর অভাব নেই!! অভাব তো শুধু মানুষের।
কোন পূজা মণ্ডপ কেমন, কাদের জৌলুস বেশি, কারা শুধু টাকাই খরচ করেছে শুধু কিন্তু সাজ সজ্জা ভাল হয়নি, কাদেরটা দারুণ হয়েছে, এই ধরনের মূল্যায়ন আমরা এই সেদিনও করতাম।পূজা শেষে জেলা পূজা উদযাপন পরিষদ থেকে ঘোষণাও করা হত কাদের মন্ডপ সব চেয়ে সুন্দর হয়েছে। আমরা মিলিয়ে নিতাম আমাদের হিসেবের সাথে। মিললে মিলল না মিললে বোঝার চেষ্টা করতাম কেন ওদের দিল, পার্থক্য কী ছিল। এই ঘোষণা আজও দেয়া হয়। বাংলাদেশের পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন পূজার শুরুতেও একটা ঘোষণা দেয়া হয়। আর এটা দেয় প্রশাসন থেকে। বলে দেওয়া হয় অমুক মণ্ডপ ঝুঁকি পূর্ণ, মণ্ডপের দায়িত্বে যারা আছে তাদেরকে ক'রে দেওয়া হয় সতর্ক।যাদের মণ্ডপ এই তালিকায় পড়ে যায় তাদের পূজা আর জমে উঠে না। সর্বক্ষণ উৎকণ্ঠা, একটু চ্যাঁচামেচি হলেও কলিজা কেঁপে উঠে তাদের আর প্রতিবার পুলিশি তল্লাশিতে মুখ থুবড়ে পরে আমার তৈরি বিশ্বাস নামক সেতু। কড়া পুলিশি তৎপরতায় কোথায় জানি হারিয়ে যায় চির চেনা সৌন্দর্য, আবহমান বাংলা আর বাংলার ঐতিহ্য।
আমাদের ছোট শহর। তাই প্রায় প্রতিটা পূজা কমিটিতে আমাদের বন্ধু বান্ধব, চেনা জানা মুখ। বন্ধুদের দেখি কী দারুণ ব্যস্ত একেক জন। সবাই কিছু না কিছু দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়ে ঘুরছে। আগে কাছের বন্ধুদের সাথে মিশে যেতাম আমরা। খুব কাছের বন্ধুদের যে মন্ডব সেটা হয়ে যেত আমার মণ্ডপ। ব্যস্ততার জন্য এখন আগের মত মণ্ডপে যাওয়া হয় না। গত বছর যখন সময় পেয়ে গেলাম আমার বন্ধু আমাকে দেখে খুশিতে ডগমগ হয়ে গেলো আর তারপরই বলল ওর না বলা কথা, ও বলল তুই আইছস, অথচ দেখ পূজা শেষ হয়ে যাইতাছে একটা পুলাপান আইলো না!! কারা আসে নাই আমি জানি, ওকেও নাম বলে বলতে হলো না। বুঝলাম দেশ এগিয়ে গেছে বহুদূর, খাদে পড়তে আর দেরি নাই।
দুর্গা পূজা দোরগোড়ায়। একটা উৎসব যে আসছে তা বোঝা যায় দুর্গা পূজার আগে আগে।উৎসবের যে আলাদা রঙ আছে তা দেখা যায় দুর্গা পূজায়। দারুণ রঙে সেজে উঠছে চারপাশ। কত কত বাতি লাগানো হচ্ছে। হাত লাগচ্ছে ছেলে বুড়ো। কেউ নিশ্চিন্তে বসে জ্ঞান ঝাড়ছে। কেউ সেই জ্ঞান গিলছে। চোখে চোখে ঠুকা ঠুকি হচ্ছে।নানান পরিকল্পনা তৈরি হচ্ছে পূজা ঘিরে। কাজের লোকরা কাজ করে যাচ্ছে ধর্ম কে হিসেবে না নিয়েই।যেমন ধরুন মঞ্জু ভাই। ডেকারেশনের কাজ করেন তিনি। এই মঞ্জু ভাইয়ের কাজ ছাড়া পূজা মণ্ডপ যেন তৈরিই হয় না। সবাই চায় মঞ্জু ভাই ওদের মণ্ডপে কাজ করুক। আর মঞ্জু ভাইয়ও হয়েছে একটা মানুষ, আটটা দশটা মণ্ডপের কাজ নিয়ে পূজার কয়টা দিন পাগলের মত ঘুরে। আমি একবার জিজ্ঞাস করেছিলাম, খুব কামাচ্ছেন? উনি হাসি দিয়ে বললেন, আরে নাহ, টাকার জন্য না, ধর্মীয় কাজে টাকার হিসাব করলে চলে!! পরে খোঁজ নিয়ে দেখলাম, আসলেই তাই। যে মঞ্জু ভাই কে বিয়ের প্রোগ্রামের জন্য দেন দরবার করে পেতে হয় আমাদের সবার, সেই মঞ্জু ভাই অনায়াসে সকলের সাথেই আছে, টাকা পয়সাও যে যত যখন পারছে দিচ্ছে। মঞ্জু ভাইদের জন্যই এখনো দেশ নিয়ে আশা করতে পারি। খাদ থেকে হয়ত বেঁচেও যেতে পারি আমরা।