রাজনীতির খোলা ময়দান, ইন্টারনেটের খোলা রাজনৈতিক সিনেমা। এই নিয়ে আমরা একটি সিরিজ প্রকাশ করছি। খোলা ইন্টারনেটের রাজনৈতিক সিনেমাগুলি কী? কেমন হচ্ছে তারা? এই লেখাটি 'ডিগিং আদানি' বিষয়ক। সিনেমাটি 'ফোর কর্নার্স' নির্মিত। সিনেমার নাম থেকেই তার বিষয়বস্তু পরিষ্কার। এবং এবিসির ওয়েবসাইটের বক্তব্য অনুযায়ী, ছবিটি বানানোর সময়, তথ্য সংগ্রহের সময়, পুলিশ ফোর কর্নার্সের দলকে ঘন্টার পর ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদ করে, ক্যামেরা বন্ধ করে দেয়, ফুটেজ মুছে দেয়। কী ছিল এই সিনেমায়? সিনেমার লিংকঃ https://www.abc.net.au/4corners/digging-into-adani/9008500
সিনেমা যে একটি অসাধারণ মাধ্যম এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ না থাকা সত্বেও আমি জীবনধারণের তুচ্ছ কাজে এতো জড়িয়ে থাকি যে সময় পাই না নাগাড়ে স্ক্রিনের সামনে বসে থাকার।
আজ মহামহিম গৌতম আদানির কর্মকান্ডের ওপর নির্মিত ফোর কর্ণারের তথ্যচিত্র ডিগিং আদানি দেখে প্রত্যয় হলো যে এই একটা বিরাট ভুল আমি করেই চলেছি। যেভাবে শকুনের ফিস্টির, মানে পরিবেশ ও মানুষ খাওয়া উন্নয়নের ছবি পরতের পর পরত উঠে এলো স্ক্রিনে, তাতে আমি নিশ্চিত যে এইরকম বহুকেলে ছাপ (লাস্টিং ইমপ্রেশন) রেখে যাওয়া আর কোনো মাধ্যমের পক্ষে বিরল-সম্ভব। যেমন, বেঁটেখাটো গোলগাল ফর্সাপানা একটি লোক, বিন্দুমাত্র হাসলে যার ঠোঁটের দুদিকের কোণ উন্মুক্ত হয়ে থাকে, সেইই হলো সেরা প্রফিটজীবী গৌতম আদানি, পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা যার সম্বন্ধে বলেছেন, এমন কোনো কাজ নেই যা সে প্রফিট- মেকিংয়ের জন্য করতে পারেনা। এবার থেকে ধনের দেবতা কুবের আর ঠোঁটখোলা হাসি হাসা আদানি আমার মনে একাকার হয়ে গেল, জেগে রইল শুধু পরমারাধ্য প্রফিট।
ঠিক তার উল্টো দিকে এক নিষ্পাপ শিশুর মুখ, বিরাট স্বচ্ছ মাস্ক পরা। শুনলাম সে রোজ সকালে উঠে বমি করে। রঙ কয়লাগুঁড়োর মতো কালো। নিঃশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে ঢুকে চিটচিটে করে দেওয়া কোল্ ডাস্ট। গোয়ার ভাস্কো ডা গামা পোর্টে আদানি কোল মাইনিংয়ের অপার মায়ায় বেড়ে ওঠা আমার দেশের ভবিষ্যত,পরবর্তী প্রজন্ম।
তথ্যচিত্রটি না হলে এই একাকার হওয়া হতো না। এই বৈপরীত্য এমন ভাবে চিন্তার ভেতরে ঢুকে যেতো না।
রাম কে নামের মতো এই ছবিটি বিজেপি বিরোধী কোন ভারতীয়ের বানানো নয়। গায়ের রঙ সাদা অস্ট্রেলিয়ান সাহেব বানিয়েছে বলে যদি পক্ষপাতের অভিযোগ একটু কম হতো। কিন্তু বাপ রে বাপ, কী সমস্ত অভিযোগ ! কালো টাকা ভুয়ো কম্পানি খুলে বিদেশে পাচার, নিজের সিঙ্গাপুরবাসী দাদার নামে দেদার টাকা পাচার, বস্তা বস্তা ঘুষ খাওয়ানো, পুলিশ প্রশাসনকে নিজের বাড়ির দারোয়ানের মতো ব্যবহার করা, অনৈতিকভাবে মুনাফা বাড়ানো, পরিবেশ তছনছ করা, কী নেই সেই তালিকায় ! আর সবই করে চলা রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায়। কী মহিমময় সেই ছায়া যে তৎকালীন পরিবেশমন্ত্রী জয়রাম রমেশ সব জেনেও একে আটকাতে পারেন না। তাহলে এখন কেমন রমরমা মাস্তুতো ভাই আদানীর তা বোঝার জন্য কোন চলচ্চিত্রের প্রয়োজন নেই। কমন সেন্সই যথেষ্ট।
কমন সেন্স বলছে ছত্তিসগড় নতুন তৈরি এসিজেডে আদানি বিপুল আর্থিক সুবিধে পাবে। ট্যাক্স মকুব, অল্প সুদে ঋণ, শ্রম আইনের তোয়াক্কা না করা,আরো কতো কী ! কর্পোরেটদের বেতাজ বাদশা কয়লা পোড়ানো বিদ্যুৎ সেখান থেকে রপ্তানি করবে বাংলাদেশে। অনেক চড়া দামে। লাভ হি লাভ। সরকারি সুবিধে প্লাস নিজের স্থির করা চড়া দাম।
এ হাত মুঝে দে দো ঠাকুর
বর্তমান শাসকের পাঞ্জা লড়ার জন্য দুই হাত -- এক ধর্ম, দুই কর্পোরেটসঙ্গ। এক দিকে রামমন্দির, অন্যদিকে উন্নয়নের গাজর। প্রথম হাতের থাপ্পড় তো রোজ খাই, আজ বরং অন্যহাত ধরে উন্নয়নের সতীপীঠ গুজরাতে ঘুরে আসি।
মুন্দ্রা পোর্ট। এ দেশের সবচেয়ে বড় পোর্ট। মুন্দ্রা পাওয়ার প্ল্যান্ট। সব গৌতম আদানির। কিভাবে যে জল জমিন তছনছ হয়েছে ভাবা যায় না। ভূগর্ভস্থ জলের ভাঁড়ারে টান, জল নোনতা হয়ে গিয়ে চাষি ও মৎস্যজীবীদের প্রাণধারণ কঠিন করে তোলা। দুর্মূল্য ম্যানগ্রোভ জঙগল পরিবেশ মন্ত্রকের ছাড়পত্র পাবার আগেই কেটে সাফ করে ফেলা, সবই করেছে এই কর্পোরেট কূলচূড়ামণি। অথচ পনের বছর আগে এর নামও শোনেনি কেউ। পলিটিক্স আর কর্পোরেট একে অন্যের দোসর হলে কী হতে পারে তার অকাট্য প্রমাণ।
কর্ণাটকের বেলিকেরিতে ঘটে গেছে ভারতের সবচেয়ে বড় মাইনিং স্ক্যাম। প্রযত্নে গৌতম আদানি। ভুয়ো নথিপত্র আর অবৈধ রপ্তানির মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টন লৌহ আকরিক পাচার।
হাত তো চাইলেই হলো না। অক্টোপাসকে লজ্জা দিয়ে আদানিগুষ্টি কিলবিলে নতুন হাত চারিয়ে দিচ্ছে সর্বত্র। এবছরের রিপোর্ট কার্ড দেখুন।
একগুচ্ছ নতুন প্রজেক্ট বাগাতে সফল হয়েছে এরা। হাইওয়ে কন্সট্রাকশন, বিমানবন্দর, সিটি গ্যাস রিটেইলিং সর্বত্র এখন আদানির ছায়া। সোলার এনার্জি প্রজেক্ট, উইন্ড এনার্জি প্রজেক্ট, ট্রান্সপোর্ট, এডিবল অয়েল,এয়ারোস্পেস যন্ত্রপাতি, রাডার, ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম - এই সাম্রাজ্য বিস্তারের কাহিনী শেষ হবার নয়। এর সঙ্গে পুরোনো ভেঞ্চার পোর্ট, মাইনিং, ফুড প্রডাকশন, পাওয়ার স্টেশন, রিয়াল এস্টেট এ সবই রইল।
কোন ঠাকুরের সাধ্য এর একটা হাতও কমাবে !
সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
দেশ উদ্ধার করে আদানি এখন বিদেশে সাম্রাজ্য বিস্তারে মগ্ন। অস্ট্রেলিয়া কুইন্সল্যান্ড। কোল মাইনিং। হাজার হাজার বেকারের চাকরির লোভ দেখানো। ওদিকে মাটির নীচের জলস্তর তরতরিয়ে নেমে যাবার আশঙ্কা, বনভূমি নির্মূল, গ্রেট বেরিয়ার রিফের চূড়ান্ত ক্ষতি হবার সম্ভাবনা। মিটিং মিছিল প্রতিবাদ। এখন অনেক ছোট করা হয়েছে আগের বিস্তারিত আগ্রাসনমূলক পরিকল্পনা। সরকারি টাকা চাই না, নিজের টাকাতেই প্রজেক্ট শেষ করব এই বাণী দিয়েছেন গৌতম। তবু চলছে প্রতিবাদ।
এই জনমত তৈরির পেছনে ডিগিং আদানি তথ্যচিত্রের অবদান অনেক। এগারটা পোর্টের অমিত শক্তিধর মালিকের পাঙ্গা নিতে ছুটে আসা এদেশে, পুলিশ প্রশাসনের বিরোধিতাতেও হাল না ছাড়া, মাঝরাতে তল্পিতল্পা নিয়ে হুমকির মুখে হোটেল ছাড়া, এসবের পরেও তৈরি হলো একটি তথ্যনিষ্ঠ ডকুমেন্টারি যা হৃষ্টপুষ্ট ফর্সাপানা আদানিকে ছিঁড়েখুঁড়ে আসল খড়ের আঁটিটিকে ল্যাংটো দাঁড় করালো চোখের সামনে।
রামকে নাম দেখুন, ডিগিং আদানি দেখুন। আধুনিক ভারতবর্ষকে জানুন।