সম্প্রতি ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্সের একটি গবেষণাপত্র নিয়ে বিতর্কের সূচনা হয়েছে। গবেষণার বিষয় সুপারকন্ডাক্টিভিটি বা অতিপরিবাহীতা। গবেষকদলের মধ্যে অন্যতম IISC র অধ্যাপক অংশু পান্ডে, যাঁর লুমিনিসেন্স নিয়ে গবেষণায় সুনাম রয়েছে। খুব সহজ করে বললে, লুমিনিসেন্স হলো পদার্থের আলোক নিঃসরণ ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়। এল ই ডির যুগের অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন পদার্থের আলোক নিঃসরণের ক্ষমতা সংক্রান্ত গবেষণা চলে আসছে। এই লেখায় আমরা লুমিনিসেন্স নিয়ে কথা বাড়াবো না, শুধু দুটো কথা জেনে রাখবো। বিভিন্ন পদার্থের ধর্ম নিয়ে যাঁরা পরীক্ষামূলক গবেষণা করেন (পরিভাষায় যাঁদের বলা হয় এক্সপেরিমেন্টালিস্ট, আর তাত্ত্বিক গবেষকেরা হলেন থিওরিস্ট) তাঁদের অনেক সময় লক্ষ্য থাকে পদার্থটির আলোক নিঃসরণ ক্ষমতা আছে কিনা জানা যা আমরা লুমিনিসেন্সের মাধ্যমে জানতে পারি, বা এটা দেখা, যে পদার্থটি তাপ বা তড়িতের সুপরিবাহী কিনা। বলা বাহুল্য, এই দুই ধরণের ধর্মেরই বিস্তৃত কারিগরি উপযোগিতা আছে, ফলে ব্যাপারটা অর্থনৈতিকভাবেও খুবই লাভজনক। এই ধরণের কাজে সাফল্য আসলে কর্পোরেট সংস্থাগুলো হামলে পড়ে পরবর্তী গবেষণার ফান্ডিং স্পনসর করে অনেক সময়। এখন, যেকোন যন্ত্রকেই ব্যবহার করতে হবে ঘরের তাপমাত্রায় (আপাতত প্রচন্ড গরম জায়গাগুলোকে অগ্রাহ্য করে আমরা ধরে নিচ্ছি সেটা ২০-২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস)। আর সেই জায়গাটাতেই গোলমাল। যেকোন পদার্থের যান্ত্রিক উপযোগিতার জন্য প্রয়োজনীয় ধর্মসমূহ সবথেকে ভালোভাবে কাজ করে ঠান্ডায়, ঘরের উষ্ণতা থেকে বহু নীচে, প্রায়শই কয়েক কেলভিন উষ্ণতায়। কয়েক কেলভিন মানে মাইনাস তিনশোর কাছাকাছি তাপমাত্রা (1 K = -272oC), মানে কিনা ভয়ানক ঠান্ডা আবহাওয়া। তাই বিজ্ঞানীদের অন্যতম লক্ষ্য থাকে যেকোন "উপযোগী" পদার্থকে ৩০০ কেলভিনের কাছাকাছি তাপমাত্রায় কাজ করানো। যে আলো দেয়, সে যেন ঐ উষ্ণতাতেও আলো দেয়, যে তড়িতের ভালো পরিবাহী সে যেন ঐ উষ্ণতাতেও একইরকম বা প্রায় কাছাকাছি পরিবাহী থাকে ইত্যাদি। এরকম ভাবার কোন কারণ নেই দরকারী ব্যাপার শুধু এই দুটিই, কিন্তু মনে রাখার সুবিধের জন্য এই দুটিই যথেষ্ট। শিরোনামে আমি স্বাভাবিক তাপমাত্রা বলতে ঘরের উষ্ণতাই বুঝিয়েছি। যাই হোক, এবার মূল ঘটনায় ঢোকা যাক।
২০১৮ সালের জুলাই মাসে অধ্যাপক পান্ডে এবং এবং তাঁর ছাত্র দেব কুমার থাপা একটি গবেষণাপত্রে ঘোষণা করেন যে তাঁরা এমন একটি পদার্থের সন্ধান পেয়েছেন যা ঘরের উষ্ণতায় অতিপরিবাহী [1]। এইরকম একটি পদার্থের খোঁজ বিজ্ঞানীরা অনেকদিন ধরেই করছেন, কাজেই পরীক্ষার ফল প্রকাশ করার পরেই গবেষকমহলে ব্যাপক সাড়া পড়ে। এবং খুব ভালো কোন কাজের ক্ষেত্রে যেমন হয়, বিশেষজ্ঞরা নানাভাবে খতিয়ে দেখার চেষ্টা করতে থাকেন, যে দাবিটি যথেষ্ট সঙ্গতিপূর্ণ কিনা। সেই সঙ্গতি খুঁজতে গিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠে এসেছে যা তীব্র বিতর্কের জন্ম দেয়। এই বিতর্কের মীমাংসা এখনও সম্পূর্ণভাবে হয়নি, তবে ২০১৯ সালের মে মাসে ঐ একই গবেষণাপত্র আরো বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। এই পরিবর্ধিত সংস্করণে পূর্বোক্ত গবেষকেরা ছাড়াও আরো কয়েকজন যুক্ত হয়েছেন। কিন্তু এই বিতর্কের আরো গভীরে ঢোকার আগে আমাদের গবেষণার বিষয়টি নিয়ে সামান্য একটু জেনে নেওয়া দরকার। সুপারকন্ডাক্টিভিটি বা অতিপরিবাহিতা খুবই জটিল তত্ত্ব, তাই আমরা যথাসম্ভব সহজ করে, যতটুকু না জানলেই নয় ততটুকুই জানবো।
তো কথা হলো, এই অতিপরিবাহী ব্যাপারটা কী?
মাধ্যমিকের পদার্থবিজ্ঞানেই আমাদের পড়ানো হয়েছে তড়িতের সুপরিবাহী পদার্থ বলতে কী বোঝায়, অপরিবাহী বলতেই বা কী বুঝবো। তামার তার সুপরিবাহী, কারণ তার মাধ্যমে তড়িৎ সহজে প্রবাহিত হয়। অন্যদিকে কাঠের টুকরো অপরিবাহী যার মধ্যে দিয়ে তড়িৎ প্রবাহিত প্রায় হয় না বললেই চলে। পরিবাহীতা মাপার একটা উপায় হলো কোন পদার্থের মধ্যে দিয়ে ইলেক্ট্রন চলাচলে কতটা বাধা পায় সেটা মাপা। সেই বাধার পরিমাপক হলো রেসিস্টিভিটি। এবং সেই বাধার কারণ হলো পদার্থের কণাগুলোর সাথে ইলেক্ট্রনের সংঘর্ষ। ধরে নেওয়া যাক একটি তামার তারের দুই প্রান্ত ব্যাটারির সাথে যুক্ত, এবং ফলে তার মধ্যে দিয়ে ইলেকট্রনের স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। তারটি কী উষ্ণতায় রাখা আছে তার ওপর নির্ভর করে ইলেকট্রন প্রবাহ কম বেশি বাধাপ্রাপ্ত হয়। এই বাধা, যা পদার্থের নিজস্ব ধর্ম, তার আরেক নাম রোধ বা রেসিস্টেন্স (সংজ্ঞা অনুযায়ী রেসিস্টিভিটি হলো একটি পদার্থের একক ঘনকের রোধ। উদাহরণস্বরূপ তামার কথা ভাবুন। একটা তামার ঘনক (cube) যার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা ১ মিটার, তার যেকোন দুটি বিপরীত তলের মধ্যেকার রোধ হলো রেসিস্টিভিটি) । এর উৎস হলো পদার্থের কণাগুলোর নিজস্ব গতিবিধি। আমাদের উদাহরণে যে তামার তারটির কথা বলা হচ্ছে, তার পরমাণুগুলি সর্বক্ষণ পেন্ডুলামের মত দুলছে। উষ্ণতা যত কম হয়, দোলন তত মৃদু হয়। ইলেকট্রনের স্রোত যখন এই সদা দোদুল্যমান পরমাণু সমবায়ের মধ্যে দিয়ে যায় তখন তাদের মধ্যে সংঘর্ষ হতে পারে। ব্যাপারটা যদি এরকম হয় যে পরমাণুগুলি খুব একটা নড়াচড়া করছেনা, তাহলে সংঘর্ষের সম্ভাবনা কমে যায়। ফলে কমে যায় রোধ, যা আমরা রেসিস্টিভিটি মেপে বুঝতে পারি। অন্যদিকে উষ্ণতা যত বাড়ে, ততই পরমাণুর দোলন তীব্র হতে থাকে। ফলে প্রবহমান ইলেকট্রনগুলোর কোন না কোন পরমাণুর সামনে পড়ে গিয়ে ধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবণাও বাড়তে থাকে। প্রতিটি সংঘর্ষের ফলে ইলেকট্রনগুলোর শক্তিক্ষয় হয়, সেই শক্তিক্ষয় আমরা তাপের মাধ্যমে টের পাই (তড়িৎ পরিবাহী তার কিছুক্ষণের মধ্যেই গরম হয়ে ওঠে)।
ফিরে যাই কাঠ ও ধাতুর তুলনামূলক আলোচনায় যাতে তড়িৎ পরিবহণের বাধার স্কেলটা আমরা বুঝতে পারি। কাঠের টুকরোর রেসিস্টিভিটি ধাতুর প্রায় 1012 গুণ। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে এদের মধ্যে উপযোগীতার পার্থক্য এত বিশাল কেন। ধাতুর রেসিস্টিভিটি খুবই কম 10-9 Ohm.m কিন্তু খুব কম হলেও এটা যেহেতু একটা সংখ্যাই, তাই এটা স্বাভাবিক যে তড়িৎ পরিবহণে ধাতুগুলিও সামান্য হলেও বাধার সৃষ্টি করে। এই বাধা কাটিয়ে উঠে ক্রমাগত পরিবহণ চালিয়ে যেতে চাইলে দরকার নিরন্তর শক্তিপ্রবাহ, যা আমরা ব্যাটারির মাধ্যমে করে থাকি। এবার ভাবুন, যদি এই বাধা না থাকতো? তাহলে ঐ রেসিস্টিভিটির মান হত শূন্য এবং পরিবাহীতা বেড়ে হত অসীম। এরকম কোন পদার্থ দিয়ে সার্কিট বানালে তাতে শক্তির ব্যয় (energy consumption) প্রচন্ড কমে গিয়ে ব্যাপারটা অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত দিক থেকে ভয়ানক লাভজনক হয়ে যায়। কারণ শক্তির ক্ষয় মানে শক্তির রূপান্তর, প্রধাণত তাপশক্তিতে পরিণত হওয়া। যাই হোক, তড়িৎ পরিবহণে শূন্যের কাছাকাছি বাধা দেয় এরকম পদার্থ অনেক আগেই আবিষ্কার হয়েছে।
১৯০৮ সালে H.K.Onnes প্রথম তরল হিলিয়াম বানাতে সক্ষম হন, যার উষ্ণতা চার কেলভিন। অত কম উষ্ণতায় তড়িৎ পরিবহণ ঠিক কেমন হবে সে বিষয়ে এরপর তাঁর গবেষণা শুরু হয়, যা তার আগে কখনও হাতে কলমে করে দেখার সুযোগ কারো হয়নি। সূচনা হয় পদার্থবিদ্যার নতুন একটি শাখার, যার পরিভাষায় নাম Low Temperature Physics।
১৯১১ সালে ওনেস পারদকে ক্রমশ ঠান্ডা করতে করতে দেখেন যে চার কেলভিন তাপমাত্রায় নিয়ে গেলে তার রেসিস্টিভিটি আচমকাই শূন্যের কাছাকাছি চলে যাচ্ছে। শুরু হয় সুপারকন্ডাক্টিভিটি নিয়ে গবেষণা। প্রসঙ্গত চার কেলভিন মানে -২৬৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য Onnes ১৯১৩ সালে নোবেল পান।
১৯৩৩ সালে দুজন জার্মান পদার্থবিদ Walther Meissner ও Robert Ochsenfeldr মিলে একটা পরীক্ষায় দেখান যে সুপারকন্ডাক্টর শুধু শূন্যের কাছাকাছি রেসিস্টিভিটিই দেয়না, তা ম্যাগনেটিক ফিল্ড বা চৌম্বকক্ষেত্রকে প্রতিহত করে। ঠিক যেভাবে নদীর স্রোতে একটা ভারি পাথর রেখে দিলে জল প্রতিহত হয়ে পাশ কাটিয়ে বয়ে যায়, ঠিক সেরকম কোন অদৃশ্য স্বচ্ছ পাথরের দেওয়াল যেন অতিপরিবাহী বস্তুটিকে ম্যাগনেটিক ফিল্ড থেকে রক্ষা করছে (চিত্র-১)। তাহলে আমরা জানলাম সুপারকন্ডাক্টরের দুটি ধর্ম, ১) একটি নির্দিষ্ট উষ্ণতার নিচে তার পরিবাহীতা অসীম (বা রোধ বা তড়িৎ প্রবাহে বাধা শূনের কাছাকাছি হবে), আর ২) একই সঙ্গে সেই পদার্থ চৌম্বকক্ষেত্রকে প্রতিহত করবে একটা ঢালের মত। যে নির্দিষ্ট উষ্ণতায় একটি সাধারণ পদার্থ এইরকম "অসাধারণ" হয়ে ওঠে, তাকে বলা হয় ক্রিটিকাল টেম্পারেচার (Tc)।
এর কিছুদিনপরে দেখা যায় সুপারকন্ডাক্টর দুরকম। একদলের ক্ষেত্রে উষ্ণতা বাড়াতে থাকলেই একইসঙ্গে উপরোক্ত দুটো ধর্মই লোপ পায় (Type I superconductor), আরেকদলের ক্ষেত্রে প্রথমে ম্যাগনেটিক ফিল্ডের একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্তই দুটি ধর্ম বজায় থাকে। তারপর চৌম্বকক্ষেত্রের শক্তি একটি নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করলে প্রথমেই চৌম্বকক্ষেত্র প্রতিহত করার ক্ষমতাটি লোপ পায়। ম্যাগনেটিক ফিল্ড আরো বাড়াতে থাকলে দ্বিতীয় আরেকটি সীমার পর রোধশূন্য অবস্থার ধর্মটিও লোপ পায় (Type II superconductor)। এই দুরকম সুপারকন্ডাক্টরের শ্রেণীবিভাগ ১৯৫০ সালের দুজন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীদের কাজের ওপর দাঁড়িয়ে। ঐ বছর Ginzburg-Landau theory প্রকাশিত হয়। আলেক্সেই আব্রিকোসভ (Abrikosov) এই তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে সুপারকন্ডাক্টরের শ্রেণীবিভাগ করলেন। ২০০৩ সালে সুপারকন্ডাক্টিভিটি নিয়ে তাত্ত্বিক কাজের জন্য আব্রিকোসভ, গিন্সবার্গ, এবং Anthony Legget নোবেল পান। অন্যদিকে ১৯৫৭ সালে বিখ্যাত BCS theory প্রকাশিত হয়, যা তিনজন বিজ্ঞানীর নামের আদ্যক্ষর দিয়ে অঙ্কিত (John Bardeen, Leon Cooper, John Robert Schrieffer)। এই তত্ত্বে দেখানো হয় কীভাবে দুটি ইলেকট্রন, যাদের পরষ্পরকে স্বাভাবিক অবস্থায় বিকর্ষণ করার কথা, তারা পরষ্পরের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে এবং এই entangled অবস্থায় তারা পরিবাহীর মধ্যে দিয়ে একত্রে চলাফেরা করছে। এই ইলেকট্রনদ্বয় পদার্থবিজ্ঞানে Cooper-pair নামে পরিচিত। এইরকম একাধিক ইলেকট্রন-জোড় তৈরী হওয়ার পর তারা পরষ্পরের সাথে একটি সমবায় গঠন করে। শুধু তাই না, ঐ অবস্থায় তাদের চলাচলে কোন শক্তিক্ষয় হচ্ছেনা কারণ কণাগুলোর প্রত্যেকেই তাদের সর্বনিম্ন শক্তি যা হওয়া সম্ভব সেখানেই অবস্থান করছে। এই কারণে তারা তড়িৎ পরিবহণ করলেও তাদের শক্তিক্ষয় হচ্ছেনা, ফলে অনন্তকাল ধরে তড়িৎপ্রবাহ চলছে। উষ্ণতা বাড়তে থাকলে পরিবাহীর পরমাণুগুলির আন্দোলন বেড়ে গিয়ে এই সমবায় ভেঙে দেয়, ফলে রোধশূন্য অবস্থাটি লোপ পায়। প্রসঙ্গত সুপরকন্ডাক্টিভিটির তাত্ত্বিক গবেষণার পীঠস্থান ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্বানা-শ্যাম্পেন (UIUC) ক্যাম্পাস। উপরোক্ত পাঁচজন নোবেল প্রাপকদের মধ্যে চারজনই (Anthony Legget, John Bardeen, Leon Cooper, John Robert Schrieffer) আর্বানা-শ্যাম্পেনের অধ্যাপক ছিলেন।
এবার আমরা আবার আগের ঘটনার খেই ধরে পৌঁছে যাব ২০১৮ সালের জুলাই মাসে। ২৩শে জুলাই গবেষণাপত্রটির প্রথম সংস্করণে প্রকাশিত হলো যে এই নতুন পদার্থের কথা যা আসলে খুব ছোট (1 nm) রৌপ্যকণিকা, অপেক্ষাকৃত বড়ো (8-10 nm) স্বর্নকণিকায় আবদ্ধ (embedded)। পরিভাষায় যাকে বলে silver particles embedded in gold matrix এবং জিনিসটা একটি কোলয়েড। আমাদের চেনা কোলয়েডের উদাহরণ হিসেবে দুধ বা রক্তের কথা ভাবা যেতে পারে।
এই পদার্থটি, যাকে অতিপরিবাহী বলে ঘোষণা করে হয়েছে, তাকে এখন থেকে আমরা সুবিধার জন্য পরীক্ষাধীন স্যাম্পল sample বলবো। ন্যানোস্ট্রাকচার আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান/রসায়ণ মিলেমিশে আরেক নতুন দিগন্ত, এবং এই লেখার গোষ্পদে সেই বিষয়ে কথা না বাড়ানোই ভালো। আপাতত বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে এটুকু জেনে রাখলেই চলবে যে আলোচ্য গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথেই বহু ল্যাবরেটরিতে এই কাজটি পরীক্ষা করে দেখার চেষ্টা শুরু হয়।
একই সঙ্গে তাত্ত্বিক পদার্থবিদরাও কাজটি সম্পর্কে খুবই উৎসাহিত ছিলেন। এম আই টি'র একজন পোস্ট ডক ব্রায়ান স্কিনার (Brian Skinner) সুপারকন্ডাক্টর নিয়ে কাজ না করলেও স্বাভাবিক উৎসাহে পেপারটি পড়তে শুরু করেন এবং খেয়াল করেন যে পরীক্ষালব্ধ ফল নিয়ে যেসব গ্রাফ আঁকা হয়েছে তার মধ্যে একাধিক কার্ভের noise একরকম [2]। যেকোন এক্সপেরিমেন্টেই ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েস থাকে, কিন্তু সেই নয়েস হয় র্যান্ডম। সাধারণতঃ কোন একটি ডেটা সেটের নয়েস অন্য আরেকটি সেটের নয়েসের সাথে মেলার কথা না। কিছু বিরল ক্ষেত্রে অবশ্য এটা সম্ভব হতে পারে। তার মধ্যে একটা হলো যদি পরীক্ষালব্ধ ফলটি বানানো অর্থাৎ ডেটা ফ্যাব্রিকেটেড হয়ে থাকে। অন্য একটি কারণ হতে পারে যদি নয়েসটি পরীক্ষাধীন স্যাম্পলের কোন ধর্মের ওপর নির্ভরশীল হয়।
সাধারণভাবে, যেকোন স্তরের গবেষণাই প্রশ্ন এবং প্রতিপ্রশ্ন তথা বিতর্কের মাধ্যমেই এগোয়। অধ্যাপক পান্ডের গবেষণা নিয়ে স্কিনারের প্রশ্ন তাই খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু অতীতের আরেকটি ঘটনার স্মৃতি সম্ভবত এই বিষয়টিকে অত্যন্ত বিস্ফোরক করে তুলেছে। এই র্যান্ডম নয়েসের মাধ্যমেই মাত্র কুড়ি বছর আগের কুখ্যাত বিতর্কের মীমাংসা হয়েছিলো, পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে যা Schon Scandal নামে পরিচিত [3]। বেল ল্যাবসের এক তরুণ বিজ্ঞানী, Jan Hendrik Schön ২০০০ সাল নাগাদ খুব দ্রুত শিরোনামে উঠে আসেন অর্গানিক সেমিকন্ডাক্টর নিয়ে কাজ করে। তাঁর একাধিক গবেষণা নেচার ও সায়েন্সে প্রকাশিত হয়। একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রাইজ টাইজও পেয়ে যান। ইতিমধ্যে গবেষকমহল খুবই হতভন্ব হয়ে আবিষ্কার করতে থাকে যে সেই একই কাজ তারা কিছুতেই করে উঠতে পারছেনা। এরপর এক সময় দেখা যায় যেসব মহামূল্যবান কাজ নেচার আদি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে তাদের ডেটায় নয়েস প্যাটার্ন একরকম। বেল ল্যাবস পরবর্তীকালে তদন্ত করে দেখে যে সিংহভাগ ডেটা ফ্যাব্রিকেটেড, তা কম্পিউটারে ম্যাথেম্যাটিকাল ফাংশনের সাহায্যে তৈরী করা হয়েছে, এবং করা হয়েছে খুবই চাতুর্যের সঙ্গে যা এক্সপেরিমেন্ট এবং প্রেডিক্টেড থিওরির সাথে মেলে। Science এর মত জার্নালে আটটি পেপার প্রকাশিত হয়েছিল যাতে এইসব জালিয়াতি রয়েছে।
সুপারকন্ডাক্টিভিটি নিয়ে কাজটিও এই গোত্রের সমস্যায় আক্রান্ত কিনা তা সময়েই বলবে, তবে আপাতত দেখাই যাচ্ছে যে কুড়ি বছর আগের ন্যক্কারজনক অসততার ভূত তাড়া করছে গবেষকমহলকে। অধ্যাপক পান্ডের কাজ নিয়ে স্কিনারের টুইট এবং বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ কাজটিকে নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা একরকম করে থামিয়েই দিয়েছে। গতবছর আগস্ট মাসে নেচার একটি প্রবন্ধে মূল কাজটির থেকেও বেশি গুরুত্ব দিয়ে লেখে স্কিনারের পর্য্যবেক্ষণ [4]। সেখানে এও জানানো হয় যে আরো অন্তত তিনটি গবেষণাগারে ঐ একই কাজ ঐ একই পদ্ধতিতে করার কথা ভাবা হচ্ছিলো, বিতর্কের পরে তা আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে।
এর মধ্যেই অন্যান্য বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের প্রতিক্রিয়া এবং তাত্ত্বিক আলোচনা চলতে থাকে। টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের অধ্যাপক প্রতাপ রায়চৌধুরী একইরকম প্যাটার্নের নয়েস পাওয়ার একটি বিকল্প সম্ভাবনা আলোচনা করেন। এই সম্ভাবনা বলে যে যাকে noise বলে মনে করা হচ্ছে তা যদি আসলে সিগনালেরই অংশ হয়, তাহলে এইরকম হলেও হতে পারে। The Wire এর বিজ্ঞান বিভাগে এই গবেষণাপত্রটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় যেখানে অধ্যাপক রায়চৌধুরীর প্রস্তাবিত সম্ভাবনাটি আলোচিত হয়েছে [5]। সেখানে আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে। এ যাবৎ জানা ছিলো যে ২০১৮ সালে গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হওয়ার পরে পরেই বেশ কিছু গবেষক একই কাজ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। The wire এর প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে এই ব্যর্থতা থেকেও প্রমাণিত হয়না যে অধ্যাপক পান্ডের কাজটি ভিত্তিহীন, কারণ যে স্যাম্পলটি নিয়ে এত হইচই, তা কীভাবে তৈরী হচ্ছে সেই গোপন রেসিপি না জানলে একেবারে সেইরকম স্যাম্পল বানানো অন্যদের পক্ষে খুবই কঠিন। সেই বিশেষ রেসিপি প্রকাশ না করায় অধ্যাপক রায়চৌধুরী বিশেষভাবে অলোচ্য গবেষণাপত্রটির লেখকদের সমালোচনা করেন।
ইতিমধ্যে এক বছর কেটে গেছে। ২০১৯ সালের মে মাসে অধ্যাপক পান্ডে ঐ একই গবেষণাপত্রের একটি বিস্তারিত সংস্করণ প্রকাশ করেন [6,7]। সেখানে দেখা যাচ্ছে তাঁরাও মনে করেন noise নিয়ে যে বিতর্ক তার মূলে স্যাম্পলটির বিচিত্র ব্যবহার, এর মূল বৈজ্ঞানিক কারণ তাঁরা এই মুহূর্তে ব্যাখ্যা করতে পারছেন না তবে মনে করছেন এটি পদার্থটির একটি নতুন ধর্ম। ইতিমধ্যে তিনি তাঁর গবেষণালব্ধ ফল, যাবতীয় raw data অন্য গবেষকদের সাথে শেয়ার করেছেন, যাঁদের মধ্যে ব্রায়ান স্কিনারও আছেন। পেপারটির নতুন সংস্করণে স্যাম্পল বানানোর রেসিপি দেওয়া হয়েছে, সর্বোপরি IISC র আরেকদল গবেষক ঐ স্যাম্পলটি অধ্যাপক পান্ডের থেকে নিয়ে ঐ একই পরীক্ষা করে দেখতে শুরু করেছেন।
কুখ্যাত Schon Scandal এর সাথে যত আপাত মিলই থাকুক, ধরা পড়ে যাওয়ার সময় Jan Hendrik Schön কোনরকম ল্যাব নোটবুক, raw data, আবিষ্কৃত স্যাম্পল দেখাতে পারেননি যার থেকে কোনভাবেই প্রমাণ করা যায় যে কাজটি তিনি করেছেন। তাঁর ল্যাবের যাবতীয় স্যাম্পল নষ্ট করে ফেলা হয়েছিলো তদন্ত কমিটি পৌঁছবার আগেই। এর বিপরীতে অধ্যাপক পান্ডে যেভাবে এই বিতর্কে অংশ নিচ্ছেন এবং চেষ্টা করছেন প্রশ্নের উত্তর দিতে তার থেকে এটিকে আরেকটা ডেটা ফ্যাব্রিকেশনের কেস বলে মনে হয়না।
অধ্যাপক পান্ডের এই গবেষণাপত্রের দাবিগুলি অচিরেই আরো স্পষ্টভাবে ভুল বা ঠিক বলে প্রমাণিত হবে। যদি তাঁদের দাবি সত্যি হয়, এটি একটি অসামান্য বৈজ্ঞানিক গবেষণার উদাহরণ হিসেবে ইতিহাসে ঠাঁই পাবে। আর অভূতপূর্ব আবিষ্কার যদি না ঘটে থাকে, স্বাভাবিক উষ্ণতায় অতিপরিবাহীর খোঁজ সম্ভবত অনিচ্ছাকৃত গবেষণাগত ভুলের উদাহরণ যা গবেষকদের নিত্যদিনের সঙ্গী।
মেইসনার এফেক্টের ছবি। সুপারকন্ডাক্টর কীভাবে ম্যাগনেটিক ফিল্ডকে প্রতিহত করে। এই প্রতিরোধ যখন ভেঙে পড়ে, তখন চৌম্বকক্ষেত্র পদার্থটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারে। (source: Wikipedia)
এই লেখা তৈরীর জন্য তথ্য নিচের লিংকগুলো থেকে নেওয়া হয়েছে।আগ্রহীরা উইকিপিডিয়া থেকে আরো বিস্তারিত পড়তে পারেন, বিশেষ করে লেভিটেশন সংক্রান্ত নানা কারিগরি প্রয়োগে কীভাবে সুপারকন্ডাক্টিভিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে তা খুবই কৌতূহলোদ্দীপক (8)। একেবারে শেষে [9] একটা ভিডিওর লিংক রইলো, যেখানে সুপারকন্ডাক্টিভিটির উৎস ভারি চমৎকার করে ভিস্যুয়াল এইডের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে। কুপার-পেয়ার নিয়ে আমার আলোচনা যদি জটিল লাগে তাহলে ঐ ভিডিওটির সাহায্য নিলে সুবিধে হবে।