ডাকাবুকো কা ডেহুয়া
কা ডেহুয়া অসুস্থ। ইয়ানানের কোনায় কোনায়, আশে পাশের গ্রামে গ্রামে খবর পৌঁছে গেছে। দলে দলে লোক তাঁকে দেখতে আসছেন দুর্গম পাহাড়ি পথ পেরিয়ে। ভিড় করছেন ডাঃ বেথুন আন্তর্জাতিক শান্তি হাসপাতালের সামনে।
কা ডেহুয়া চীন দেশের লোক নন। হিমালয়ের অপর পারে ভারতবর্ষ বলে যে বিশাল দেশটি আছে, সেখান থেকে উনি এসেছিলেন চীনের মুক্তি যোদ্ধাদের পাশে দাঁড়াতে। তরুণ চিকিৎসক। প্রাণ শক্তিতে ভরপুর। এ দেশের সব কিছু আপন করে নিয়েছিলেন। মাও সে তুঙের বিখ্যাত এইট রুট আর্মির সাথে জাপানীদের রাইফেল, গ্রেনেড, কার্পেট-বম্বিং উপেক্ষা করে স্বাধীনতার পথে হেঁটেছেন।
অন্যরা যখন শত্রু সৈন্যর সাথে লড়াই করছেন, তিনিও লড়েছেন। তবে তাঁর লড়াই ছিল জীবন বাঁচানোর জন্য। খোলা আকাশের নীচেই আহত সৈন্যদের চিকিৎসা করেছেন। অসংখ্য অপারেশন করেছেন। এবং আশ্চর্যজনক ভাবে বিশেষ পরিকাঠামো ছাড়াই তাঁদের সুস্থ করে তুলেছেন।
ডাঃ নর্মান বেথুনের অকাল মৃত্যুর পরে তাঁর শূন্যস্থান পূরণ করেছিলেন এই চিকিৎসক। যুদ্ধক্ষেত্রে টানা ৭২ ঘণ্টা না ঘুমিয়ে একের পর এক অপারেশন করে গেছেন। নিজের হাতে তাঁদের ড্রেসিং পরিবর্তন করেছেন। তাঁদের ওষুধ পত্র খাওয়ার কথা বারবার মনে করে দিয়েছেন।
মৃত্যু মুখ থেকে ফিরে চীনা সৈন্য তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছেন, ‘আমার জন্য আপনি এতো করলেন কেন ডাক্তার?’
তিনি মধুর হেসে বলেছেন, ‘ভাইয়ের জন্য ভাই এই টুকু করবে না!’
‘এটাতো আপনার নিজের দেশ নয়... আমরাও অন্য জাতি?’
‘পৃথিবীতে দুটিই জাতি; শাসক আর শোষিত। ভারতে ও চীনে, দুদেশের মানুষই স্বাধীনতার জন্য লড়ছেন। যেখানেই স্বাধীনতার যুদ্ধ, সেটাই আমার নিজের যুদ্ধ। সব মুক্তি যোদ্ধা আমার ভাই।’
অবশেষে বহু লোকক্ষয়ের পর জাপান পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। মাও সে তুঙের নেতৃত্বে নতুন চীন গড়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
সেই কঠিন হৃদয়ের প্রধান কারিগর ভালোবেসে ফেলেছিলেন এই নিঃস্বার্থ তরুণ চিকিৎসককে। তিনি ভারতীয় নামেই তাঁকে ডাকতেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ডাঃ কোটনিস, ভারত থেকে বাকি যে চারজন চিকিৎসক এসেছিলেন ডাঃ অটল, ডাঃ সোলকার, ডাঃ বসু আর ডাঃ মুখার্জী সকলেই যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফিরতে চাইছেন। আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই। যতদিন মহা-চীনের অস্তিত্ব থাকবে, স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয় চিকিৎসকদের অবদানের কথা আমরা কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করব। আপনি কবে বাড়ি ফিরতে চাইছেন?’
ডাঃ দ্বারকা নাথ কোটনিস হাসলেন। বললেন, ‘আমার কাজ কি সত্যি শেষ হয়েছে কমরেড? আমি বিশ্বাস করি না বন্দুকের নল ক্ষমতার উৎস। মানুষের সত্যিকারের ক্ষমতার উৎস প্রকৃত শিক্ষা আর স্বাস্থ্যের অধিকার।’
মাও সে তুং খানিকক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, ‘সেটা আমিও জানি। মুশকিল হল একজন সেনানায়ক হিসাবে সৈন্যবাহিনী গঠন করা, শত্রুর সাথে যুদ্ধ করা এসব আমার খুব কঠিন বলে মনে হয় না। সত্যিকারের কঠিন কাজ এবার শুরু হবে। দেশ গঠনের কাজ। এক স্বপ্নের দেশ, যে দেশে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থাকবে রাষ্ট্রের হাতে।’
ডাঃ কোটনিস বললেন, ‘স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতির জন্য আমাদের প্রথমে প্রচুর সংখ্যক স্বাস্থ্য কর্মী তৈরি করতে হবে। দক্ষ নার্স, খালি পায়ের গ্রামীণ চিকিৎসক। জটিল রোগের চিকিৎসা নয়, আমাদের জোর দিতে হবে টিকা করণে, প্রাথমিক চিকিৎসায়, রোগ প্রতিরোধে। ঠিক যেমন ডাঃ নর্মান বেথুন ভেবেছিলেন।’
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘কার আবেদনে আমি এখানে এসেছি জানেন? সুভাষ চন্দ্র বসু। ১৯৩৮ সালে তিনি যখন কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন আবেদন করেছিলেন চিনের মুক্তিযুদ্ধে চিকিৎসক ভলান্টিয়ার চেয়ে। কলকাতায় আমাদের বিদায় নেওয়ার সময়ে হাত ধরে বলেছিলেন, আপনারা যাচ্ছেন এক পরাধীন দেশ থেকে আরেক পরাধীন দেশে। তাঁদের স্বাধীনতার লড়াইয়ে অংশ নিতে। তাঁদের জানাবেন এই মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যেক ভারতবাসী চীনাদের পাশে আছেন। আমাদের দেশও খুব তাড়াতাড়ি স্বাধীন হবে। তারপর স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে এশিয়ার এই বিশাল দুটি দেশের পারস্পরিক সহযোগিতা অত্যন্ত প্রয়োজন হবে।’
অন্য চারজন ভারতীয় চিকিৎসক দেশে ফিরে গেলেন। বিদায়ের সময় নতুন চীন সরকার তাঁদের বিপুল সংবর্ধনা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলেন। ডাঃ কোটনিস থেকে গেলেন। তিনি যোগ দিলেন ডাঃ বেথুন আন্তর্জাতিক শান্তি হাসপাতালের প্রধান হিসাবে।
এখানেই তাঁর সাথে পরিচয় হল নার্স গুয়ো কুনলাং এর। তরুণী কুনলাং প্রচণ্ড ভাবে আকৃষ্ট হলেন এই স্বার্থহীন, ছেলে মানুষীতে ভরা ভারতীয় চিকিৎসকের প্রতি। ডাঃ কোটনিস ততদিনে চীনা ভাষায় বেশ দক্ষ। ভারতীয় চিকিৎসকদের মধ্যে তিনিই একমাত্র প্রথম থেকেই চীনা ভাষা শেখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। তাঁর গানের গলাও ছিল মধুর।
ডাঃ কোটনিস একটি শতচ্ছিন্ন মিলিটারি জ্যাকেট পরে ঘুরতেন। কুনলাং নিজের সবটুকু ভালোবাসা মিলিয়ে সোয়েটার বুনে উপহার দিলেন তাঁকে। কিন্তু ডাঃ কোটনিস সোয়েটার নিতে অস্বীকার করলেন। তাঁর সহকর্মীদেরও জ্যাকেটের অবস্থা করুণ। সকলে শীতে কষ্ট পাবে আর তিনি নতুন সোয়েটার পরে ঘুরবেন, তা সম্ভব নয়।
তবে তরুণী নার্স যখন নিজেকেই ডাঃ কোটনিসের হাতে তুলে দিতে চাইলেন, তিনি বিশেষ আপত্তি করেননি। ১৯৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে দুজনের বিয়ে হল। কিন্ত সংসার করার সময় নেই। প্রচুর কাজ। এক বিশাল দেশ গঠনের কাজ। এতো ব্যস্ততার মধ্যেও ডাঃ কোটনিস নিয়মিত চিঠি লেখেন মহারাষ্ট্রের সোলাপুরে তাঁর দিদি মনোরমাকে। সেই চিঠিতে অচেনা চীনের খবর থাকে। থাকে তাঁদের নতুন সংসারের খবর।
১৯৪২ সালের আগস্ট মাসে তাঁদের একটি পুত্র হয়। পিপল লিবারেশন আর্মির মার্শাল ও বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা নি রংচেন তাঁদের সন্তানের নাম রাখেন ইনহুয়া। ইন মানে ইন্ডিয়া আর হুয়া মানে চীন।
কিন্তু তাঁদের এই সুখ স্থায়ী হয়নি। সন্তান জন্মের মাত্র তিন মাসের মাথায় এক অদ্ভুত মৃগী রোগে আক্রান্ত হলেন ডাঃ কোটনিস। এবং মাত্র দু সপ্তাহের মধ্যেই দিনের মধ্যে একাধিক বার খিঁচুনিতে আক্রান্ত হতে থাকলেন। জোর করে তাঁকে ভর্তি করা হল হাসপাতালে। তখনও যুদ্ধ বিধ্বস্ত চীনে আধুনিক পরীক্ষা নিরীক্ষা, আধুনিক চিকিৎসার বিশেষ সুযোগ ছিল না।
৯ই ডিসেম্বর ১৯৪২। চীনের সাধারণ মানুষকে কাঁদিয়ে মাও সে তুং ঘোষণা করলেন ‘আজ চিনের মুক্তিযোদ্ধারা হারিয়েছে তাঁদের এক সাহায্যকারী বন্ধুকে। যতদিন আমরা বাঁচব, কৃতজ্ঞ চিত্তে তাঁর অবদানের কথা স্মরণ করব।’