
মালুমঘাটের এলেমদার
১৯৬৯ সালের জুলাই মাস। জায়গাটার নাম মালুমঘাট। পার্বত্য চট্টগ্রামের বার্মা বর্ডারের কাছাকাছি দুর্গম অঞ্চল। খ্রিষ্টান মিশন হাসপাতালের একটি ঘরে মুখোমুখি বসে আছেন দুইজন ডাক্তারবাবু। ডাঃ রফিকুল ইসলাম ও আমেরিকান চিকিৎসক নলিন (David Nalin)। দলের আরেকজন সদস্য ক্যাশ (Richard Cash) কাছের একটি গ্রামে ভিজিটে গেছেন।
প্রায় দেড় বছর একসাথে কাজ করতে করতে কখন যে এই তিনজন তরুণ চিকিৎসক পরস্পরের হৃদয়ের কাছাকাছি চলে এসেছেন নিজেরাই বুঝতে পারেননি। কিন্তু আজই তাঁদের একসাথে থাকার শেষদিন। কাল সকালেই নলিন আর ক্যাশ ফিরে যাবেন ঢাকার Pakistan-SEATO Cholera Research Laboratory হাসপাতালে। আর ডাঃ রফিকুল ইসলাম থেকে যাবেন এই পাণ্ডব বর্জিত গ্রামে।
নলিন প্রথম মুখ খুললেন, ‘তোমার জন্য খারাপ লাগছে ডাক্তার।’
রফিকুল হাসলেন, ‘কেন?’
নলিন বললেন, ‘কলেরায় ওরাল রিহাইড্রেশন থেরাপি নিয়ে যত কাজ হয়েছে, প্রায় সবই আমার জানা। বলতে বাধা নেই, বিদেশীরা লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যায় করে, আধুনিক গবেষণাগারে কাজ করে যে সাফল্য পেয়েছে, তুমি বন জঙ্গলের মধ্যে বসে একটা পোড়ো হাসপাতালে নিজের তৈরি গবেষণাগারে সে সব সাফল্যকে ছাড়িয়ে গেছ। সবচেয়ে বড় কথা সেই সাফল্যকে তুমি বাস্তবে প্রয়োগ করে হাজার হাজার মানুষের জীবন বাঁচিয়েছ। কিন্তু তোমার কাজের স্বীকৃতি তুমি পেলে না।’
‘কে বলেছে আমি স্বীকৃতি পাই নি। ওই বেঁচে থাকা প্রাণগুলিই আমার কাজের স্বীকৃতি।’
‘তবু তোমার চোখের দিকে তাকালেই ভীষণ অপরাধ বোধ হচ্ছে।’
‘অকারণে নিজেকে অপরাধী ভেবো না নলিন। অনাহারে, শাসকদের অত্যাচারে আর রোগব্যাধিতে জর্জরিত পূর্ব পাকিস্তান আমার জন্মভূমি। এই দেশকে সামান্য আলোর দিশা দেখানোর সৌভাগ্যটুকু অর্জন করেছি এটাই আমার কাছে অনেক।’
‘সত্যি করে বলতো রফিকুল, তোমার ‘ইসলাম প্রটোকল’ যে ছোট্ট ভুলটার জন্য মান্যতা পেলনা, সেই ছোট্ট ভুলটা তুমি ইচ্ছে করেই করেছিলে কিনা?’
‘ভুল কেউ ইচ্ছে করে করে! ওআরএস আবিষ্কারের কৃতিত্বের ভাগ কেউ ইচ্ছে করে ছাড়তে চায়!’
‘আমিও সেটা তোমায় দেখার আগে বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু তোমাদের বাঙালীদের পক্ষে সবই সম্ভব। মাতৃভাষার জন্য যারা প্রাণ দিতে পারে তাঁরা খুব সহজেই দেশের মানুষের প্রাণ বাঁচানোর জন্য নিজের গৌরবকে তুচ্ছ করতে পারে।’
ডাঃ রফিকুল ইসলাম শুধু হাসলেন।
নলিন উত্তেজিত ভাবে বললেন, ‘নাহলে দেখ, তোমার ওআরএস এর ফর্মুলা এখনও পর্যন্ত সব ফর্মুলার মধ্যে নিঃসন্দেহে উৎকৃষ্টতম। এবং ফিল্ড ট্রায়ালেও তাঁর প্রমাণ মিলেছে। পাহাড়ি দুর্গম জঙ্গলে ঘেরা গ্রাম গুলিতে, যেখানে কোনও হাসপাতাল নেই আগে কলেরায় গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। তোমার ওআরএস ব্যবহারের পরে সেখানে কলেরায় মর্টালিটি রেট শূন্যে নেমে এসেছে। কিন্ত তারপরেও ছোট্ট একটা ভুলের জন্য তোমার পুরো ফিল্ড ট্রায়ালটাই মান্যতা পেল না।’
ডাঃ রফিকুল ইসলাম বললেন, ‘এই রকম একটা গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের ইতিহাসে ভুলে ভরা প্রটোকলের কোনও স্থান হবেনা সেটা আগেই জানতাম। তাঁর জন্য আমি আদৌ দুঃখিত নই।’
নলিন বললেন, ‘ভুলে ভরা নয়। একটাই ভুল এবং সম্ভবত সেটাও ইচ্ছাকৃত ভুল। তবে ‘ইসলাম প্রটোকলের’ বদলে এটা ‘নলিন প্রটোকল’ হলে হয়ত এথিকাল কমিটি ট্রায়ালটা বাতিল করত না। নিজে আমেরিকান হলেও বলতে লজ্জা নেই পশ্চিমি বিজ্ঞানীরা এত সহজে বাঙালীদের কৃতিত্বের ভাগীদার হতে দেবে না। কলকাতার ডাক্তার শম্ভুনাথ দে’র কথা ভাবো। কলেরার অধিবিষ নিয়ে ওনার কাজকর্ম রবার্ট কখের কলেরার জীবাণু আবিষ্কারের চেয়ে কম নয়। অথচ বাংলা কাগজগুলো পর্যন্ত ওই মহান আবিষ্কারের পরেও ওনাকে নিয়ে কোনও খবর করেনি।’
ডাঃ ইসলাম বললেন, ‘সাহেব, উপনিষদে রয়েছে “আত্মনং বিদ্ধি”। নিজেকে জানো। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশ পাথর। আমরা রবীন্দ্রনাথের দেশের লোক। সারাজীবন নিজেকে অন্বেষণেই শেষ হয়ে যাবে। বহির্বিশ্বের কাছে আমার কাজ টুকুই পরিচিতি পাক, আমি না’হয় অপরিচিতই থাকব।’
নলিন বললেন, ‘নিখুঁত ‘ইসলাম প্রটোকলে’ একটাই ভুল। সব কলেরার রোগীকে প্রতি ঘণ্টায় এক লিটার করে ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশান খাওয়াতে হবে। রোগীর রোগের সিভিয়ারিটির সাথে ওআরএস এর পরিমাণের কোনও হেরফের হবে না। তাহলে তো কেউ ওভারহাইড্রেট হয়ে যাবে। কেউ আবার ডিহাইড্রেটেড থাকবে। এই বিষয়টা নিয়ে তুমি ভাবনা চিন্তা করনি?’
ডাঃ রফিকুল বললেন, ‘করেছি। আমার এই প্রটোকল সম্পূর্ণ অদক্ষ স্বাস্থ্য কর্মীদের নিয়ে। এবং জায়গাটাও অত্যন্ত দুর্গম। তাদের রোগের সিভিয়ারিটি নির্ণয়, ওআরএস এর ডোজ এইসব শিক্ষা দিতে গেলে বড় দেরী হয়ে যেত। কলেরার সিজিন চলে এসেছিল। আমি হাতে অমৃত পেয়েছি। সেই অমৃত নিয়ে চুপচাপ বসে দেশবাসীর মৃত্যুর মিছিল দেখতে পারি?’
নলিন উঠে দাঁড়িয়ে রফিকুলকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলেন। ক্যাশ সাহেব ঘরে ঢুকে বললেন, ‘শেষ বারের মত গ্রাম ঘুরে এলাম। রোগীরা সবাই ভালো আছে। আজও নো মর্টালিটি। শুধু কালু শেখের ছোটো ছেলেটা এখনও রাইস ওয়াটার পায়খানা করে চলেছে। আর দুটো খবর আছে। একটা ভালো আর একটা খারাপ। কোনটা আগে বলব?’
‘খারাপটাই বল।’
‘শেখ সানারুলের বাড়িতে কাল রাতে নতুন করে ওলা বিবি ঢুকেছে। আমি প্রভাসকে ওর বাড়ি পাঠিয়েছি ওআরএস সহ।’
নলিন বলল, ‘শুনেছিলাম মুসলিমরা পৌত্তলিক নয়। এবং পৌত্তলিকতাকে ঘৃণা করে। এখানে এসে অন্য জিনিস দেখলাম। দেখলাম রীতিমতো মুর্তি গড়ে ওলাবিবির উপাসনা হচ্ছে। ওলাবিবি একা নন, সঙ্গে আছে আরও ছয় বিবি ঝোলাবিবি, আজগৈবিবি, চাঁদবিবি, বাহড়বিবি, ঝেটুনেবিবি ও আসানবিবি। তোমারা কি বিবিগান শুনেছো? বিবিগান আখ্যান অনুসারে ওলাবিবি এক কুমারী মুসলমান রাজকন্যার সন্তান। তিনি অলৌকিক উপায়ে অদৃশ্য হয়ে যান এবং পরে দেবী রূপে আবির্ভূত হন। তাঁর আবির্ভাবের কারণ ছিল দাদামশাইয়ের ও রাজ্যের সব মানুষের আরোগ্য দান। তাঁর মাথায় থাকে মস্তকাবরণী, গলায় গলবস্ত্র ও গয়না। পায়ে তিনি নাগরার জুতো পরেন। এক হাতে জাদুদণ্ড ধরে থাকেন। এই দণ্ডের মাধ্যমে তাঁর ভক্তদের রোগ দূর করেন। এই কলেরা আর ওআরএস এর কাজটাজ মিটলে আমি ঠিক করেছি শেষ জীবনে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বাংলার লোকসংস্কৃতির চর্চা করব।’
রফিকুল বললেন, ‘শুধু মুসলিম নয়, হিন্দু প্রধান অঞ্চল ওলাইচণ্ডী দেবীর মন্দিরে ভরে গেছে। মহামারী শুধু মারতেই জানে। মারার সময় ধর্ম দেখেনা। মৃত্যুভয়ে মানুষের ধর্ম টর্ম গুলিয়ে গেছে। হিন্দুরা দরগায় মানত করছে। মুসলিমরা বারের পুজোর সিন্নি খাচ্ছে। মহামারীর এটা অন্তত একটা ভালো দিক।’
নলিন বললেন, ‘এবার ভালো খবরটা বলে ফেল ক্যাশ।’
ক্যাশ একটা খবরের কাগজ বের করলেন। বললেন, ‘নিল আর্মস্ট্রং আর অলড্রিনের চাঁদে পৌঁছানোর ছবি সহ খবর বেরিয়েছে। ইংরাজি সংবাদ পত্র জোগাড় করতে পারিনি। বাংলা এনেছি। ডাক্তার, তুমিই পড়ে শোনাও।’
রফিকুল শিরোনাম পড়লেন। “বিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় অগ্রগতি। মানুষ পা রাখল চাঁদের বুকে।”
নলিন বলল, ‘মানতে পারলাম না। আমার মতে বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় অগ্রগতি নুন, গ্লুকোজ আর জলের এই সাধারণ মিশ্রণ। যা বছরের পর বছর ধরে কোটি কোটি মানুষের প্রাণ বাঁচাবে। দুঃখের ব্যপার এই আবিষ্কারের জন্য সংবাদ পত্র গুলি একটা অক্ষরও ব্যায় করবে না।’
aranya | unkwn.***.*** | ১১ আগস্ট ২০১৯ ১১:১৫78926
Atoz | unkwn.***.*** | ১১ আগস্ট ২০১৯ ১১:৪৬78927
রোদন | unkwn.***.*** | ১৫ আগস্ট ২০১৯ ১০:০৭78928