
১৮৫৪ সাল। লন্ডনের এক শীতল ও ভূতুড়ে রাত্রি।
রাস্তায় কুকুর বেড়ালও দেখা যাচ্ছে না। টিম টিম করে কয়েকটা গ্যাসের আলো জ্বলছে। সেগুলোর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে না, সকাল অবধি সেগুলো জ্বলবে।
সারা শহরটাই কুয়াশার আস্তরণে ঢাকা। এই কুয়াশা নেমে এসেছে লন্ডনের মানুষদের জীবনেও। গত দশদিনে কলেরা মহামারির মত ছড়িয়ে পড়েছে শহরের আনাচে কানাচে। প্রতিদিন মারা যাচ্ছে শয়ে শয়ে লোক।
সন্ধ্যে হতেই লোকজন যে যার বাড়িতে ঢুকে দরজা জানলা বন্ধ করে গৃহবন্দী হয়ে থাকছে। খুব প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বেরোচ্ছে না কেউ। বাতাসে যে বিষ মিশে আছে। বিষ-বাষ্প।
বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা বলেছেন, কলেরা রোগ ছড়ায় বাতাসের মাধ্যমে। লন্ডন শহরে পয়ঃপ্রণালী বলে কিছু নেই। সারা শহরের মানুষ এবং অন্যান্য জীবজন্তুর মলের দুর্গন্ধ, পচা জঞ্জালের দুর্গন্ধ কলেরার বিষ-বাষ্প তত্ত্বকে আরও বেশী যুক্তিগ্রাহ্য করেছে।
পাথরের রাস্তায় একটা জুতোর শব্দ শোনা গেল। ঠক... ঠক... ঠক...। কে এই সাহসী পুরুষ। তাঁর পরনে ওভারকোট। টুপিতে চোখ ঢাকা পরেছে। মুখে রেশমি রুমাল বাঁধা। হয়ত বিষ-বাস্প থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যই। তাতে আরেকটা সুবিধাও হয়েছে। ব্যক্তিটিকে চেনা যাচ্ছে না।
তিনি নিজেও চান না তাঁর পরিচয় প্রকাশ পাক। আজ যে কাজ তিনি করতে চলেছেন, সেটি সরকারের দৃষ্টিতে গুরুতর অপরাধ। ধরা পড়লে তাঁর কঠিন শাস্তি হবে। কিন্তু কাজটা তাঁকে করতেই হবে। না হলে বাকি জীবন তিনি আয়নায় মুখ দেখতে পারবেন না।
এই ব্যক্তির নাম জন স্নো। তিনি লন্ডন শহরের একজন নাম করা অজ্ঞান করার চিকিৎসক। কিন্তু দশদিন ধরে অপারেশন থিয়েটারের বদলে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন কলেরা আক্রান্ত শহরের অলিতে গলিতে। নিজের হাতে এঁকেছেন একটি মানচিত্র।
সেই মানচিত্রে আছে শহরের তেরটি জলাধার এবং ৫৭৮ জন কলেরায় মৃত ব্যক্তির ঠিকানা।
এই মানচিত্র আঁকার সময় তিনি একটি অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করেন। লন্ডনের জল সরবরাহ তখন নির্ভরশীল ছিল মূলত তেরটি অগভীর জলাশয়ের উপর। সেখান থেকে হাতে চাপা পাম্পের সাহায্যে সাধারণ মানুষ জল সংগ্রহ করতো। জন স্নো লক্ষ্য করেন ব্রড স্ট্রীটের(বর্তমানে ব্রডউইক) জলের পাম্প ব্যবহারকারীদের মধ্যে বেশী মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হচ্ছেন।
কিন্তু তা কি করে সম্ভব। সকল চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানীরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন বাতাসের মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায়। সেখানে একটা জলাধারের কি ভূমিকা থাকতে পারে? তাহলে কি রোগটা বাতাসের মাধ্যমে নয়, ছড়ায় পানীয় জলের মাধ্যমে।
কেউ তাঁর কথা মানেননি। তিনি লন্ডন শহরের প্রশাসনকেও জানিয়েছেন। প্রশাসনের কর্তারা হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু ডাঃ জন স্নো কি করে নিজের পর্যবেক্ষণকে অগ্রাহ্য করবেন। সত্য তো সবসময় সত্যই। সমস্ত পৃথিবী যদি অন্য দিকেও থাকে তার চাপে কি করে তিনি সত্যকে অস্বীকার করবেন।
তাই এই মাঝরাতে তিনি বেরিয়ে পড়েছেন। তাঁর ওভার কোর্টের পকেটে আছে একটা বড় রেঞ্জ। যা হয় হোক। তিনি তার কর্তব্য পালন করবেন। মনে মনে আরেকবার হিপোক্রেটিসের শপথ আউড়ে নিলেন। “প্রাণভয়ে ভীত হয়ে আমি যেন রোগীর চিকিৎসায় গাফিলতি না করি। আমার অর্জিত জ্ঞানকে প্রতিকুল পরিস্থিতিতেও আমি যেন রোগীকে সুস্থ করার কাজে ব্যবহার করতে পারি।”
তিনি অনুভব করতে পারছিলেন হৃদপিণ্ডের গতি ক্রমশ বাড়ছে। তিনি কি পারবেন তার কার্যে অবিচল থাকতে। ডাঃ জন স্নো বিশ্বাস করেন ঈশ্বর সকলকেই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন বিশেষ কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে। আজ তাঁর ঈশ্বরের কাছে জবাবদিহি করার দিন।
ব্রড স্ট্রীটের হস্ত চালিত জলের পাম্পের সামনে এসে তিনি থামলেন। এদিক ওদিক দেখলেন। কেউ কোথাও নেই। নিশ্চিন্ত হয়ে নিজের কাজ শুরু করলেন।
চারদিক ভয়ংকর শান্ত। দিনের বেলায় এখানে জল নেওয়ার জন্য গরীব শ্রমিকদের লাইন পরে। কোলাহলে রাস্তাটা গম গম করে। আর এই মাঝ রাতে শুধু শোনা যাচ্ছে ইস্পাতে ইস্পাতে ঠোকাঠুকির ধাতব শব্দ। এই শীতেও ডাক্তারবাবুর কপালে ঘাম জমছে।
শেষ পর্যন্ত তিনি পারলেন। খুলে ফেললেন জলের পাম্পের হ্যান্ডেল।
পরেরদিন সকালে হই চই পরে গেল। কে যেন পাম্পের হ্যান্ডেল খুলে ফেলেছে। পুরো নলকূপটাই অকেজো। কে জানে সারাতে কতদিন লাগবে। লন্ডনে কর্পোরেশনের আঠারো মাসে বছর। সে কদিন দূর থেকে জল আনতে হবে। একে ঘাড়ের উপর কলেরার মৃত্যু খাঁড়া। তার সাথে ঘরের পাশের নলকূপটাও খারাপ। কর্পোরেশনকে গালা গালি দিতে দিতে তারা চলল অন্য জায়গায় জলের সন্ধানে।
কিন্ত কি আশ্চর্য। নাটকীয়ভাবে কলেরার মহামারী থমকে গেল তারপরেই। ডাঃ স্নো তখন জনসমক্ষে আনলেন ঘটনাটিকে। বললেন, কলেরা বায়ুবাহিত নয়, এটি আসলে জলবাহিত রোগ।
কিন্ত এর পরেও বৈজ্ঞানিকরা বিশ্বাস করেননি ডাঃ জন স্নো- এর মতবাদ। বিখ্যাত জার্মান বৈজ্ঞানিক ম্যাক্স ভন পেটেনকন এর বিরোধিতা করে বলেছিলেন, কলেরা একটি বায়ুবাহিত রোগ যার উৎপত্তির কারণ জীবাণু, স্থানীয় ও জলবায়ুর অবস্থান এবং এই ধরণের রোগীদের রোগ সংক্রমণের ব্যাপারে অন্তর্নিহিত কোনও দুর্বলতা থাকে।
যদিও পরে ফিলিপো পসিনি, রবার্ট কখ প্রমুখ বিজ্ঞানীরা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করেন কলেরা বায়ু বাহিত নয়, বরঞ্চ জল বাহিত রোগ।
ডাঃ জন স্নোর সেই কলেরা রোগীদের অবস্থান দেখিয়ে লন্ডনের বিখ্যাত মানচিত্রটি epidemiological Society of London – এ রাখা আছে।
Jaya Kundu | unkwn.***.*** | ০৫ জুন ২০১৯ ০৩:১৪78742
dc | unkwn.***.*** | ০৫ জুন ২০১৯ ০৩:৩৪78743
সুব্রত দেববর্মা | unkwn.***.*** | ০৫ জুন ২০১৯ ০৫:০৩78741
b | unkwn.***.*** | ০৫ জুন ২০১৯ ০৫:০৯78744
b | unkwn.***.*** | ০৬ জুন ২০১৯ ০৪:১৩78745