মুর্শিদাবাদের খড়গ্রাম গ্রামীণ হাসপাতাল থেকে এম ডি করতে এলাম আমার পুরনো হাসপাতালে। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ। হাসপাতালে ফিরে রাজ্যের নস্টালজিয়ায় ভুগতে শুরু করলাম। প্যারামাউন্টের শরবত, দিলখুশার কবিরাজি, ভীম নাগের সন্দেশ, পায়রাগলির চা আর কলেজ ক্যান্টিনে বাইশ টাকার চিকেন চাউমিন খেয়ে বেশ কাটছিল।
সন্ধ্যের সময় কলেজ স্ট্রীটের এমাথা থেকে ও মাথা হাঁটতাম। পাতিরামে ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাতাম। মোহণী মোহন কাঞ্জিলালের সামনে দাঁড়িয়ে রাস্তার লোক দেখতাম। ফিরে যেতাম ছয় বছর আগে সেই এম বি বি এসের দিনগুলিতে। এর মধ্যে যে আমি বিয়ে থাওয়া করে ফেলেছি, এমনকি বাবা হয়ে গেছি সেসব কেমন অলীক লাগত।
প্রথম ঘোর কাটল আমার গবেষণা পত্রের প্রস্তাব এথিকাল কমিটিতে পাশ করানোর সময়। দুই রাত্রি জেগে বেশ জম্পেশ করে থিসিসের প্রপোজাল তৈরি করলাম। জমাও দিলাম। পত্রপাঠ এথিকাল কমিটি আমার প্রস্তাব বাতিল করল।
আমার থিসিসের এক জায়গায় ছিল রোগীদের ঠোঁট থেকে লালা গ্রন্থির বায়োপসি করতে হবে। এথিকাল কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, যদি কোনও ভাবে ওই বায়োপসি ব্যাপারটাকে বাতিল করা যায়। কারণ এতে রোগীদের সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
কি কেলেঙ্কারি কাণ্ড। থিসিস ‘জোগরেন সিন্ড্রোম’ নিয়ে। মাইনর স্যালাইভারি গ্লান্ডের বায়োপ্সি করে তাতে শ্বেত রক্ত কণিকার ঝাঁক খুঁজতে হবে। বায়োপ্সি ছাড়া কিভাবে ‘জোগরেন সিন্ড্রোম’ নির্ণয় করা সম্ভব?
সে কথা লিখলাম। কিন্ত থিসিস আবার বাতিল হল। এবার এথিকাল কমিটির সদস্যরা প্রশ্ন তুলেছেন, ‘জোগরেন সিন্ড্রোম একটি বিরল রোগ। ঐ রোগ নির্ণয় করে এমন কি মহাভারত শুদ্ধ হবে?’
আমি রীতিমতো অপমানিত বোধ করলাম। জবাব দিলাম, ‘মহাভারত শুদ্ধ- অশুদ্ধের প্রশ্ন নয়। এই ভাবে গবেষণার মাধ্যমেই বিজ্ঞান এগিয়ে চলে। প্রকৃত বিজ্ঞানী লাভ লোকসানের চিন্তা করে না।’
আবার বাতিল। রীতিমতো অপমান জনক ভাষায় আমার উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, বিজ্ঞানের অগ্রগতির দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নেওয়ার আগে প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতে। এই লিপ বায়োপ্সিতে ঝুঁকি কিরকম? এই ঝুঁকি নেওয়ার পর রোগীরা কিভাবে লাভবান হবেন। জোগরেন সিন্ড্রোম ধরা পরলে তার চিকিৎসার ক্ষেত্রে কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে... ইত্যাদি, ইত্যাদি।
গ্রামীণ হাসপাতালে রোজ পাঁচশ রোগী দেখতাম, সতেরোটা থেকে কুড়িটা প্রসব করাতাম। লাইগেশন ক্যাম্প প্রতি একাই পঞ্চাশ থেকে ষাটটা বন্ধ্যত্ব করনের অপারেশন করতাম। জনা দশেক মারমুখী জনতাকে ঠিক ম্যানেজ করে নেব, কিন্তু এই এথিকাল কমিটির লোকদের কিভাবে ম্যানেজ করব বুঝতে পারছিলাম না।
এদিকে থিসিস এর প্রপোজাল জমা দেওয়ার শেষ দিন চলে আসছে। বাধ্য হয়ে আমার গাইড প্রফেসর (ডাঃ) এস বি গাঙ্গুলির শরণাপন্ন হলাম।
ডাঃ গাঙ্গুলি সব শুনে বললেন, ‘দ্যাখ ঐন্দ্রিল, আমি বললে হয়ত এথিকাল কমটির সদস্যরা মেনে নেবেন। তোর মুখ চেয়ে সেটা আমি করে দিতে পারি। কিন্তু তার আগে তুই একটা প্রশ্নের উত্তর দে। তুই কি ডাঃ জোসেফ মেঙ্গেলের নাম শুনেছিস?’
‘তিনি খুব বিখ্যাত ডাক্তার বুঝি?’
‘বিখ্যাত নয়, কুখ্যাত। ডাঃ মেঙ্গেলে একজন জার্মান চিকিৎসক ছিলেন। নাৎসি বন্দি শিবিরে তিনি বন্দীদের উপর নানারকম অমানবিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। তার জন্য তিনি অ্যাঞ্জেল অফ ডেথ নামে পরিচিত।’
খানিকক্ষণ চুপ করে ডাঃ গাঙ্গুলি বললেন, ‘তুই আজ নাৎসি বন্দি শিবিরগুলিতে যে সব মেডিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট হয়েছিল তাই নিয়ে পড়াশুনো কর। কাল আমাকে বলিস। তখন আমি না হয় কমিটির লোকজনকে রিকোয়েস্ট করব তোর থিসিসের প্রপোজাল আটকে না রাখতে।’
যাহ... বাব্বা। আমার থিসিসের সাথে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের কি সম্পর্ক। বাড়ি ফিরে হ্যারিসন না খুলে ল্যাপটপ খুললাম। সার্চ দিলাম ‘হলোকাস্ট- মেডিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট’।
গুগুল আমায় হাজার হাজার সাইটের ঠিকানা দিল। পড়াশুনো শুরু করলাম।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিঃসন্দেহে মানব সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কলঙ্ক। এই যুদ্ধে ‘মিত্র শক্তি’ বা ‘অক্ষ শক্তি’ কোনও পক্ষই নিষ্ঠুরতার দিক থেকে পিছিয়ে ছিল না। আমেরিকা হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা ফেলে লক্ষাধিক সাধারণ মানুষকে মারার আগে একবারও ইতস্তত করেনি। অন্যদিকে জার্মান একনায়ক অ্যাডলফ হিটলার জাত্যভিমানে সুড়সুড়ি দিয়ে পৈশাচিক ইহুদী নিধনযজ্ঞ চালিয়েছিলেন, যাতে প্রায় ষাট লক্ষ ইহুদী প্রাণ হারিয়েছিলেন।
নাৎসি বাহিনী ইহুদী ও যুদ্ধ বন্দীদের মারার কৌশল নিয়ে রীতিমত গবেষণা করেছিল। কিভাবে সহজ উপায়ে এবং কম খরচে বেশী সংখ্যক মানুষ মারা যায়। কিন্তু সেসব নয়, আজ আমার পড়াশুনোর বিষয় নাৎসি শিবিরের মেডিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট।
কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দী করে আনা ইহুদীদের উপর হিটলার বাহিনীর চিকিৎসকেরা নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতেন। তাদের পরীক্ষার বিবরণ শুনলে মনে হবে, তারা বুঝি মানুষ নয়, বরং কোনও কুকুর, শেয়াল কিংবা বানরের উপর পরীক্ষা চালাচ্ছিলেন। ইচ্ছামতো মানুষ মেরে তার দেহ নিয়ে গবেষণা হতো তখন। যেন সেগুলো খেলনা পুতুল। খেলা শেষ তো ফেলে দাও!
প্রথম মেডিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট নিম্ন তাপমাত্রা সংক্রান্ত পরীক্ষা। ইস্টার্ন ফ্রন্টে গিয়ে জার্মান বাহিনী যে ধরনের শীতের মুখোমুখি হয়, তার জন্য তারা একেবারেই প্রস্তুত ছিলো না। ফলে মারা যায় হিটলার বাহিনীর হাজার হাজার সৈন্য। এর প্রতিকার খোঁজার চেষ্টা করেন জার্মান চিকিৎসকরা। বার্কন, অসউইৎজ ও ডাকাউ ক্যাম্পের বন্দীদের উপর পরীক্ষা চালানো হয়। উদ্দেশ্য ছিলো মূলত দুটি- শরীরের তাপমাত্রা কমতে কমতে কতক্ষণে একজন বন্দী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সেই সময়টি বের করা এবং যারা সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়, তাদেরকে কিভাবে পুরোপুরি সুস্থ্য করে তোলা যায় তার উপায় খোঁজা।
এজন্য ইহুদী বন্দীদের উলঙ্গ করে বরফ পূর্ণ চৌবাচ্চা কিংবা হিমশীতল জলে ডুবিয়ে রাখা হতো। কখনো আবার বাইরের মারাত্মক ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় উলঙ্গ অবস্থাতেই ছেড়ে দেয়া হতো। অধিকাংশ বন্দীই এতে মারা যেত। যারা বেঁচে যেত, তারা হয়তো তাদের মৃত সঙ্গীদের সৌভাগ্যবান ভাবতো। কারণ সেই বেঁচে যাওয়াদের উপরই শুরু হতো আসল পরীক্ষা।
পুনরুজ্জীবিত করতে বন্দীদের মারাত্মক উত্তপ্ত ল্যাম্পের নিচে রাখা হতো যাতে পুড়ে যেত তাদের চামড়া। শরীর উত্তপ্ত করতে এমনকি তাঁদের কোনও নারীর সাথে দৈহিক মিলনে বাধ্য করা হতো। তাদের গরম জল খাওয়ানো হতো কিংবা গরম জলে ডোবানো হত।
সমুদ্রের লবণাক্ত জলকে পানযোগ্য করা যায় কিনা তাই নিয়ে চালানো পরীক্ষাতে গিনিপিগ হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছিলো ডাকাউ ক্যাম্পের বন্দীদের। বন্দীদের চারটি দলে ভাগ করে নেয়া হতো। এগুলো হলো- ১) কোনও জল নয়, ২) কেবলমাত্র সমুদ্রের জল, ৩) বার্কা পদ্ধতিতে শোধন কৃত সমুদ্রের জল এবং ৪) লবণ মুক্ত সমুদ্রের জল।
এ সময় বন্দীদেরকে কোনও খাবার কিংবা দলের জন্য নির্ধারিত জল ছাড়া অন্য কোনও পানীয়ও দেয়া হতো না। বন্দীরা নানারকম শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত হতো। ডায়রিয়া, কনভালশন, হ্যালুসিনেশন, উন্মত্ততা ইত্যাদির পর একসময় তারা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো।
এছাড়াও নাৎসি বন্দি শিবিরগুলিতে নানারকম পৈশাচিক পরীক্ষা করা হত। কিছু অমানুষ চিকিৎসক তাঁদের যত রকম অদ্ভুত অদ্ভুত ও বীভৎস পরিকল্পনা, সবই প্রয়োগ করেছেন বন্দীদের উপরে।
যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যদের অঙ্গহানি হত। কারো হাত, কারো পা বাদ গিয়ে সৈন্যরা পঙ্গু হয়ে পরত। চিকিৎসকরা সেই অঙ্গ প্রতিস্থাপনের কথা ভেবেছিলেন। তাঁরা চিন্তা করেছিলেন ইহুদী বন্দিদের হাত পা কেটে সেটা জার্মান সৈন্যদের দেহে প্রতিস্থাপন করবেন।
যা ভাবা, তাই কাজ। ইহুদী বন্দীরা তাঁদের কাছে গিনিপিগের চেয়ে বেশী কিছু ছিল না। বিনা এনাস্থেসিয়ায় বন্দীদের হাত পা কেটে একজনেরটা অন্যজনের দেহে লাগানো হত। বলা বাহুল্য অসীম কষ্ট পেয়ে সকলেরই মৃত্যু হত।
ডাকাউ ক্যাম্পের ডাক্তার সিগমুন্ড র্যা শার দাবী করলেন তিনি রক্ত বন্ধ করার ওষুধ আবিষ্কার করেছেন। এর কার্যকারিতা পরীক্ষা করা দরকার। প্রায় একশত ইহুদীকে এই ওষুধ খাওয়ানো হল। কিছু সময় বাদে পরীক্ষা শুরু হল। কাউকে গুলি করে সরাসরি হত্যা করা হল। কারো হাতে পায়ে গুলি করা হল। কারো হাত, পা বা দেহের অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কেটে ফেলা হল। লক্ষ রাখা হল রক্ত জমাট বাঁধতে কত সময় লাগছে। বলাই বাহুল্য ওষুধটির কোনও কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়নি এবং এই ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে সকলেই মারা পড়েছিল।
জার্মান চিকিৎসকদের যে মেডিক্যাল এক্সপেরিমেন্টটি কিছুটা সাফল্যের মুখ দেখেছিল, সেটা হল সালফোনামাইডের এন্টিবায়োটিক হিসাবে ব্যাবহার। এক্ষেত্রে বন্দীদের দেহে অস্ত্রের আঘাতে বীভৎস ক্ষত তৈরি করা হত। সেই ক্ষত বিষিয়ে ওঠার পর ওষুধ হিসাবে সালফোনামাইড ব্যবহার করা হত।
তাছাড়াও স্পটেড ফিভারের ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়েছিল। ভ্যাকসিনটি একেবারেই কার্যকারী ছিল না। পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রায় নব্বই শতাংশ ইহুদী স্পটেড ফিভারে মারা যায়। বাকিদের গ্যাস চেম্বারে পাঠানো হয়েছিল। প্রায় একই পরিণতি হয়েছিল ম্যালেরিয়া ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে।
আরেকটি ভয়ংকর পরীক্ষা ছিল বিষের কার্যকারিতা দেখার। বন্দীদের উপর নানা রকম বিষ প্রয়োগ করা হত। তারপর দেখা হত মৃত্যুর আগে তাদের মধ্যে কি লক্ষণ প্রকাশ পায়। কোন বিষ কত মাত্রায় প্রয়োগ করলে মৃত্যু ঘটতে কত সময় লাগে।
এছাড়াও মানুষ কতদিন সম্পূর্ণ অনাহারে বেঁচে থাকতে পারে, কত উষ্ণতা পর্যন্ত সহ্য করতে পারে, সর্বোচ্চ কত উচ্চতায় উঠে বেঁচে থাকতে পারে এসবও ছিল গবেষণার বিষয় বস্তু। এবং এই সব পরীক্ষায় অংশ নেওয়া প্রায় কোনও মানুষই পরীক্ষার শেষে বেঁচে থাকত না।
তবে নিষ্ঠুরতায় সবাইকে ছাড়িয়ে গেছিলেন ডাঃ জোসেফ মেঙ্গেলে। তিনি ছিলেন কুখ্যাত অসউইৎজ ক্যাম্পের চিফ মেডিক্যাল অফিসার। তিনি যথেষ্ট উচ্চশিক্ষিত। ফ্রাঙ্কফুর্ট ইউনিভার্সিটি থেকে এম ডি করার সময় তার থিসিসের বিষয় বস্তু ছিল যমজ বাচ্চাদের মধ্যে ক্লেফট লিপ, ক্লেফট প্যালেটের (ঠোঁট ও তালু কাটা) ক্ষেত্রে জেনেটিক ফ্যাক্টরের ভূমিকা। যমজ বাচ্চাদের উপর তার একাধিক গবেষণা সেসময়য়ের বিখ্যাত সব মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল।
তিনি অসউইৎজ ক্যাম্পে আগত বন্দীদের মধ্যে কে কাজ করার যোগ্য আর কে নয় তা নির্বাচন করতেন। বৃদ্ধ, শিশু, অসুস্থ মানুষ ও গর্ভবতী মহিলাদের আলাদা করা হত। তাদের সরাসরি হত্যা করা হত। বয়স্কদের গ্যাস চেম্বারে পাঠিয়ে আর শিশুদের জীবন্ত অবস্থায় আগুনে ছুড়ে ফেলে।
ডাঃ মেঙ্গেলে অন্যদের সাথে হাসি ঠাট্টা করতে করতে এই নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করতেন। তিনি ছিলেন সুদর্শন। কোনও রকম নেশা করতেন না। অচিরেই তিনি সকলের কাছে অ্যাঞ্জেল অফ ডেথ নামে পরিচিত হন।
তিনি শিশুদের মধ্যে থেকে যমজ বাচ্চাদের আলাদা করতেন। এবং এই যমজ বাচ্চাদের উপর তিনি নানা রকম গবেষণা করতেন। এজন্য তিনি একটি জার্মান রিসার্চ ফাউন্ডেশন থেকে অর্থ সাহায্যও পেয়েছিলেন।
প্রতিদিন রুটিন করে যমজদের রক্তের নমুনা নেয়া হতো। যমজদের শরীর অত্যন্ত নিখুঁতভাবে পরীক্ষা করা হতো। তাদের শরীরের প্রতিটি অংশের মাপ নেয়া হতো যথাসম্ভব নির্ভুলভাবে। কখনো কখনো একজন থেকে আরেকজনের শরীরে রক্ত সঞ্চালনও করা হতো মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে।
যমজদের একজনের শরীরে টাইফাস বা অন্য কোনও রোগের জীবাণু প্রবেশ করানো হতো। যদি সে মারা যেত, তাহলে অপরজনকেও মেরে ফেলা হতো দুজনের শারীরিক বিষয়াবলীর তুলনামূলক গবেষণার জন্য। চেতনা নাশক ছাড়াই অনেকের বিভিন্ন অঙ্গ কেটে ফেলা হতো। এবং একজনের অঙ্গ অন্যজনের দেহে প্রতিস্থাপনের চেষ্টা করা হত।
তাঁর আরেকটি পরীক্ষা ছিল চোখের রঙ পরিবর্তনের। তিনি যমজ বাচ্চাদের চোখে নানা রকম রঞ্জকের ইংজেকশন দিতেন। তারপর সেই চোখ তুলে বার্লিনে পাঠানো হত পরীক্ষার জন্য। বিকলাঙ্গ শিশুদের হত্যা করে তাঁদের কংকালও বার্লিনে পাঠানো হত।
দুঃখের বিষয় এই অমানবিক চিকিৎসক শাস্তি পাননি। তিনি পালিয়ে গিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে অন্য পরিচয়ে বাকি জীবন কাটান। ১৯৭৯ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি বৃদ্ধ বয়সে তিনি হার্ট এটাকের ফলে মারা যান।
১৯৪৭ সালে নুরেমবার্গে নাৎসি যুদ্ধ বন্দীদের বিচারের সময় উঠে আসে কিভাবে বন্দী শিবিরগুলিতে অমানবিক হিউম্যান এক্সপেরিমেন্ট হয়েছিল। এবং তখনই প্রথম চিকিৎসা শাস্ত্রে হিউম্যান এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে এথিকাল কমিটির ভাবনা আসে।
নুরেমবার্গ কোড চালু হয়। এতে ১০ টি বিষয়ের উল্লেখ আছে।
১. স্বেচ্ছায় লিখিত সম্মতি নিতে হবে।
২. পরীক্ষার ফলাফল সমাজের ভালোর জন্য ব্যবহার হবে।
৩. মানুষের উপর কোনও পরীক্ষা করার আগে তা জন্তুদের উপর করতে হবে।
৪. পরীক্ষার সময়ে কোনও ভাবেই কারো মানসিক বা শারীরিক ক্ষতি করা যাবে না।
৫. মানুষের মৃত্যু বা পঙ্গুত্ব হতে পারে এমন কোনও পরীক্ষা করা যাবে না।
৬. ঝুঁকি কখনই পরীক্ষা লব্ধ লাভকে ছাড়িয়ে যাবে না।
৭. যার উপর পরীক্ষা করা হবে তাকে রক্ষা করার সব ব্যবস্থা থাকতে হবে।
৮. একমাত্র উপযুক্ত চিকিৎসকই পরীক্ষার অনুমতি পাবেন।
৯. যার উপর পরীক্ষা হবে সে যখন খুশি এই পরীক্ষা থেকে অব্যাহতি চাইতে পারে।
১০. কারো কোনও ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিলে সাথে সাথে পরীক্ষা বন্ধ করতে হবে।
ল্যাপটপ যখন বন্ধ করলাম, তখন ভোরের আলো ফুটবে ফুটবে করছে। খাতা কলম নিলাম। এথিকাল কমিটি আমার থিসিস নিয়ে যে প্রশ্ন গুলি তুলেছে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা লিখব। ডাঃ গাঙ্গুলি স্যারকে বলব যত সময়ই লাগুক, কমিটির সব মেম্বারকে সন্তুষ্ট করেই আমি থিসিসের অনুমতি আদায় করব। তার জন্য ওনাকে কাউকে বলতে হবে না।