
জীবনপুরের পথিক
১৯২৬ সাল। নিউইয়র্কের ট্রুডিউ টিবি স্যানিটোরিয়াম। পাশেই বিশাল সারেনাক লেক। অফুরন্ত প্রাকৃতিক শোভা। কিন্তু টিবি স্যানিটোরিয়ামের বাসিন্দারা এইসব প্রাকৃতিক শোভা-টোভা নিয়ে মাথা ঘামান না।
তাঁদের কাছে সবকিছুই সাদা কালো। সারাদিন তাঁরা উপাসনা করেন, নয়তো জ্বরের তাড়সে অচৈতন্য হয়ে থাকেন, অথবা কাশতে কাশতে রক্ত তোলেন, আর প্রতীক্ষা করেন সর্বরোগ হরা মৃত্যুর।
শুধু একজন অন্যরকম। তিনি সারাদিন ধরে পড়াশুনো করেন। আর রাত জেগে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখেন।
লোকটির চেহারা খুবই সাধারণ। ক্ষয় রোগ সেই চেহারার অবস্থা আরও খারাপ করেছে। কিন্তু তাঁর চোখ দুটি অসম্ভব উজ্জ্বল। হাসপাতালের জুনিয়ার রেসিডেন্ট ডাঃ জন ফিলিপস সিনিয়র ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘উনি কে? সারাদিন কি এতো পড়েন?’
‘উনি একজন কানাডিয়ান ডাক্তার। ডাঃ নর্মান। বর্তমানে উনি পড়ছেন ডাঃ জন আলেকজান্ডারের একটি বই–‘The surgery of pulmonary tuberculosis’।’
‘ভদ্রলোকের মনের জোড় আছে বলতে হবে! এই স্যনিটরিয়ামের অধিকাংশ মানুষই মানসিক অবসাদে ভোগেন। ধর্মগ্রন্থ ছাড়া কিছুই পড়েন না। আচ্ছা উনি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা কি লেখেন?’
‘ওনার স্ত্রী ফ্রান্সেস ক্যাম্পবেল পেনিকে চিঠি লেখেন।’
‘সেই চিঠি পাঠান না কেন?’
‘আসলে ওনার স্ত্রীর সাথে ডিভোর্স হয়ে গেছে। যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়ার পরে নিজেই জোড় করে স্ত্রীকে ডিভোর্স করেছেন।’
‘স্ট্রেঞ্জ…’
‘আরও স্ট্রেঞ্জ ব্যাপার হচ্ছে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েও উনি ভবিতব্য মেনে নিতে চাইছেন না। পাল্টা লড়াই করতে চাইছেন। কয়েকদিন ধরেই আমাকে ধরেছেন একটা নতুন পদ্ধতিতে অপারেশন করে ওনার বাঁ দিকের ক্ষতিগ্রস্ত ফুসফুস চিপসে নিউমোথোরাক্স করে দিতে। আমি চাই তুমি ওনার সাথে একটু কথা বলো। আমার একার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন।’
সেদিন বিকালে দুইজন চিকিৎসক বসলেন মুখোমুখি। ডাঃ নর্মান বেথুন তরুণ চিকিৎসককে বোঝাতে লাগলেন কিভাবে কেমন করে Thoracoplasty আর pneumothorax চিকিৎসা পদ্ধতিতে যক্ষ্মা রোগীকে সুস্থ করে তোলা যেতে পারে।
‘দেখো আমার বাঁদিকের ফুসফুসেই এখনও রোগটা সীমাবদ্ধ আছে। কিন্তু বেশীদিন থাকবে না। বাঁ দিকের ফুসফুস থেকে জীবাণু মজাসে পুষ্টি, অক্সিজেন সংগ্রহ করছে। এবং সংখ্যায় বাড়ছে। কিছুদিনের মধ্যে তারা ছড়িয়ে পড়বে ডানদিকের ফুসফুসে। শরীরের অন্যত্র। তার আগেই বাঁ দিকের ফুসফুসটা নষ্ট করে ফেলতে হবে। যাতে মাইকোব্যাক্টেরিয়াম খাবার দাবারের অভাবে শুকিয়ে মরে যায়। ব্যাপারটা অনেকটা শত্রুবাহিনীর খাদ্য পানীয়ের সরবরাহ আটকে রাখার মতো। একদিন না একদিন শত্রুকে হার মানতেই হবে।’
জন বললেন, ‘আপনার সাহসের প্রশংসা না করে পারছি না।’
নর্মান হাসলেন। বললেন, ‘কি জানি সাহস কাকে বলে! যদি মৃত্যুভয় না পাওয়াকে সাহস বলে, তাহলে আমাকে সাহসী বলতে পারো। টরেন্টো ইউনিভার্সিটিতে ডাক্তারি পড়ার সময় দুবার পড়া ছেড়ে দিয়েছিলাম। ১৯১১ সালে সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে অন্টারিও’তে উদ্বাস্তু খনি শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করেছিলাম। আর ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কানাডিয়ান আর্মির সাথে যোগ দিই। ফ্রান্সের যুদ্ধক্ষেত্রে অ্যাম্বুলেন্সের ট্রেচার বওয়ার কাজ করতাম। বোমার আঘাতে একটা পা বিষিয়ে গেছিল। তিনমাস হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। অসংখ্য তরুণ যুবকে কোনও কারণ ছাড়াই মরে যেতে দেখেছি। মরতে আমি ভয় পাই না, কিন্তু বাঁচতে আমার ভাল লাগে।’
‘একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করব? আপনার এই অবস্থায় স্ত্রীর সাথে জোড় করে বিবাহ বিচ্ছেদ করলেন কেন? উনি পাশে থাকলে আপনি ভরসা পেতেন।’
নর্মান খানিকক্ষণ চুপ করে তারপর মুচকি হাসলেন। বললেন, ‘এখনও তুমি প্রেমে পড়োনি হে ছোকরা। তাহলে এই প্রশ্ন করতে না। কে বলল, ফ্রান্সেস আমার সঙ্গে নেই? বেশী আঁকড়ে ধরলেই বুঝি তাকে ভালোবাসা বলে?’
আবার নীরবতা। নর্মান নীরবতা ভঙ্গ করলেন। ‘ফ্রান্সেস ছিল নম্র, লাজুক, চাপা স্বভাবের। আমি ছিলাম কটুভাষী, অস্থির-উদ্দাম। যা করতাম তা প্রবলভাবে করতাম। ডেট্রয়েটে ডাঃ মার্টিনের সাথে যখন কাজ করতাম, জলস্রোতের মতো পয়সা আসছিল। কিন্তু আমি হতাশায় ভুগছিলাম। রোগীরা সবাই বিত্তবান। সামান্য অসুখেই ডাক্তারের কাছে আসে, হিসাব না করেই ফি দেয়। কিছুদিনের মধ্যেই ধিক্কার জন্মালো নিজের প্রতি। আর যে পথে টাকা রোজগার করছি সেই পথের প্রতি। আমি আবার ফিরে গেলাম ডেট্রয়েটের বস্তি অঞ্চলে। দিন রাত এক করে তাঁদের মধ্যে কাজ শুরু করলাম। সেই সময় শত অভাবেও ফ্রান্সেস আমার স্বাধীনতা হরণ করেনি। একবারও প্রশ্ন তোলেনি কেন আমি রাত্রে ঘরে না ফিরে কোনও বেশ্যা-পল্লীতে কারও সন্তান প্রসব করাচ্ছি। আজ কি করে তাঁর স্বাধীনতা হরণ করব আমি?’
জন অবাক ভাবে তার থেকে বয়সে সামান্য বড় এই চিকিৎসককে দেখছিলেন। মারণ রোগে আক্রান্ত হয়েও কি অদ্ভুত প্রাণ শক্তি তাঁর। তিনি বললেন, ‘একটা প্রশ্ন করি স্যার। এই ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক বৈষম্যের মধ্যে আমাদের চিকিৎসকদের কি কর্তব্য হওয়া উচিৎ?’
‘দেশের প্রতিটি মানুষ যাতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার সুযোগ পায় সে জন্য আমাদের উচিৎ সরকারের কাছে একটি সুনিশ্চিত কর্মসূচি পেশ করা। সে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করার পর যে অবস্থার সৃষ্টি হবে সেটা বিনা প্রতিবাদে মেনে নিতে হবে। আদর্শ জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে প্রথম প্রথম হয়তো অনেক চিকিৎসককেই ক্ষতি স্বীকার করতে হবে। অবশ্য আমার কাছে ক্ষতি কথাটা খুব ছোট মনে হয়। আমি বলি আত্মদহন। ফিনিক্স পাখি নিজেকে দহনের মধ্য দিয়ে যেমন নিজের মধ্যে নতুন প্রাণ সৃষ্টি করে, আত্মদহনের মধ্য দিয়ে ঠিক তেমনি আজকের চিকিৎসকরা ভবিষ্যতে একদিন চিকিৎসাশাস্ত্রের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় সৃষ্টি করবে।’
জন নর্মান বেথুনের হাত আঁকড়ে ধরল। বলল, ‘আপনাকে বাঁচতেই হবে।’
নর্মান বললেন, ‘যদি না বাঁচি চিঠি কটা পুড়িয়ে ফেলো। আর হ্যাঁ, অপারেশনের জন্য কয়েকটি যন্ত্রের পরিকল্পনা আমি করেছি। সেগুলো বানানোর জন্য কিছু কাঁচা মাল আর একটু সাহায্য লাগবে।’
স্যানিটোরিয়ামে বসে তিনি নিজের উপর অপারেশনের জন্য কিছু নতুন যন্ত্রপাতি তৈরি করেন। পরবর্তী কালে সে সব যন্ত্র থোরাসিক সার্জেনদের কাছে ভীষণ জনপ্রিয়তা পায়। তার মধ্যে বেথুন রিব শিয়ার্স একশো বছর পরেও আজও থোরাসিক সার্জারির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
তাঁর পরিকল্পনা মতোই বাঁ দিকের ফুসফুস চুপসে নিউমোথোরাক্স করে দেওয়া হয় এবং বাঁ দিকের প্লুরোডেসিস করা হয়। এবং মাত্র দুমাসের পরেই তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন।
সুস্থ হয়ে তিনি ফ্রান্সেস ক্যাম্পবেল পেনিকে পুনরায় বিবাহ করেন এবং বেশ দীর্ঘ সময় ধরে মন্ট্রিরিয়েলের রয়াল ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে একজন থোরাসিক সার্জেন হিসাবে কাজ করেন। এসময় তার অসংখ্য গবেষণা পত্র বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়। তিনি এক ডজনেরও বেশী থোরাসিক সার্জারির যন্ত্রপাতি তৈরি করেন যা সারা বিশ্বে সার্জেনদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অর্থ আর খ্যাতি আসতে থাকে জল স্রোতের মতো।
কিন্তু ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন তিনি। কারণ তিনি আবিষ্কার করেছিলেন যক্ষ্মা রোগের মূল উৎস জীবাণু নয়, দারিদ্র্য। দেশজুড়ে অর্থনৈতিক, সামাজিক বিপর্যয় আর বৈষম্য। একদল মানুষের জীবনে আছে সীমাহীন বিলাসিতা আরেকদল অনাহারক্লিষ্ট। তাঁর কথায় ডাক্তারি করা মানে স্বাস্থ্য বেচা নয়। ডাক্তারের কাজ রোগের উৎস সন্ধান করা।
ফ্রান্সেসকে আবার জোড় করেই ডিভোর্স করে তিনি ছুটে গেলেন স্পেনে। প্রথম মোবাইল ব্লাড ব্যাঙ্ক তৈরি করে ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার জীবন বাঁচিয়েছেন। তারপর হয়েছেন মহা চীনের পথিক। এবং চিনের এক অখ্যাত গ্রামে সেপ্টিসেমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শত্রু ব্যূহের মধ্যে মৃত্যুবরণের আগে শেষ অসমাপ্ত চিঠিটিও ফ্রান্সেসকে লিখেছিলেন এই আজন্ম প্রেমিক মানুষটি। ফ্রান্সেস তখন অন্য একজনের ঘরণী।
গবু | unkwn.***.*** | ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৭:০৩78040
দ | unkwn.***.*** | ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৯:৪১78039
aranya | unkwn.***.*** | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১২:৫১78041