২০২৩ সালে ২৮ মে স্বাধীন ভারতের নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন কালে চোল সাম্রাজ্যের রাজদণ্ডের প্রতীক সেঙ্গল প্রতিষ্ঠা করেন প্রজাতান্ত্রিক ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এই সময় একটা বিতর্ক উত্থাপিত হয়েছিল অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতিকে আমন্ত্রণ না জানানো নিয়ে। সমালোচকদের একাংশের দাবি ছিল হিন্দু কুল ঐতিহ্য অনুসারে এই 'পবিত্র' অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত করা হয়নি ভারতীয় সংসদের প্রধান রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু কে। কারণ তিনি উপজাতি জনজাতির মানুষ। বিতর্ক যাই হোক না কেন ঘটনা এটাই যে এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি বিজেপির ভারতের প্রথম 'আদিবাসী' রাষ্ট্রপতিকে।
অথচ ২০২২ সাল থেকে ভারতের ১৫ তম রাষ্ট্রপতি হিসাবে তাঁকে মনোনয়ন দেওয়ার সময় বিজেপির দাবি ছিল দেশের আদিবাসী জনজাতি গোষ্ঠীকে সম্মান ও মর্যাদা দিতেই এই ভূমিকা নিয়েছে তারা। যদিও বিজেপির পক্ষ থেকে এই মনোনয়নকে সন্দেহের চোখেই দেখেছিলেন দেশের বিভিন্ন ব্যাক্তিত্ব। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আদিবাসী জনজাতির ব্যাক্তিত্বকে সামনে রেখে মোদী সরকার আদতে আদিবাসীদেরই সর্বনাশের ফাঁদ পাতছেন কিনা সেই নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব এবং স্বাধীন ভারতে জন্মগ্রহণকারী প্রথম রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর কার্যকালের দু'বছরের মধ্যেই সমস্ত প্রশ্ন ও সন্দেহের নিরসন ঘটেছে। দেশের বিস্তৃত অরণ্যের একটা বড় অংশই লুণ্ঠনের দায়িত্ব নরেন্দ্র মোদী তুলে দিয়েছেন তাঁর কাছের মানুষ সেই আদানি এণ্ড কোম্পানির হাতেই। শুরু হয়ে গেছে নির্বিচার অরণ্য ছেদন।
২০১৮-র ডিসেম্বরে পার্লামেন্টে সরকার জানায় যে, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে মোট ২০,৩১৪.১২ হেক্টর বনভূমি কর্পোরেট সংস্থার হাতে খনিজ পদার্থ উত্তোলনের জন্য তুলে দেওয়া হয়েছে। যদিও আদিবাসীদের আন্দোলন, গ্রামসভা গুলির আপত্তি ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে কর্পোরেট সংস্থাগুলোর পক্ষে কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় কিছু সমস্যা হচ্ছিল, বিশেষ ছত্তিশগড়ের গভীর অরণ্য বেষ্টিত আদিবাসী জনজাতি নির্ভর এলাকাগুলিতে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে ছত্তিশগড়ে বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসকে পরাজিত করে সরকার গঠন করে বিজেপি। এখানেও কায়দা করে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী করা হয় বিজেপির আদিবাসী নেতা বিষ্ণু দেও সাই কে। ২০২৪ ডিসেম্বর মাসে শপথ নেন তিনি আর জানুয়ারি থেকেই গৌতম আদানির কোম্পানি শুরু করেছে নির্বিচার অরণ্য নিধন।
২০১৯-র মার্চ মাসে আদানিদের কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল হাসদেও-আরন্দ বনভূমির ১ লক্ষ ৭০ হাজার হেক্টর (১৭০০ বর্গ কিলোমিটার) বনভূমি। ভারতের মধ্যভাগের এই অঞ্চলকে গন্দোয়ানাল্যান্ড হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের বহু আগে যে আদিম মহাদেশ থেকে ভারত ভূখণ্ড তৈরি হয়েছিল সেই আদিম মহাদেশ ছিল এই গন্ডোয়ানাল্যান্ড। একসময় এই অঞ্চলটি ‘নো গো’ অঞ্চলভুক্ত হওয়ায় ওখানে যে কোনো ধরনের প্রকল্প রূপায়ণ আইনবিরুদ্ধ কাজ বলে চিহ্নিত করা হয়। মোদী গদিতে বসার পর থেকেই সেই সব বিধি নিষেধ শিথিল করা হতে থাকে। মধ্য ভারতের এই প্রাচীন বনভূমির তলায় রয়েছে বিশাল কয়লা ভান্ডার। লুটেরা কর্পোরেট সংস্থাগুলোর চোখ ছিল ওই অঞ্চলের দিকে। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী হিসেবে আদানিরা সেই সুযোগ নেয়।ছত্তিশগড়ের সাতটি কয়লা খনির পাশাপাশি দুটি লোহা আকরিক খনির মালিকানা অর্জন করে গৌতম আদানির কোম্পানি। দেখা যাচ্ছে এই প্রক্রিয়ার ফলে দেশের মধ্যদিয়ে ব্যক্তিগত মালিকানায় এটি দেশের বৃহত্তম খনি-অঞ্চলের দখল নিয়েছে এই আদানিরাই। । ভারত সরকারের কয়লা মন্ত্রক হাসদেও অরণ্যে তিরিশটি কয়লা ব্লক চিহ্নিত করেছে।
ভারতের অরণ্য গবেষণার সর্ববৃহৎ এবং একমাত্র সরকারি বন গবেষণা সংস্থা ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ ফরেস্ট্রি রিসার্চ অ্যান্ড এডুকেশন ( আইসিএফআরই)-এর সাম্প্রতিক প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, এই অঞ্চলের প্রস্তাবিত কয়লা ব্লক কম করে ১৪টি ঘন বনাঞ্চলের মধ্যে অবস্থানের কারণে সেগুলিকে ছাড়পত্র দেওয়া উচিত নয়।
আইসিএফআরই বলছে, “খনির সাথে সম্পর্কিত ভূমি-ব্যবহারের পরিবর্তনগুলি বনের আচ্ছাদন/ঘনত্ব, বনের ধরন এবং অরণ্যকে খণ্ডিত করে বড়ো পরিমাণ ক্ষতি করবে। শুধু তাই নয় জঙ্গল বিভাজনের ফলে বন্য প্রাণীদের যাতায়াতের পথের প্রভূত ক্ষতিসাধন হবে। খণ্ডিত বনভূমির প্রান্তীয় প্রভাব অর্থাৎ বনভূমির প্রান্তে মনুষ্যকৃত বা অন্যন্য ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব বৃদ্ধি পাবে। এর ফলস্বরূপ বনভূমির মধ্যে মাইক্রোক্লাইমেটের পরিবর্তন এবং বিভিন্ন ধরনের আক্রমণাত্মক প্রজাতি-র প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাবে।”
অন্যদিকে এই অঞ্চলের গ্রামবাসীদের দাবি হলো যে, এই ধরনের এক গুরুত্বপূর্ণ বনভূমি এবং বিভিন্ন উপজাতির যেমন, গোন্ডদের মতো একটি আদিম বনবাসী গোষ্ঠীর বাসভূমি হওয়ার কারণে ভূমিব্যবহারে যে কোনো পরিবর্তনের আগে এখানকার বনবাসী-আদিবাসীদের সঙ্গে আলোচনা জরুরি ছিল। তাদের দাবি হলো, বন অধিকার আইন-২০০৬ অনুযায়ী এই আলোচনা বাধ্যতামূলক। খনি স্থাপনের আগে সংশ্লিষ্ট গ্রামসভাগুলির লিখিত সম্মতিপত্র জরুরি ছিল। সালহি, হরিহরপুর, ফতেহপুর এবং ঘাটবাড়ার ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলিতে ব্যক্তি ও সম্প্রদায়ের অরণ্য অধিকারের নিষ্পত্তি এখনও হয়নি।
এই ঘটনাগুলি সামনে আসার পরে, ছত্তিশগড় বাঁচাও আন্দোলন এবং ছত্তিশগড় বন অধিকার ফোরাম এই বিষয় সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ জানায়। কিন্তু এখনও কোনো সুরাহা হয়নি। কেন্দ্রীয় সরকার শুধুমাত্র কর্পোরেটদের মুনাফা নিশ্চিত করার জন্য আদিবাসী- বনবাসীদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এসেছে শুধু নয়, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার উদ্যোগও ইতিমধ্যে অনেক দূরে সরে গেছে। এটি প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই প্রতারণা সংবিধানের পঞ্চম তপশিলে হাসদেও-আরন্দের আদিবাসী-বনবাসী সম্প্রদায়ের প্রতি সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘনের এক স্পষ্ট নজির। এই একই চলছে ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ সহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। শুধু যে অরণ্য নিধন ও সেই সম্পর্কিত পরিবেশ প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে তা নয় পাশাপাশি এই জঙ্গল উচ্ছেদের ফলে আদিবাসী জনজাতি ও বিভিন্ন বনবাসী গোষ্ঠীগুলোর জীবন জীবিকা বিপন্ন হচ্ছে।