লোক ঠকানর কত বুদ্ধিই যে বাংলাদেশে চালু আছে! কিছুদিন আগে ঢাকায় এক রিকশাওয়ালা শুনিয়েছিল এক গল্প। যাত্রী ভদ্র মানুষ, সাথে ব্যাগ আছে। যাত্রা পথে একটু রিকশা দাঁড় করিয়ে একটা শপিং মলে ঢুকেছে। ভদ্রলোক রিকশাওয়ালার কাছেই কিছু টাকা চাইছে। বলল সামনে বুথ থেকে তুলে দিয়ে দিবে। রিকশাওয়ালা সরল মনে সাথে যা ছিল সব দিয়ে দিছে। যাত্রী ব্যাগ রিকশায় রেখে যাচ্ছে, সমস্যা কী? তিনি তো ফিরবেনই! কিন্তু তিনি আর ফিরেন নাই। হাওকাও করে যখন ব্যাগের তল্লাসি নেওয়া হল দেখা গেল ব্যাগটা একটা ছেঁড়া ব্যাগ, ভিতরে দুইটা ইট, পুরাতন কাপড় রাখা! কত নিয়েছে? পাঁচ সাতশ হবে! মানুষের বিবেক কোন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে!
এমন গল্প ঢাকায় প্রায়ই শোনা যায়। সবাই ভদ্রলোকের মতো পোশাক পরা, রিকশাওয়ালারা বিশ্বাস না করে পারে না। কিন্তু ভাড়া না দিয়ে যাওয়া এক জিনিস আর উল্টা তাঁর কাছ থেকেই টাকা নিয়ে কেটে পড়া! অবিশ্বাস্য না? কিন্তু এই ব্যবসা এখন উল্টা মোচড় নিয়েছে। এখন রিকশায় উঠলেই এই গল্প শুরু করে রিকশাওয়ালারা! আশ্চর্য! দুনিয়ার সব রিকশাওয়ালা ধরা খেয়েছে আর সব ধরা খাওয়া রিকশাওয়ালারাই আপনের কপালে এসে জুটছে? না, এই ধরণের গল্প বলে রিকশাওয়ালারা যাত্রীর সহমর্মিতা আদায় করে, যার একটুও সামর্থ্য আছে সে ভাড়ার চেয়ে যতটুকু পারে বেশি দেওয়ার চেষ্টা করে। পঞ্চাশ টাকা ভাড়া, আচ্ছা, তুমি একশ রাখ, বেশি নাই, বাড়তি বিশ টাকাই রাখো! রিকশাওয়ালারা এখন উল্টো ধান্দাবাজি শুরু করেছে। সবারই মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়েছে, মেয়েটা পড়াশোনায় ভালো মামা, সরকারি পলিটেকনিকে সুযোগ হইছে! মা মরা মেয়ে, বিয়ে দিয়ে দিচ্ছি, ছেলের পরীক্ষা ফি ইত্যাদি ইত্যাদি! অবশ্যই প্রকৃত অভাবই রয়েছে। কিন্তু নতুন এই ধান্দাবাজদের জন্য তাঁরা মারা খেয়ে সারা হয়ে যাচ্ছে!
মোবাইলে ফোন দিয়ে লোক ঠকানো সম্ভবত দুনিয়া জুড়েই চালু। আমার এক বন্ধু আমেরিকা থাকে। ও বলল সেখানেও আছে এরা। ওরা না কি ফোন দিয়ে কোন এলাকায় বাড়ি জিজ্ঞাস করে। যে এলাকায় বাড়িই বলুক সে বলবে আরে আমিও তো এখনেই আছি। তো আমার বন্ধুকে এমন বলার পরে ও বলছে আমি নোয়াখালী আছি, সাথে সাথে উত্তর আরে আমিও তো নোয়াখালী! কতটা সত্য আর কতটা ওর বানানো জানি না, তবে শুনে আমার হাসতে হাসতে মরার দশা হয়েছিল।
লোক ঠকানোর এই ব্যবসা অনেক আগে থেকেই চালু আছে আমাদের দেশে। আগে মোবাইল ব্যাংকিং ছিল না। তখনকার এক কাহিনী শুনলাম। আমাদের শেরপুরের অন্যতম সেরা অর্থ সম্পদশালী মানুষ, তিনি আসছেন গ্রামীনফোন সেন্টারে, কেউ একজন তাঁকে ফোন দিয়ে কী বুঝ দিয়েছিল আল্লা মালুম, তিনি কয়েকটা নাম্বারে চল্লিশ পঞ্চাশ হাজার টাকার স্ক্র্যাচ কার্ড ঘষে নাম্বার পাঠিয়েছন! এখন যখন বুঝেছে যে ধরা খাওয়া সারা তখন এসে ওই নাম্বারের ঠিকুজি খোঁজার চেষ্টা করছেন! ওর মতো লোকেরও আরও পাওয়ার লোভ!
আমার খালার ফোনে ফোন আসল একটা। উনার বিকাশ ( বাংলাদেশের অন্যতম সেরা মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান) একাউন্টের পিন নাম্বারে সমস্যা হয়েছে, ঠিক করাতে হবে। খালার সাথে কথা বলে ওরা বুঝছে এই মহিলা এগুলা কম বুঝে। ওদের আত্মবিশ্বাস এতো যে তারা বলছে যে বুঝে তার কাছে নিয়ে যান। খালা আমার কাছে আসতেছিল পথে মধ্যে আরেক 'বিশেষ ভাবে অজ্ঞ' একজনের সাথে দেখা, তিনি তাদের সাথে কথা বলে যেমন যেমন করতে হয় তেমন তেমন করে কাজ সমাধা করেছেন। খালা এরপরে আসছে আমার কাছে। এসে বলল তোমার কাছেই আসতেছিলাম, বিকাশের পিন ঠিক করতে হব বলে, পথে অমুকের সাথে দেখা, ও ঠিক করে দিল! আমি শুনেই বুঝলাম এইটা গন কেস! বললাম, খালা বিকাশে টাকা কত ছিল? খালা বলল চার পাঁচ হাজারের মতো। আমি বললাম, ব্যালেন্স দেখেন, সম্ভবত এক টাকাও নাই! খালা বলে আরে না, ওরা তো পিন ঠিক করার জন্য বলছে। আমি বললাম, আপনে দেখেন! দেখা হল, ফিনিশ! এক টাকাও নাই!
খালার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে তা হচ্ছে অজ্ঞানতা। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় মানুষ লোভের ফাঁদে পড়ে। নানান প্রলোভন, এতো টাকা বিকাশ করলে এতো টাকা বোনাস! আর এই লোকেরা দুর্দান্ত ক্রিয়েটিভ হয়ে থাকে। আপনার পিন আমি চাচ্ছি না, আপনে শূন্য দিন, আবার শূন্য দিন, এবার কত টাকা আছে লেখেন ব্লা ব্লা ব্লা! যারা ধরা খায় তারা নিজেকে অতি অবশ্যই অতি চালাক ভাবে। ভাবে এই জিনিস আমার কপালে আসছে, আমি আগে টাকাটা নিয়ে নেই, পরে সবাইকে বুঝিয়ে বলতেছি। আমি একজনের সাথে প্রায় মারামারি শুরু করেছিলাম। ওকে বুঝাইতেই পারছিলাম না যে ও ফাঁদে পড়েছে। তুই যেটা জানস না ওইটা নিয়া প্যাঁচাল পারিস না, আমাকে ঠেলে সরায় দিছে ওইখান থেকে। পঞ্চাশ হাজার যাওয়ার পরে হুশ ফিরছিল ওর!
লোভের সাথে যোগ হয় অলৌকিকের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস! আর এখানেই আসে বাংলাদেশের সেরা স্ক্যাম, জিনের বাদশা! জিনের বাদশার ফোন পায় নাই ( আমি পাই নাই) এমন লোক এই দেশে সম্ভবত খুব কমই আছে। জিনের বাদশা প্রথমেই মধ্য রাতে অদ্ভুত কণ্ঠে মানুষকে ভড়কে দিবে। এরপরে ভালো ভালো কথা বলবে। নামাজ পড়বি, বাবা মাকে দেখবি, মসজিদে কোরান শরীফ কিনে দিস দুইটা ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপরেই ওরা বুঝে যায় কে ফাঁদে পড়ছে আর কে পড়ে নাই। তোর জন্য কিছু চাস? এবার আসল লোভ! কত মানুষ, কত তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ যে এদের ফাঁদে পড়ে ধরা খেয়েছে তার কোন ইয়াত্তা নাই। আমার বন্ধুকে একবার ফোন দিল, ও ওর বউ বাচ্চা নিয়ে ঘুমাচ্ছিল। তো ও ভদ্র ভাষায় বিরক্ত করতে না করেছিল। ওই পাস থেকে গালিগালাজ দেওয়া শুরু করে দিল। ফোনে কথা না বললে ওর কী কী ক্ষতি হবে এই সব। ও আস্তে করে উঠে পাশের রুমে গিয়ে পাল্টা যখন কাঁচা খিস্তি দেওয়া শুরু করল তখন খেলা জমল! গালির এই চ্যাম্পিয়নশিপে শেষে কী জিতছিল জানি না, তবে আমার বন্ধুর টাকা পয়সা যায় নাই এইটা জানি আমি!
আমার এই বন্ধুকেই একদিন একজন ফোন দিয়ে বলছিল যে ভাই ভুলে আপনার বিকাশে কিছু টাকা গেছে, যদি ফেরত দিতেন তাহলে খুব ভালো হত। আমার বন্ধু বলল আচ্ছা আমি দেখতেছি, বলে ফোন কেটে ম্যাসেজ দেখতেছিল, দেখে একটা ম্যাসেজ আসছে, তাতে টাকাও লেখা। ম্যাসেজ দেখতে যতক্ষণ, এর মধ্যেই আবার ফোন, এবার গলার স্বর চড়া, ফোন কাটলেন কেন? দিবেন না? ও বলছে ভাই, আমি আমার বিকাশের ব্যালেন্স না দেখে তো টাকা ফেরত দিব না! ওই পাশ থেকে উত্তর আসল, ধুর শালা! বলে ফোন কেটে দিল। এবার যখন ব্যালেন্স দেখা হল, দেখা গেল কোন টাকাই আসে নাই!
তবে আমার একটা উপকার করেছিল জিনের বাদশা। আব্বা অসুস্থ, বিছানায় পড়া রোগী। মধ্য রাতে ফোন আসছে জিনের বাদশার। আব্বা ফোন ধরে হ্যালো হ্যালো করছে, কাকে চান জিজ্ঞাস করছে। আমি উঠে আব্বার হাত থেকে ফোন নিলাম। কানের পাশে ধরতেই শুনি মহামান্য বিকৃত এক কণ্ঠে কথা বলছেন। আমি ঠাণ্ডা গলায় বললাম, ভাই, যাকে ফোন করছেন তিনি সত্তর ঊর্ধ্ব একজন রোগী মানুষ, উনার ফোনে ফোন দিয়ে শুধু শুধু উনাকে আর কষ্ট দিয়েন না! আশ্চর্য, তিনি মেনে গেলেন, ফোন কেটে দিলেন আর কোনদিন ফোনও দেন নাই!
আচ্ছা, এবার একটা ভিন্ন গল্প বলি, স্ক্যাম না, অপরাধ, ভিলেজ পলিটিক্স কী জিনিস তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এইটা আমাদের শেরপুরের বর্তমান সময়ের অন্যতম আলোচিত ঘটনা। পুলিশ কেস চলছে। কিন্তু নানান দিক থেকে পুরো গল্পটা আমার জানার সুযোগ হয়েছে। হয়ত বাস্তব ভিন্ন, হয়ত আমি এক পক্ষের কথা শুনেই বিশ্বাস করেছি, হয়ত আসলেই তিনি অপরাধী। কিন্তু সেই সব পরে, গল্পটা বলি আগে।
ভদ্রলোক আমেরিকা প্রবাসী। দীর্ঘদিন আমেরিকায় থেকেছেন। এখন দেশে ফিরে আসছেন। দেশ প্রেম? জানি না। দুইটা বিয়ে করেছেন। দুই স্ত্রী নিয়ে ক্যাচাল লেগেই আছে উনার। উনি দেশে আসার সময় কী কী আনছে জানি না, তবে একটা জিনিসের খোঁজ পাওয়া যায়, তা হচ্ছে জুয়ার নেশা! শেরপুর ছোট শহর, এখানে চোখের সামনে কিছুই নাই আবার একটু আড়ালেই সব চলে! মদ, নারী, জুয়া! এই লোক এই আড্ডার নিয়মিত সদস্য। এই জুয়ার ঠেক যিনি পরিচালনা করেন তিনি চরের চেয়ারম্যান ছিলেন, উনার বাবাও চেয়ারম্যান ছিলেন। ইদানীং প্রভাব কমে গেছে উনাদের। কারণ উনার বাবা জাতীয় পার্টির রাজনীতি করতেন। এখন বাংলাদেশে জাতীয় পার্টির কী দশা তা সম্ভবত সকলেরই জানা। প্রভাব কমে যাওয়ায় সেখানে আরেক শক্তির উত্থান হয়েছে। চরের রাজনীতিতে মারামারি খুব স্বাভাবিক ঘটনা। বর্শা মেরে পানিতে গেঁথে ফেলাও স্বাভাবিক। আমরা একবার এদের এলাকায় বন্যার সময় ত্রাণ নিয়ে গেছিলাম, তখন এদের আচারন দেখে এখন পর্যন্ত শিউরে উঠি আমি।
সে যাই হোক। গল্পটা শেষ করি, আমেরিকানের ৯৩ হাজার টাকা জুয়ার টাকা বাকি পড়েছে। টাকার জন্য তাকে ধরে চরে নিয়ে গেছে জুয়ার আড্ডা চালান যিনি তিনি। বাড়িতে ফোন গেছে, ৯৩ হাজার টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে। ৯৩ হাজার টাকা মুক্তিপণ, এইটা আমি তখনই শুনেছিলাম। আমার তখন মনে হয়েছে এক এইটা বাচ্চা কোন পুলাপানের কাজ। ভাগের টাকার হিসাব মিলানোর জন্য এমন একটা অংকের টাকা চেয়েছে, দুই এইটা অন্য কেস। শহরের সবাই তখন জেনে গেছে যে এমন একজনকে কারা জানি কিডন্যাপ করেছে। পুলিশ নানান সূত্র থেকে এক জায়গায় হানা দিলো। গিয়ে পাইছে আমেরিকানের লাশ! দুইজন আহত, বাকিদের ধরে নিয়া আসছে পুলিশ।
এখানে চোখের আড়ালে যা হয়েছে তা হচ্ছে চরের যে প্রতিপক্ষ সে খবর পেয়ে গেছিল যে কোথায় বন্দী করে রেখেছে আমেরিকানকে। তিনি একটা ঝুঁকি নিলেন। তার প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর এমন সুবর্ণ সুযোগ তিনি হাত ছাড়া করলেন না। লোক দিয়ে মেরে ফেললেন, দারুণ একটা চাল! পুলিশ জুড়ার ঠেক চালানো এই লোককে না ধরার কোন যুক্তিই খুঁজে পাই নাই। তিনি কঠিন এক ফাঁদে ধরা খেয়ে গেছেন! সমস্ত কিছুই তার বিপরীতে।
হিসাবটা এই হিসাবে মিলে দেখে আমার কাছে এইটাকেই বিশ্বাস যোগ্য ব্যাখ্যা মনে হয়েছে। ৯৩ হাজার মুক্তিপণ চেয়ে তার জন্য মেরে ফেলার কথা না। আর মেরে ফেললে দুইজন আহত হল কিসের সাথে যুদ্ধ করে? কিংবা শুরুতে যা বললাম, আমার হিসাব ভুলও হতে পারে। আসল সত্য কোনদিন দিনের আলো দেখবে কি না কে জানে!
মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করে। এতো এতো লোক ঠকানোর গল্প, তবুও মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করে। এদেরকে আপত দৃষ্টিতে বোকা, আহাম্মক, বুধাই মনে হলেও মানুষকে এরা বিশ্বাস করে বলেই সম্ভবত সভ্যতা আজো টিকে রয়েছে। মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করবে এইটাই তো স্বাভাবিক, তাই না? একবার ভাবুন তো সাতশ কোটি মানুষের মধ্যে একজনও আরেকজনকে বিশ্বাস করছে না! কেমন হবে সেই সমাজের চেহারাটা?
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।