গত সপ্তহখানেক আগে – ১৩ এপ্রিল, ২০২৪ – একই দিনে ল্যান্সেট-এর মতো বন্দিত মেডিক্যাল জার্নালে দুটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। প্রথমটির শিরোনাম “India's elections: why data and transparency matter”, এবং দ্বিতীয়টির শিরোনাম হল “Modi's health agenda under scrutiny”। প্রথম নিবন্ধে বলা হয়েছে – এ মাসের পরের দিকে ভারতের ৯৭ কোটি মানুষ, যা পৃথিবীর জনসংখ্যার ১০%, জাতীয় সাধারণ নির্বাচনে যাচ্ছে। এর অর্থনীতির ওজন ৩.৭ ট্রিলিয়ন (আমেরিকান ডলার) এবং, হয়তো, শীঘ্রই পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠবে।
কিন্তু, এসব সত্ত্বেও, “Health care under Modi has fared poorly, as described in this week's World Report. Overall, government spending on health has fallen and now hovers around an abysmal 1·2% of gross domestic product, out-of-pocket expenditure on health care remains extremely high, and flagship initiatives on primary health care and universal health coverage have so far failed to deliver services to people most in need. Persistent inequity in both access to and quality of health care are well recognised. But a major obstacle that India also faces, which many Indians might be unaware of, relates to health data and a lack of data transparency.” প্রকৃত তথ্যের নাগাল এবং সেসমস্ত তথ্যের স্বচ্ছতা প্রশ্নের মুখে রয়েছে।
স্বাস্থ্যখাতে জিডিপি-র ১.২% বরাদ্দ নিয়ে সরকারি মহলে শোরগোল পড়েছে। ইকনোমিক টাইমস-এর সংবাদ অনুযায়ী (১৫.০৪.২০২৪) “India rubbishes Lancet report, says spending on healthcare is at all-time high”। যুক্তির খাতিরে সরকারের এ কথা মেনে নিলেও যে বিষয়টি অনুক্ত থাকল তাহল, স্বাস্থ্যের ডাটা এবং এর স্বচ্ছতা নিয়ে যে প্রশ্ন ল্যান্সেট-এর লেখায় তোলা হয়েছে। ল্যান্সেট-এর পূর্বোক্ত লেখাতেই একটি গভীর সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছিল – “It would be appropriate for India to aspire to lead with data and be unafraid of its uses. The systematic attempt to obscure through the lack of data, means that the Indian people are not being fully informed.”
ল্যান্সেট-এর দ্বিতীয় প্রতিবেদনটিতে (“Modi's health agenda under scrutiny”) পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে – “A parliamentary panel that reviewed PMJAY in 2023 noted that “even if the beneficiaries are insured, they must bear the high indirect cost that might go beyond their ability to pay”. An independent survey of over 57 000 PMJAY beneficiaries in six states, conducted by researchers from Heidelberg University (Heidelberg, Germany) and King's College London (London, UK), reported a 17% reduction in out-of-pocket expenditure but noted that this reduction was entirely driven by private facilities, wherein the average out-of-pocket expenditure was substantially higher than in public facilities. “The promise of PMJAY was zero expense to beneficiaries.”
এ পটভূমিতে “জনস্বাস্থ্য অভিযান” নামক অ-সরকারি সংস্থা “has appealed to political parties to commit to increasing public investment in health to 3·5% of gross domestic product and to transfer administrative and financial powers to state governments and local governance bodies.”
ভোটের ঠিক আগে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি কত টাকার ইলেকটোরাল বন্ড কিনেছে এ নিয়ে কয়েকদিন আগেও সর্বস্তরের (প্রিন্ট এবং ইলেকট্রোনিক) সংবাদমাধ্যমে বেশ কিছুদিন ধরে খবর হচ্ছিল। ইলেকটোরাল বন্ড এবং ওষুধ কোম্পানির নিবিড় যোগ নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে। শিক্ষিত জনতার একটি বড় অংশই, আশা করা যায়, এ বিষয়ে অবহিত। শুধু কিছু তথ্য প্রাসঙ্গিক হবার কারণে যোগ করা যায়। এবং, ভেবে দেখতে হবে, এর সাথে আমাদের দেশের ওষুধনীতি, নির্বাচনী রাজনীতি ও জনস্বাস্থ্যের সংযোগ আছে। নীচের টেবিল থেকে এ ব্যাপারে যথেষ্ট অবহিত হওয়া যাবে।
প্রথমত, এপ্রিল ২০২২-এ হেটেরো ড্রাগস লিমিটেড এবং হেটেরো ল্যাবস লিমিটেড দুটি সংস্থাই ২০ কোটি টাকা করে মোট ৪০ কোটি টাকার ইলেকটোরাল বন্ড কিনেছিল। এর আগে অক্টোবর ৬, ২০২১-তে ৬টি রাজ্যে এদের বিভিন্ন সংস্থায় আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে কেন্দ্রীয় সরকার-পুষ্ট কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা হানা দিয়েছিল। ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট নগদে ১৪২ কোটি টাকা বাজেয়াপ্তও করেছিল। যাহোক ইলেকটোরাল বন্ড কেনার পরে (শেষ হিসেব ৫৫ কোটি টাকা) এরা স্বচ্ছ নির্মল জলে ধুয়ে যায়। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থারা আর ফিরেও তাকায়নি। প্রশ্ন উঠবে, খামোকা ৫৫ কোটি টাকা এরা দেবে কেন যদি লাভের কোন আশা না থাকে? যদি এরপরে ওষুধের দাম বাড়ে সেরকম দামী ওষুধ কি সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থাকবে? এতে দেশের জনস্বাস্থ্যের কিছু উন্নতি হবে কি? আমাদের সাধারণ বিচার-বুদ্ধি কি বলে?
প্রসঙ্গত বলে নেওয়া ভাল, ২০২৩ সালের হিসেবে বহুমূল্য চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে গিয়ে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি মানুষ ভারতে দারিদ্র্যসীমার নীচে চলে যায়। একটি নতুন শব্দবন্ধই তৈরি হয়ে “মেডিক্যাল পভার্টি ট্র্যাপ”’। “About 55 million Indians were pushed into poverty in a single year due to patient-care costs, as per a study by the Public Health Foundation of India. The medical debt trap is a big issue in India. A significant percentage of urban as well as rural households are victims of medical debt traps ... According to World Bank data, India’s private health expenditure was 72.4% of the total current health expenditure in 2018, whereas the global average was 40.2% in 2018.” (“Medical Debt Trap - Pushing Indians in Poverty” – https://www.linkedin.com/pulse/medical-debt-trap-pushing-indians-poverty-swadl)
দ্বিতীয়ত, হেটেরো গ্রুপসের মতো একই পরম্পরায় ইন্টাস, লুপিন, ম্যানকাইন্ড, মাইক্রোল্যাবস, টরেন্ট ফার্মা, জাইডাস ফার্মা, গ্লেনমার্ক, সিপলা ইত্যাদি কোম্পানির অফিসে প্রথমে দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়মের জন্য হানা দেওয়া হয় এবং এরপরে সবাই ইলেকটোরাল বন্ড কেনে কোটি কোটি টাকার। ওষুধের দামের ওপরে এর প্রভাব সহজেই অনুময়ে। দান-খয়রাতি করার জন্য এরা টাকা খরচ করেনা। ওষুধের মার্কেটিং (যার মধ্যে ডাক্তারকে দেওয়া উপঢৌকনও আছে) ইত্যাদির জন্য কোটি কোটি খরচ করে। না করলে হয়তো ওষুধের দাম সাধারণ মানুষের আরেকটু নাগালের মধ্যে থাকতে পারত। এখানে আরেকটি উল্লেখযোগ্য তথ্য হল, হায়দ্রাবাদ থেকে এই হেটেরো গ্রুপ কাজ চালায়। এদের সিইও-কে (মি. পার্থসারথি রেড্ডি) রাজ্যসভায় নমিনেশন দেবার জন্য তেলেঙ্গানার তৎকালীন শাসক দলকে ১২০ কোটি টাকার “ডোনেশন” দিয়েছিল। পাঠক নিশ্চয়ই প্রশ্ন করবে, এ টাকা উশুল হবে কি করে? সরল উত্তর হল – কোম্পানির রয়েছে ওষুধ, সাথে রয়েছে বন্ধু শাসকদল আর ওষুধ কেনার জন্য রয়েছে ১৮২ কোটির দেশের সুবিপুল জনতা। ফলে ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি অনিবার্য।
তৃতীয়ত, ১৪ মার্চ, ২০২৪-এ ইলেকশন কমিশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৩৫টি ফার্মা কোম্পানি প্রায় ১০০০ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে। এবং এই কোম্পানিগুলোর মধ্যে অন্তত ৭টি কোম্পানি আমাদের দেশের দুর্বল পরীক্ষাকাঠামো থাকা সত্ত্বেও নিম্ন মানের ওষুধ তৈরি করার জন্য চিহ্নিত হয়েছিল। ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ মেডিক্যাল এথিক্স-এর সম্পাদক অমর জেশানি বলেছেন – “We often see a lax approach by drug regulators, both at state and central level ... if pharma companies finance political parties to strike some compromise in regulatory cases at the state level.”
নিয়তির কি পরিহাস, যে অরবিন্দ ফার্মার সিইও ইলেকটোরাল বন্ড কেনার জন্য শাসকদলকে ৩৪ কোটি টাকা দিয়েছে সে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হতে সম্মত হয়েছে। এ যেন অনেকটা সূর্যমন্ত্রের মতো – “জবাকুসুম, সঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম্ ধান্তারীং সর্বপাপঘ্নং প্রণতোহস্মি দিবাকরম্।”
সতীনাথ ভাদুড়ী “ঢোঁড়াই চরিত মানস”-এ জব্বর ভোটের বর্ণনা দিয়েছেন। সম্ভবত উপনিবেশিক ভারতের প্রথম ভোটের কথা বলেছেন – ১৯৩৪ সালে। ঢোঁড়াইয়ের অনুভূতি হয়েছিল – “অদ্ভুত জিনিস এই ‘বোট’। হঠাৎ টাকা পেলে লোকের ইজ্জত বাড়ে, এর অভিজ্ঞতা ঢোঁড়াইয়ের জীবনে আগে হয়ে গিয়েছে। বোটও সেই রকম রাতারাতি লোকের ইজ্জত বাড়িয়ে দেয়, কেবল যে বোট দেবে তার নয়, সারা গাঁয়ের।” এরকম তারণায় “ঝাঁপিয়ে কেড়ে নেয় ঢোঁড়াই পাশের বলান্টিয়ারের হাতের চোঙাটা; গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে।
বাবুসাহেবের পাহারাদার বজ্রবাঁটুল তিলকুমাঝি ছুতো করে তাঁবুর বাইরে এসে ঢোঁড়াইকে ইশারা করে জানিয়ে যায় যে, তারা ঠিক আছে।” এ অব্দি পড়ার পরে স্তব্ধতা গ্রাস করে যেন! সতীনাথ বাস্তবিকই ক্রান্তদর্শী। আমাদের সময়কার ‘বোট’ বা ভোট দেখতে পেয়েছেন বুঝি নিজের চোখে অন্তত ৬০-৭০ বছর আগে।
ভোট, মানে যাকে বলা হয় গণতন্ত্রের বৃহত্তম উৎসব, একদিকে যেমন আমাদের দেশের পাঁচ বছরের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বিদেশনৈতিক, সামরিক এবং জনতোষিনী ইত্যাদি বিভিন্ন কার্যক্রমের বিচার-বিশ্লেষণ, তেমনি আরেকদিকে মানুষের ভাবনা-জগৎ, বীক্ষা, সামাজিক পারস্পরিকতা ইত্যাদির নতুন উদয়, নতুন নির্মাণও বটে। ৭২ বছরের গণতান্ত্রিক দেশে গণতন্ত্র তার শেকড় সামাজিক জীবনের অনেক গভীরে, অনেক বিস্তারে ছড়িয়েছে। যে যে স্বাধীন, সবাক, স্বরাট প্রতিষ্ঠানগুলো গণতন্ত্রের স্তম্ভ, রক্ষাকবচ, সেগুলো সুরক্ষিত রয়েছে কিনা মানুষ তো তার মতো করে হিসাব বুঝে নেবেই। এরকম ক্ষমতাসমৃদ্ধ বলেই বহু ক্ষুণ্ণতা, ক্লিন্নতা, অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও এদেশে গণতন্ত্র বেঁচে থাকে। সমাজের যে যে স্তর, স্বর ও বিষয় রাষ্ট্রের ভাষ্যে কোন পরিসর পায়না সেগুলো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জোরে জায়গা করে নেয়। রাষ্ট্র এবং সমাজের, প্রশাসন এবং নাগরিকের, ভোটার এবং ভোটের মেশিনারির পারস্পরিক সম্পর্ক কখনোই একমাত্রিক নয়, দ্বান্দ্বিক। এই দ্বান্দিকতার ভারসাম্য, সুষম সুস্থিতি গণতন্ত্রের elan vital তথা জীবনীশক্তি। এটা যেদেশে নেই সেখানে দেশটি রাষ্ট্রের বিচারে failed state – এক ব্যর্থ প্রক্রিয়ার সাক্ষী। সে পাকিস্তান কিংবা অন্য যেকোন রাষ্ট্র হতে পারে। তবে যেসব ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াগুলোর স্বচ্ছন্দ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় জীবিনীশক্তিসম্পন্ন জনগণের রাষ্ট্র হতে পারে – যেখানে ঢোঁড়াইও থাকে দানা মাঝিও থাকে, আসিফাও থাকে নীতা আম্বানিও থাকে, নির্ভয়াও থাকে গৌরি লঙ্কেশও থাকে, যেখানে আমিও থাকি আপনিও থাকেন – সে প্রশ্নগুলোর বিচার করা, ভেবে দেখা জরুরি। একটি রাষ্ট্র একসময়ের failed state বলে আবার গণতান্ত্রিক ভোর দেখবেনা এমনটা নাও হতে পারে। আবার গণতন্ত্রের পরীক্ষায় ৭২ বছর ধরে পরীক্ষিত একটি রাষ্ট্রের ইতিহাসের কোন এক মুহূর্তে fail করবেনা এরকম কোন নিশ্চয়তাও ভবিতব্য আমাদের দেয়নি। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর দিকে আমরা তাকালে দেখতে পাবো এরকম ইতিহাস।
প্রায় ৩৫টি ওষুধ কোম্পানি ১০০০ কোটি টাকার ইলেকটোরাল বন্ড কিনেছে। হিন্দু সংবাদপত্রের একটি সাম্প্রতিক খবরের শিরোনাম “Many pharma companies that bought electoral bonds faced regulatory actions” (মার্চ ১৯, ২০২৪) ।
২৯.০৩.২০২২ তারিখে বিজনেস ইন্ডিয়া-য় প্রকাশিত খবর “ফার্মা ফার্মস এইম ফর হায়ার রেভেন্যুজ অ্যাজ গভর্নমেন্ট হাইকস প্রাইসেস অফ লাইফসেভিং ড্রাগস” থেকে জানা যাচ্ছে, ভারতের প্রথমদিকের ২৫টি বৃহৎ কোম্পানি “এসেনশিয়াল ড্রাগস” বিক্রির পরিমাণ তাদের মোট বিক্রির পরিমাণের ৭-৪৪%। পরিমাণটি নেহাত কম নয়। মনে রাখতে হবে, ভারতে ওষুধের খুচরো বিক্রির বাজার প্রায় ১.৫ লক্ষ কোটি টাকার। ইকনমিক টাইমস পত্রিকা-র সংবাদ অনুযায়ী (১ এপ্রিল, ২০২২), অ্যাক্টিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্টসের দাম গত দু’বছর ধরে ১৫% থেকে ১৩০% বৃদ্ধি পেয়েছে। প্যারাসিটামলের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় ওষুধের দাম বেড়েছে ১৩০%। এছাড়া ‘এক্সসিপিয়েন্টস’ যেগুলো বিভিন্ন সিরাপ থেকে বিভিন্ন ড্রপ তৈরি করতে আবশ্যক সেগুলোর দাম রকেট গতিতে বেড়েছে এমনকি ২৬৩% পর্যন্ত। পেনিসিলিনের মতো ওষুধের দাম বেড়েছে ১৭৫%। ফলে সরকারিভাবে ঘোষিত ১০.৮% মূল্যবৃদ্ধির আগেই এরকম অসম্ভব মূল্যবৃদ্ধি হয়ে আছে আমাদের আগোচরে। এবার সরকারিভাবে ঘোষিত হল এই যা। আমজনতার গোচরে এল।
মুক্ত বাজারের অর্থনীতি ওষুধের বাজার, মুনাফা এবং একে জনগ্রাহ্য করে তোলার সমগ্র প্রক্রিয়াকে সচল রাখে। স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হয় – (১) মানুষ চির-অতৃপ্তির ধারক একটি জীব এবং সে সবসময়ে অতৃপ্তিকে তৃপ্তিতে এবং সুখে রূপান্তরিত করার জন্য সবকিছু বাজি রাখতে পারে, (২) ধরে নেওয়া হয় মুক্ত বাজার হল সে স্থান যেখানে মানুষ ‘স্বাধীন পছন্দের’ সাহায্যে তার প্রয়োজনগুলো মেটাতে পারে, (৩) “মুক্ত বাজারে অবাধ প্রতিযোগিতা” হল সমস্ত আবিষ্কারের চালিকা শক্তি।
ওষুধের বাজারকে এই অর্থনৈতিক-সামাজিক দর্শনের সামগ্রিক প্রভাবের সাহায্যে ক্রমাগত আর পাঁচটা পণ্যসামগ্রীর মতো পণ্যবাজারে পরিণত করা হয়েছে। আমেরিকাতে একজন মানুষ গড়ে জীবনের এক-তৃতীয়াংশ সময় টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন দেখার পেছনে ব্যয় করে। এক নতুন ধরণের সামাজিক মানসিকতার নির্মাণ হয়, নতুন ধরণের মেডিক্যাল ভোক্তা তৈরি হয় যারা কেবল পণ্যের সন্ধান করে। বাজার বেঁচে থাকে, ফনফনিয়ে বেড়ে ওঠে। প্রায় ২ বছর ধরে চলা কোভিড অতিমারির পরেও আন্তর্জাতিক জগতে দানবীয় বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মুনাফায় ঘাটতি পড়েনি। আমি কয়েকটি কোম্পানির হিসেব দিচ্ছি – জনসন অ্যান্ড জনসন ২০২০-তে রেভেন্যু ৮২.৬ বিলিয়ন ডলার, ২০১৯-এ ছিল ৮২.১ বিলিয়ন। নোভার্টিস ২০২০-তে রেভেন্যু ৪৮.৬৬ বিলিয়ন, ২০১৯-এ ৪৭.৪৫ বিলিয়ন। মার্কের ক্ষেত্রে এই সময়ে ৪৬.৮৪ থেকে ৪৮ বিলিয়নে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইলি লিলির ক্ষেত্রে পরিমাণ যথাক্রমে ২২.৩২ (২০১৯) এবং ২৪,৫৪ (২০২০)। অ্যাবভি কোম্পানির ক্ষেত্রে ৩৩.২৭ (২০১৯) এবং ৪৫.৮০ (২০২০)।
দেখা যাচ্ছে প্রায় সবকটি অতিবৃহৎ বহুজাতিকের মুনাফা ১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি বা বেশি। এদের ভারতীয় শাখাগুলোও এ সুবিধে ভোগ করার অবারিত দ্বার পাচ্ছে। কারণ ভারতের অর্থনীতি পূর্ণত মুক্ত বাজারের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। গুণাগার দেবে আমজনতা, যারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই সময়কালে। এবং সবক্ষেত্রে বাজারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েই চলেছে। যদিও মানসিক জগতে একে সইয়ে নেবার এক বিপজ্জনক ঐতিহাসিক অবস্থা জন্ম নিয়েছে। একধরনের সামগ্রিক সামাজিক চৈতন্যের বিবশতা সর্বব্যাপী চেহারা নিয়েছে। আমাদের সামাজিক মানসিকতাকে গড়েপিটে নিচ্ছে। আমরা ক্রমবর্ধমান পথে রাষ্ট্রানুগত্যকে আমাদের আইডেনটিটির মধ্যে প্রবেশ করতে অনুঘটক হিসেবে নিজেরাই ভূমিকা পালন করছি। কোভিড পরবর্তী সময়ে এটা আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে।
করোনা অতিমারি-অতিক্রান্ত সময় সম্ভবত আমাদের দেশের এবং বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থার গোড়া ধরে কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনতে চলছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার ধারণা সম্ভবত একটি স্মারক ছাড়া আর কিছু থাকবেনা। এ মারাত্মক সময়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা মানুষের দৃষ্টিপথ, শ্রুতিপথ এবং ভাবনার ক্ষেত্রপথের একেবারে বাইরে চলে যাচ্ছে। ক্ষোভ থাকা সত্ত্বেও নামী হাসপাতাল এবং দামী টেকনোলজি ভালো চিকিৎসার সমার্থক হয়ে উঠছে। লক্ষ্যণীয় হল কর্পোরেট পুঁজি শাসিত ও নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র এটাই চায়। অতিরাষ্ট্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা মানুষের নতুন চাহিদা এবং স্মৃতি প্রতিনিয়ত নির্মাণ করে চলে – সে রামমন্দির নিয়েই হোক বা হাই-টেক পাঁচতারা কর্পোরেট চিকিৎসাই হোক।
নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ ২৪শে জুন, ২০০১ সংখ্যায় মার্গারেট ট্যালবট একটি প্রবন্ধে (“দ্য শাইনেস সিন্ড্রোম”) দেখান যে ডেভিড বেকহ্যাম, স্পাইস গার্ল বা রিকি উইলিয়ামস-এর মতো সেলিব্রিটিরা ওষুধ কোম্পানির টাকায় মিডিয়ার সামনে কেমন করে নতুন ধরণের সোশাল ফোবিয়ার শিকার হচ্ছেন বলে জানাচ্ছেন। একটি নতুন অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট ওষুধ তৈরি হচ্ছে সোশাল ফোবিয়ার জন্য। এরকম একটি ওষুধের উদাহরণ হচ্ছে প্র্যাক্সিল (প্যারোক্সেটিন)। পরিণতিতে, কয়েক বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা হবে।
যে বিশেষ বৈশিষ্ট্য মানুষের ভিন্নতার জন্ম দেয়, সেরকম একটি বৈশিষ্ট্য স্বল্পবাক বা লাজুক চরিত্র যদি “মেডিক্যালাইজড” হয়ে যায় তাহলে মানুষের এসমস্ত স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যও ওষুধের এবং চিকিৎসার আওতার মধ্যে চলে আসবে। এমনকি কখনো কখনো আগে ওষুধ তৈরি করা হয়, পরে রোগের লাগসই নামকরণ হয়। ট্যালবট আশঙ্কা বোধ করেন এমন কোন দিন হয়তো আসবে যখন পৃথিবীতে মৃদুভাষী, স্বল্পবাক বা স্বভাব ভীরু বলে কিছু থাকবে না। এ আশঙ্কার বাস্তব ভিত্তিতে আছে অর্থনৈতিক মুনাফা। ফলে ওষুধের মূল্যবৃদ্ধিও আমাদের কতটা নাড়া দেবে সেটা চিন্তাসাপেক্ষ।
ভারতের ক্ষেত্রে ওষুধের জন্য মানুষের পকেট থেকে ৭০% খরচ হয়। ডায়াবেটিসের ওষুধ মেটফরমিনের দাম একবছরে বেড়েছে ২৫০ টাকা/কি্লোগ্রাম থেকে ৪০০ টাকা/কিলোগ্রাম (৫১% বৃদ্ধি)। প্যারাসিটামলের ক্ষেত্রে ৫৯৯ টাকা থেকে ৯২৫ টাকা (প্রায় ৫০% বৃদ্ধি)। বিশেষজ্ঞদের মতে দ্রুত এ মূল্য ১০০০ টাকা ছাড়িয়ে যাবে। জীবনদায়ী ক্যান্সারের ইনজেকশন ট্র্যাস্টুজুমাবের ‘সিলিং প্রাইস’ গতবছরের মূল্য ৬০,২৯৮ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৬,৭৯০ টাকা। বিশেষ ধরনের স্টেন্টের দাম গত একবছরে বেড়ে হয়েছে ৩০,৮১১ থেকে ৩৪,১২৮ টাকা। নজরে রাখতে হবে, ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির হার মুদ্রাস্ফীতির হারের চেয়ে বেশি। ভারতে ওষুধ তৈরির কাঁচা মালের ৭০% সরবরাহ আসত চিন থেকে। ‘আত্মনির্ভর’ ভারতের শ্লোগান এই সরবরাহ বিপুল পরিমাণে কমিয়ে দিয়েছে।
এর ফলে ওষুধ প্রস্তুতকারক যেসব ছোট সংস্থা আছে তারা বৃহৎ কোম্পানিগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠতে পারবেনা। শেষ অবধি বৃহৎ কোম্পানিগুলোই বাজারে ওষুধের উচ্চ মূল্য নির্ধারণ করবে। ভারতের আভ্যন্তরীন ওষুধের বাজার ২০২১-এ ৪২ বিলিয়ন ডলারের, ২০২৪-এ ৬৫ বিলিয়ন ডলার এবং ২০৩০-এ ১২০-১৩০ বিলিয়ন ডলার হবে। ড্রাগ প্রাইস কন্ট্রোল অর্ডার (১৯৭৯) অনুযায়ী, লাইফ-সেভিং এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় ওষুধের ক্ষেত্রে ‘প্রাইস প্রোটেকশন’ ছিল। সেটা পরিবর্তিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য, ভারতে ওষুধের দাম মেটাতে গিয়ে প্রতিবছর ৬-৬.৫ কোটি মানুষ (প্রায় ইংল্যান্ডের জনসংখ্যার সমান) দারিদ্র্যসীমার নীচে চলে যায়। এখানে ওষুধের দাম আবার বাড়লে আরও বেশি মানুষ দরিদ্র হবে। যখন সংবাদ পোর্টালের (স্ক্রোল.ইন – মার্চ ১৮, ২০২৪) খবর হয় “Seven firms that failed drug quality tests gave money to political parties through electoral bonds”। এরকম পরিস্থিতিতে কার ওপরে বিশ্বাস স্থাপন করা যাবে? ওষুধ কোম্পানি? কেন্দ্রের শাসকদল? ভারতীয় রাজনীতি? সাধারণ মানুষ কোন দিশায় হাঁটবে? কোন উত্তর নেই আমাদের কাছে।
শ্রীনাথ রেড্ডি নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন-এ প্রকাশিত (জুলাই ২, ২০১৫) একটি প্রবন্ধে (“ইন্ডিয়া’জ অ্যাস্পিরেশন ফর ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ”) প্রশ্ন রেখেছিলেন, “যে দেশকে অসংখ্য কম দামের ওষুধের জন্য পৃথিবীর ওষুধাগার বলা হয় সেখানে স্বাস্থ্যপরিষেবার মূল্য চোকাতে ৬৩ মিলিয়ন মানুষ প্রতিবছর দারিদ্র্যে তলিয়ে যায় সেখানে কি করা হবে?” নানা অসাধু উপায়ে, বিভিন্ন ঘুরপথে ওষুধের আবার মূল্যবৃদ্ধির পরে এ প্রশ্ন আরও জীবন্ত হয়ে উঠেছে। আগেই বলেছি, এদেশে বছরে প্রায় ৫.৫ কোটি মানুষ চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে দারিদ্র্যসীমার নীচে চলে যায়। এর আদুরে নাম হল “মেডিক্যাল পভার্টি ট্র্যাপ”।
ভারতের ক্ষেত্রে, ২০১৬ সালে সংসদীয় কমিটির প্যানেল রিপোর্ট অনুযায়ী (২০২৩-এর রিপোর্ট আমার হাতে নেই), প্রতি ১০,১৮৯ জন মানুষের জন্য ১ জন সরকারি ডাক্তার, প্রতি ২,০৪৬ জনের জন্য সরকারি হাসপাতালে একটি বেড বরাদ্দ এবং প্রতি ৯০,৩৪৩ জনের জন্য একটি সরকারি হাসপাতাল – এই হচ্ছে সেসময় পর্যন্ত স্বাস্থ্যের চিত্র। ২০২০ সালের মার্চ মাসের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৩৭ কোটি মানুষের জন্য সরকারি হাসপাতালে বেড রয়েছে ৭,১৩,৯৮৬টি। এর অর্থ দাঁড়ায়, প্রতি ১০০০ ভারবাসীর জন্য ০.৫টি করে বেড। বিহারে আবার এই সংখ্যা ১০০০-এ ০.১১, দিল্লিতে ১.০৫ – বৈষম্য সহজেই চোখে পড়ে। এরসাথে যুক্ত করতে হবে, হু-র দেওয়া হিসেব অনুযায়ী, এইমস থেকে পাস করে বেরনো ৫৪% ডাক্তার বিদেশে পাড়ি দেয়। এরকম পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্য এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে হবে।
স্বাস্থ্যকে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। করোনা পরবর্তী সময়ে জনসমাজের গর্ভ থেকে এ দাবী আরও জোরদার হয়ে ওঠা দরকার।