এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • ট্রিনিটি সাইট : এক প্রেম কাহিনী

    সহস্রলোচন শর্মা
    আলোচনা | বিবিধ | ২০ আগস্ট ২০২৩ | ১২২৩ বার পঠিত | রেটিং ৪.৩ (৩ জন)

  • Come, Madam, come, … Unlace yourself, for that harmonious chime – John Donne

    ।। ১ ।।
    ১৯৩৬ সালের বসন্ত কাল। আর মাস খানেক বাদেই রয়েছে ইউএসএর স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল বিভাগে ভর্তির পরীক্ষা। সেই পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতেই এখন বেশ কিছুটা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন বছর বাইশের তরুণী জিন ফ্রান্সেস ট্যাটলক (Jean Frances Tatlock)। তা নাহলে এতক্ষণে হয়তো তিনি কমিউনিস্ট পার্টির কোনও কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। কমিউনিস্ট পার্টি অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকার সক্রিয় কর্মী তিনি। ট্যাটলকের জন্ম ইউএসএর বিখ্যাত পঞ্চ হ্রদ তীরবর্তী মিচিগান প্রদেশে। তবে বর্তমানে পশ্চিম ইউএসএর ক্যালিফর্নিয়া প্রদেশের বার্কলে শহরের বাসিন্দা তিনি। বার্কলে শহরের কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবীদের ঘরোয়া সভাই হোক বা ডক শ্রমিকদের পথসভা- সর্বত্র হাজির থাকেন তিনি। কিন্তু ইদানীংকালের সভা সমিতিতে বড় একটা দেখা যাচ্ছে না তাঁকে। ওই যে, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল বিভাগে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি।

    ধুরর্‌, সারাদিন কি আর বসে বসে পড়তে ভালো লাগে? বিকেলের দিকে মাঝে মাঝেই তাই এদিক ওদিক থেকে কিছুক্ষণ ঘুরে আসেন ট্যাটলক। আজ ভাবলেন, একবার মেরি এলেন ওয়াসবার্নের (Mary Ellen Washburn) বাড়ি যাওয়া যাক। তাঁর থেকে বছর দশকের বড় মেরিও ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির অব দ্য ইউএসএর সক্রিয় কর্মী। প্রায়শই তাঁর বাড়িতে বসে পার্টির মিটিং। আজও এমনই একটা সভা আছে তাঁর বাড়িতে। অনেকদিন পার্টির কোনও সভায় উপস্থিত থাকেন নি ট্যাটলক। মনটা তাই কেমন যেন উচাটন হয়ে আছে তাঁর। আজ তাই হাঁটতে হাঁটতে মেরির বাড়ি হাজির হলেন ট্যাটলক।

    ট্যাটলককে দেখে ভীষণ খুশি হলেন মেরি। সাদরে আপ্যায়ন করে নিয়ে গেলেন ভিতরের ঘরে। ঘরে বেশ কিছু লোক উপস্থিত হয়েছেন তখন। কিন্তু ট্যাটলকের চোখ আটকে গেল চেয়ারে বসে ধূমপানরত এক ব্যক্তির দিকে। একে তো আগে দেখেন নি তিনি। পাতলা ছিমছিমে শরীরের লোকটার চেহারায় কি যেন এক ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠেছে। মেরি আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ইনি হলেন বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী জুলিয়াস রবার্ট ওপেনহাইমার (Julius Robert Oppenheimer), আমার নতুন ভাড়াটে। ইনিও আমাদের পার্টির সমর্থক’।

    ইওরোপ থেকে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে বেশ কয়েক বছর হল বার্কলে শহরের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফর্নিয়াতে অধ্যাপনা করছেন ওপেনহাইমার। প্রথম দিকে বেশ কয়েক বছর ধরে বন্ধুর ফ্ল্যাটেই থাকতেন তিনি। অতি সম্প্রতি মিসেস মেরি ওয়াসবার্নের বাড়ির একটা অংশ ভাড়া নিয়েছেন। গৃহকর্ত্রী মেরি ওয়াসবার্ন যে কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় কর্মী, তা বিলক্ষণ জানতেন ওপেনহাইমার। আসলে পৃথিবীর সব দেশেই কমিউনিস্টদের সংস্পর্শে আসাটা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ বলেই বিবেচিত হয়ে থাকে। ওপেনহাইমার অবশ্য সেই দলে পড়েন না। উলটে, কমিউনিজম নিয়ে বরাবরই আগ্রহান্বিত তিনি। কমিউনিজমকে গোড়া থেকে জানতে মূল জার্মান ভাষায় লেখা ‘দাস ক্যাপিটাল’ পড়েছেন তিনি। তাঁর পরিবার পরিজনের অনেকেই কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন। তাঁর ভাই, পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রাঙ্ক ফ্রেইডম্যান ওপেনহাইমার (Frank Friedman Oppenheimer) তাঁর থেকেও অধিক সক্রিয় পার্টির কর্মী ছিলেন। ফ্রাঙ্কের স্ত্রী জ্যাকনেটি ইভন কোয়ান (Jacquenette Yvonne Quann) কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী ছিলেন। ওপেনহাইমারের বিশিষ্ট বন্ধু ও ফরাসী ভাষার অধ্যাপক হাকোঁ মরিস শেভলিয়েঁ (Haakon Maurice Chevalier) ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির কট্টর সমর্থক। ফলে আগাগোড়াই একটা কমিউনিস্ট পরিমণ্ডলের মধ্যেই বসবাস করতেন ওপেনহাইমার। তাই ওয়াসবার্নের বাড়ি নেওয়া বা তাঁর বাড়ির মিটিঙে যোগদান করাটা কোনও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ বলে কখনই মনে হয় নি তাঁর। সাবলীল ভাবেই সেদিনের মিটিঙে উপস্থিত হয়েছিলেন ওপেনহাইমার। সেই মিটিঙে তাঁর সাথে আলাপ হয় মিস জিন ট্যাটলকের। আসলে ট্যাটলক ঘরে ঢোকা মাত্রই ওপেনহাইমারের নজরও যেন আটকে যায় তাঁর দিকেই। বব কাট চুল, স্লিম ফিগারের ট্যাটলকের চেহারায় যেন অনন্ত যৌবনের ইশারা। যৌবনের সে ডাকে সাড়া না দিয়ে পারলেন না ওপেনহাইমার। প্রথম সাক্ষাতেই পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করলেন তাঁরা দুজনেই। ইংরাজিতে যাকে বলে ‘লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট’।

    তারপর থেকে প্রায়ই তাঁদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হতে থাকল। ওপেনহাইমার যুক্তিবাদী। তিনি বেশ বুঝতে পারলেন যে তাঁদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কিন্তু আমি একা একতরফা ভাবে ভাবলে তো আর হবে না- মনে মনে বিড়বিড় করে চলেন ওপেনহাইমার- এই বিষয়ে ট্যাটলকের মনোভাবটাও জানা প্রয়োজন। পরের দিনই তাই সরাসরি ট্যাটলককে জিগ্যেস করেন, তুমি কি আমায় পছন্দ করো?

    পছন্দ? মানে, প্রেম? কোনও প্রশ্নই ওঠে না। এসব নিয়ে আদৌ ভাবিত নন ট্যাটলক। তাঁর জীবন জুড়ে আছে মেহনতি মানুষের মুক্তির স্বপ্ন। আর আছে মনোরোগ নিয়ে ডাক্তারি পড়ার তীব্র বাসনা। এই দুই স্বপ্নে সম্পৃক্ত আজ তাঁর জীবন। প্রেম বা পুরুষ নিয়ে তো এখনই কিছু ভাবতেই পারছেন না তিনি। এই বিষয়ে বেশ কট্টর মনের অধিকারী তিনি। কিন্তু ওপেনহাইমারের মুখ থেকে আচমকা প্রশ্নটা শুনে সহসাই যেন বেড়ে গেছে তাঁর হৃদস্পন্দন। লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠেছে তার মুখমণ্ডল। ওপেনহাইমারের দিকে আর তাকাতেই পারছেন না তিনি। গলাটাও কেমন যেন শুকিয়ে আসছে। মাথা নিচু করে কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে বিবশ ট্যাটলক বলে ওঠেন, হ্যাঁ, তিনি পছন্দ করেন তাঁকে। ঠিক সেই মুহূর্তে চারিদিকে যেন ঝুপ করে নেমে আসে অনন্ত নিস্তব্ধতা। ভাষাহীন দুটো ঠোঁট পরস্পরকে আলিঙ্গন করে উঠল যে সেই প্রান্তরে।

    কিন্তু তাঁদের এই মিলন টিকল না বেশি দিন। ডাক্তারি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন ট্যাটলক। ট্যাটলকের ঠিকানা এখন সান ফ্রান্সিসকো শহরেরও দক্ষিণে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেই থাকতে হবে তাঁকে এখন। বার্কলে শহর থেকে স্ট্যানফোর্ডের দূরত্ব খুব বেশি নয়- ৭৫ কিমি মতো হবে (কলকাতা থেকে কোলাঘাট বা রানাঘাট)। কিন্তু নিজের কাজ ছেড়ে রোজ ৭৫ কিমি পথ যাতায়াত করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। সপ্তাহান্তে ওপেনহাইমারই তাই ছুটে যান ট্যাটলকের কাছে। সেখানে দিন দুয়েক কাটিয়ে আবার ফিরে আসেন বার্কলেতে। এই সময়ে বেশ কয়েকবার অন্তরঙ্গ ‘ডেটিং’এও সময় অতিবাহিত করছেন তাঁরা।

    ওপেনহাইমার-ট্যাটলক প্রেম কাহিনীর দুই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হল- কমিউনিজম ও সাহিত্য। ওপেনহাইমার ও ট্যাটলক দুজনেই কমিউনিস্ট পার্টির কাজকর্মের সাথে জড়িত ছিলেন। তবে ওপেনহাইমারের থেকে ট্যাটলক ছিলেন অধিক সক্রিয় পার্টি কর্মী। তাঁদের প্রেম পর্বের দিনগুলোতে কমিউনিজম নিয়ে বিশদে আলোচনা করতেন ট্যাটলক। হালফিল দুনিয়ায় ঘটে চলা স্পেনের গৃহযুদ্ধ, জাপানের চিন আগ্রাসন প্রভৃতি নিয়ে মতামত ব্যক্ত করতেন তিনি। ওপেনহাইমার একজন পদার্থবিদ। বিজ্ঞানই তাঁর ধ্যান, জ্ঞান, স্বপ্ন। রাজনীতিতে তাঁর আগ্রহ থাকলেও এত সবিস্তারে বাম আন্দোলনের খোঁজ খবর রাখতেন না তিনি। ট্যাটলকের কাছ থেকে পাওয়া বিশ্ব জোড়া বাম আন্দোলনের খবর বিশেষ উদ্দীপ্ত করত তাঁকে। বলা যেতে পারে, কমিউনিজম নিয়ে তাঁর আগ্রহকে ত্বরান্বিত করেছিলেন তন্বী ট্যাটলক। পরিণতিতে, স্পেনের গৃহযুদ্ধে বামপন্থীদের সাহায্যার্থে অনুদান সংগ্রহে ব্রতী হলেন ওপেনহাইমার। তিনি নিজে দিলেন ১,৫০০ ডলার (আনুমানিক ৫০০০ টাকা)। তবে ওপেনহাইমার নিজে কখনও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ গ্রহণ করেন নি। সমর্থক হিসেবে বাইরে থেকে সাধ্যমত সাহায্য করতেন তিনি পার্টিকে।


    ১৭ শতকের ইংরেজ কবি জন ডন।


    ওপেনহাইমার-ট্যাটলক প্রেম কাহিনীর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হল- সাহিত্য। সাহিত্য ছিল তাঁদের দুজনেরই অত্যন্ত প্রিয় বিষয়। প্রাচীন গ্রীস, ভারত প্রভৃতি দেশের সাহিত্যে বিশেষ আগ্রহ ছিল ওপেনহাইমারের। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের প্রতি তাঁর আকর্ষণের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল- গীতা। মূল সংস্কৃত ভাষায় গীতা পড়ার জন্য সংস্কৃত ভাষা শিখেছিলেন তিনি। অপরদিকে, ট্যাটলকের বাবা জন স্ট্রং পেরি ট্যাটলক (John Strong Perry Tatlock) ছিলেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফর্নিয়ার মধ্যযুগীয় সাহিত্যের অধ্যাপক। বাবার হাত ধরেই মধ্যযুগীয় সাহিত্যের সাথে পরিচয় ঘটেছিল জিন ট্যাটলকের। সাহিত্য তাঁদের দুজনেরই সাধারণ আকর্ষণের বিষয় হওয়ায়, দুজনে একান্তে দীর্ঘক্ষণ ধরে বিভিন্ন কাব্য, কবিতা পাঠ করতেন। এমনই একদিন, ওপেনহাইমারকে জন ডনের (John Donne) লেখা একটা কবিতা পড়ে শোনান ট্যাটলক। ১৭ শতকের ইংরেজ কবি জন ডন ছিলেন গোঁড়া ক্যাথলিক। আধ্যাত্মবাদ, প্রেম, প্রার্থনা প্রভৃতি ছিল তাঁর কবিতার মূল প্রতিপাদ্য। জন ডনের লেখা সনেট Batter my heart, three-person'd God কবিতাটা বড় প্রিয় ছিল ট্যাটলকের। খ্রিস্টধর্মের অন্যতম প্রধান তত্ত্ব হল ‘ট্রিনিটি’ বা ত্রিত্ব। পিতা (ঈশ্বর), পুত্র (যিশু খ্রিস্ট) ও বিশ্বাস- এই তিনের সমন্বয়কে ত্রিত্ব বা ট্রিনিটি বলা হয়। তাঁর কবিতায় three-person'd God বলতে ট্রিনিটি তত্ত্বই বুঝিয়েছেন জন ডন। কবিতায় ঈশ্বরের কাছে আর্জি জানিয়ে কবি লিখেছেন, তাঁকে আঘাত করে, চূর্ণ করে, দগ্ধ করে ঈশ্বর যেন তাঁর মতো করে গড়ে নেন তাঁকে, যাতে সারা জীবন তিনি ঈশ্বরের অর্চনা করে যেতে পারেন। কবির আর্তি নাস্তিক ওপেনহাইমারের মনেও রেখাপাত করে যায়। পরবর্তী জীবনও কবিতাটা স্বচ্ছন্দে মনে করতে পারতেন তিনি।

    প্রেম তো অনেক হল, এবার বিয়ের পালা- এমনটাই মনে করলেন ওপেনহাইমার। কিন্তু বিয়ের নাম শুনেই বেঁকে বসেন ট্যাটলক। বিবাহের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন তিনি। তবে তার জন্য অবশ্য তাঁদের প্রেম পর্বে কোনও বিঘ্ন ঘটে নি। সপ্তাহান্তে ওপেনহাইমার এখনও ছুটে আসেন স্ট্যানফোর্ডে। গল্পে, কবিতায়, রাজনৈতিক তর্জায় কেটে যায় তাঁদের সময়। কিন্তু এভাবে আর কত কাল অপেক্ষা করবেন ওপেনহাইমার? ট্যাটলকের কাছে আবার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেলেন তিনি। এবার সাথে নিয়ে গেলেন সুদৃশ্য বিদেশি অন্তর্বাস। সেই অন্তর্বাস ও বিয়ের প্রস্তাব আবারও সবিনয়ে ও দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করেন ট্যাটলক। তিনি বলেন, যেখানে বুভুক্ষু মানুষের দুবেলা খাওয়া জোটে না সেখানে এই জাতীয় কথা বলা অর্থহীন।
    অর্থহীন?! প্রেম-বিবাহ অর্থহীন?! মানুষ অনাহারে রয়েছে বলে কেউ বিয়ে করবে না? কমিউনিস্টরা বিয়ে করছেন না? এ কেমন যুক্তি? ট্যাটলকের মন বুঝে উঠতে পারেন না ওপেনহাইমার। তাঁদের সম্পর্কের পরিণতি নিয়ে এখন বেশ হতাশই তিনি। ট্যাটলককে এখনও ভালোবাসেন তিনি। সম্মান করেন তাঁর প্রতিভাকে। চান তাঁকেই বিয়ে করতে। কিন্তু ট্যাটলকের মন আর বুঝে উঠতে পারেন না ওপেনহাইমার। এর পর থেকেই তাঁদের সম্পর্ক ক্রমেই ম্লান হতে থাকে। আগে যে পথ নিমেষেই অতিক্রান্ত হত, সেই বার্কলে থেকে স্ট্যানফোর্ড এখন বহু দূরের পথ হয়ে দাঁড়াল। সময়ের সাথে সাথে আবার দুজনেরই বাড়তে থাকে কাজের চাপ। দুজনেই বুঝতে পারেন কোন দিকে এগিয়ে চলেছে তাঁদের পরিণতি। দুজনেই পরিণত মনের অধিকারী, তাই কেউই বিশেষ বিচলিত নন সেই পরিণতিতে। এখনও তাঁদের মধ্যে রয়েছে পারস্পরিক ভালোবাসা ও সম্মানের সম্পর্ক। নেই শুধু শরীরী প্রত্যাশা।

    ওপেনহাইমারের চলনবলন, আদবকায়দা, পোশাক পরিচ্ছদ ছিল নায়কোচিত। তার উপর তিনি ছিলেন ক্ষুরধার যুক্তিবাদী এবং নাস্তিক। তাঁর উপস্থিতি তাই সহজেই নজর কাড়ত সকলের। ফলে কী বিবাহিত, কী কুমারী- মহিলা মহলে তিনি ছিলেন কাঙ্ক্ষিত পুরুষ। ওপেনহাইমারও উপভোগ করতেন নারী সঙ্গ। সম্ভোগ করেছেন বহু নারী সঙ্গ। আগস্ট ১৯৩৯ সাল, ট্যাটলকের সাথে তখন আর তেমন যোগাযোগ নেই তাঁর। এমন সময়ে তাঁর সাথে পরিচয় ঘটে মিসেস ক্যাথরিন হ্যারিসনের (Katherine Harrison)। ক্যাথরিনের এটা তৃতীয় বিবাহ। এহেন ক্যাথরিনের সাথে যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন ওপেনহাইমার। পরিণতিতে গর্ভবতী হয়ে পড়লেন মিসেস ক্যাথরিন। ক্যাথরিনের স্বামী স্টিওয়ার্ট হ্যারিসনকে (Stewart Harrison) সরাসরি ডিভোর্সের প্রস্তাব দেন ওপেনহাইমার। ১ নভেম্বর ১৯৪০, বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে হ্যারিসন দম্পতির। ঠিক ওইদিনই চতুর্থ স্বামী হিসেবে ওপেনহাইমারকে বরণ করেন ক্যাথরিন।

    ।। ২ ।।
    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রায় শুরুর দিন থেকেই ‘পারমাণবিক বোমা বানানো সম্ভব’ এমন একটা পরিমণ্ডল গড়ে উঠতে থাকে ইউএসএতে। প্রথম দিকে বোমা বানানো নিয়ে তেমন একটা উৎসাহ দেখান নি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট (Franklin Delano Roosevelt)। কিন্তু স্বয়ং আইনস্টাইন যখন পত্র মারফৎ প্রেসিডেন্টকে জানালেন, তিনি নিশ্চিত যে পারমাণবিক বোমা বানানো সম্ভব, তখন আর মুহূর্ত বিলম্ব করে নি প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্টের অনুমোদনক্রমে দেশের বিভিন্ন স্থানে অত্যন্ত সংগোপনে শুরু হয় বোমা বানানোর প্রাথমিক পর্যায়ের পরীক্ষা নিরীক্ষা। বছর দুয়েক ধরে চলা প্রাথমিক পর্যায়ের এই পরীক্ষা নিরীক্ষায় সাফল্য পান বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানীরা জানান, বৃহদাকারে মূল বোমা বানানো সম্ভব। বিজ্ঞানীদের এই সাফল্যের পরিণতিতে শুরু হল বৃহদাকারে মূল বোমা বানানোর প্রক্রিয়া। ১৩ আগস্ট ১৯৪২, বোমা বানানোর জন্য গঠন করা হল শীর্ষ কমিটি- ‘ম্যানহাটন ইঞ্জিনিয়ারিং ডিস্ট্রিক্ট’, লোকমুখে যা ‘ম্যানহাটন প্রজেক্ট’ হিসেবে পরিচিতি পায়। প্রজেক্টের সামরিক ও প্রশাসনিক কাজের দায়ভারসহ শীর্ষ নেতা মনোনীত হলেন লেফটেনেন্ট জেনারেল লেসলি গ্রোভস (Leslie Richard Groves)। কিন্তু বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম দেখাশোনার জন্য প্রথম ‘ডিরেক্টর’ নির্বাচিত হলেন জুলিয়াস রবার্ট ওপেনহাইমার। দুজনের উপর দায়িত্ব পড়ল, সম্পূর্ণ গোপন এক স্থানে নতুন করে নির্মাণ করতে হবে উপযুক্ত এক গবেষণাগার। সেই গবেষণাগারে অতিমাত্রায় সতর্কতা আর সুরক্ষার সাথে তৈরি করা হবে পারমাণবিক বোমা। সেই গোপন গবেষণাগার নির্মাণের জন্য উপযুক্ত স্থান নির্বাচনে ব্রতী হলেন গ্রোভস ও ওপেনহাইমার। ১৬ নভেম্বর ১৯৪২, বেশ কয়েকটা স্থান দেখার পর, নিউ মেক্সিকো প্রদেশের লস অ্যালামস (Los Alamos) স্থানটাকে নির্বাচন করেন তাঁরা। সেই দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় গবেষণাগার নির্মাণের যাবতীয় প্রক্রিয়া। ৩-৪ মাসের মধ্যেই লস অ্যালামসে গবেষণাগার নির্মাণের প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শেষ হয়। ১৫ মার্চ ১৯৪৩, অল্প কিছু টেকনিশিয়ান, স্টাফ ও বিজ্ঞানীদের নিয়ে লস অ্যালামসে এসে বসবাস শুরু করেন ওপেনহাইমার।

    প্রথম দিন থেকেই কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার আয়োজন করা হয়েছিল লস অ্যালামসে। যে সমস্ত বিজ্ঞানী, টেকনিশিয়ান, স্টাফদের লস অ্যালামসে আনা হয়েছিল, তাঁদের সাথে চুক্তিই ছিল লস অ্যালমসের চৌহদ্দির বাইরে বেরতে পারবেন না তাঁরা। তেমন প্রয়োজন পড়লে, বিশেষ অনুমতি নিয়ে লস অ্যালামস থেকে ১৫০ কিমি পর্যন্ত যেতে পারবেন তাঁরা। কোনও শর্তেই ১৫০ কিমির অধিক দূরত্ব যেতে পারবেন না কেউই। সেই কারণে লস অ্যালামসের নিকটবর্তী সমস্ত শহর, মফস্বলের হোটেল ও পানশালাগুলোর উপর গোয়েন্দাদের নজরদারি বজায় থাকত। কে কখন কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে দেখা করছে, সব কিছুর উপরই গোয়েন্দাদের নজর থাকত। এই সমস্ত অঞ্চলে বহিরাগতদের উপরও চলত তীক্ষ্ণ নজরদারি। লস অ্যালমস থেকে বাইরে বেরনো ছিল যেমন নিয়ন্ত্রিত, লস অ্যালামসে প্রবেশ করা ছিল তার থেকেও অধিক নিয়ন্ত্রণাধীন। অচেনা লোক তো দূরের কথা, কর্মচারীদের নিকট আত্মীয় স্বজনের অনুপ্রবেশও ছিল অতিমাত্রায় নিয়ন্ত্রিত। শুধু আত্মীয় স্বজন কেন, লস অ্যালামস থেকে চিঠি চালাচালিও ছিল নজরদারি ভুক্ত।

    ১৪ জুন ১৯৪৩, এক বিশেষ কাজ নিয়ে লস অ্যালামস থেকে বার্কলে শহরে আসেন ওপেনহাইমার। সড়ক পথে লস অ্যালামস থেকে বার্কলের দূরত্ব প্রায় ২০০০ কিমির কাছাকাছি। লস অ্যালামস থেকে এত দূরের কোনও শহরে যাওয়ার অনুমতি ছিল না কারোরই। যেহেতু ‘প্রজেক্ট’এর বিশেষ কাজ নিয়েই যেতে হচ্ছে তাঁকে, সেনাবাহিনীর তরফ থেকে তাই শর্ত সাপেক্ষে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। ওপেনহাইমারের বার্কলে শহরে যাওয়ার শর্ত ছিল, ২৪ ঘণ্টা তাঁর ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকবে গোয়েন্দা পুলিশ। অর্থাৎ, তিনি কখন কোথায় যাচ্ছেন, কার সাথে দেখা করছেন সব কিছুর উপরই সর্বদা নজর থাকবে গোয়েন্দাদের।

    তা সে গোয়েন্দারা নজর রাখতে চান তো রাখুন না। তিনি তো আর অন্যায় কিছু করতে যাচ্ছেন না। ‘প্রজেক্ট’এর কাজে নিয়েই যাচ্ছেন। নির্ভাবনায় তাই লস অ্যালামস থেকে রওনা দিলেন ওপেনহাইমার। বার্কলে শহরে এসে তিনি জানতে পারেন ঠিক এই মুহূর্তে বার্কলে শহরেই রয়েছেন ট্যাটলক। এতো কাছাকাছি এসে একবার দেখা করবেন না ট্যাটলকের সাথে? একবার লস অ্যালামসে ফিরে গেলে সেখান থেকে আবার কবে বেরতে পারবেন তার কোনও ঠিক নেই। আজ অন্তত একবার ট্যাটলকের সাথে দেখা করতে মন চাইছে তাঁর। মনের তাগিদেই ট্যাটলকের সাথে দেখা করলেন ওপেনহাইমার। সাক্ষাৎ হওয়া মাত্রই, পুরনো প্রেমে আবেশে মোহিত হয়ে গেলেন দুজনে। মনের আগল ভেঙ্গে প্রেমের প্লাবনে খড়কুটোর মতো ভেসে গেলেন দুজনে। ওপেনহাইমারের পিছু পিছু তখন সেখানে উপস্থিত হয়েছেন গোয়েন্দা বাহিনী। ওপেনহাইমারের সমস্ত গতিবিধির উপর নজর রেখে চলেছেন তাঁরা। তাঁর সমস্ত কার্যকলাপের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তৈরি করতে থাকেন গোয়েন্দারা। গোয়েন্দাদের করা সেই রিপোর্ট এখনও অক্ষত আছে এফবিআই দপ্তরে। ওপেনহাইমারের বার্কলে আগমন প্রসঙ্গে গোয়েন্দাদের করা সেই রিপোর্টে লেখা আছে, ”Oppenheimer, arriving at 9:45 PM, rushed to meet a young lady whom he kissed, and they walked away arm in arm”।

    সেই রাতটা যেন ছিল ট্যাটলক আর ওপেনহাইমারের রাত। হাতে হাত রেখে গল্প করতে করতে হাঁটতে লাগলেন তাঁরা। ট্যাটলককে নিয়ে একটা নামী এক হোটেলে ডিনার করতে ঢোকেন ওপেনহাইমার। কিন্তু এত দামী হোটেলে ডিনার করতে নারাজ ট্যাটলক। ট্যাটলকের পছন্দ সস্তার কোনও হোটেল, যেখানে সাধারণ মানুষ বা মেহনতি মানুষরাও স্বচ্ছন্দে যাতায়াত করতে পারেন। সেই মতো একটা সস্তার মেক্সিকান হোটেলে ডিনার সারেন তাঁরা। এই বিষয়ে এফবিআই রিপোর্টে লেখা আছে, "Drove to Xochiniloc Cafe, 787 Broarway at 10 pm. Cheap bar, café, and dance hall operated by Mexicans. Had few drink, something to eat"। ডিনারের শেষে তাঁরা চললেন স্ট্যানফোর্ড অভিমুখে। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাক্তারি পাশ করার পর, স্ট্যানফোর্ড শহরেই প্র্যাকটিস শুরু করেছেন ট্যাটলক। এখনেই একটা ফ্ল্যাট কিনেছেন তিনি। ট্যাটলকের সেই ফ্ল্যাটে এসে উঠলেন ওপেনহাইমার। এখানে রাত্রি যাপন করেন তাঁরা। ফ্ল্যাটের বাইরে থেকে তাঁদের গতিবিধির উপর তখনও নজর রেখে চলেছেন গোয়েন্দারা।

    ওপেনহাইমারের সমস্ত গতিবিধির খবর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানান গোয়েন্দারা। গোয়েন্দাদের রিপোর্ট পেয়ে ওপেনহাইমারের উপর ভয়ঙ্কর ক্ষুব্ধ হন সামরিক নেতৃত্ব। তাঁরা জানতেন ট্যাটলক হলেন একজন কমিউনিস্ট। এহেন কমিউনিস্টের সাথে এতো দহরম তো মোটেও সুলক্ষণ নয়। তাছাড়া প্রজেক্টের নির্দিষ্ট কাজে বার্কলেতে পাঠানো হয়েছিল ওপেনহাইমারকে। সেখানে গিয়ে তো যাচ্ছেতাই রকমের ফষ্টিনষ্টি করছেন তিনি। এখনই ডিরেক্টর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হোক ওপেনহাইমারকে- দাবি করেন সামরিক নেতৃত্ব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই রকম কোনও পদক্ষেপ অবশ্য নেওয়া হয় নি।

    এল নতুন বছর ১৯৪৪ সাল। জগত বিচ্ছিন্ন হয়ে সংগোপনে বোমা বানানোর কাজে মত্ত লস অ্যালামস। বোমা বানানোর কাজে তখন চূড়ান্ত ব্যস্ত ওপেনহাইমার। এমন সময়ে এল এক মর্মন্তুদ সংবাদ। আত্মঘাতী হয়েছেন জিন ট্যাটলক। ৫ জানুয়ারি ১৯৪৪, বার্কলে শহরে আত্মহত্যা করেন ট্যাটলক। সংবাদ আদান প্রদানে বিধি নিষেধ থাকায় তখনই সংবাদটা জানতে পারেন নি কেউই। সামরিক বিভাগের গোয়েন্দাদের থেকে সংবাদটা পান লস অ্যালামসের সিকিউরিটি চিফ। তিনিই ওপেনহাইমারকে ট্যাটলকের মৃত্যু সংবাদটা জানান। সেই সংবাদ শুনে অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে থমথমে মুখে তাঁর অফিসেই বসে রইলেন ওপেনহাইমার। দুচোখ জলে ভরে উঠেছে তাঁর। অবিশ্বাস্য সংবাদ! ট্যাটলক নেই- এমন কথা মানতেই পারছেন না তিনি। তাঁর চোখে তখন ভিড় করে আসছে ট্যাটলকের স্মৃতি। কান্না ভেজা সেই স্মৃতির মধ্যেই একান্তে ঢুবে রইলেন ওপেনহাইমার।

    কেন আত্মঘাতী হলেন ট্যাটলক? প্রচলিত ব্যাখ্যা অনুসারে, ট্যাটলক ছিলেন ভীষণ একরোখা ও জেদি প্রকৃতির মহিলা। যে কাজই তিনি করতেন সেই কাজে সমস্ত মন প্রাণ অর্পণ করে দিতেন। দ্বিতীয় বা বিকল্প কিছুতে বিশ্বাস করতেন না তিনি। ফলবশতই প্রায়ই আশাভঙ্গ হতে হত তাঁকে। যা থেকে প্রায়ই মানসিক অবসাদে ভুগতেন তিনি। ট্যাটলক নিজে মনোরোগ নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। ডাক্তারি পাশ করার পর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ (psychiatrist) হিসেবে প্রাকটিস শুরু করেন তিনি। তিনি নিজেই নিজের মানসিক অবসাদের চিকিৎসা করতেন। প্রায় নিয়মিত তিনি বারবিচুরেট (Barbiturates) ও ক্লোরাল হাইড্রেট (Chloral hydrate) গ্রহণ করতেন। মূলত ঘুমের ওষুধ হিসেবে পরিচিত এই ওষুধগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছিল বেশি রকমের। ট্যাটলকের পোস্টমর্টেম রিপোর্টে, তাঁর দেহে এই দুই ওষুধের উপস্থিতির কথা উল্লেখ করা আছে। তবে দুটো ওষুধই ছিল পরিমিত পরিমাণে। মধ্যাহ্ন ভোজের পর এই ওষুধ গ্রহণ করেছিলেন ট্যাটলক। তারপর বাথটবে ঢুবে মারা যান তিনি। তাঁর মৃত্যু যে কোনও দুর্ঘটনা নয় তার প্রমাণ তাঁর সুইসাইড নোট। সেই নোটে তিনি লিখে গেছেন, “I am disgusted with everything ... I wanted to live and to give and I got paralyzed some how. ... I think I would have been a liability all my life—at least I could take away the burden of a paralyzed soul from a fighting world.”

    পেশায় চিকিৎসক ছিলেন জিন ট্যাটলকের দাদা হিউ ট্যাটলক (Hugh Tatlock)। বোনের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে মনে করেন না ডা. হিউ। ট্যাটলকের দেহে যে পরিমাণে ঘুমের ওষুধ পাওয়া গেছে তা আত্মহত্যার জন্য যথেষ্ট নয় বলেই মনে করেন তিনি। আত্মহত্যা করতে হলে এর থেকে অনেক বেশি পরিমাণে ঘুমের ওষুধ ব্যবহার করতে হয়। ডা. হিউর মতে, আত্মহত্যা নয়, এটা হত্যা। ম্যানহাটন প্রজেক্টের গোয়েন্দাদের সুচতুর কাজ এটা। ডা. হিউর মতো আরও অনেকই মনে করেন, আত্মহত্যা নয়, হত্যা করা হয়েছে ট্যাটলককে। কারণ, জিন ট্যাটলক সর্বদাই গোয়েন্দাদের নজরবন্দী ছিলেন। তাঁর সমস্ত কার্যকলাপের উপর নজর থাকত গোয়েন্দাদের। তাঁর ফোনেও আড়ি পেতে রেখেছিলেন গোয়েন্দারা। তাই অনেকেই মনে করেন ট্যাটলকের মৃত্যুর জন্য গোয়েন্দারাই দায়ী। ইউএসর এক চিকিৎসক তো চমৎকার ভাবে বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করে বলেছেন- নেশা করিয়ে জলে ফেলে দেওয়াই হল সব থেকে বুদ্ধিমত্তার খুন।

    ।। ৩ ।।
    এল নতুন বছর- ১৯৪৫ সাল। এক বছর হল মারা গেছেন ট্যাটলক। এদিকে লস অ্যালামসের বিজ্ঞানীরাও প্রায় শেষ করে ফেলেছেন বোমা তৈরির কাজ। কয়েক মাসের মধ্যেই পরীক্ষামূলক ভাবে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটাতে চলেছেন তাঁরা। প্রচণ্ড শক্তিশালী এই পারমাণবিক বোমা তো আর লস অ্যালামসের ল্যাবেরেটরিতে বসে বিস্ফোরণ ঘটানো যাবে না। তাহলে তো গোটা শহরটাই উড়ে যাবে বিস্ফোরণে। ঠিক করা হল, বিস্ফোরণ ঘটানো হবে নির্জন মরুভূমিতে। লস অ্যালামসের ৩৫০ কিমি দক্ষিণে রয়েছে হোরনাডা ডেল মোরাটো মরুভূমি। বিস্ফোরণের স্থান হিসেবে এই মরুভূমিকেই নির্বাচন করা হল। ওপেনহাইমার সমেত এক দল বিশেষজ্ঞ পর্যবেক্ষণ করে এলেন সেই মরুভূমি। মরুভূমির মাঝামাঝি একটা স্থান নির্বাচন করলেন তাঁরা। সেই স্থানেই ঘটানো হবে পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ। ঠিক যে জায়গায় বিস্ফোরণটা ঘটানো হবে বলে স্থির করলেন তাঁরা, সেই স্থানের তো কোনও নাম নেই। জনশূন্য সেই মরুভূমিতে কেইবা সেই স্থানের নাম দেবেন? কার জন্যইবা নাম দেবেন? কিন্তু নামহীন সেই প্রান্তরের একটা নাম তো দিতেই হয় এখন। ওপেনহাইমার বললেন, এই স্থানটার নাম দেওয়া হল ‘ট্রিনিটি সাইট’। ট্রিনিটি সাইট? কেন, ট্রিনিটি সাইট কেন? এতো নাম থাকতে হঠাৎ ট্রিনিটি সাইট নামে কেন ডাকা হবে? না, ঠিক তখনই এই প্রশ্নগুলো করেন নি কেউই। কারণ, সেই মুহূর্তে তাঁদের সামনে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল বোমা বিস্ফোরণ। ঠিক সেই সময়ে তাই এই প্রশ্নগুলো ছিল নিতান্তই অবান্তর। সেই স্থানের নামকরণ নিয়ে তাই মাথা ঘামান নি কেউই।


    জুলাই ১৯৪৫, প্রথম পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর বিদীর্ণ ট্রিনিটি সাইট পর্যবেক্ষণরত দুই শীর্ষ নেতা জুলিয়াস রবার্ট ওপেনহেইমার এবং লেফটানেন্ট জেনারেল লেসলি রিচার্ড গ্রোভস।


    পাঠক নিশ্চয় এখন বুঝতে পারছেন, ট্রিনিটি সাইট নামকরণের পিছনে ঠিক কি মনস্তত্ত্ব কাজ করেছিল ওপেনহাইমারের মনে? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। ট্রিনিটি সাইট নামকরণের পিছনে রয়েছে ট্যাটলকের ছায়া। ওপেনহাইমারের কাছে ট্রিনিটি মানে ট্যাটলক। ওপেনহাইমারের কাছে ট্রিনিটি মানে জন ডনের লেখা Batter my heart, three-person'd God। ট্যাটলকের বড় প্রিয় কবিতা ছিল এটা। ট্যাটলক মারা যাওয়ার পর, ১ বছরেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেল। ট্যাটলকে এখনও ভুলতে পারেন নি ওপেনহাইমার। ভুলতে পারেন নি Batter my heart কবিতায় জন ডনের আর্তি। কবিতার মধ্য দিয়ে আত্মনিগ্রহের যে চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন কবি, আজ যেন সেই ব্যথাই অনুভব করছেন তিনি তাঁর মনে। শুধু ট্যাটলকের মৃত্যুই নয়, বোমা বানানোর এই কর্মকাণ্ডের জন্যও আজ তিনি ব্যথিত। ওপেনহাইমার জানেন তাঁর তৈরি এই পারমাণবিক বোমা অচিরেই মারণাস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে। তিনি চান না তাঁর তৈরি বোমা মানব নিধন যজ্ঞে ব্যবহৃত হোক। কিন্তু তাঁর কর্মের নিয়ন্ত্রক তো তিনি নন। আজ তাই রক্তাক্ত তিনি। জন ডনকে অনুসরণ করে আজ যেন তাঁর বলতে ইচ্ছে করছে, ‘আরো আরো প্রভু আরো আরো/ এমনি করে আমায় মারো’। তাঁর অন্তরের সমস্ত বেদনা, ক্রন্দন, আক্ষেপ যেন মুক্তি পেল এই ‘ট্রিনিটি সাইট’ নামকরণের মধ্যে দিয়ে।

    ১৬ জুলাই ১৯৪৫, সোমবার, ভোর ৫.৩০, ট্রিনিটি সাইটে পরীক্ষামূলক ভাবে বিস্ফোরণ ঘটানো হল প্রথম পারমাণবিক বোমার। বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের নিক্তিতে সম্পূর্ণ সফল হল সেই পরীক্ষা। আর তারপরই ঘটল মানব সভ্যতার সবথেকে নারকীয় কাণ্ড। ৬ ও ৯ আগস্ট ১৯৪৫, পারমাণবিক বোমায় বিধ্বস্ত হল জাপানের হিরোশিমা আর নাগাসাকি শহর। পরিণতিতে আত্মসমর্পণ করল জাপান। পরিসমাপ্তি ঘটল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের।

    থামল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হল জীবন যাত্রা। ট্রিনিটি সাইটে পরীক্ষামূলক ভাবে প্রথম বোমা বিস্ফোরণের পর কেটে গেল অনেকগুলো বছর। মানুষের মনে কিন্তু তখনও জেগে আছে সেই প্রশ্ন- কে এই ট্রিনিটি সাইট নামকরণ করেছিলেন? কেন করেছিলেন? প্রশ্নটা তখনও জনমানসে এতটাই জীবন্ত যে, প্রশ্নের নিষ্পত্তি করতে এগিয়ে এলেন লেফটানেন্ট জেনারেল লেসলি গ্রোভস। সেটা ১৯৬২ সাল, ট্রিনিটি সাইট নামকরণ প্রসঙ্গে ওপেনহাইমারকে তিনি জিগ্যেস করেন, ‘ট্রিনিটি সাইট নামটা কি আপনিই দিয়েছিলেন?’ প্রত্যুত্তরে ওপেনহাইমার জানান, “হ্যাঁ এই নামটা আমি দিয়েছিলাম বটে … তবে এখন আর ঠিক মনে নেই কেন এই নামটা দিয়েছিলাম। যতদূর মনে পড়ছে জন ডনের লেখা একটা কবিতা থেকে এই নামটা দিয়েছিলাম, Batter my heart, three-person'd God”।

    না, গ্রোভসকে দেওয়া ওপেনহাইমারের এই বয়ানে ট্যাটলকের নাম নেই। কিন্তু রয়েছে জন ডনের নাম। আর ওপেনহাইমারের কাছে জন ডনের কবিতা মানেই ট্যাটলক। অর্থাৎ ট্যাটলককে ভোলেন নি তিনি। ট্যাটলক আজও শায়িত আছেন তাঁর হৃদয়ে। স্নিগ্ধ মোমের আলোর মতো চিরকালই তাঁর অন্তরে প্রজ্বলিত থাকবেন ট্যাটলক। তাঁর কাছে এক বেদনার নাম ট্যাটলক। এক বাঁধনহীন উদ্দাম প্রেমের নাম ট্যাটলক। এক লাল টুকটুকে স্বপ্নের নাম ট্যাটলক। ট্যাটলকের মৃত্যু নেই। মৃত্যু নেই ট্যাটলক-ওপেনহাইমার প্রেম কাহিনীর। ট্রিনিটি সাইটের বিদীর্ণ মাটির খাঁজে খাঁজে আজও লেখা আছে তাঁদের অমর প্রেম কাহিনী।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২০ আগস্ট ২০২৩ | ১২২৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • দীমু | 182.69.***.*** | ২০ আগস্ট ২০২৩ ২০:১০522736
  • yes​​
  • dc | 2401:4900:1cd1:121e:f8af:ee8c:f571:***:*** | ২০ আগস্ট ২০২৩ ২০:২৮522739
  • দারুন ভালো লাগলো। প্রোজেক্ট ম্যানহাটান নিয়ে নানা বই পড়েছি, কিন্তু এই দিকটা কখনো পড়িনি। লেখককে ধন্যবাদ। 
  • জয়ন্ত | 2409:4060:200:2020::113f:***:*** | ২১ আগস্ট ২০২৩ ০৬:১৬522765
  • খুব ভালো লেখা।
  • :|: | 174.25.***.*** | ২১ আগস্ট ২০২৩ ০৮:২১522768
  • ঠিক। একটা  না-জানা দিক। চাঁদের সাউথ পোলের আলো। :)
    সন্দেহবাতিকওলা মন বলছে যদি, মানে একেবারেই "যদি", খুন হয়ে থাকে তবে বিজ্ঞানী নিজেই পাথরটা ইচ্ছাকৃত ভাবে ঠেলে দেননি তো? বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের প্রতিশোধ? উনি জানতেন মেয়েটির পলিটিক্যাল স্ট্যাটাস, উনি এও জানতেন গোয়েন্দারা সঙ্গে আছে। এর পরিণতি কী হতে পারে সেটা খুবই অবভিয়াস।
    মানুষের মন বড় বিচিত্র।
  • &/ | 107.77.***.*** | ২১ আগস্ট ২০২৩ ০৮:৩৪522770
  • এঁরা একেবারে কোনো প্রোটেকশন ছাড়া শুধু সাধারণ পোশাক পরে বিস্ফোরণের পরে ওই সাইটে দাঁড়িয়ে আছেন !!!!কী সাংঘাতিক!!!  রেডিয়েশনের অবস্থা কী ? ওরে বাবা !!!
  • মোহাম্মদ কাজী মামুন | ২১ আগস্ট ২০২৩ ২৩:১৫522814
  • '' প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের প্রতি তাঁর আকর্ষণের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল- গীতা। মূল সংস্কৃত ভাষায় গীতা পড়ার জন্য সংস্কৃত ভাষা শিখেছিলেন তিনি। '' 
    এ কিন্তু অনেকে মানতে চাইবেন না যে গীতা সাহিত্য। অনেকের কাছেই এ শুধুই ধর্মগ্রন্থ। 
    অসাধারণ রোমাঞ্চকর একটি কাহিনি পড়লাম। খুব ভাল লাগল। সুইসাইড নোট টা তীরের মত বিঁধল। 
     
  • kk | 2607:fb91:149f:50ef:267:eb00:bd75:***:*** | ২১ আগস্ট ২০২৩ ২৩:৪৮522817
  • ভালো লাগলো।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন