‘ঠিক আছে, দশ টাকা বাড়ায় নিও’ – যদিও লোকটির দাবির মুখে বলল, মনটা খচ্খচ্ করছিল সৈকতের। রাস্তাটা সত্যি খারাপ ছিল, না হলে…।
এরপর ‘আর পাঁচডা টাকা দিয়েন, কাহা’। বলেই লোকটি তাকে গদিতে বসিয়ে দিল আর প্যাডেল মারতে শুরু করল। লোকটার বয়স ষাটের উপর নিশ্চিত, এমনকি সত্তরও হতে পারে। হাড়গুলো বেরিয়ে পড়েছে। তপ্ত সূর্যের মত খটখটে মুখ, ভাবলেশহীন চোখ।
উপরে হচ্ছিল উড়াল রেলপথ, আর তাতে করে রাস্তাটিকে ভাঙা হয়েছিল ইচ্ছেমতন একটুও দয়া বা সন্মান না দেখিয়ে। ফলে জায়গায় জায়গায় খানা খন্দ তৈরী হয়েছিল, গ্রামের পাকা রাস্তার পাশে দেখতে পাওয়া লিকলিকে খন্দগুলোর সাথে এগুলোর পার্থক্য এইটুকুই যে ওরা প্রাকৃতিক, আর এরা কৃত্রিম।
অতিরিক্ত ভাড়ার টেনশানটা কিছুতেই যাচ্ছিল না সৈকতের, “আরেকটু দাঁড়ালেই হইত, বুইড়া সুযোগ বুইঝা কোপ মারছে!” হঠাৎ সে তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো, ‘এই দাঁড়াও, দাঁড়াও’। চালকটি একটি ঘুরতি পথ ধরতে শুরু করেছিল।
“এইদিক দিয়াও একটা রাস্তা আছে, কাহা। চিন্তা কইরেন না, জায়গামত নামায় দিমু কইসি তো!”
“আমার একদম টাইম নাই, বুজলা? ধানাই-পানাই বাদ দিয়া সোজা রাস্তা ধরো।” সময়ের হেরফের পাঁচ মিনিটের বেশী হওয়ার কথা না, কিন্তু পেছন দিক তাকিয়েই কপালের রগগুলো ফুলে উঠলো সৈকতের! বুইড়া বেজায় চালাক!
ঘাড় প্রায় সোজা রেখেই কয়েক সেকেন্ডের জন্য সাদা চুলভর্তি মাথাটা নাড়ালো বৃদ্ধ চালক। তারপর কোমরের গামছাটা খুলে তার একটা কোনা দিয়ে মুখের ঘামটুকু মুছে সেখানে একটুকরো হাসি ফোটাল। এরপর ঘুরতি পথ থেকে ঘুরিয়ে একটা বিশাল রানআপ ধরে রিকশাটা ছোটাতে শুরু করল সে। কিন্তু কানা খোঁড়া রাস্তাটা যতই এগুতে লাগল, গতি ততই কমে আসতে লাগলো। একটি শক্তসামর্থ হলদে বুলডোজার পাশেই সুঁচোলো দাঁত বসিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল রাস্তাটার হাড়গোড়। কোথাও শুধুই মাটি, কোথাও কংক্রিট, কোথাও বা বেঁচে যাওয়া এক স্কোয়ার পিচ – দেহের ভারসাম্য রাখতে গেলে রিকশা সরছিল, আর রিকশাটা ধরে রাখতে গেলে দেহটা উড়ছিল - কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা সুপারভাইজার প্রবল ভৎর্সনা করে চালকটিকে, এমন আহাম্মকি করে কেউ! জেনেশুনে ডেথ ভ্যালিতে! হয়ত কোট-টাই পরিহিত প্যাসেঞ্জার দেখেই ফিরে যেতে বলে না।
একটা সময় বৃদ্ধ চালক গদি থেকে নেমে দাঁড়ালো। মনে হচ্ছিল সে বোধহয় ইস্তফা দিয়েছে। কিন্তু কিছুক্ষণ জিরিয়ে সে যখন হাতে টানতে শুরু করল তার যানটিকে, সৈকতের অস্থি-মজ্জা জয়েন্টে জয়েন্টে শক্ খেতে লাগলো, জাহান্নামের পুলসিরাত পার হচ্ছিল যেন সে! এরপর এক বাঁধভাঙ্গা ক্রোধের ম্যাগাজিন থেকে তুলে নেয়া ‘চোখের মাথা খাইছস, হারামির বাচ্চা?’ –
হুংকারটা যখন টার্গেট লাইন ছুঁইছুঁই করতে থাকলো, ঠিক তখুনি একটি অসম কোণের বড়সড় গর্তে আবিষ্কার করল সে নিজেকে। গর্তটা শান্ দিচ্ছিল ঝলসানো রোদে, আর কিনারের নালাটা দিয়ে উঁকি মারছিল পিচ কালো ক্ষুদে জীবের দল!
যখন উঠে দাঁড়ালো, একটা পাহাড়ও তার সাথে সাথে উঠে এল! প্যান্ট, শার্ট, হাত, মুখ ও মাথা থেকে ধূলো ঝাড়তে ঝাড়তে দেখতে পেল অদূরেই রিকশাওয়ালাটি তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে, সেই ভাবলেশহীন চোখেই।
বেশীদূর খুঁজতে হল না, রাস্তাটার ওপারেই চোখে পড়ল এক বড়সড় ডেস্পিনসারি। ওদিকে পা চালানোর আগে পকেট হাতড়ে দেখে নিল মানিব্যাগটা অবিকল আগের মতই আছে কিনা। দোকানটা থেকে প্যারাসিটামল কিনে নিল, যতগুলো পেল। আজকে আর জায়গাটায় যাওয়া হবে না। একটা মেসেজ করে দিতে হবে, ‘সিরিয়াসলি ইনজিউরড, প্লিজ স্পেয়ার মি ফর দ্যা মিটিং।’
যাক্, পনেরোটা টাকা অতিরিক্ত আর দিতে হয়নি! উল্টো মূল ভাড়াটার পুরোটাই রয়ে গেছে পকেটে। বাতাসের ঝাপ্টায় কপালে এসে পড়া চুলগুলিকে জায়গায় পৌঁছে দিয়ে সে নতুন একটি রিকশা খুঁজতে লাগলো, আর একটি সমান রাস্তা, বাড়িতে পৌঁছুনোর জন্য।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।