বইটির কথকতা শুরু হয়েছে ৯৩ বছরের ভি এন ডাটের স্মৃতিচারণা দিয়ে। হত্যাকাণ্ডের ৭ বছর বাদে জন্মানো মানুষটি কান্নায় ভেঙে পড়েন সেদিনের কথা বলতে গিয়ে, আর কথক বলেন, সে জায়গাটা 'বাগানে পরিণত হওয়া তখন ছিল কল্পনারও অতীত!' হঠাৎ সেদিনের অসহনীয় শোক তার সমস্ত তীব্রতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এক অর্বাচীন পাঠকের ওপর, কারণ সদ্যই সে ফিরেছে ঐ তীর্থ পরিক্রমা করে। শব্দের কী বিচিত্র শক্তি! কত স্বল্প আয়াসেই সে মিলিয়ে দিতে পারে চোখে দেখা, কানে শোনা আর পাঠসঞ্জাত উপলব্ধিকে।
যা ছিল হাহাকার থেকে উদ্ভূত এক বিরাট অনুভূতি-স্থল, দেশপ্রেমের চরম নিশান, তা হয়ে গেল 'বাগান', প্রমোদ-উদ্যান না হলেও ভ্রমণবিলাসীর রম্য কানন! তবে কি পাঞ্জাবেরই একার দায় ইতিহাসের এই রক্ত দিয়ে লেখা অধ্যায়কে অটুট রাখবার? দিল্লি- হরিয়ানা সীমান্তে কিষাণ কিষাণীরা উধম সিং-এর ছবি-আঁকা প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে আন্দোলন করেন আর আমরা দলে দলে ছুটি ওয়াগা বর্ডারে, যেখানে দু দেশের ইউনিফর্ম পরা সৈনিকের দল ঝুঁটিওয়ালা মোরগের মতো বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে রোজ অবনমিত করে যার যার দেশের পতাকা। প্রবল করতালি, হাজার মোবাইলের ঝলকে শেষ হয় সেই বিচিত্র নাচনকোঁদন, নকল দেশপ্রেমের উচ্ছাসে আকাশ বাতাস ভরে ওঠে। অথচ জালিয়ানওয়ালাবাগ আমাদের ভ্রমণ সূচিতে কদাচিৎ থাকে, ঘরের শিশুটিকে কখনও বলি না উধম সিং, ভগত সিং-এর কাহিনি! এই সত্যিকারের শহিদ-এ-আজমদের ভুলে গিয়ে নির্মাণ হতে থাকে নতুন শহিদ, ব্রিটিশের কাছে লেখা মুচলেকাকে কার্পেটের নীচে ঠেলে দিয়ে শহিদত্ব আরোপকে নতমস্তকে মেনে নিই।
এইখানে, এই পরিস্থিতিতে আলোচ্য বইটির গুরুত্ব অসীম। খুবই সুলিখিত, অজস্র সাদা কালো ছবিতে সাজানো বইটি হাত ধরে আমাদের নিয়ে যায় সঠিক ইতিহাসের কাছে, সেই অর্থে সত্যেরও কাছাকাছি।
একথা কি ঠিক স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ ছিল সকলের, কিন্তু সামনের সারিতে ছিল পাঞ্জাব আর বাংলা? প্রবাসী থেকে লেখক-উদ্ধৃত অংশ আমাদের পরিষ্কার জানায় রাওলাট এক্ট পরবর্তী পাঞ্জাব যেন ঠিক এখনকার কাশ্মীর! সেখানে কেউ যেতে আসতে পারছে না, সামরিক আইনে যাদের বিচার হচ্ছে তাদের আইনি সহায়তা দেবার কেউ নেই। এমনকি বাংলা চিঠি খুলে পড়ার জন্য বাংলা থেকে অনেক বাঙালি ক্লার্ক অবদি নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। একটা সময় ছিল যখন গোটা দেশে ১৩ই এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগ দিবস পালিত হত। অনেকে উপবাসে থাকতেন, অরন্ধন রাখতেন। আর আজ? ইতিহাসে বইয়ের পাতায় চার লাইন। তাও আছে কিনা আমি সঠিক জানি না।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডে শুধু নাইটহুড ত্যাগ করেই রবীন্দ্রনাথের কাজ শেষ হয়নি, তার প্রমাণ এই বইয়ে পরিশিষ্টতে গ্রন্থিত দুটি চিঠি। চিঠিদুটির প্রেরক এন্ড্রুজ, প্রাপক রবীন্দ্রনাথ। চিঠি দুটি সাক্ষ্য দিচ্ছে, কোনো তদন্ত কমিশন বসবার আগেই কবির নির্দেশে এন্ড্রুজ পৌঁছে গিয়েছিলেন পাঞ্জাবে, গ্রামে গ্রামে ঘুরে অসংখ্য লোকের সঙ্গে কথা বলে, সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করে, বোঝার চেষ্টা করেছিলেন জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যার এবং তার পরবর্তীতে সাধারণ মানুষের ওপর শাসকের নামিয়ে আনা চূড়ান্ত অবদমনের স্বরূপকে। গ্রামের পর গ্রাম সফর করেছেন এন্ড্রুজ এবং স্বচক্ষে দেখেছেন কিভাবে মানুষ সন্ত্রাসের বলি হচ্ছে। গোটা গ্রামে নির্বিচারে গুলি বর্ষণ চলছে, পুরুষদের বলপূর্বক নাঙ্গা করে দিয়ে দুপুরের খরতাপে ঘন্টার পর ঘন্টা মাটিতে উপুড় করে শুইয়ে রাখা হচ্ছে। মেয়েদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, ঘর গেরস্থালী তছনছ করে দেওয়া, অসংখ্য মানুষকে কারারুদ্ধ করা এসবই ঘটে যাচ্ছিল গ্রামীণ পাঞ্জাবে। দলে দলে মানুষ আসছিল এন্ড্রুজ সাহেবকে তাদের দুর্দশার কথা জানাতে। তারা দু হাত তুলে আশির্বাদ জানাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথকে, যিনি খেতাব ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে তীব্র ভাষায় লাগাতার প্রতিবাদ করে যাচ্ছিলেন এই পরিকল্পিত গণহত্যার বিরুদ্ধে। ভাইসরয়কে লেখা চিঠির ছত্রে ছত্রে ফেটে পড়ছিল সেই প্রতিবাদ। রবীন্দ্রনাথের এই ভুমিকা খুব বেশি মানুষ জানেন না, আমাদের দৌড় ঐ নাইটহুড ত্যাগ অবদিই। তাই ভবিষ্যতের গবেষকদের কাছে এ চিঠিদুটি অমূল্য। এদের সংগ্রহ করা, অনুবাদ করিয়ে সংকলিত করা গবেষক- লেখকের মূল্যবান কৃতিত্ব।
একটা তফাত কিন্তু চোখে পড়ে। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সেদিন সারা দেশ গর্জে উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথের খেতাব ত্যাগ ও লাগাতার প্রতিবাদ ইতিহাসের অঙ্গ। কিন্তু আজ অন্যায়ের বিরুদ্ধে এইরকম সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিবাদ চোখে পড়ে কই? তার কারণ কি কেবলই রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের জাল বহুগুণ শক্ত হওয়া? আমাদেরও কি তাতে কোনও দায় নেই? আত্ম-পর্যালোচনায় উৎসাহ হারান জাতিই তো শেষ অব্দি আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়ে। এই বিশাল দেশে বর্তমান অবস্থা দেখে মনে সেই অধোগতির দিকেই আমাদের অনিবার্য যাত্রা!
লড়াই সংগ্রামে মেয়েদের ভূমিকা আলাদা করে উল্লেখ করবার রেওয়াজ ছিল না বহুদিন। এখন হয়েছে, লেখক এই বইতে তার পূর্ণ সদব্যবহার করেছেন। মাতা আত্তর কৌর, রত্তন দেবী, পূরণ দেবীদের কথা তিনি বলেন গভীর মমতার সঙ্গে। প্রথম জন ইংরেজ সরকারের দেওয়া ক্ষতিপূরণের টাকা তিন তিন বার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। অথচ স্বামীকে হারিয়েছেন বাগের সেই কুখ্যাত দিনে, ঘরে তিন শিশু সন্তান। রত্তনের সম্বন্ধে জনশ্রুতি তিনি সারা রাত লাঠি হাতে স্বামীর মৃতদেহকে কুকুরের দাঁত থেকে রক্ষা করেছিলেন। শেষের জনের আত্মত্যাগ বড়ই করুণ, একটু উদ্ধৃত করি তাঁর কথা, " স্বামী যখন মারা যান, তখন তাঁর বয়স ১৯। গর্ভে একমাত্র সন্তান। সুনীল বলছিলেন, পরে যাতে কলঙ্ক না রটে, তাই তার প্রপিতামহের দেহ সৎকার হওয়ার পূর্ব মূহুর্তে সমবেত জনতাকে পরিবারের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে ঘরের বৌটির গর্ভে লালিত হচ্ছে 'শহিদ' স্বামীর সন্তান! মেয়েটির শোক-নিভৃতি এখানে ধর্তব্যের মধ্যেই নয়! "(পৃষ্ঠা ৪৭)
৭৫ বছরের বৃদ্ধা এই নীরক্ত স্বাধীনতা শুধু চেয়ে দেখছে ফাদার স্ট্যান স্বামীর হত্যা, সাইবাবার হেনস্থা। শত সহস্র সাধারণ মানুষের হেনস্তা আর খিদেয় কুঁকড়ে মরা। অতিমারির সময়কার চরম দুর্দশা। সবই সে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে, কারণ বাজারে চলে এসেছে দুটি ক্ষমতাবান শব্দ, উন্নয়ন আর পরিবর্তন। আজ ম্যুরাল বাহারি বাগান ইত্যাদি দিয়ে সাজিয়ে " ভ্যানিশ" করে দেওয়া হল বাইরে বেরোবার পথ রুদ্ধ করে রাখা সেই অন্ধগলির ভয়াবহতা আর আতঙ্ক। আজকের জালিয়ানওয়ালাবাগে ট্যুরিস্টের দিল খুশ। পয়সা ভি উসুল। অনুভবের কোনো দায় তার নেই। তার সহায়ক পরিবেশও নেই। লেখক উদবেগ প্রকাশ করেছেন যে শোনা যাচ্ছে এই সৌন্দর্যায়নের পরের বলি সবরমতী আশ্রম। কিন্তু ইতোমধ্যে আর একটি বলি চড়েছে, সেটি হচ্ছে দিল্লির লাল কেল্লা। বিশাল বিশাল চারতলা প্রাসাদ হেরিটেজ স্থলে কী ভাবে নির্মিত হল জানি না। টয়লেট, খাবার দোকান, কফির স্টল, ২৪ ঘন্টার লাইট এন্ড মিউজিক, কী নেই সেখানে! এমনই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা, মনে হয় প্রাচীন সৌধ তার সমস্ত সৌন্দর্য আর ইতিহাস হারিয়ে পরিণত হয়েছে এক হট্টমেলায়।
তাই প্রায়ই বেরিয়ে পড়ি। ঘুরে বেড়াই এই দেশের কোণায় কোণায়। সব ধ্বংস হয়ে যাবার আগে চোখ ভরে উঠুক। এই বইটি পড়ে আবার যাব জালিয়ানওয়ালাবাগে। দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে যে ইতিহাস তাকে সযত্নে ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে এই বইটির পাতায় পাতায়। সেই অর্থে এটি একটি অমূল্য দলিল। অনেক আদরে একে বার বার পড়ে চলেছি। আর ধন্যবাদ জানাচ্ছি লেখক প্রকাশক এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে।
শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত
দে'জ পাবলিশিং
মুদ্রিত মূল্য ৩৯৯ টাকা