এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  ইতিহাস

  • ধর্মাধর্ম – পঞ্চম পর্ব  - চতুর্থ ভাগ 

    Kishore Ghosal লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ইতিহাস | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১২৯১ বার পঠিত | রেটিং ৪.৫ (২ জন)
  • ধর্মাধর্ম – পঞ্চম পর্ব  - চতুর্থ ভাগ
    ৫..১ শ্রীমদ্ভাগবতের কৃষ্ণ
    শ্রীমদ্ভাগবত পূর্ণতঃ বিষ্ণুর মহিমা বর্ণন। তার মধ্যে অবশ্যই সিংহভাগ দখল করেছেন শ্রীকৃষ্ণ। এই পুরাণে শ্রীকৃষ্ণের মর্ত্যলীলার যাবতীয় ঘটনার কথা জানা যায়। শ্রীকৃষ্ণের জন্ম বিবরণের কথা ভারতীয় হিন্দুদের অতি পরিচিত, সে বর্ণনায় যাচ্ছি না। একটিমাত্র বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। কৃষ্ণের জন্মের পরেই মাতা যশোদার কন্যার সঙ্গে মাতা দেবকীর পুত্রের বদলাবদলি ঘটিয়ে ছিলেন পিতা বসুদেব। মাতা দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান ভেবে, রাজা কংস এই কন্যাটিকে যখন হত্যা করতে গেলেন, দেখা গেল, এই কন্যা কোন সাধারণ শিশু নয়, তিনি দেবী যোগমায়া। তিনি অষ্টভুজা দেবী, তাঁর হাতে ধনু, শূল, বাণ, চর্ম, খড়গ, অসি, চক্র ও গদা। তিনি দিব্যমালা, বসন ও রত্ন-অলংকারে ভূষিতা। পুজোর অর্ঘ নিয়ে তাঁর সঙ্গীরা - সিদ্ধ, চারণ, গন্ধর্ব, কিন্নর, অপ্সরা ও উরগগণ - তাঁর স্তুতি করছিল। বলা বাহুল্য, এই দেবী অনার্য দেবী, কৃষ্ণের জন্মের নিরাপত্তার জন্যেই তিনি মাতা যশোদার গর্ভে আবির্ভূতা হয়েছিলেন।
     
    এরপর কৃষ্ণের শৈশব, বাল্য ও কৈশোরের নানান আশ্চর্য লীলার কথা আমরা সকলেই জানি, তবুও আরেকবার সংক্ষেপে আলোচনা করে নেওয়া যাক।

    রাজা কংস দেবকীর কন্যা সন্তানের দেবী রূপ দেখেও নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না, কারণ অন্তর্হিত হওয়ার আগে দেবী ঘোষণা করেছিলেন, “রে দুষ্ট কংস, আমাকে মেরে তুই কী করবি? তোর শত্রু তোর মৃত্যুরূপে কোথাও না কোথাও জন্ম নিয়েছেন। অতএব, এরপর তুই আর অন্য নিরাপরাধ শিশুদের অকারণ বধ করিস না”। কংসের মন্ত্রণাদাতারা সকলেই ছিলেন, রাক্ষস বা দৈত্য-দানব। তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করে, তিনি স্থির করলেন, মথুরা, ব্রজ (বৃন্দাবন) এবং আশেপাশের গ্রামের শিশুদের, যাদের বয়স দশদিনের আশেপাশে, তাদের হত্যা করবেন। ভোজরাজ কংসের এই “কৃষ্ণ-হত্যা” সিদ্ধান্তের সঙ্গে রোম প্রশাসক হেরডের “যিশু-হত্যা” ঘোষণার আশ্চর্য মিল। দুই কাহিনীর কোনটি মূল এবং কোনটি অন্যকে প্রভাবিত করেছিল, আজ তার হদিশ খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।

    শ্রীকৃষ্ণ শৈশব থেকেই অলৌকিক শক্তির অধিকারী, আর হবে নাই বা কেন, মানুষের রূপে তিনিই যে পরমপুরুষ পুরুষোত্তম ঈশ্বর বিষ্ণু। তাঁর নিত্য সঙ্গী ছিলেন তাঁর বৈমাত্রেয় দাদা, বলরাম, গোপরাজা নন্দর পত্নী রোহিণীর পুত্র। তিনিও বিষ্ণুর অংশ-অবতার। দুই ভাইকে একত্রে রাম-কৃষ্ণও বলা হত। শৈশব থেকে বাল্য বয়েসের মধ্যেই তিনি অনেকগুলি কীর্তি করে ফেললেন। কৃষ্ণকে বধ করতে রাজা কংস তাঁর যে অনুচরদের পাঠাচ্ছিলেন, যেমন পূতনা রাক্ষসী, দৈত্য তৃণাবর্ত বা চক্রবাত, বৎসাসুর, বকাসুর, ধেনুকাসুর, অঘাসুর বা অজগর অসুর, অরিষ্টাসুর, কেশী দৈত্য, প্রলম্ব– সকলেই কৃষ্ণের হাতে নিহত হলেন। তরুণ বয়সে তিনি দমন করলেন কালিয় নাগকে।

    এই কাহিনীগুলিতে অলৌকিক রোমাঞ্চ অনুভব করা ছাড়া আর কোন তাৎপর্য নেই।  অবশ্য চিন্তা করলে একটি তাৎপর্য মনে আসে, শ্রীকৃষ্ণের মামা রাজা কংস নিশ্চয়ই অনার্য? তা নাহলে তাঁর মন্ত্রণাদাতা পারিষদ থেকে শিশু কৃষ্ণকে বধ করতে আসা অনুচরী/অনুচররা রাক্ষসী, দৈত্য, অসুর কেন? সদ্যজাত শ্রীকৃষ্ণকে রক্ষা করতে শিশুকন্যা রূপে জন্ম নিলেন অনার্য দেবী যোগমায়া, আবার তাঁকে হত্যা করতে রাজা কংস “সুপারি” দিলেন অনার্য খুনীদের! অতএব শ্রীকৃষ্ণর সঙ্গে মাতুল কংস ও মাতুলের শ্বশুর জরাসন্ধের সঙ্গে যে দীর্ঘ বিবাদ সেটি আসলে ছিল অনার্য যদু, বৃষ্ণি, শূরসেন, ভোজ, অন্ধক ও চেদি গোষ্ঠীর অন্তর্দ্বন্দ্ব। সে কথা আগেও বলেছি, এই গ্রন্থের ২.৬.২ অধ্যায়ে।

    এবার শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলার দুটি ঘটনা, আমার কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে, সে দুটির উল্লেখ এখানে করছি।  

    ৫...১ ব্রাহ্মণযজ্ঞে অন্ন প্রার্থনা
    একবার যমুনা তীরে গোচারণের সময় রাম-কৃষ্ণ সহ সকল গোপবালক ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ গোপবালকদের বললেন, “একটু দূরেই দেখ, ব্রাহ্মণরা দেবযজ্ঞ করছেন। সেখানে গিয়ে তোরা দাদা আর আমার নাম করে বল, আমরা সবাই ক্ষুধার্ত আমাদের অন্নদান করুন”। গোপবালকরা যজ্ঞস্থলে গিয়ে ব্রাহ্মণদের সেকথা বলাতে, ব্রাহ্মণেরা “হ্যাঁ” বা “না” কোন উত্তর দিলেন না। গোপবালকরা ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসে শ্রীকৃষ্ণকে সব কথা বলাতে, কৃষ্ণ হাসলেন, বললেন, “এবার তোরা ব্রাহ্মণীদের কাছে যা, সেখানে গিয়ে একই কথা বলবি”। গোপবালকরা এবার ব্রাহ্মণীদের কাছে গিয়ে রাম ও কৃষ্ণের নামে অন্ন প্রার্থনা করল।

    ব্রাহ্মণীরা কৃষ্ণের অনেক কথা আগেই শুনেছিলেন। তিনি কাছেই যমুনাতীরে রয়েছেন শুনে, তাঁরা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। প্রচুর অন্ন এবং সুস্বাদু খাদ্যের সম্ভার নিয়ে তাঁরা প্রায় দৌড়ে এলেন। কৃষ্ণের শ্যামলবরণ[1] কান্তি, পীতবসন, গলায় বনমালা, মাথায় শিখীপুচ্ছ দেখে তাঁরা বিহ্বলা হয়ে কৃষ্ণকে আলিঙ্গনও করে ফেললেন। রাম-কৃষ্ণ ও গোপবালকদের অন্ন ও খাদ্য নিবেদন করে, তাঁরা কিছুক্ষণ কৃষ্ণের সঙ্গে আলাপ করলেন। কিন্তু ফেরার সময় তাঁরা বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন, কারণ আসার সময় তাঁরা স্বামীদের অনুমতি না নিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে এসেছিলেন। উপরন্তু আবেগের বশে তাঁরা গোপবালক কৃষ্ণকে আলিঙ্গন করে ফেলেছিলেন। তাঁরা আশংকা করছিলেন, তাঁদের স্বামীরা হয়তো তাঁদের গ্রহণ করবেন না। কিন্তু কৃষ্ণ তাঁদের আশ্বাস দিলেন, সেরকম কিছু ঘটবে না, বললেন, “আপনারা আমাতেই সমর্পিত চিত্ত, নিবেদিত প্রাণ, অতএব কেউ আপনাদের কোন দোষ দেখবে না”। ব্রাহ্মণীরা যজ্ঞস্থলে ফিরে যেতে, সত্যিই কেউ কিছু বললেন না। ব্রাহ্মণরা নিজ নিজ পত্নীদের সঙ্গে যথারীতি যজ্ঞে আহুতি দিয়ে, যজ্ঞ সম্পন্ন করলেন।

    ব্রাহ্মণ্য ধর্মের যজ্ঞ-অনুষ্ঠানে আহুতি দেওয়ার সময়, পত্নীদের পতির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কোন ভূমিকা থাকত না। সেই বুঝেই কী কৃষ্ণ এমন একটা ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। তিনি কী অনুমান করেছিলেন, ব্রাহ্মণরা যজ্ঞের ব্যস্ততায় গোপবালকদের কথায় গুরুত্ব না দিলেও, অলস বসে থাকা দ্বিজপত্নীরা তাঁর নাম শুনলেই, তাঁকে দেখার জন্যে উদ্গ্রীব হয়ে উঠবেন? আশৈশব তাঁর অতিনায়কোচিত অলৌকিক কীর্তির সৌরভ যে মহিলা মহলে তাঁকে প্রবাদে পরিণত করেছে, সেটাও কী তিনি বুঝতে পেরেছিলেন? এও কী বুঝেছিলেন, নায়কের প্রতি মহিলাদের উদ্বেল আবেগকে তাঁদের স্বামীরা তেমন দোষাবহ মনে করেন না? ধন্য বটে তাঁর নারী ও নর-চরিত্র বিশ্লেষণ।   

    ৫...২ কৃষ্ণের ইন্দ্র বিরোধ
    একবার রাম-কৃষ্ণ গোকুলে যাওয়ার পথে দেখলেন, গোপেরা ইন্দ্রযজ্ঞ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি পিতাকে এই যজ্ঞের কথা জিজ্ঞাসা করায় গোপরাজ নন্দ বললেন, “বৎস, ভগবান ইন্দ্র মেঘের দেবতা। বর্ষায় মেঘ থেকে তিনি বৃষ্টি দেন বলেই আমাদের ক্ষেত্র, নদী, সরোবর সরস হয়, আমাদের সমৃদ্ধি আসে। এই কারণেই আমরা দেবরাজ ইন্দ্রের প্রীতির জন্যে এই যজ্ঞের অনুষ্ঠান করি”। এর উত্তরে কৃষ্ণ যে কথাগুলি বললেন, সেগুলিকে বৈপ্লবিক বললেও কম বলা হয়। তিনি বললেন, “পিতা, নিজের কর্মবশেই জীব সুখ, দুঃখ, ভয় বা মঙ্গল ভোগ করে। যদি কর্মফল দাতা কোন ঈশ্বর থেকে থাকেন, তিনি কর্মকর্তাকেই সমর্থন করবেন। কারণ যে কোন কর্মই করে না, তাঁকে তিনি ফল দেবেন কী করে? চতুর্বণ অনুযায়ী কর্ম নির্দিষ্ট করা আছে। ব্রাহ্মণরা বেদপাঠ ইত্যাদি, ক্ষত্রিয়রা পৃথিবীর রক্ষণাবেক্ষণ, বৈশ্যরা বার্তা অর্থাৎ কৃষি-বাণিজ্য এবং শূদ্ররা তিনবর্ণের সেবা করে জীবিকা নির্বাহ করবে। বৈশ্যবৃত্তি চার ধরণের কৃষি, বাণিজ্য, গোরক্ষা ও কুসীদ[2]। এর মধ্যে আমরা গোপালন করে থাকি।
    তাছাড়া সৃষ্টি, স্থিতি ও ধ্বংসের কারণ যথাক্রমে সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণ। মেঘরাজি রজোগুণে পরিচালিত হয়ে, বর্ষা ঘটায়, তার থেকে শস্যাদি উৎপন্ন হয় এবং মানুষ শস্য দিয়ে জীবনধারণ করে। এখানে ইন্দ্রের ভূমিকা কোথায়? আমরা বনবাসী, আমাদের নগর ও জনপদ কিছুই নেই। অতএব আমাদের কর্তব্য গো, ব্রাহ্মণ ও পর্বতের উদ্দেশে যজ্ঞ করা। পিতা, এই আমার অভিমত। আপনি যদি ভালো মনে করেন, তাহলে ইন্দ্রযজ্ঞ ছেড়ে এই যজ্ঞের অনুষ্ঠান করুন। এই যজ্ঞ ব্রাহ্মণদের এবং আমারও অভিপ্রেত”। গোপরাজ নন্দ খুশি মনেই গো, ব্রাহ্মণ ও পর্বত যজ্ঞের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করলেন।

    ওদিকে স্বর্গে বসে ইন্দ্র শুনলেন, ব্রজে তাঁর যজ্ঞ স্থগিত হয়ে গেছে। তিনি কৃষ্ণ ও গোপরাজ নন্দের উপর ক্রুদ্ধ হয়ে সংবর্তক নামের ভয়ংকর মেঘকে পাঠালেন, প্রবল বর্ষণ ও বজ্রপাতে ব্রজের গোষ্ঠকে প্লাবিত করার জন্যে। তিনি বললেন, “কৃষ্ণ কে? একজন সাধারণ মানব। সে অবিনীত, অজ্ঞ, বাচাল, বালকমাত্র। ঐশ্বর্যের অহংকারে গোপেরা উদ্ধত হয়ে, আমার অপ্রিয় আচরণ করল? সংবর্তক, যাও, তুমি গোপদের ঐশ্বর্য এবং তাদের পশু সম্পদ ধ্বংস করে এসো”।

    সংবর্তকের প্রভাবে গোকুলে প্রবল ঝড়, ঝঞ্ঝা ও শিলাবৃষ্টি শুরু হল। প্রবল বর্ষণে নদীতে বন্যা দেখা দিল। কৃষ্ণ বুঝতে পারলেন, ইন্দ্রের যজ্ঞ না করাতে, ইন্দ্র ক্রুদ্ধ হয়েছেন। তিনি নিজের হাতে গোবর্ধন পর্বত তুলে নিলেন এবং ব্রজবাসী সবাইকে বললেন, সমস্ত পশুদের নিয়ে, সেই পর্বতের গুহায় আশ্রয় নিতে। ব্রজবাসীরা তাই করলেন এবং সাতদিন প্রবল বর্ষণের মধ্যে তাঁরা সকলেই নিরাপদে সেই পর্বতের অন্দরে বাস করলেন। সাতদিন ধরে গোবর্ধন পর্বতকে হাতে ধারণ করে থাকা শ্রীকৃষ্ণের অদ্ভূত বিক্রমে ইন্দ্র হার মানলেন, তিনি বর্ষণে ক্ষান্ত হলেন। মেঘ সরে গিয়ে উজ্জ্বল সূর্যের উদয় হল। ব্রজবাসীরা গিরি কন্দর ছেড়ে বের হয়ে এলেন, শ্রীকৃষ্ণও গোবর্ধন পর্বতকে আবার যথাস্থানে স্থাপনা করলেন।

    ইন্দ্র পূজা ছেড়ে, গো-ব্রাহ্মণের পূজা করার মধ্যে, ব্রাহ্মণ্যধর্মকে অবহেলা করে হিন্দুধর্মের প্রতিষ্ঠা বলেই আমি মনে করি। হিন্দু ধর্মে ভগবান কৃষ্ণ-গোবিন্দের স্তবের মন্ত্রই হল “ওঁ ব্রহ্মণ্যদেবায়, গো-ব্রাহ্মণ হিতায় চ, জগদ্ধিতায় শ্রীকৃষ্ণায়, গোবিন্দায় নমোনমঃ”। আরও একটা বিষয়ে খটকা লাগে, দেবরাজ ইন্দ্র যখন শুনলেন, ব্রজবাসীরা তাঁর পূজা বন্ধ করেছেন এবং এর পিছনে আছেন কৃষ্ণ, তখন তিনি কৃষ্ণকে “অবিনীত, অজ্ঞ, বাচাল, বালক” বললেন কেন? দেবরাজ হয়েও তিনি কী জানতেন না, কৃষ্ণরূপে ভগবান বিষ্ণুই মর্তে আবির্ভূত হয়েছিলেন? পৃথিবীতে ধর্ম সংস্থাপনের জন্যে কৃষ্ণ হয়ে ভগবান বিষ্ণুর আবির্ভাবের অনেক আগে থেকেই স্বর্গের দেবমহলে এর প্রস্তুতি হয়েছিল, শ্রীরামচন্দ্রের আবির্ভাবের পূর্বপ্রস্তুতির মতো। যেমন, ব্রজরাজ নন্দ, তাঁর দুই রাণি – রোহিণী ও যশোদা, বলরাম (যিনি বিষ্ণুর অংশ-অবতার) এবং ব্রজের সকল গোপ ও গোপীগণ স্বর্গ থেকে আবির্ভূত, তাঁরা কৃষ্ণের আগে জন্ম নিয়েছিলেন, শিশু ও বালক কৃষ্ণকে লালন-পালনের জন্য। রাজা কংসের চোখে ধুলো দিতে, কৃষ্ণের সঙ্গে একই সময়ে আবির্ভূতা হয়েছিলেন, দেবী যোগমায়া। দেবরাজ ইন্দ্র স্বর্গের এই সব সংবাদ কিছুই জানতেন না?  কেমন দেবরাজ তিনি? নাকি পুরাণকারেরা কাহিনী কল্পনার সময়, এই দিকটি খেয়াল রাখেননি? নাকি অনার্য বা হিন্দু দেবতার কাছে বৈদিক দেবরাজের লাঞ্ছনার ঘটনাটি ইচ্ছাকৃত ভাবেই উপস্থাপিত করেছেন?  

    ৫...৩ রাস উৎসব
    মহিলা মহলে কৃষ্ণের আধিপত্য ছিল প্রবল। ব্রজের বয়স্থা মহিলাদের আদর্শ ছিলেন মা যশোদা, তাঁদের সকলেই দুরন্ত শিশু ও বাল-কৃষ্ণের দৌরাত্ম্য অনুভবের স্বপ্ন দেখতেন। বালক-কৃষ্ণের মুখ দর্শনেই তাঁদের কুচযুগ পয়স্বিনী হয়ে উঠত। আবার ব্রজের কিশোরী থেকে যুবতীরাও তাঁর দর্শন এবং স্পর্শ লাভের জন্যে ব্যাকুল। এমন কি বিবাহিতা রমণীরাও কৃষ্ণ প্রেমে উন্মাদিনী। তাঁদের এই গণ উন্মাদনার কারণ কৃষ্ণের রূপ, তাঁর অপ্রচলিত বেশভূষা, তাঁর অলৌকিক কীর্তির প্রবাদ এবং তাঁর মোহন-বাঁশির সুরের জাদু। সবার উপরে রয়েছে তাঁর কোমলে-কঠোর মেশা অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। 

    মহিলা মহলে কৃষ্ণের এই গণ সম্মোহনকে ভাগবত শাস্ত্রে রাস-উৎসব, রাস-যাত্রা বা রাস-ক্রীড়া বলা হয়েছে। রাস শব্দের উৎপত্তি রস থেকে, আবার রাস শব্দের অর্থ শব্দ, ধ্বনি বা কোলাহল। অর্থাৎ রাস-উৎসব রসময় কোলাহল।  

    সেদিন কার্তিকমাসের পূর্ণিমা তিথি। পূর্ণ চন্দ্র উদিত হয়েছে পূর্ব আকাশে। সামান্য হিমের পরশ লাগা স্নিগ্ধ বাতাস বহমান। যমুনার তীরে একাকী ভ্রমণ করতে করতে, কৃষ্ণ তাঁর বাঁশিতে তুললেন অদ্ভূত মোহন সুর। গোপপল্লীগুলিতে সেই মোহিনী সুরের মন-কাড়া জাদু বয়ে নিয়ে গেল হেমন্তের মনোরম বাতাস। নির্মেঘ  আকাশ প্লাবিত নির্মল জ্যোৎস্নায়। বাতাসে ভেসে আসা সূরমূর্ছনা, আকাশের মোহিনী আলোক গোপনারীদের ঘর ছাড়তে বাধ্য করল। কেউ রান্না করছিলেন, কেউ শিশুকে স্তন্যপান করাচ্ছিলেন, কেউ স্বামীসেবা করছিলেন। যাঁর যা কিছু হাতের কাজ ফেলে, তাঁরা দৌড়ে চললেন যমুনার তীরে। তাঁদের পিতা, মাতা, স্বামী, পুত্র, ভ্রাতারা নিষেধ করলেন বারবার, কিন্তু ওই আহ্বানে সাড়া না দিয়ে তাঁদের যে অন্য কোন উপায় নেই! তাঁরা সমবেত হলেন যমুনা পুলিনে।


    বাঁকুড়া - বিষ্ণুপুরের শ্যামরাই মন্দিরের দেওয়ালে "রাসযাত্রা"-র টেরাকোটা মোটিফ। চিত্র - লেখক।   

    সমবেত ব্রজবালাদের দেখে লীলাপুরুষ বললেন, “এত রাত্রে তোমরা এখানে কেন? তোমরা কী জানো না, নির্জন এই যমুনাতটে এখন নিশাচর পশুরা ঘুরে বেড়ায়? তোমরা এখনই ব্রজপল্লীতে ফিরে যাও, সেখানে তোমাদের মাতা-পিতা-পতি-ভ্রাতারা তোমাদের দেখতে না পেয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তোমাদের আচরণে বন্ধু ও আত্মীয়দের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করো না”। গোপললনারা কৃষ্ণের কথায় হতাশ হলেন, তাঁরা প্রণয়-অভিমানে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন। কৃষ্ণ স্মিতমুখে আবার বললেন, “তোমরা কি, যমুনার তীরে পূর্ণ-জ্যোৎস্নার শোভা দেখতে এসেছ? তাহলে বলি, দেখা তো হয়েছে, এবার গৃহে ফিরে যাও। হে কল্যাণি, তোমরাই গৃহের ঐশ্বর্য, তোমরা ঘরে ফিরে পতি, পিতা-মাতা-সন্তান-শিশুদের সেবায় মনোনিবেশ করো। হে কুলকামিনীগণ, আমার ধ্যান, চিন্তা বা আমার কথাতে যেমন প্রীতিবন্ধন হয়, আমার স্পর্শে তেমন হয় না। অতএব তোমরা এখনই ঘরে ফিরে যাও”।

    গোপললনারা ক্ষুব্ধ স্বরে বললেন, “হে প্রভো, এমন কঠিন কথা তোমার বলা উচিৎ হচ্ছে না। স্বামী-পুত্র-সংসার সব ছেড়েই আমরা তোমার কাছে এসেছি। তোমার সেবা করলেও স্বামী-পুত্রেরই সেবা হবে। আমাদের যে মন ও হাত এতদিন সংসারের কাজে সতত লিপ্ত ছিল, সেই মন ও হাত তুমি কেড়ে নিয়েছ। আমরা জেনেছি, তুমিই সেই আদি পুরুষ, যিনি দেবতাদের রক্ষা করেন, এখন এসেছ আমাদের ব্রজভূমির দুঃখনাশ করতে। আমরা তোমার কিংকরী, তোমার করকমল আমাদের তপ্ত স্তনে এবং মাথায় অর্পণ করো, আমাদের তৃপ্ত করো”। এর পর কৃষ্ণ মনোরম যমুনা পুলিনে গোপললনাদের আলিঙ্গন করলেন, তাঁদের হাতে, চুলে, উরুতে, কোমরে, স্তনে হাত রাখলেন। শতাধিক গোপরমণী তাঁর স্পর্শে মানিনী হয়ে উঠলেন। তাঁরা সকলেই নিজেকে জগতের শ্রেষ্ঠ নারী বলে মনে করলেন। গোপীদের এই গর্ব, অভিমান ও তূরীয় অবস্থা দেখে কৃষ্ণ সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

    কৃষ্ণ অদৃশ্য হয়ে যেতে গোপ কামিনীরা তাঁর বিরহে অস্থির হয়ে উঠলেন। তাঁরা বনের তৃণ, গাছপালা, নদীর জল, বালুতট সকলের কাছে উন্মাদিনীর মতো, জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন, তারা কৃষ্ণকে দেখেছে কিনা? তাঁদের মধ্যে কেউ নিজেই কৃষ্ণ হলেন, কেউ হলেন বৎসাসুর, কেউ হলেন পূতনা। তাঁরা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায় মত্তা হলেন। কেউ হামাগুড়ি দিয়ে বালকৃষ্ণের মতো আচরণ করতে লাগলেন। এক কথায় তাঁরা কৃষ্ণময় হয়ে নিজেদের মধ্যেই মত্ত হয়ে উঠলেন। এক সময়ে তাঁরা কৃষ্ণ বিরহে ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে গান ধরলেন।

    এই সময়েই হঠাৎ উপস্থিত হলেন কৃষ্ণ। তাঁর অকস্মাৎ আবির্ভাবে গোপললনাদের মধ্যে আনন্দের স্রোত বয়ে গেল, গোপরমণীদের অবসন্ন শরীরে যেন প্রাণ ফিরে এল। তাঁরা সকলে কৃষ্ণকে আলিঙ্গন করে, মাঝখানে বসিয়ে, চারদিকে ঘিরে রাখলেন। একজন গোপকামিনী কৃষ্ণের প্রতি কটাক্ষ করে জিজ্ঞাসা করলেন, “হে কৃষ্ণ, কেউ ভজনা করলে, তাঁকেও অন্য কেউ ভজনা করেন। আবার তাঁকে কেউই ভজনা করেন না। অথবা কেউই কাউকে ভজনা করেন না। হে সখে, এই ব্যাপারটা কেমন, আমাকে বুঝিয়ে দাও তো!”

    কৃষ্ণ বললেন, “সখীরা, যাঁরা পরষ্পরের ভজনা করেন, তাঁরা স্বার্থের জন্যেই ভজনা করেন, সেখানে ধর্ম বা বন্ধুত্বের কোন উদ্দেশ্য থাকে না। যাঁরা ভজনা করেন না, অথচ তাঁদের যাঁরা ভজনা করেন, তাঁরা পিতামাতার মতো দয়ালু ও স্নেহ অনুসারে দুই প্রকারের ভজনা করেন। দয়ালু ভজনায় নিষ্কৃতি লাভ হয় এবং যাঁরা স্নেহময় হয়ে ভজনা করেন, তাঁরা বন্ধুত্ব লাভ করেন। দরিদ্র ব্যক্তি হঠাৎ ধন লাভ করে, সে ধন যদি হারিয়ে ফেলে, তাহলে সে যেমন সর্বদা এই নিয়েই চিন্তায় মগ্ন থাকে, তেমনি তোমরাও সব ভুলে এতক্ষণ আমার চিন্তাতেই মগ্ন ছিলে। তোমরা গৃহের কঠিন শৃঙ্খল ছিন্ন করে আমার কাছে এসেছ, এই মিলন অনিন্দনীয়। আমি তোমাদের এই উপকারের কোন প্রতিদান দিতে পারবো না। সুতরাং প্রত্যুপকার করে আমি অ-ঋণীও হতে পারলাম না, আমার ঋণ মোচনের একমাত্র সহায় তোমাদের এই প্রেমবন্ধন”।

    গোপীরা ভগবান কৃষ্ণের এই সান্ত্বনা বাক্যে, বিরহের কথা ভুলে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন এবং তাঁরা পরমানন্দে নিজেদের হাতে হাত রেখে কৃষ্ণকে ঘিরে নৃত্য ও গীত শুরু করলেন। কৃষ্ণ-গোবিন্দ রমণীবেষ্টনে আবদ্ধ হয়ে রাসলীলা করতে লাগলেন। রাস-উৎসব শুরু হল। কৃষ্ণ প্রতি দুই জন গোপীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুই হাত দুই গোপীর কাঁধে রাখলেন। প্রত্যেক গোপ রমণীরই মনে হল, কৃষ্ণ তাঁর পাশেই আছেন, তাঁর কণ্ঠে হাত রেখে তাঁর মুখের দিকেই তাকিয়ে রয়েছেন। এই রাস উৎসবে বিভোর হয়ে রইলেন গোপরমণীরা, তাঁদের সকলের অঙ্গেই কৃষ্ণের মোহন স্পর্শের অনুভব। রাত্রি শেষ প্রহরে কৃষ্ণের আদেশে তাঁরা যখন অনিচ্ছায় নিজ নিজ ঘরে ফিরলেন, কৃষ্ণ মায়ায় মোহিত ব্রজবাসীরা মনে করলেন, তাঁদের পত্নী, মা, ভগিনী ও কন্যারা সারারাত তাঁদের পাশেই ছিলেন।

    বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাজস্থান, গুজরাট, মধ্যভারত এবং মথুরার মতো বেশ কিছু অঞ্চলের পশুপালক অনার্য গোষ্ঠীদের মধ্যে কৃষ্ণ নামে এক বংশীধারী রাখাল বালক ভীষণ জনপ্রিয় ছিলেন এবং বালদেবতা হিসেবে পূজিত হতেন। মহিলা মহলে তাঁর প্রভাব ছিল ঈর্ষণীয়। সেই অনার্য কৃষ্ণের নানান প্রবাদ কাহিনীকে আরও রমণীয় এবং কামোদ্দীপক (erotic) করে তুলেছিলেন পুরাণকারেরা। হয়তো তাঁরা মনে করেছিলেন, ধর্মরসের মধ্যে কিছুটা দৈবী আদিরস সঞ্চার করলে, সাধারণ জনসমাজ কৃষ্ণ সম্পর্কে আরও কৌতূহলী হয়ে উঠবে, বাড়বে ভাগবত ধর্মের প্রভাব।

    ৫...৪ দ্বারকাধীশ কৃষ্ণ
    দ্বারকা ও রাজস্থানে কৃষ্ণ “রণছোড়জী” নামেই প্রসিদ্ধ। এই নামটি সম্ভবতঃ মধ্যযুগ থেকে প্রচলিত হয়েছিল। যেমন আমাদের পূর্বভারতে, কৃষ্ণ নামটি কাহ্ন, কানু, কানাই নামেও জনপ্রিয় হয়েছে মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদকর্তাদের প্রভাবে।

    অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ “রণছোড়” শব্দটির অর্থ – যিনি যুদ্ধ ছেড়ে এসেছেন। মথুরায় কংসবধের পর, রাজা কংসের শ্বশুর পরাক্রান্ত চেদিরাজ জরাসন্ধ, কৃষ্ণ-নিধনের জন্যে বারবার (পৌরাণিক মতে আঠারোবার) মথুরা আক্রমণ করেছিলেন। সে যুদ্ধে কোন পক্ষই জয়ী হতে পারেননি, কিন্তু প্রতিটি যুদ্ধেই দুই পক্ষের বহু নিরীহ সৈন্য নিহত হত এবং অজস্র সম্পদ হানি হত। এই অকারণ রক্তপাত এবং শক্তি ও সম্পদ-ক্ষয় এড়াতে কৃষ্ণ যুদ্ধ ছেড়ে সুদূর দ্বারকায় সরে গিয়েছিলেন। নিঃসন্দেহে এ তাঁর অসাধারণ দূরদর্শীতা, ধৈর্য ও বিচক্ষণতার পরিচয়। কারণ পরবর্তীকালে তিনি মধ্যম পাণ্ডব ভীমের সঙ্গে একক যুদ্ধে প্ররোচিত করে জরাসন্ধকে নিহত করিয়ে শত্রুমুক্ত হয়েছিলেন, সেখানে কোন নিরীহের রক্তপাত হয়নি। প্রতিকূল সময়ে যুদ্ধ ছেড়ে আসা যে আসলে অনুকূল সময়ে যুদ্ধজয়ের প্রস্তুতি, সে কথাটাই শ্রীকৃষ্ণের “রণছোড়জি” নামের মহিমা।                 

    দ্বারকাধীশ কৃষ্ণের দশজন প্রধানা পত্নীর নাম শোনা যায় - রুক্মিণী, সত্যভামা, জাম্ববতী, নাগ্নজিতী, কালিন্দী, মাদ্রী, মিত্রবৃন্দা, ভদ্রা। প্রাগজ্যোতিষপুরের ভৌমাসুর বহু রাজাকে পরাস্ত করে ষোল হাজার রাজকন্যাকে বন্দী করে রেখেছিলেন। প্রাগজ্যোতিষপুরের নরকাসুরকে বধ করে, কৃষ্ণ ভৌমাসুরের অন্তঃপুরে যান এবং বন্দিনী রাজকন্যাদের মুক্ত করার আদেশ দিলে, ষোল হাজার রাজকন্যা তাঁকেই পতিরূপে বরণ করেছিলেন। কৃষ্ণও সানন্দে তাঁদের গ্রহণ করে, দ্বারকায় পাঠিয়েছিলেন, এবং প্রত্যেক পত্নীর জন্যে সুন্দর গৃহ নির্মাণ করিয়েছিলেন। প্রধানা দশ মহিষীর প্রত্যেকের গর্ভে ভগবান কৃষ্ণের দশটি করে পুত্রের জন্ম হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন, প্রদ্যুম্ন, চারুদেষ্ণ, ভানু, শাম্ব, সুমিত্র, পুরুজিৎ, বীর, সুবাহু, প্রঘোষ, বৃক, হর্ষ, সংগ্রামজিৎ, বৃহৎসেন প্রমুখ। শোনা যায় তাঁর মোট পুত্রসংখ্যা নাকি সহস্রাধিক।

    ব্রজবাসী কৃষ্ণের আরও একটি বহুল জনপ্রিয় প্রেমের উপাখ্যানের উল্লেখ মহাভারত বা শ্রীমদ্ভাগবতে পাওয়া যায় না। সেটি হল পরবর্তী কালের বহুল জনপ্রিয় রাধা-কৃষ্ণ উপাখ্যান। মহাভারতের পরিপূরক গ্রন্থ “খিলহরিবংশ”-এ – কৃষ্ণের রাসলীলার বর্ণনায় কৃষ্ণের মুখে দুটি মাত্র নামের উদ্দেশে বিরহ ভাবের উল্লেখ পাওয়া যায়, “হা রাধে! হা চন্দ্রমুখি!” (খিল হরিবংশ, অধ্যায় ৭৬), কিন্তু তাঁদের সম্পর্কে আর কোন বিবরণ বা তথ্য পাওয়া যায় না। অথচ পরবর্তী কালের কবিকুল, বিশেষত বঙ্গের কবিকুল এই যুগলকে নিয়ে অজস্র ভাবের ও আবেগের গান ও পদাবলী রচনা করেছেন। কৃষ্ণভক্ত যুগাবতার শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর (১৪৮৬-১৫৩৩ সি.ই) আবির্ভাবের পর, বঙ্গদেশে রাধা-কৃষ্ণই অন্যতম প্রধান উপাস্য হয়ে উঠেছিলেন।

    ৫.৪.২ ভক্তিযোগের ঐক্য
    জ্ঞানযোগ, কর্মযোগের পর যে ভক্তিযোগের কথা আগে বলেছিলাম, গুপ্তযুগের সমসাময়িক কালে সেই ভক্তিযোগ সম্পূর্ণ রূপ নিয়ে বিকশিত হয়ে উঠেছিল এবং প্রধানতঃ এই ভক্তি আন্দোলনের বিপুল জনপ্রিয়তাই সমগ্র ভারতবর্ষে পূর্ণতঃ হিন্দুধর্মকে প্রতিষ্ঠা করল। হিন্দু ধর্ম এই সময়ে শুধু যে রাজন্য বর্গের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করল তাই নয়, দেশের সাধারণ জন সমাজ, আর্য এবং অনার্য উভয়েই, হিন্দু ধর্মের প্লাবনে একই সূত্রে বাঁধা হয়ে গেল। আর্য-অনার্যের প্রধান বিভেদটা দূর হয়ে গেল, অর্থাৎ আর্যরা ভারতবর্ষের প্রতিটি প্রান্তের অনার্যদের সঙ্গে মিশে যেতে পারল। কিন্তু এই সময় থেকেই জন্মগত বর্ণভেদ অনেকটা নমনীয় হলেও অর্থনৈতিক বর্ণভেদটা আরও প্রকট হয়ে উঠতে লাগল। অর্থাৎ তখন থেকে প্রভাবশালী ও বিত্তশালী বৈশ্য এবং শূদ্ররাও সমাজে সম্মানীয় হয়ে উঠল, কিন্তু সমাজের প্রান্তিক ও দরিদ্র বৈশ্য এবং শূদ্ররা হয়ে উঠল অন্ত্যজ, অস্পৃশ্য বা অচ্ছ্যুৎ। চার বর্ণের থেকেও ভয়ংকর হয়ে উঠল “জাতি” এবং “বর্গ” – সে কথা পরে আলোচনা করা যাবে।

    ভাগবত ধর্মে অনার্য এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সমন্বয় বিধান করেছেন, স্বয়ং কৃষ্ণ - শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতার বিভূতি যোগে এবং শ্রীমদ্ভাগবতের একাদশ স্কন্ধের ষোড়শ অধ্যায়ে। প্রথম ক্ষেত্রে তিনি প্রিয়সখা অর্জুনকে বলেছিলেন, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আরও সবিস্তারে বলেছেন ভাগবত উদ্ধবকে। তিনি বলছেন, “উদ্ধব, আমি সর্বভূতের সুহৃদ, আত্মা, ঈশ্বর; আমিই সর্বভূতস্বরূপ এবং আমিই সর্বভূতের সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহার-হেতু”। তিনি আরো বলছেন,
    ১. সকল দেবতাদের মধ্যে তিনিই হিরণ্যগর্ভ (ব্রহ্ম), বিষ্ণু, শিব, ইন্দ্র, অগ্নি, বরুণ। অতএব সকল দেবভক্তদের মধ্যে তিনিই পরম উপাস্য, তাঁর উপাসনা করলে সকলেরই উপাসনা হয়ে যায়।
    ২. সকল তত্ত্বের মধ্যে তিনিই মহৎ-তত্ত্ব, তিনিই ওঁকার, তিনিই অ-কার, তিনিই গায়ত্রী ছন্দ। অতএব তিনিই সকল তত্ত্বের আধার।
    ৩. সকল ঋষিদের মধ্যে তিনিই মহর্ষি ভৃগু, রাজর্ষি মনু, দেবর্ষি নারদ, সিদ্ধেশ্বর কপিল, মুনিদের মধ্যে নারায়ণ, ব্রহ্মচারীদের মধ্যে সনৎকুমার।
    ৪. সকল প্রাণী - গবাদি পশুর মধ্যে তিনিই কামধেনু, পাখিদের মধ্যে গরুড়, উচ্চৈঃশ্রবা অশ্ব, ঐরাবত হাতি, বাসুকি সাপ, অনন্ত নাগ, তৃণভোজীদের মধ্যে কৃষ্ণসার হরিণ এবং মাংসাশীদের মধ্যে সিংহ। জলচর প্রাণীদের দেবতা তিনিই বরুণ। এই প্রাণীদের মধ্যে অনেকগুলিই অনার্য মানবগোষ্ঠীদের দেব-আত্মা হিসেবে পূজিত হতেন, যেমন গরুড়, হাতি, সাপ, নাগ, সিংহ ইত্যাদি - তাঁরা সকলেই এখন হয়ে গেলেন কৃষ্ণের স্বরূপ। মাত্র কয়েকবছর আগে সংবাদে এসেছিল রাজস্থানের কিছু জনগোষ্ঠী “কৃষ্ণসার” হরিণকে দেবতা বলে মান্য করেন।
    ৫. উপদেবতাদের মধ্যে তিনিই অর্যমা (পিতৃদেব), দক্ষ (প্রজাপতি)।
    ৬. বিভিন্ন মানব গোষ্ঠী – তিনিই দৈত্য ও অসুরদের প্রহ্লাদ, যক্ষ ও রাক্ষসদের কুবের। অর্থাৎ এতদিন রাক্ষস, দৈত্য, দানবদের সম্বন্ধে আর্যদের যে উদ্ভট বৈরীভাব ছিল, সেটাও দূর হয়ে গেল। তিনিই গন্ধর্ব ও অপ্সরাদের মধ্যে বিশ্বাবসু ও পূর্বচিত্তি, (বানরগোষ্ঠীর) হনুমান।
    ৭. পণ্ডিত ব্যক্তি -  তিনিই ধীর ব্যক্তিদের মধ্যে অসিত, (ইনিই বুদ্ধদেবের জন্মের পর রাজা শুদ্ধোদনের সঙ্গে দেখা করেছিলেন), দ্বৈপায়ন বেদব্যাস, দেবগুরু বৃহষ্পতি ও দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য। স্ত্রীগণের মধ্যে শতরূপা, পুরুষদের মধ্যে স্বায়ম্ভূব মনু। পুরোহিতদের মধ্যে বশিষ্ঠ।
    ৮. গুণ ও দোষ – তিনিই ক্ষমাশীলদের ক্ষমা, সত্ত্বশীলদের সত্ত্ব, বীরদের জিগীষা, বণিকদের সম্পদ-আহরণ। তিনিই ধূর্তদের ছল, পাশাখেলার চাতুরি।
    ৯. বীরত্ব ও যুদ্ধ – তিনিই বীর শ্রেষ্ঠ অর্জুন, দেবসেনাপতি কার্তিকেয়।
    ১০. প্রকৃতি – তিনিই নদীর মধ্যে গঙ্গা, জলাশয়ের মধ্যে সমুদ্র, দুর্গম পর্বতের মধ্যে হিমালয়, বৃক্ষের মধ্যে অশ্বত্থ, শস্যের মধ্যে যব। গঙ্গানদী, হিমালয় পর্বত এবং অশ্বত্থে দেবত্ব আরোপ বহু প্রাচীন প্রচলিত বিশ্বাস। প্রধান ফসল উৎপাদনে নবান্ন উৎসব কৃষিজীবনের শুরুর থেকে ওতপ্রোত জড়িত, অঞ্চল ভেদে সে গম, যব বা ধান যাই হোক না কেন।

    ভাগবত ধর্ম তথা হিন্দুধর্ম ভগবান কৃষ্ণের বিভূতি অর্থাৎ তাঁর ঐশ্বর্য দিয়ে জয় করে ফেললেন সমগ্র ভারতের সমাজ। হিন্দু ধর্মের এই প্রবল প্রসারের ফলে ভারতবর্ষের জনসমাজ থেকে বৌদ্ধধর্মের প্রভাবও ধীরে ধীরে ক্ষীণ হতে লাগল। তবে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবকে দুর্বল করার আরও একটি কারণ হল, বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতার বানিয়ে তোলা। ব্রাহ্মণ্যধর্ম বিদ্বেষী বা বিরোধী প্রাচীন অনার্য সমাজ, যাঁরা বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি কিছুটা সহানুভূতিশীল ছিলেন, তাঁদের বোঝানো হল, ভগবান বুদ্ধও ভগবান বিষ্ণুর অবতার। অতএব ভগবান বুদ্ধও যখন হিন্দুধর্মেরই একজন দেবতা, তখন না হক বৌদ্ধধর্মে গ্রহণে তাঁরা উৎসাহ হারালেন। তবে বিষ্ণু-অবতারের সাম্মানিক পদটুকু ছাড়া হিন্দুধর্ম থেকে ভগবান বুদ্ধ, কোনদিন আর কিছুই পাননি।    

    কিন্তু হিন্দু ধর্ম হঠাৎ এমন জনপ্রিয় হয়ে উঠল কী করে? এর উত্তর একটাই ভক্তিযোগ। হিন্দুধর্মের নতুন শাস্ত্র ও পুরাণে রাজা-রাজড়াদের জন্যে যজ্ঞ অনুষ্ঠানের কথা থাকলেও, সাধারণ মানুষের জন্যে প্রচলন হল সহজ পুজো পার্বণের, আর তার সঙ্গে যাঁরা মুক্তি বা মোক্ষ পথের পথিক, তাঁদের বলা হল, নিঃস্বার্থ অর্থাৎ অহৈতুকী ভক্তি করো। সে ভক্তিরও নানান পথ আছে, যার যেমন পছন্দ, যার যেমন বিশ্বাস। পুরাণে বলা হয়েছে, ভক্তিভাবের পাঁচটি প্রকার আছে, যাদের একত্রে পঞ্চভাব বলে। যেমন,
    ১. শান্ত ভাব – বিষ্ণুর প্রতি একনিষ্ঠ শ্রদ্ধা ও জ্ঞান - সনক, সনন্দন, সনাতন ও সনৎকুমার, শুকদেব, দেবর্ষি নারদ।
    ২. দাস্য ভাব – কোন উদ্দেশ্য ছাড়া বিষ্ণুর সেবা করাই দাসের কর্তব্য, যেমন জয়-বিজয়, হনুমান, উদ্ধব।
    ৩. সখ্য বা ভ্রাতৃত্ব ভাব – নিঃস্বার্থ বন্ধু হিসেবে ভক্তি, যেমন বলরাম, ব্রজের গোপ বালকেরা, অর্জুন, দ্রৌপদী, সুদামা, বিদুর, অক্রুর।
    ৪. বাৎসল্য ভাব – পিতৃত্ব বা মাতৃত্ব ভাব, মা-বাবা যেমন কোন স্বার্থ ছাড়াই সন্তানের সেবা করেন, যেমন মাতা যশোদা, গোপরাজ নন্দ, বসুদেব, মাতা দেবকী, মাতা কুন্তী, বিদুর।       
    ৫. মধুর বা প্রেমভাব– প্রেমিকা হিসেবে নিঃস্বার্থ ভালবাসা, যেমন শ্রীরাধিকা, গোপরমণীগণ, কুব্জা, দেবী মীরা, শ্রীচৈতন্যদেব।
    এই পাঁচটি ভক্তিভাবের মধ্যে পঞ্চমটি শ্রেষ্ঠ ও সহজতম ভক্তি পথ এবং প্রথমটি জ্ঞানীর তপস্যাজনিত কঠিন পথ।   

    এছাড়াও আরেকটি ভাবের কথা শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে, যদিও সেই ভাব কখনোই সাধারণের আচরণীয় নয়, সেটি হল শত্রুভাব। চরম বিষ্ণু-বিদ্বেষী হয়েও বিষ্ণুকে খুব দ্রুত লাভ করা যায়। যেমন, সত্যযুগে হিরণ্যাক্ষ-হিরণ্যকশিপু, ত্রেতাযুগে রাবণ-কুম্ভকর্ণ এবং দ্বাপরে শিশুপাল-বক্রদন্ত ভয়ংকর বিষ্ণু-বিদ্বেষী ছিলেন। এঁরা সকলেই স্বয়ং বিষ্ণুর অবতারের হাতে নিহত হয়েছিলেন বলে, সকলেই সরাসরি বিষ্ণুতে লীন হয়ে বৈকুণ্ঠলোকে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। অবিশ্যি এর পিছনে যে পৌরাণিক কাহিনী আছে, সেটি হল,-
     
    বৈকুণ্ঠে বিষ্ণুলোকের দুই বিষ্ণুভক্ত দ্বারপাল ছিলেন জয় ও বিজয়। একবার যোগসিদ্ধ ও পরম বিষ্ণুভক্ত চার কুমার – সনক, সনন্দন, সনাতন ও সনৎকুমার (এঁরা সকলেই শান্তভাবের ভক্ত) বৈকুণ্ঠে গিয়েছিলেন বিষ্ণুর সঙ্গে দেখা করতে। সিদ্ধযোগী অর্থাৎ বালকের মতোই সরল ও নগ্ন ওই চারকুমারকে জয়-বিজয়, বিষ্ণু-নিবাসের দ্বারে প্রবেশের অনুমতি দেননি। তাতে চার কুমার তাঁদের অভিশাপ দিয়েছিলেন, জয়-বিজয়কে মর্ত্যে জন্ম নিতে হবে।

    প্রধান দ্বারে গোলমালের সংবাদ শুনে স্বয়ং বিষ্ণু এসে উপস্থিত হলেন। তিনি তাঁর পরমভক্ত চার কুমারকেই সমর্থন করলেন এবং জয়-বিজয়ের মর্ত্যে পতনকে, তিনি যদিও রদ করতে পারতেন, কিন্তু করলেন না। তিনি জয়-বিজয়কে প্রস্তাব দিলেন, তাঁরা যদি মর্ত্যে গিয়ে মিত্রভাবে বিষ্ণুর উপাসনা করেন, তাহলে তাঁদের বৈকুণ্ঠে ফিরে আসার আগে বহুজন্ম মর্ত্যেই কাটাতে হবে। আর যদি শত্রুভাবে বিষ্ণুকে বিদ্বেষ করেন, তাহলে মাত্র তিন জন্মেই তাঁদের উদ্ধার হওয়া সম্ভব। জয়-বিজয় বিষ্ণুর পরমভক্ত ছিলেন, তাঁরা চাইছিলেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বৈকুণ্ঠে ফিরে ভগবান বিষ্ণুর সেবা করতে এবং প্রত্যেকদিন তাঁর দর্শন পেতে। অতএব তাঁরা দ্বিতীয় প্রস্তাবেই রাজি হয়েছিলেন। এই জয়-বিজয়ই তিন যুগে তিন বিষ্ণু-বিদ্বেষী ভাই হয়ে জন্ম নিয়েছিলেন এবং সরাসরি বিষ্ণু অবতারের হাতে নিহত হয়ে বৈকুণ্ঠলোকে ফিরে গিয়েছিলেন।

    এই কাহিনীর গূঢ় তত্ত্ব হল, বেদ-ব্রাহ্মণ্য তথা বিষ্ণু-বিরোধী অনার্য বা আর্য রাজাদের হত্যাকে যুক্তিসিদ্ধ করা। আদতে এঁরা যেন সকলেই ছিলেন বিষ্ণুর পরমভক্ত জয়-বিজয়ের শাপগ্রস্ত জাতক, তাঁরা সকলেই বিষ্ণুর বিরোধীতা করেছিলেন, বিষ্ণুর হাতেই নিহত হয়ে দ্রুত বিষ্ণুলোক অর্জনের লক্ষ্যে। অনার্য গোষ্ঠীদের মনে কোথাও কোন বিদ্বেষভাব যদি থেকেও থাকে – এই কাহিনী তাতে সান্ত্বনাময় প্রলেপের কাজ করেছিল, সন্দেহ নেই। কিন্তু বিদ্বেষ-ভক্তির এই পথ অবশ্য পরিত্যাজ্য। কারণ আমাদের মতো সাধারণ মানুষরা কেউই শাপভ্রষ্ট জয়-বিজয়ের জাতক নই। অতএব বিষ্ণুবিরোধী ভক্তিপথে গেলে, বিষ্ণুর অবতারের হাতে নয়, তাঁর ধর্মরক্ষকদের হাতে গণধোলাইতেই নিহত হতে হবে।

    ৫.৪.৩ শিব - শৈব
    শিবের উদ্ভব বৈদিক দেবতা রুদ্র থেকে। রুদ্র পৃথ্বীলোকের দেবতা এবং তিনি একাদশ রুদ্র অর্থাৎ অগ্নিরূপে তাঁর এগারোটি রূপ – অতএব তিনি ভীষণ তেজোময় ও শক্তিশালী। কিন্তু তাঁর প্রকৃতি বিষ্ণুর একেবারেই বিপরীত। তিনি শ্মশানে-মশানে থাকেন। তাঁর ত্রিনয়ন, তাঁর মাথায় বিশাল জটা, পরনে বাঘের ছাল, সারা গায়ে ভস্ম মাখা। সাধারণ মানুষের কাছে যা কিছু ভয়ংকর সে সবই তাঁর অত্যন্ত প্রিয়। যেমন তাঁর অলঙ্কার সাপ, তাঁর সঙ্গী সাথীরা সকলেই ভূত, প্রেত, পিশাচ। অথচ তাঁর জটাতেই স্বর্গ থেকে মন্দাকিনীর পতন এবং সেখান থেকে মঙ্গলময় গঙ্গার উৎপত্তি। তাঁর জটায় চন্দ্রকলা শোভা পায়। পৌরাণিক তত্ত্ব অনুযায়ী তিনি ত্রিদেবের মহেশ্বর – ব্রহ্মা সৃষ্টি করেন, বিষ্ণু পালন করেন, মহেশ্বর হয়ে তিনি ধ্বংস করেন। অতএব তিনিই মহাকাল, রুদ্র ভৈরব। তবে অধিকাংশ সময়েই তিনি শিব, পরম মঙ্গলময়, রক্ষাকর্তা।  তিনি যখন শিব – তিনি আশুতোষ - খুব অল্পেই তিনি সন্তুষ্ট হয়ে যান। কিন্তু ক্রুদ্ধ হলে তাঁর তৃতীয় নয়ন থেকে ঝলসে ওঠে অগ্নি।

    হিমালয়ের কৈলাস পর্বতেই তাঁর স্থায়ী অধিষ্ঠান এবং সর্বদাই তিনি ধ্যান করতে থাকেন। তিনি মহাযোগী তপস্বী, যোগ সমাধিতেই তিনি জগতের মঙ্গলামঙ্গল নিয়ন্ত্রণ করেন। ভারতের সকল যোগীদের তিনি যোগগুরু, তাঁর অনুসরণেই সকলে যোগ অনুশীলন করেন। একদিকে তিনি যেমন সকল তপস্বীদের যোগ-সমাধিগুরু আবার অন্যদিকে তিনি নৃত্যগুরুও। তিনি নৃত্যের স্রষ্টা নটরাজ। তিনিই ভারতের নৃত্যকলার স্রষ্টা। কিন্তু ক্রুদ্ধ হয়ে যখন তিনি নৃত্য করেন, তখন ধ্বংস হতে থাকে সৃষ্টি, সে নৃত্যের নাম প্রলয় বা তাণ্ডব নৃত্য।

    ৫.৪.৩.১ দক্ষ-যজ্ঞ
    ভগবান শিবের দক্ষ-যজ্ঞ কাণ্ডটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বিভিন্ন পুরাণে এই ঘটনার বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। মহাভারতেও এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন স্বয়ং কৃষ্ণ। প্রথমে শ্রীমদ্ভাগবত (চতুর্থ স্কন্ধ, অধ্যায় ২, ৩, ৪, ৫, ৬) থেকে ঘটনাটির সংক্ষেপে বিবরণ দিচ্ছি।  

    সত্যযুগে প্রজাপতি দক্ষ একবার “শিব-হীন” যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন, অর্থাৎ সেই যজ্ঞে রাজা দক্ষ সকল দেবতাদের নিমন্ত্রণ করলেও শিবকে নিমন্ত্রণ করেননি। এই দক্ষের কন্যা ছিলেন সতীদেবী, শিবের প্রথমা পত্নী। শিবের ঘোরতর আপত্তি সত্ত্বেও, সতীদেবী এই যজ্ঞের সময়েই পিতৃগৃহে গিয়েছিলেন এবং সেখানে তাঁর পিতা দক্ষ, কন্যা সতীদেবীর সামনেই, শিবের কঠোর সমালোচনা এবং নিন্দা করলেন। স্বামীর নিন্দা সহ্য করতে না পেরে, দক্ষের যজ্ঞ সভাতেই সতীদেবী অগ্নি-সমাধিযোগে[3] নিজের প্রাণ আহুতি দিলেন।

    এই সংবাদ যখন কৈলাসে শিবের কাছে পৌঁছল, ভগবান শিব রুদ্র-ভৈরব হয়ে উঠলেন, তিনি জটা থেকে একগাছি চুল ছিঁড়ে মাটিতে ফেলা মাত্র বীরভদ্র নামে তাঁর ভয়ংকর এক অনুচর উপস্থিত হলেন। তাঁর আকাশস্পর্শী দেহ, সহস্র বাহু, তিনটি চোখ যেন সূর্যের মতো উজ্জ্বল, গলায় নরকপাল মালা, গায়ের রং ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। বীরভদ্রকে ভগবান ভৈরব বললেন, “তুমি অতীব রণদক্ষ, তোমার সমস্ত অনুচরদের সঙ্গে নিয়ে যাও, দক্ষের যজ্ঞে অনর্থ ঘটাও এবং দক্ষকে বধ করো”। বীরভদ্র প্রভুর আদেশে তাঁর অনুচরদের নিয়ে দক্ষের যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হলেন। তাদের কেউ বেঁটে, কারও গায়ের রং পিঙ্গল, কারও হলুদ, কারও কারও মুখ ও উদর মকরের মত। তারা কিছুক্ষণের মধ্যেই যজ্ঞস্থল লণ্ডভণ্ড করে দিল এবং বীরভদ্র দক্ষের শিরশ্ছেদ করে, কাটা মুণ্ড যজ্ঞের আগুনে দগ্ধ করে, কৈলাসে ফিরে এলেন।

    এই যজ্ঞে নিমন্ত্রিত হয়েও ব্রহ্মা ও বিষ্ণু উপস্থিত ছিলেন না, কারণ শিব-হীন যজ্ঞে তাঁদের অনুমোদন ছিল না। কিন্তু দক্ষের যজ্ঞস্থলে উপস্থিত যে দেবতা ও মুনি-ঋষিরা বীরভদ্র ও তার সঙ্গীদের হাতে আহত হয়েছিলেন, তাঁরা ব্রহ্মার কাছে এসে অনুরোধ করলেন, ভগবান শিবকে বুঝিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা হোক এবং অসম্পূর্ণ যজ্ঞ সম্পূর্ণ করা হোক। ব্রহ্মা সদলবলে কৈলাসে গেলেন শিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে।

    স্বয়ং ব্রহ্মাকে সামনে উপস্থিত দেখে দেবাদিদেব শিব আসন থেকে উঠে দাঁড়ালেন এবং নতমস্তকে ব্রহ্মার বন্দনা করলেন। তার উত্তরে, ব্রহ্মা সহাস্যে বললেন, “তুমি যদিও আমাকে প্রণাম করলে, তবুও আমি তোমাকেই এই বিশ্বের ঈশ্বর বলেই জানি। যেহেতু এই জগতের যোনিরূপা প্রকৃতির ও বীজস্বরূপ পুরুষের তুমিই একমাত্র কারণ। তৎসত্ত্বেও তুমি নির্বিকার ব্রহ্মরূপে বিরাজ করে থাক। হে ভগবন, তুমি নিজের অংশ থেকে জাত এই প্রকৃতি ও পুরুষ থেকেই, খেলার ছলে ঊর্ণনাভি[4]র মতো এই বিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় করে থাক।  বেদ-ধর্ম রক্ষার জন্যে তুমিই যজ্ঞের সৃষ্টি করেছিলে, তুমিই এই যজ্ঞের বিধি বিধান নির্দিষ্ট করেছিলে। হে মঙ্গলময়, যারা শুভকার্যের অনুষ্ঠান করে, তুমি তাদের স্বর্গ বা মোক্ষ দান করে থাক, আর যারা পাপ আচরণ করে তুমি তাদের নরক বিধান করে থাক। হে রুদ্র, তুমি প্রজাপতি দক্ষের যজ্ঞ ধ্বংস করায়, ওই যজ্ঞ অসমাপ্ত রয়েছে। তুমি সর্বজ্ঞ, অতএব তুমি ওই যজ্ঞে উপস্থিত থেকে, ওই যজ্ঞ সম্পন্ন করাও। যজমান দক্ষ আবার জীবিত হোক, অন্যান্য দেবতা, মুনি-ঋষিদেরও সুস্থ করে দাও”। আশুতোষ ব্রহ্মার কথায় সন্তুষ্ট হলেন, বললেন, “সকলেই সুস্থ হোক। কিন্তু দক্ষের মাথা, যজ্ঞের আগুনে দগ্ধ হয়ে গেছে, অতএব এখন তাঁর দেহে ছাগলের মুণ্ড সংযুক্ত করতে হবে। আর আরব্ধ যজ্ঞ সম্পাদনের আয়োজন শুরু হোক”।

    অন্য পৌরাণিক কাহিনী থেকে পাওয়া যায়, সতীদেবীর দেহত্যাগের সংবাদ পেয়ে ভগবান রুদ্র নিজেই এসেছিলেন তাঁর অনুচরদের নিয়ে। দক্ষের যজ্ঞস্থল লণ্ডভণ্ড করে দেওয়ার পর, পত্নীর শোকে সতীদেবীর মৃতদেহ নিজের কাঁধে নিয়ে প্রলয় নৃত্য শুরু করেছিলেন। সেই ভয়ংকর নৃত্যের নামই “তাণ্ডব”। সেই নৃত্যে জগতে প্রলয় শুরু হয়ে যাওয়াতে, বিষ্ণু তাঁর চক্র দিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেন, সতীদেবীর শব। সেই শব মোট একান্নটি টুকরো হয়ে দেশের যেখানে যেখানে ছড়িয়ে পড়েছিল, সে স্থানগুলিই হয়ে উঠেছিল শক্তিপীঠ। তাঁরা সকলেই হয়ে উঠলেন আদ্যাশক্তি মহামায়ার একান্নটি মাতৃকামূর্তি - ভগবান শিবের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ দেবীসতীর অবিনশ্বর রূপ। সে কথা পরে আসবে।
     
    এবার মহাভারতের দক্ষযজ্ঞ পর্বের (অনু/১৬০) দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রাজা যুধিষ্ঠিরকে বলছেন, “প্রজাপতি ব্রহ্মা বহুকাল তপস্যা করে, ভগবান ভূতপতির মাহাত্ম্য প্রকাশ করেছেন। ভবানীপতি এই স্থাবর-জঙ্গমাত্মক পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা। এই ত্রিলোকে তাঁর থেকে শ্রেষ্ঠ এবং তাঁর সমতুল্য আর কেউ নেই। তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে রণক্ষেত্রে দাঁড়ালে, শত্রুরা তাঁর গায়ের গন্ধেই ভয়ে কাঁপতে থাকে, জ্ঞান হারায়, অনেকে মারাও যায়। একবার প্রজাপতি দক্ষ বিপুল যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন কিন্তু সেখানে তিনি ভবানীপতির যজ্ঞভাগ বিবেচনা করেননি। ভবানীপতি ক্রুদ্ধ হয়ে ভয়ংকর গর্জনে যজ্ঞস্থল বিদ্ধ করলেন। ওই সময় মহাদেবের জ্যা[5]শব্দে উপস্থিত দেবতা, অসুর সকলেই আতঙ্কিত এবং পৃথিবীও কেঁপে উঠল। এরপর রুদ্রদেব দেবতাদের দিকে দৌড়ে গিয়ে ভগের দুই চোখ উপড়ে নিলেন এবং লাথি মেরে পূষা[6]র দাঁত ভেঙে দিলেন। দেবতারা রুদ্রের এই ভয়ংকর রূপ দেখে তাঁকে প্রণাম করতে লাগলেন, করজোড়ে শতরুদ্রীয় মন্ত্র জপ করতে লাগলেন। তাতে দেবাদিদেব কিছুটা শান্ত হয়েছেন দেখে দেবতারা তাঁর জন্যে বেশ বড়ো রকম যজ্ঞভাগ নির্দিষ্ট করলেন। ভগবান ভূতভাবন এবার সন্তুষ্ট হয়ে, যজ্ঞের প্রতিষ্ঠা করলেন এবং নষ্ট হওয়া উপচারের সংস্থাপন করলেন”।
     
    এই কাহিনীর পৌরাণিক এবং মহাভারতীয় বর্ণনা থেকে অনেকগুলি বিষয়ে সন্দেহ আসে, যেমন,
    ১. পুরাণে ব্রহ্মা এবং মহাভারতে কৃষ্ণ দুজনেই বলছেন, মহাদেব এই পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা। তাহলে দক্ষ তাঁকে যজ্ঞে আমন্ত্রণ করলেন না বা যজ্ঞভাগ নির্দিষ্ট করলেন না কেন? মহাদেবকে তিনি কি দেবতা হিসেবে মেনে নিতে পারেননি? মহাদেব কি, বৈদিক রুদ্র হিসেবে তখনো পূর্ণ দেবত্বে অধিষ্ঠিত হননি? প্রতিপত্তিশালী অনার্য দেবতা হিসেবে ব্রাহ্মণ্য সমাজের অভিজাত মহলে তখনও তিনি পূর্ণ স্বীকৃতি পাননি? তাহলে তাঁর হাতে দক্ষ নিজের কন্যাকে দান করেছিলেন কেন? কিন্তু সতীদেবীর আচরণে মহাদেবের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা, ভক্তি এবং ভালোবাসার কোন ত্রুটি তো দেখা যায়নি।
    ২. পুরাণ এবং মহাভারতের বর্ণনায় দক্ষের যজ্ঞস্থলে ব্রহ্মা এবং বিষ্ণু উপস্থিত ছিলেন না। দক্ষের সিদ্ধান্তের কথা তাঁরা দুজনেই জানতেন এবং মহাদেব যে ছেড়ে কথা বলবেন না, এটা বুঝেই তাঁরা বিপদ এড়িয়ে গিয়েছিলেন?
    ৩. ভগবান কৃষ্ণ তাঁর পরাক্রমের বর্ণনায় “গায়ের গন্ধ"-র উল্লেখ করলেন কেন? কোন বীরের বীরত্বের বর্ণনায় এখনও পর্যন্ত গায়ের গন্ধেই শত্রু নিপাত হয় এমন শোনা যায়নি। মহাদেবের সঙ্গী বা অনুচরেরা ভূত, প্রেত, তাঁদের চেহারার বর্ণনার মধ্যেও ব্রাহ্মণ্য শ্লেষ ধরা পড়ছে। অনার্য মানুষদের তাঁরা যেমন রাক্ষস, দানব এবং দৈত্য বলে বিকট এবং ভয়াল চেহারার বর্ণনা দিয়ে থাকেন, এখানেও তার ব্যতিক্রম করেননি।  
    ৪. অতএব, দক্ষযজ্ঞ ঘটনার বিশ্লেষণ করলে এমন অনুমান করাই যায়, মহাদেব ছিলেন, শৈব বা পাশুপত্যধর্মে বিশ্বাসী পরাক্রমী অনার্য গোষ্ঠীপতি, তাঁর অনুগত অনার্য সেনারা দুর্ধর্ষ, দুর্দান্ত এবং বেশ নৃশংসও। অবশ্য ব্রাহ্মণ্য সমাজের থেকে অধিকার আদায়ের জন্যেই সম্ভবতঃ তাঁকে একটু অস্বাভাবিক আক্রমণাত্মক হতে হয়েছিল। এই প্রজাপতি দক্ষের যজ্ঞে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর, তাঁকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর থেকে তিনিই মহাদেব, তিনিই রুদ্র, তিনিই শিব, তিনিই মহেশ্বর ও পশুপতি।  ব্রহ্মা ও কৃষ্ণ বা বিষ্ণুর সমান্তরাল দেবতা হয়ে উঠেছিলেন।

    চলবে…
    (পঞ্চম পর্বের পঞ্চম ভাগ আসবে ১১.০৯.২২ তারিখে।)  

    গ্রন্থঋণঃ
    ১। শ্রীমদ্ভাগবত– মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস (?) রচিত মূল সংস্কৃত থেকে বাংলায় গদ্য অনুবাদ – সম্পাদনা তারাকান্ত কাব্যতীর্থ ভট্টাচার্য।
    ২। মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস রচিত মহাভারত – মূল সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ - মহাত্মাকালীপ্রসন্ন সিংহ মহোদয়। বসুমতী সাহিত্য মন্দির, কলকাতা ৭০০০১২। এই পর্বে বহু ক্ষেত্রেই এই গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি গ্রহণ করা হয়েছে।

    [1] ভালোবেসে আমরা যতই “শ্যামলবরণ” বা “রঙটা একটু চাপা” বলি না কেন, এই গাত্রবর্ণ অনার্য লক্ষণ। আদতে তিনি কৃষ্ণবর্ণই ছিলেন, তাই তাঁর নামও কৃষ্ণ। তাঁর কৃষ্ণবরণ বলিষ্ঠ কান্তিতে উজ্জ্বল পীতবসন, গলায় বনফুলের মালা, অঙ্গে হাল্কা স্বর্ণালঙ্কার এবং কেশে শিখীপক্ষ – অসাধারণ এক স্টাইল স্টেটমেন্ট। আর্য বা অনার্য – সে যে সভাতেই তিনি উপস্থিত হোন না কেন –তাঁর উপস্থিতি সর্বদাই প্রত্যয়ী পৌরুষরূপে অনন্য এক ঔজ্জ্বল্য সঞ্চার করে। এর সঙ্গে ছিল শৈশব থেকে আবাল্য, তাঁর নানান কীর্তির মহিমা। বাস্তবিক, এমন একজন ব্যক্তিত্ব সামনে এসে দাঁড়ালে, হয় মুগ্ধ হতে হয় অথবা ঈর্ষায় দগ্ধ হতে হয়, কিন্তু কোনমতেই অবহেলা করা যায় না। মহিলাদের আর দোষ কি?    

    [2] কুসীদ মানে সুদ, কুসীদজীবী মানে যাঁরা সুদের বিনিময়ে ঋণ দেন, এখানে শ্রেষ্ঠী অর্থাৎ Banker।  

    [3] অতি উচ্চকোটির যোগীদের পক্ষেই নাকি অগ্নি-সমাধি যোগে দেহত্যাগ করা সম্ভব, অতএব সতীদেবী তাঁর পতির মতোই মহাযোগিনী।    

    [4] ঊর্ণ বা ঊর্ণা মানে জাল, জাল নাভিতে যার সেই ঊর্ণনাভি – অর্থাৎ মাকড়সা। মাকড়সা যেমন নিজেরই নাভির রস থেকে জাল বুনে তোলে, তেমনি ব্রহ্মও তাঁর নিজের অংশ থেকে ব্যাপ্ত এই বিশ্বচরাচর সৃষ্টি করেছেন। 

    [5] জ্যা – ধনুকের ছিলা।

    [6] দ্বাদশ আদিত্যের মধ্যে দুই আদিত্য ভগ ও পূষা বা পূষণ – সূর্য - দুজনেই বৈদিক দেবতা।
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১২৯১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • হীরেন সিংহরায় | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০১:৩৭511648
  • কিশোর 
    অসাধারন। অনেক শোনা কাহিনির সাযুজ্য দেখতে পেলাম।
     
    হেরোড যিশু হত্যা নয়  শিশু হত্যা করেন বলে কথিত আছে,  দু বছর বয়েস অবধি ( Murder of the innocents ) । 
  • Kishore Ghosal | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ ২১:২৩511663
  • ঠিকই স্যার, কিন্তু এই দুই শিশুকে হত্যা করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য - মাঝের থেকে কিছু নিরপরাধ শিশুকে প্রাণ দিতে হয়েছিল।   
  • Sara Man | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১১:৩৭511669
  • কিশোর বাবু, 
    ১। ধান, গম বাদ দিয়ে যব কেন শ্রেষ্ঠ হল? ভাত রুটি খাই, যব তো সেভাবে খাওয়া হয়না। 
    ২। প্রৌঢ়ত্বের আগে সনাতন ধর্ম কথাটা সেভাবে শুনিনি। ফর্মে লিখতাম, আমি হিন্দু। কিন্তু এখন শব্দটা খুব শুনি চারপাশে। ক) এই সনাতন ধর্ম আর ভাগবত ধর্মের পার্থক্য কী? 
    খ) আমার মামার বাড়িতে অগ্নি সাক্ষী করে বিয়ে হয়না। নারায়ণ সাক্ষী রেখে বিয়ে হয়। তাই মেয়ের বিয়েতে নিরামিষ খাওয়া হয়। অগণিত পরিবারে দেখেছি গৃহদেবতা কৃষ্ণ। আমি ভাবতাম এটা শ্রীচৈতন‍্যের প্রভাব। তাকি নয়? এই সমাজ ব‍্যবস্থা কি তবে ভাগবত ধর্ম তৈরি করেছে? 
    শ্রীচৈতন্য কি সমাজ বদল করলেন? নাকি তিনি নিজেই সমাজের ফসল? 
  • হীরেন সিংহরায় | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৭:৪৩511673
  • হিন্দু শব্দ টি কি ফারসি অবদান নয়? 
  • Kishore Ghosal | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৮:৪৭511677
  • শারদা ম্যাম, 
    আর্যরা ভারতে আসার আগে যব ছাড়া অন্য কোন শস্য জানত না, অতএব  ভারতবর্ষের অজস্র শস্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও যবটাই তাদের কাছে পবিত্র শস্য রয়ে গেছিল। যেমন আমরা আজও সংস্কৃত বুঝি না, উপরন্তু থাকে পুরোহিতের অসহনীয় মন্ত্রোচ্চারণ - কিন্তু তাও বিয়ে, পৈতে, মুখেভাত কিংবা শ্রাদ্ধবাসরে  দুর্বোধ্য সংস্কৃত না শুনলে অনুষ্ঠানগুলো পবিত্র হয়ে ওঠে না। এ একধরনের "সনাতনী" মানসিকতা। 
     
    সনাতন কোন ধর্ম নয় ম্যাডাম। যে আচরণগুলি আমরা বংশপরম্পরায় প্রাচীনকাল থেকে শুনে আসছি এবং পালন করে আসছি, সেটাই সনাতন ধর্ম। একটা উদাহরণ ওপরে দিলাম। আজকের কোন দম্পতি যদি সুবোধ্য মাতৃভাষার মন্ত্রে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয় - সেটা সনাতনী মতে বিবাহ হবে না। সেটি অর্বাচীন হয়ে উঠবে। আমার মতো প্রাচীনপন্থী গোঁড়া মানুষ, এমন বিয়ে দেখে বলব, "না বাপু, মনটা ঠিক ভরল না,  বিয়েটা সনাতনী মতে হলেই সর্বাঙ্গসুন্দর হত..."।
     
    বাংলা বা পূর্ব ভারতে শ্রীকৃষ্ণ ও রাধার বিপুল জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিলেন কবি জয়দেব (১১৭০-১২৪৫ সি.ই.) - তাঁর গীতগোবিন্দ কাব্যে। শ্রীচৈতন্যের সময়কাল ১৪৮৬ - ১৫৩৪ - শ্রী চৈতন্য কবি জয়দেবের  নিবিড় ভক্তিরসে প্রভাবিত হয়ে - শ্রীরাধিকাভাবে শ্রীকৃষ্ণের ভজনা করে নতুন এক ভক্তিচেতনার প্রবর্তন করেছিলেন, যার প্লাবনে আমরা ভেসে গিয়েছিলাম। 
     
    আপনার মামার বাড়িতে নারায়ণ সাক্ষী রেখে বিয়ে হয় - তাঁরা নিশ্চয়ই বৈষ্ণব এবং আমার মনে হয় এটি তাঁদের কৌলিক আচার। গীতায় কৃষ্ণ বলেছেন, তিনি সকল দেবতার দেবতা - অর্থাৎ নারায়ণ বা বিষ্ণুর পূজা করলেই সর্বদেবতারই পূজা করা হয়। 
  • Kishore Ghosal | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৯:০৩511678
  • হীরেন স্যার, 
    হিন্দু নামটি অবশ্যই পারস্য বা ফারসি ভাশার অবদান - যে ভাষায় সপ্তসিন্ধু হয়েছিল হেপ্তহিন্দ - অর্থাৎ  পারস্য সাম্রাজ্য থেকে যে সাতটি নদী পার হয়ে ভারতের মূল ভূখণ্ডে ঢুকতে হত তার নাম হিন্দ - আর সেই দেশের অধিবাসীদের নাম দিয়েছিল হিন্দু। পরবর্তী কালে আরবীয়রা এই নামটিকেই বহুল প্রচার করে হিন্দুস্তান নাম দিয়েছিল।  
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় প্রতিক্রিয়া দিন