২০০৯ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর কোবাড গান্ধী দিল্লি থেকে গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তার না বলে এটাকে ফিল্মি স্টাইলে অপহরণ বলা যেতে পারে। তিনি কিছু কম্পিউটার সামগ্রী কিনে একটি বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়েছিলেন। হঠাৎ একটি এসিইউভি তাঁর পাশে এসে দাঁড়ায়। কয়েকজন ষন্ডাগুন্ডা লোক বেরিয়ে এসে তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাঁর সমস্ত জিনিসপত্র কেড়ে নেয় এবং তাঁকে ঠেলে গাড়িতে তুলে দেয়। প্রায় বারো ঘন্টা গাড়িটি তাঁকে নিয়ে দিল্লির রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। অপহরণকারীদের কোনও কথা কোবাড বুঝে উঠতে পারেন না, কারণ তারা তেলুগুতে কথা বলছিল। মাঝেমধ্যে শুধু এয়ারপোর্ট কথাটা ভেসে আসছিল এবং কোবাড আশঙ্কা করছিলেন কুখ্যাত অন্ধ্রপ্রদেশ-পুলিশ তাঁকে কোনও জঙ্গলে নামিয়ে ভুয়ো সংঘর্ষে খতম করে দেবে। তিন দিন বাদে মিডিয়ার ব্রেকিং নিউজ: বড়সড় এক মাওবাদী চাঁই পুলিশের জালে ধরা পড়েছে। তিনি জানতে পারেন, যে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ – তিনি মাওবাদী দলের পলিটব্যুরোর সদস্য, দেশের নানা রাজ্যে অপরাধমূলক কাজকর্মে যুক্ত। ২১শে সেপ্টেম্বর তাঁকে তিহার জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। কোবাডের তখন ঘুণাক্ষরেও ধারণা ছিল না, যে প্রবল লাঞ্ছনা, অপমান, শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন সহ্য করে তিহার সহ বিশাখাপত্তনম, পাতিয়ালা, হাজারিবাগ, সুরাট ইত্যাদি জেলে দশটা বিভীষিকাময় বছর তাঁকে কাটাতে হবে।
২০১২-২০১৩ সালে তিনি মেইনস্ট্রিম পত্রিকায় বিভিন্ন প্রবন্ধে সমাজতন্ত্র ও দেশ বিদেশের কম্যুনিস্ট আন্দোলন সম্পর্কে নানা প্রশ্ন তুলে ধরতে শুরু করেন। মার্ক্সবাদ ও সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর সমালোচনাগুলো পরিচিত, তাতে অভিনব খুব একটা কিছু নেই। যদিও সেগুলি এখনো খুবই প্রাসঙ্গিক; বহু বছর ধরেই চিন্তাবিদরা এই ধরণের সমালোচনা করে আসছেন। যেমন ধরা যাক, অতি পরিচিত একটি সমালোচনা – যাতে বলা হয়ে থাকে মার্ক্সবাদ মূলত অর্থনীতির ওপর জোর দেয়, মানুষের প্রকৃতি, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, মনস্তত্ত্বর সেখানে কোনও স্থান নেই; কিংবা আমাদের দেশের কম্যুনিস্টরা মার্ক্সবাদের ভারতীয়করণ করে উঠতে পারেননি। প্রাথমিক ভাবে সিপিআই (মাওবাদী) এই সমালোচনাগুলোকে লঘু চোখে দেখে। উল্টে জানা যায়, যে এই সময়ে দলের অভ্যন্তরের একটি সার্কুলারে কোবাড গান্ধী সহ চারজন বরিষ্ঠ নেতার মুক্তির জন্য চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০১৪ সালে দল কোবাডের ওপর জেলে নির্যাতনের প্রতিবাদ করে প্রেস বিবৃতিও দেয়। ২০১৯ এর অক্টোবরে তিনি জামিনে মুক্তি পান। ২০২১ এর মার্চে রোলি বুকস থেকে তাঁর বই ‘ফ্র্যাকচার্ড ফ্রীডম: আ প্রিজন মেমোয়ার’ প্রকাশিত হয়। প্রায় আট মাসের এক অস্বস্তিকর নীরবতার পর দল তাঁকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করে।
তাঁকে বহিষ্কার করার মূল কারণগুলি হল নিম্নরূপ:
(১) তিনি মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদের পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন এবং বুর্জোয়া অতীন্দ্রিয়বাদে সুখ ও স্বাধীনতা খুঁজে পেয়েছেন।
(২) তিনি মাওবাদী হিসাবে নিজের পরিচয় দিতে অস্বীকার করেছেন যদিও তিনি সর্বোচ্চ নেতৃত্বের অন্যতম একজন ছিলেন।
(৩) তিনি জেলের গ্যাংস্টারদের গুণগান করেছেন এবং একই সাথে জেলের মাফিয়ার সাথে নক্সালদের যোগসাজশের কথা উল্লেখ করে পার্টিকে হেয় করেছেন। আরও অভিযোগ – কারাগারে নক্সালদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের ঐতিহ্যকে নসাৎ করে তিনি জেলের অব্যবস্থার বিরুদ্ধে বন্দীদের নিয়ে কোনও প্রতিবাদ গড়ে তোলার চেষ্টা করেননি। বরঞ্চ জেলে তিনি আরামে জীবন কাটিয়েছেন।
(৪) জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি দলের সাথে যোগাযোগ করার কোনও চেষ্টা করেননি।
(৫) দলের অনুমতি ছাড়াই নিজের বই প্রকাশ করেছেন।
দ্বিতীয় অভিযোগটি নিয়ে প্রথমে আলোচনা করা যেতে পারে। এটা সত্যি – তিনি মাওবাদী হিসাবে নিজের পরিচয় দিতে অস্বীকার করেছেন। ‘গ্রেপ্তার’ এর সময় কোবাড গান্ধীর মানসিক অবস্থা পর্যালচনা করে দেখা যেতে পারে। আঠেরো মাস আগে তিনি তাঁর প্রিয় জীবনসঙ্গিনী অনুরাধা গান্ধীকে হারিয়েছেন। চিকিৎসার কারণে তিনি মুম্বাই থেকে দিল্লি এসেছিলেন। তিনি প্রস্ট্রেট ও মূত্রাশয়ের সমস্যা এবং অর্থোপেডিক ও উচ্চচাপজনিত ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিলেন। এটা পরিষ্কার, মানসিক ও শারীরিক ভাবে তিনি ভালো অবস্থায় ছিলেন না। এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ, বন্দী জীবনের প্রথম মুহুর্ত থেকে যে কোনও মূল্যে বেঁচে থাকাটাই হয়তো তাঁর কাছে প্রাধান্য পেয়েছে। এর কারণ হতে পারে, যে অপহৃত হওয়ার আগেই তাঁর মধ্যে পার্টি-লাইন সম্পর্কে সংশয় জন্মেছিল। তিনি আশঙ্কা করেছিলেন মাওবাদী নেতা হিসাবে নিজের পরিচয় স্বীকার করে নিলে তাঁর জীবন বিপন্ন হতে পারে। এই জন্য তিনি ধারাবাহিকভাবে অস্বীকার করেছেন, যে তিনি দলের পলিটবুরোর সদস্য ছিলেন এবং বলেছেন এটি একটি সাজানো অভিযোগ এবং মিডিয়ার রটনামাত্র।
জেলে তিনি আরামে জীবন কাটিয়েছেন এই কথাটি আদৌ সত্য নয়। দশ বছরের বন্দী জীবনের প্রায় সাত বছর তিনি তিহার জেলে কাটিয়েছেন। তাঁর বইয়ে তিহার জেল সম্পর্কে তিনি প্রথমেই মন্তব্য করছেন, তিহার জেল এমনভাবেই তৈরি, যা আপনাকে পিষে ফেলবে – যদি না আপনি পুরোপুরি অসংবেদনশীল হন কিংবা আপনার চামড়া মোটা হয়। অথচ এটাকে বলা হয় তিহার আশ্রম! এখানে প্রশাসনের মানসিকতা এমনই, যে কেউ আনন্দে থাকুক এটা তারা চায় না। বন্দীদের যত বেশি হেনস্থা করা হয়, তত তারা মজা পায়। পদে পদে অভাবনীয় লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়। কারাগারে ঢোকামাত্র তাঁকে নগ্ন করে সার্চ করা হয়েছিল – একবার নয়, বারবার। বয়স ও অসুস্থতার কারণে তাঁকে একটি আলাদা সেল দেওয়া হয়; স্পন্ডিলাইটিসের কারণে চেয়ার টেবিল দেওয়া হয়। নক্সাল হওয়ার অভিযোগের কারণে তিনি জেল পাঠাগার ব্যবহার করতে পারতেন না; একই কারণে কারাগারে IGNOU-এর একটি শাখা থাকা সত্ত্বেও সেখান থেকে কোনও কোর্স করা তাঁর ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ ছিল। শুরুতে তাঁকে একটি রেডিও রাখতে দেওয়া হয়েছিল, পরে সেটি নিয়ে নেওয়া হয়। হাতঘড়িও নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। সপ্তাহে দু’দিন মাত্র পাঁচ মিনিট করে শুধুমাত্র ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে ফোন করা যেত, কোনও বন্ধু এমনকি আইনজীবীকেও নয়। যাকে ফোন করা হচ্ছে, সে যে ঘনিষ্ঠ আত্মীয় – এটা প্রমাণ করার জন্য হলফনামা দাখিল করতে হত। বিনা কারণে যখন তখন হাই রিস্ক বন্দীদের ফোন করা বন্ধ করে দেওয়া হত। তাঁদের জন্য টিভি নিষিদ্ধ ছিল। প্রথমে তিনি আইনজীবীদের সঙ্গে প্রতিদিন দেখা করতে পারতেন, পরে এটা সাপ্তাহিক করে দেওয়া হয় – তাও মাত্র আধ ঘণ্টার জন্য। যেহেতু দেশের বিভিন্ন রাজ্যে তাঁর বিরুদ্ধে কেস ছিল, তাই বিভিন্ন শহর থেকে তাঁর আইনজীবীরা আসতেন। নতুন নিয়মের ফলে তাঁদের দিনের পর দিন রাজধানীতে এসে তাঁর সাথে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করতে হত। এইভাবে তাঁর আইনি সাহায্য পাওয়ার সাংবিধানিক অধিকারকে ব্যাহত করা হয়েছিল।
তিহারে অনেকগুলি জেল আছে। প্রতি তিন মাস অন্তর, হাই রিস্ক বন্দীদের, একটা থেকে আরেকটায় বদলি করা হত। এটি একটি রীতিমতো অবমাননাকর প্রক্রিয়া। নিজের জিনিস গোছানোর জন্য ঘণ্টাখানেক সময় দেওয়া হত; প্রস্তুত না হলে জিনিসপত্র ঘরের বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হত। সেল থেকে সরানোর জন্য শারীরিকভাবে তুলে নেওয়ার হুমকি দেওয়া হত। কোবাডের ওপর জেল প্রশাসন বিশেষ ভাবে বিরূপ ছিল, কারণ তিনি কিছু কর্মচারীর দুর্ব্যবহারের বিরুদ্ধে সমস্ত বন্দীদের সই করা একটি পিটিশন জমা দিয়েছিলেন। এই বদলি প্রথার বিরোধিতা করে তিনি বারবার অনশন করার চেষ্টা করেছেন, যার জন্য তাঁকে বেশি করে হেনস্থা করা হয়েছে। এটাকে কি আদৌ তিনি জেলে আরামে ছিলেন বলা যায়?
এটা কোনও নতুন কথা নয়, যে জেলে গ্যাংস্টাররা নক্সালদের সমীহ করে। এই বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ভীমা কোরেগাঁও মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া ‘কবির কলা মঞ্চ’র সাগর গোর্খে ও রমেশ গাইচোরের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তাঁরা একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, নক্সাল কি – সেটা এই দুর্বৃত্তরা বোঝেন না, বা বুঝতেও চান না। তাঁরা শুধু জানেন, নক্সালরা পুলিশের বিরুদ্ধে এবং তাঁদেরও পুলিশের ওপর রাগ আছে; সুতরাং দুইয়ে দুইয়ে চার। ঝাড়খন্ডে কারাবাসকালে সেই রাজ্যের মাওবাদী আন্দোলন সম্পর্কে কোবাড গান্ধীর কিছু অভিজ্ঞতা হয়, যা তাঁকে একই সাথে হতবাক ও হতাশ করে। প্রথমেই তিনি লিখছেন, যখন আমাকে হাজারিবাগ জেলে বদলি করা হল, আমি আবিষ্কার করলাম যে সেখানকার মাফিয়ার প্রায় অনেকটাই খোদ নক্সাল বন্দীরাই নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি দেখেছেন, ঝাড়খন্ডের নক্সাল বন্দীরা নিজেদের রাজ্য, এমনকি নিজের গ্রাম সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানেন না। তিনি সেই রাজ্যের মাওবাদী আন্দোলনের নৈতিক অবক্ষয় খুঁটিয়ে বর্ণনা করেছেন। ক্ষমতা ও অর্থ কীভাবে তাঁদের উদ্ধত ও দুর্নীতিগ্রস্ত করে তুলেছে সেটা তিনি নির্দ্বিধায় তুলে ধরেছেন। ঝাড়খন্ডের এই অভিজ্ঞতা নিশ্চিতভাবে মাওবাদী রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর মোহভঙ্গ সম্পূর্ণ করেছিল। এরপরে কেন তিনি মুক্তি পাওয়ার পর দলের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি, বা কেন বই প্রকাশনার জন্য দলের অনুমতি নেননি – এই প্রশ্নগুলি আলোচনা করা অর্থহীন হয়ে যায়।
মাওবাদী পার্টি কোবাড গান্ধিকে বহিষ্কার করার অন্যতম যে কারণটি উল্লেখ করেছে, সেটি হল তিনি মার্ক্সীয় দর্শন পরিত্যাগ করে বুর্জোয়া অতীন্দ্রিয়বাদে আশ্রয় নিয়েছেন। কোবাড, তাঁর বইয়ে এবং করন থাপার সহ অন্যান্যদের সাথে সাক্ষাৎকারে, বারবার যেটা উল্লেখ করেছেন এবং যেটা আসলে তিনি নিজেকে বারবার প্রশ্ন করেছেন সেটা হল – ষাটের দশকে তিনি যখন রাজনীতিতে এসেছিলেন, তখন অর্ধেক বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক ছিল আর আজ অর্ধ শতাব্দী বাদে তাঁদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া ভার। এই নিদারুণ ব্যর্থতা কেন, কীভাবে হল? কোবাড খুব নিশ্চিত, যে পুঁজিবাদ মানুষের কোনও সমস্যার সমাধান করতে পারবে না, বরঞ্চ তা আরও ঘনীভূত হবে। সীমিত সময়ের জন্য হলেও, সমাজতন্ত্রই মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করেছে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু সমাজতান্ত্রিক আদর্শ আজও অম্লান। ধরে নেওয়া হয়েছিল, যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলেই মানুষের মধ্যে আপনা থেকেই সমাজতান্ত্রিক চেতনা গড়ে উঠবে। কিন্তু সেভাবে হয় না, যে কারণে সোভিয়েত ইউনিয়ান সমৃদ্ধ হয়ে উঠলেও সেই ‘নিউ ম্যান’ গড়ে তোলার ভাবনা অধরাই থেকে যায়। এর কারণ, সমাজতন্ত্র রূপায়ণের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা থেকে যাচ্ছে। সমাজ পরিবর্তনের এই প্রজেক্টের মধ্যে তিনটি উপাদান যুক্ত করতে হবে – সুখ, স্বাধীনতা এবং মূল্যবোধ। তিনি মনে করেন, জীবিকার সংস্থানের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ যাতে আনন্দে থাকে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। মানুষকে স্বাধীন হতে হবে, তার নিজের মধ্যে স্বাধীনতা উপভোগ করতে হবে। তিনি নিজে যদি স্বাধীনতা অনুভব না করেন, তাহলে তিনি অন্যকে স্বাধীন করবেন কী ভাবে? – তিনি প্রশ্ন করেন। আজকের ভোগবাদী সমাজে মানুষ একটা বিচ্ছিন্ন জীব, যে নিজের মধ্যে গুমরোয়, হতাশায় অবসাদগ্রস্ত হয়। সেখান থেকে তাকে মুক্তি দিতে হবে; তার দৈনন্দিন অর্থনৈতিক প্রয়োজন মেটানোটাই যথেষ্ট নয়। তৃতীয় উপাদানটি হল মূল্যবোধ, যে ক্ষেত্রে তিনি তাঁর স্ত্রী অনুরাধা গান্ধীর জীবনকে মডেল হিসাবে তুলে ধরছেন। অনুরাধা ছিলেন একজন নিবেদিত মাওবাদী নেত্রী। তাঁর প্রবন্ধ সংকলন, ‘SCRIPTING IN TIME’এ তিনি জাতপাত ও লিঙ্গ সমস্যা নিয়ে যে ক্ষুরধার আলোচনা করেছেন, তা ভারতবর্ষের কোনও কম্যুনিস্ট নেতানেত্রী আজ অবধি করে উঠতে পারেননি। কোবাড বলছেন, একজন মার্ক্সবাদীকে সরল, সাদাসিধে হতে হবে; দম্ভ, অহংবোধ, আত্মপ্রচার পরিহার করতে হবে, সর্বদা হাসিখুশি থাকতে হবে এবং প্রায় শিশুসুলভ সারল্য নিয়ে মানুষের সাথে মিশতে হবে।
দুঁদে সাংবাদিক করন এই বিষয়টিকে আরও একটু উস্কে দেন। তিনি বলেন, কম্যুনিজম ব্যর্থ হয়েছে, কারণ মার্ক্স মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতি (HUMAN NATURE) বুঝে উঠতে পারেননি। মানুষ আদপে স্বার্থপর, নিজের এবং পরিবারের সুখ-সমৃদ্ধি ছাড়া কিছু বোঝে না। কোবাড বলে ওঠেন, এটা একশো শতাংশ ঠিক, কিন্তু ফ্রয়েডের তত্ত্ব অনুযায়ী বাল্যকালের প্রথম পাঁচ-ছয় বছরে একজন মানুষের পছন্দ-অপছন্দ, আচার-আচরণ, চিন্তাভাবনা, রুচি নির্ধারিত হয়ে যায়। বাকি জীবনে সেই মানসিকতাই বারবার তাঁর বিভিন্ন কাজকর্মের মধ্যে ফুটে ওঠে। এই চক্র থেকে কী ভাবে উদ্ধার পাওয়া যায়, তা ভাবতে হবে। ‘ফ্র্যাকচার্ড ফ্রীডম’-এর শেষ দিকে মানুষের ওপরে তাঁর দৃঢ় আস্থা তিনি ব্যক্ত করেন। তিনি লিখছেন, আশা ও উৎকর্ষের বীজ মানুষের চরিত্রে মজ্জাগত; কোনও একদিন তা ফুল হয়ে বিকশিত হবে।
স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্যকে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলছেন, কোনও আন্দোলন অহিংস না সহিংস হবে – এই প্রশ্ন অবান্তর। প্রশ্নটা কেন অন্যভাবে করা হয় না? হিংসা তো সর্বত্র, সর্বব্যাপী; রাষ্ট্র তো সামান্য অজুহাতে নিরীহ, অসহায় নাগরিকদের দমন-পীড়ন করে, গুলি চালায়, হত্যা করে। উপনিবেশ স্থাপন করার সময় ইউরোপীয় দেশগুলি কত আদিম জনজাতিকে সম্পূর্ণ নিকেশ করে দিয়েছে। আসল ব্যাপারটা হল, ‘কীভাবে’ জিততে হবে। তাতে হিংসার প্রয়োজন হতেও পারে, নাও হতে পারে। তিনি কৃষক আন্দোলনের উদাহরণ উত্থাপন করেন, কীভাবে তাঁরা সম্পূর্ণ অহিংস পন্থায় রাষ্ট্রকে নতজানু হতে বাধ্য করেছেন। তাঁরা আদানি-আম্বানিকে বয়কট করে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়কার বয়কট আন্দোলনকে ফিরিয়ে এনেছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কম্যুনিস্টরা কোনদিনও এসব নিয়ে ভাবেননি। আমাদের দেশের কম্যুনিস্টরা ভীষণ গোঁড়া, সংকীর্ণমনা, উদ্ভাবনী চিন্তাকে আমল দেন না; বাস্তবে কোনও নতুন চিন্তাকে নেতৃত্ব বিপজ্জনক মনে করেন এবং সেই ব্যক্তিকে দলে টার্গেট করে কোণঠাসা করে দেওয়া হয়। তাঁদের বহু বিতর্কিত সাংগঠনিক ব্যবস্থা ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা’র কথা ধরা যাক। তত্ত্বগতভাবে এর থেকে বেশি গণতান্ত্রিক কিছু হয় না: সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত সবার ওপর বর্তাবে এবং মতামতের ভিন্নতা থাকলেও, তাঁরা সেটা মেনে চলবেন। বাস্তবে নেতা এবং তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা নিজেদের খুশি মত যে সিদ্ধান্ত নেন, সেটাই অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মূল্যবোধ সম্পর্কে আমাদের ভক্তি, সুফি আন্দোলন, চার্বাক থেকে অনেক কিছু শেখার আছে, যা আমরা কোনওদিনই চেষ্টা করিনি।
ভবিষ্যতের কথা বলতে গিয়ে তিনি মনে করান যে রুশ, চিন – দু’টি বিপ্লবই দুই মহাযুদ্ধের সময়ে হয়েছে; এমনকি পারি কমিউনের সময়ও প্রাশিয়ান যুদ্ধ চলছিল। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে সশস্ত্র সংগ্রাম অনিবার্য হতে পারে, কিন্তু শান্তির সময়ে তা আদপেই কার্যকরী নয়। এখন হিংসার সময় নয়। যে সাংবিধানিক অধিকারগুলি আমরা অর্জন করেছি, সেগুলি আমাদের রক্ষা করতে হবে। নির্বাচন বয়কট করে নক্সালরা ভুল করছে, তাঁদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে। প্রবল এই সংকটের সময়েও, শেষের সময় আগত এটা বিশ্বাস করতে আমি অস্বীকার করি। আমি আশাবাদী।