নকশিকাঁথা – উপন্যাসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং বাঙালি অভিবাসী জীবনের না জানা সময়
১৮৯০ এর দশক। তখন আমেরিকা এক সন্ধিক্ষণে। কালো মানুষেরা সদ্যই স্বাধীন। কিন্তু আমেরিকার দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে বিভিন্নভাবে তাদেরকে আবার অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। অন্যদিকে শিল্প বিপ্লবের শেষ পর্যায়ে এসে মধ্যবিত্ত সাদা মানুষের আমেরিকা নিজেদের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য পেরিয়ে ধর্ম এবং সংস্কৃতির খোঁজ শুরু করেছে। বিবেকানন্দের আমেরিকা বিজয়, হিন্দু ধর্মের জন্য আমেরিকার কৌতূহল এবং পৃষ্ঠপোষকতার খবর আমাদের জানা আছে। কিন্তু এই আগ্রহ শুধু ধর্মের ক্ষেত্রে নয়। পণ্য এবং বিনোদনের জগতেও ছিল। তারই হাত ধরে এমনকি বিবেকানন্দ আসার আগেও আমেরিকায় এসে গেছিল চুঁচুড়া, তারকেশ্বর, চন্দনপুর, বাবনানের কিছু লোক তাদের চিকনের কাজের পসরা নিয়ে। হাজির হয়েছিল উত্তর আমেরিকার সমুদ্রতটে। ছড়িয়ে পড়েছিল আমেরিকার বিভিন্ন শহরে, সংসার পেতেছিল কালোদের সমাজের অংশ হয়ে। শুধু চিকনদারেরা নয়। শতাব্দীর শেষের দিকে বৃটিশ জাহাজ থেকে পালিয়ে নিউ ইয়র্কে নেবে যাচ্ছিল সিলেট, চট্টগ্রাম থেকে আসা মাঝি-মাল্লারাও। মধ্য আমেরিকার শিল্পাঞ্চলে কাজের অভাব ছিল না কোন।
বড় অদ্ভুত এই সময়। একদিকে দ্রুত শিল্পের বিকাশ ঘটছে, দেশ বিদেশ থেকে মানুষ এসে জড়ো হচ্ছে আমেরিকায়। আবার পাশাপাশি কালোদের উপর নিপীড়ন বাড়ছে, এশিয়া থেকে আসা অভিবাসীদের জন্য কঠিন হয়ে উঠছে সব নিয়মকানুন। বাবনানের চিকনদার আলেফ আলি আর পাঁচকড়ি মণ্ডল, সিলেটের গোবিন্দ সারেং কি আক্রাম, বেদান্ত সোসাইটি গড়ে তুলতে আসা অভেদানন্দ - এমনি আরও অনেকের জীবন জড়িয়ে যাবে অনেক রঙের মানুষের দেশ আমেরিকার এক উথালপাথাল সময়ে, বুনবে নানা রঙের নকশিকাঁথা।
বর্ষার দিনে পথঘাট কাদায় প্যাচপ্যাচ। হাঁটাই মুশকিল। যেখানে জল কম, মাটি আঠার মত থকথকে। আর যেসব জায়গায় জলে আর কাদায় মিশে মাখামাখি, সোজা পায়ে চলাই দুষ্কর। তার উপর মাথায় পেটি। টালমাটাল অবস্থা। তবু যতটা সম্ভব জোরে পা চালিয়ে চলছিল মনিরুদ্দি।
মনিরুদ্দির বাড়ি সিনহেট। কিন্তু এই চত্বরের অনেক গ্রামগঞ্জেই তার ঘোরা। চিকনের ব্যাপারী, মাল তুলতে কোথায় কোথায় না যেতে হয়। কিন্তু দাদপুরে যেদিন আসতে হয়, এমনকি গাঁয়ের পাশ দিয়েও যাওয়ার থাকে, তার চলার গতি ঊর্ধমুখী। ত্রস্ত হরিণের মত ইতিউতি চাইতে চাইতে পার করে দিতে চায় পথটুকু। আবার যদি সেই মেয়েটা পাকড়িয়ে সওয়াল শুরু করে, যার কোনো জবাব নেই মনিরুদ্দির কাছে, সে বড় হাঙ্গামার। একই সওয়াল রোজকার, মানে আগে যে বার তিনেক এই পথে গিয়েছে প্রতিদিন। ধরেও ফেলে ঠিক। যেন মনিরুদ্দি আসবে সেটা আগে থেকেই জানা। তখন আর লুকোবার পথ থাকে না। না পালিয়ে উপায় কি? তার কাছে আলেফের কোনো হদিশ তো নেই। চেনেই না কে আলেফ আলি, সে কি বেত্তান্ত খুঁজে আনবে?
মেয়ের নাম আমিনা। তার আলেফ গেছে এক জস্টিতে। আরেক জস্টি ছাড়িয়ে ভাদ্র মাস পড়ে গেল, সে কেন একনো এলো না?
যুবতী মেয়েছেলে, চেহারা সরেস। প্রথমবার এই প্রশ্নে পেটি নামিয়ে দাঁত বের করেছিল মনিরুদ্দি। কে এলো না মেয়ে? কার জন্য তরাস কচ্চো?
আলেফ আলি, চেনো তারে?
এবার একগাল হেসেছিল মনিরুদ্দি। সারাদিন কাজে কর্মে মাথায় বোঝা নিয়ে চষে বেড়ায়। এমন খেজুরে আলাপ পেয়ে জমে গেছিল মনিরুদ্দি।
আলেফ মিয়ারে কে না চেনে? গোপীনাথপুরে কত বড় দোকান হাঁক্কেচে।
সেই ভর দুপুরে এক নিমেষে সব আলো শুষে নিয়ে মেঘ জমা হয়েছিল আমিনার মুখে। গলায় যেন কেউ শিরিষ কাগজ ঘষে দিয়েছে। গোপীনাথপুরে কত বড় দোকান হাঁক্কেচে? এতো খানি মিছা কতা কয়ে গেল আমায়?
আলেফ মিয়া আদমি তো খুব সাঁচা, মিছা কইবে কেনে? তার সনঝে তুমার দেকা হল কোন ঠেয়ে?
থরথর করে কাঁপছিল আমিনার দুই ঠোঁট। আলেফ এমন করে ঠকাল তাকে? বছর ঘুরে গেছে, আর কারো সঙ্গে নিকা কবুল না করে পথ চেয়ে বসে আছে আমিনা, আর সে কিনা – কোনমতে উগরে দিল আমিনা। সে যে তোমার মত আসতো এই গেরামে, চিকনের কাজ নিতে। তকনো দোকান দেয়নি গোপিনাথপুরে।
কার কতা বলচো? আমাদের আলেফ মিয়া চালের ব্যাপারি, কুনুকালে চিকনের ফিরি করেনিকো। তাইলে আমি জানতাম না?
অন্য লোক? সন্দেহ যায়নি আমিনার। বয়েস কত? কালো না ধলো? লম্বাই কেমন? তার মাতার মধ্যিকানে চারগাচি চুল কি আকাশপানে উট্টে তাকে?
তার মাতাজোড়া টাক! বলে মুচকি হেসেছিল মনিরুদ্দি। দুইখান বিবি তার, কয়েকগাচি চুল বেঁচেবত্তে আছে, সেই কি ভাগ্যি।
আমিনার মুখেও মেঘ কেটে রোদ উঠেছিল। বাঁচালে মিয়া, সে তাইলে অন্য নোক, আমার আলেফ নয়কো।
কে তোমার আলেফ?
চিকনের ব্যাপারি। আমাদের কাজ কিনে নে যেতো।
চিকনের কাজ করো নিকি মেয়ে? ভাবনা কিসের, আমারে দে দাও। ন্যায্য দামে কিনবো।
আলেফ কেন আসে না মিয়া কাপড় নিতে? সে বলেচিল জারের আগ দে ফিরে আসবে। বছর ঘুইরে গেল, সে এমুখো হল না কো।
আমিতো চিনিনে তারে। কোত্থে ফিরবে? গেচে কোতা?
গেচে কোতা? আমি মেইয়ে মানুষ অত কি বুজি? সে কোন জায়াজে চেপে দেশান্তরে গ্যাচে। সেখেনে দরিয়া কিনারে পেল্লাই হাট বসে নিকি, আমাদের দশটা গেরাম জুড়লেও তার নাক ছুঁতে পারবে না কো।
যে গ্যাচে, গ্যাচে। আলেফ ছেড়ে আর কুনো ব্যাপারি নেই নিকি? বুঝদারের হাসি খেলল মনিরুদ্দির মুখে। বুঝেচি, ভাবচ নতুন ব্যাপারি তোমারে ঠক্কে নেবে। তুলুমূল্য দাম দেবো আমিও, হক কতা কইচি মেয়ে। দেকাও কি আচে তুমার কাচে।
কাজ ছিল কিছু আমিনার ঘরে। দেখেই মনিরুদ্দির পছন্দ। খুব খোলতাই একেকটা চাদর। যেমন বুনট, তেমনি আঁট ফোঁড়। আমিনার হাতে পাখিরা ডানা মেলে, গাছের পাতা তিরতির করে কাঁপে, নাচের জুড়িরা বোল তোলে কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে। দেখে চোখ জুড়িয়ে গেছিল মনিরুদ্দির। ওদিকে এটা সেটা দেখাতে দেখাতে আমিনার মুখে শুধু আলেফ আর আলেফ। সেদিনই আলেফের বেবাক কথা জানা হয়ে গেছিল মনিরুদ্দির। বলেছিল, আমার সামানও তো জায়াজে করে সাত সমুদ্দুর পেরিয়ে যায়। আমার কাছে এক ব্যাপারি আসে ওয়াহিদ বক্স। কলিঙ্গা বাজারে পেটি নিয়ে গিয়ে জায়াজে তুলে দেয়। ওদেশে যেসব চিকন্দারি ব্যাপারি আসা যাওয়া করে তাদের সনঝে ওর খাস দোস্তি।
শুনে চকচক করে উঠেছিল আমিনার চোখ, আশা আর আনন্দে চোখের কোলে টলটল করছিল দুটো মুক্তোদানা। ডান হাতে খামচে ধরেছিল মনিরুদ্দির পেটি। একটা খপর এনে দাও আমায়। আজ থে তুমি আমার ভাইজান হলে, আলেফের খপর তোমাকে আনতেই হবে ফের।
কি কুক্ষণে মনিরুদ্দি সেদিন ব্যাপারি বুদ্ধি খেলিয়ে ভাইজান হবার সুবাদে কম পয়সায় মাল খরিদ করেছিল। তখন কি জানত ওয়াহিদ বক্স কোনো খবর আনতে পারবে না। মোদ্দা কথা হল, ওয়াহিদ নিজে তো যায়নি, এরকম বছর বছর লোক যায়। তার মধ্যে থাকবে কোনো এক আলেফ। কিন্তু যদি দশজনা যায়, ফেরে মুরুব্বি গোছের দু’জন। ক’মাস বাদে তারা আবার সঙ্গীসাথী জুটিয়ে পেটি নিয়ে সফরে রওয়ানা হয়ে যায়। আর সবার যাওয়ার জায়গা – সে-ও কি এক? বুঝিয়েছিল ওয়াহিদ বক্স। কেউ যায় লন্ডন, জোহানেসবার্গ, আবার এক দল যাবে নিউ ইয়র্ক, নিউ অরলিন, ভ্যাঙ্কুভার – এমনই হরেক বন্দর। কে আলেফ আলি, সে কোন দিকে গেছে, কে জানবে তার ঠিকানা?
খবর আনতে না পারায় সে এক তুফান হাজির করেছিল আমিনা। মাঠের ধারে দাঁড় করিয়ে ঝাড়া আধা ঘণ্টা মনিরুদ্দির মাথা খেয়েছে। তাহলে তুমি সেদিন মিছে কথা কয়ে গেচো।
মিছে কেন কইব? ওয়াহিদ বক্স কিছু খপর জানে আন্দাজ করেচিলুম। সে বান্দা কিচুটি কইতে পারল না। মহা ফাঁপরে পড়ে গেছিল মনিরুদ্দি।
তুমি ভাল করে কইতে পারনি। আলেফ আলি, বাবনানের আলেফ আলি। লম্বা, হাট্টা কাট্টা চেয়ারা তার, কেয়ারি করা দাড়ি, মাতার চারগাচি চুল আকাশপানে উট্টে থাকে। বলতে বলতেই আলেফকে যেন চোখের সামনে দেখতে পায় আমিনা। জলে ভরে আসা চোখে আঁচল চাপা দেয়।
কি বলবে মনিরুদ্দি? সেদিন পেটি মাথায় রওয়ানা হয়েছিল এই বলে, যে আমি আবার করে বলছি ওকে। আগের বার আলেফ আলির এত হালহদিশ দাওনিকো, আমি ওকে বিশদ করে কইবো আবার।
কি আর বলবে মনিরুদ্দি? আমিনার হাত থেকে বাঁচার জন্য এসব কথায় জট পাকিয়ে পালিয়েছিল বই তো নয়। তারপর থেকেই সাবধানে যেত এই পথে। মেয়েটার হাতের কাজের দর আছে, তবু এড়িয়ে যাচ্ছিল যতটা পারে। আজকেও তাই। অনেক দূর থেকে খেয়াল করতে করতে মাঠ ভাঙছিল। এ মেয়ে যেন বাতাসে গন্ধ পায়। ঠিক দেখে ফেলেছে। কাদামাটি ঠেলে সে মেয়েকে দৌড়ে আসতে দেখেই মনিরুদ্দির পরাণ শুকিয়ে কাঠ। এই রে, খেয়েচে! যেখেনে বাঘের ভয়, সেখেনেই সনঝে হয় গো! বলে উল্টোমুখে হাঁটা লাগিয়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে ধপাস। এমন প্যাচপ্যাচে রাস্তায় ঝটিতি পথ বদলানো আসান কাজ না।
আমিনার ঘরগেরস্তির কাজ কিছু কম থাকে না। মায়ের হাতে হাতে কুটনো জুগিয়ে দেওয়া, ছোট ছোট দু’টি ভাই বোনকে নাওয়ানো-খাওয়ানো, উঠোন নিকানো, গরুর জাবনা দেওয়া – তারপর একঠেয়ে বসে মার সঙ্গে সেলাইয়ের কাজ। এক চোখ কাজ গোছায়, তো আর এক চোখ আলেফকে খোঁজে।
উঠোন নিকোতে নিকোতে চোখ থাকে পথের দিকে, কেউ কি এল? আলেফ। মনিরুদ্দি।
আধা উঠোন নিকোন হয়, আধা বাকি। আলেফ ভেবে গাছের গায়ে হাত বোলায়, কথা বলে বিড়বিড়িয়ে। পাতারা হাওয়ায় সড়সড় করে, কানের দোরে আলেফের ফিসফিসানি।
গরুর জাবনা দিতে গিয়ে ঘুঁটতেই থাকে, ঘুঁটতেই থাকে – গরু ঘন ঘন অস্থির স্বরে হাম্বা ডেকে উঠলে হুঁশ ফেরে।
ভাত মেখে ভাই আব্দুলের মুখে দিতে গিয়ে খাবার পৌঁছে যায় সে ছেলের কানে, আমিনার চোখ যে দূরের মাঠে। আব্দুল ফিক করে হেসে আমিনাকে ঠেলা মারে, অ আপু! কুন দিকে গরাস দিচ্চিস দ্যাক!
সেলাই করতে করতে চোখ ইতিউতি চায়, সুঁই আঙ্গুলে ফুঁড়ে খুন বেরিয়ে কাপড় রাঙিয়ে দেয়। মা চুলের মুঠি ধরে গমাস করে পিঠে কিল মারে। বেলুজ্জে মেয়ে, সারাদিন উইড়ে বেড়াচ্চে।
তাতে কি আমিনার মনের কপাটে শিকলি পড়ে? যখন মাঝ দুপুরে কাজের ফাঁকে আব্বু ঝিমায়, মা জিরোয়, আব্দুল টো টো করতে বেরোয়, সেলিমা উঠোনে এক্কাদোক্কা খেলে, আমিনা হাতের কাজ ফেলে পথ ঘাট মাঠ চষে বেড়ায়। ঘনঘন চোখ চলে যায় দূরে, পথ যেখানে দাদপুরের দিকে বাঁক নিয়েছে। পথে কোনো মুনিশ গেলে, তাকে সওয়াল-জবাবে জেরবার করে, পথে দেখলে কারোরে, মাথায় পেটি? খালেবিলে ছিপ নিয়ে বসে থাকা ছেলেদের কাছে খবর নেয়, কে এলোরে আজ গাঁয়ের পথে, দেখেচিস কারুক্কে?
এর মধ্যে যদি দ্যাখে মাথায় পেটি নিয়ে কেউ মাঠ ভেঙে আসছে, দেখা গেল কি গেল না, পড়ি কি মরি করে দৌড়ায়। কে জানে আলেফ এল বুঝি। আলেফ না সই, আলেফের খবর নিয়ে মনিরুদ্দি! কখনো সে হয় ঝাঁকা মাথায় মাটির পুতুলের কারিগর, কিংবা ছুরি কাঁচির ফেরিওয়ালা। রেশমি চুড়ির বেচনদার ছুটতে ছুটতে আসা মেয়েকে দেখে খরিদ্দার পেয়েছে ভেবে দাঁড়িয়ে পড়ে। হাতসাফাইয়ের খেল দেখানো বাজিগর হাঁক পাড়ে, কি মেয়ে দেকবে আমার ভোজবাজি? হাঁফাতে হাঁফাতে কাছে এসে যখন ভুল বোঝে আমিনা, দমে না মোটেই। মাঠের ধারের বুনোফুল তুলে একটা একটা করে তার পাপড়ি ছেঁড়ে। একটা পাপড়িতে আলেফ আসবে, আর একটাতে আসবে না। একটাতে আসবে, পরেরটাতে না, এল না। শেষ পাতায় যদি আসবেতে থামে, আমিনা আরও উৎসাহে দিগন্তে চোখ মেলে। যদি আসবে না-তে দাঁড়িয়ে পড়ে, আর একখানা ফুল তুলে পরের দফা গোনা শুরু করে। এইভাবে যে চোখ সারাদিন আকাশ বাতাস ডালে পাতায় মাঠে ঘাটে আলেফকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, সেই চোখকে ফাঁকি দিয়ে মনিরুদ্দি যাবে কোথায়?
আমিনা যতক্ষণে এসে পৌঁছেছে, মনিরুদ্দি তখনো কাদামাটিতে থেবড়ে বসে আঁকুপাঁকু করছে। ব্যাপারির জাত – নিজে পড়েছে, কিন্তু দুই হাতে এঁটে ধরে রেখেছে তার মাথার পেটি। খুব ঝটকা লেগেছে কাঁধে।
তার এই অবস্থা দেখে আমিনা হেসে অস্থির। সেলামালেকুম ভাইজান, আমারে দেকে উল্টোমুকে ছুটতে নেগেচিলে? আমিনাকে ফাঁকি দেবার শাস্তি দিয়েচে আল্লাতালা। জানো না দাদপুরে পীরের দরগা আছে, সে বড় মান্যির পীর।
আমি কি করেচি, শাস্তি পাবো। নিদান দিতে হয় আলেফ মিয়ারে দাও। বেজার মুখে বলল মনিরুদ্দি।
ছলছল করে উঠল আমিনার দুই চোখ। ভাইজান, সে লোক কত দূর দেশে গ্যাচে, পথে কোনো বিপদ আপদ হয়েচে কি, সে কি কচ্চে, কোতায় শুচ্চে না বসচে, আমরা সেসব জানি কি? তার উপরে কি নিদান চাওয়া যায়?
আগে আমারে পাকড়ে তুলবে কি? আর না হোক পেটিটা তো ধরো, আমি এট্টু উটে দাঁড়াই।
আমিনার সাহায্যে উঠে গাছের তলায় বসল মনিরুদ্দি। ঘাড়ে বেদনা, গায়ের পিরানটা কাদায় মাখামাখি, লুঙ্গি তথৈবচ। সব রাগটা গিয়ে পড়েছে আমিনার উপরে।
ও মা, আমি কি করিচি? এখন দাঁতের ফাঁক দিয়ে টগর ফুলের মত হাসির দানা ছড়াচ্ছিল আমিনা। আমায় দেইখ্যে তুমি এমন সিঁদেল চোরের মত পাছু মুড়লে, তবে না আছাড় খেলে। কেন ভাইজান, আমি কি কোন ডাইন, তোমার কাঁধে চড়াও হতে নেগেচি?
মিঠা কথায় গলে যাবার লোক না মনিরুদ্দি। খেঁকিয়ে উঠল এবার। আমি কি তোমার আলেফের জিম্মা নিইচিলাম? দেকা হলেই আলেফের খপর দাও, আলেফ কেন আসচে না, আমি কি গুনতে জানি? আমি কয়েছিলাম ওয়াহিদ মিয়ারে পুছতাছ করবো, ঘাট হয়েছে আমার। তোমার আলেফ কুন লাটের পো হয়েচে, সবাই তার খপর জানবে?
আমিনার মুখ শরতের আকাশ। এই ছিল ফুলকো হাসি, এখন থোকা থোকা মেঘ। চোখ ছলছল করে উঠল। আমি কি তা বলিচি? ভাইজান বলে ডেকেচি, তবু তুমি বুনকে দেকলে উল্টো দিকে পলাচ্চো।
মনিরুদ্দি একটু লজ্জা পেল। আচ্চা, সে যা হল হোক। আমায় একটা বার্তা দাও দিনি। আলেফের সঙ্গে তুমার নিকার কতা কি হইচিল?
লজ্জায় মাথা নিচু করে আমিনা। মাথা নেড়ে বলে হ্যাঁ।
মুরুব্বিরা কতা কয়েচিল?
আমার আব্বুর সনঝে আলেফ মিয়ার আব্বার কতা হয়েচিল। আলেফ ফিরলে নিকার বন্দোবস্ত হবে এমনটাই ঠিক করেছে মুরুব্বিরা।
তাহলে আব্বাজানকে পাটাও ওর ভিটেতে? আলেফের হদিশ ওরা তো জানবে।
জোরে জোরে মাথা নাড়ল আমিনা। আব্বু একবার ঘুরে এয়েচে, ওরাও কিছু খপর পায়নিকো। না চিঠি, না কোনো পরচি। কিচুটি জানায়নি আলেফ। ওতে করে আমার ভয় আরও বেড়ে গ্যাচে ভাইজান।
ঠিক আচে, আমি নিজে জায়াজ ঘাটায় গিয়ে খোঁজ নিচ্চি দাঁড়াও, ওয়াহিদ মিয়ার পরে আর ভরসা করবো নাকো।
নিজে যাবে ভাইজান? সত্যি? আনন্দে অবিশ্বাসে চোখ বড় বড় হয়ে যায় আমিনার।
মনিরুদি অনেকদিন ধরেই ভাবছিল নিজে যাবে একবার। তার বেশ সন্দেহ হয় ওয়াহিদ মোটেই ন্যায্য দাম দিচ্ছে না। একবার নিজে গিয়ে তত্বতালাশ করে নিলে দাম বেশি পাবে তার ধারণা। ওয়াহিদের কাছ থেকে খোঁজখবর নিয়েছে। নৌকা করে গঙ্গা ধরে চলে যাবে খিদিরপুর। সেখানে কলিঙ্গা বাজার। যারা জাহাজঘাটায় কাজের খোঁজে আসে, থাকে কলিন লেন কি টার লেনে। চিকনদারি ব্যাপারিরাও ওখানে জোটে। জনে জনে মাল নিয়ে এলে বড় বড় পেটিতে মাল তোলে। ওয়াহিদ অবশ্য ভয় দেখিয়েছে। ঘাঘু লোক। বলেছে, মনির, তুমি ভেবেচো ওখেনে গিয়ে মাল তুলে দেওয়া বুঝি সোজা কাজ। তা নয়কো মোটে। কলিন লেন জায়গা মন্দ। যত মদো-বেবুশ্যেদের ঠাই। গোরা পল্টন টহল দিচ্চে দেকলে জান উজার লাগে। দেশ বিদেশের লস্কর মাল্লারা এদিক ওদিক হল্লা কচ্চে। ফিরিঙ্গি নাবিক সব কি খিস্তিখাস্তা করছে, হাতেফাই লেগেই আচে। চলো একদিন আমার সনঝে, দেক্কে এসবে কি হাল সে জায়গার।
মনিরুদ্দি তবু ঠিক করেছে সে যাবে, দুটো বেশি পয়সার মুখ দেখতে পাবে।
কবে যাবে ভাইজান? আমার একটা জিনিস দেবো তুমার সনঝে।
কি জিনিস?
আমিনা একটা রেশমের রুমাল বানিয়েছে আলেফের জন্য। সেখানে সুতোয় নিমের পাতার ফোঁড় তুলেছে। নিম গাছ বড় ভালবাসত আলেফ, আর নিমফুল। এই গাছের বাতাস নাকি বড় শীতল, পেটি মাথায় গাঁয়ে গাঁয়ে ঘোরার সময় নিমগাছের তলায় জিরোতে বসত। আলেফ দেখলেই ঠিক চিনে যাবে। আমিনা নিশ্চিত।
একখান রুমাল দেবো তোমার সনঝে। আলেফ মিয়ার জন্য।
আলেফকে কোতায় পাব সেখেনে? মনিরুদ্দি দেখল এ তো আরেক ফাঁপর।
ওই দেশে যে পেটি যাবে, তার সনঝে চলে যাবে। বলে দেবে আলেফকে যেন দে দেয়।
মনিরুদি বুঝেছে এই মেয়ের সঙ্গে তকরারে গিয়ে কোনো ফয়দা নেই। বড় করে মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ করে দিল। পাঠিয়ে দিতে তার কি আপত্তি। তারপর পড়ুক যার হাতে যে পড়বে। দাও তালি, আবার কি আসা হবে ইদিকে। আমি আজই নিয়ে যাই।
রুমাল আনতে হাওয়ার বেগে বাড়ির পথ ধরল আমিনা। খুশিতে পাখির মত ডানা ঝাপটে। শুধু রুমাল দেবে না আমিনা, কয়েক লব্জ লিখেছে আলেফের জন্য, মনিরুদ্দিকে বলতে মুখে বেঁধেছে। দেবে সেটাও।