“এদিকে দেশের লোক যারা এক বছর ধরে কাটাকাটি মারামারি রক্তগঙ্গায় স্নান, নারীর বস্ত্রহরণ, লজ্জা মান সম্ভ্রম হরণ করেছিল সেই কলাবাগান রাজাবাজার, মেটেবুরুজ, পার্কসার্কাস এবং বড়বাজার, হাওড়া, কালীঘাট, বালীগঞ্জের সবাই আতরদান, গোলাপপাশ, কেওড়াজল, মিষ্টি, সন্দেশ, পেঁড়া, বরফি নিয়ে খাওয়াতে ও পরস্পরের গায়ে গন্ধজল ছিটিয়ে দিতে লাগলো। দুদলেই সভয়ে শঙ্কায় সতর্ক হয়ে কোলাকুলি ‘মুবারকবাদ’ও করলো সন্দিগ্ধ নেত্রে। কে জানে কোন সময়ে আবার ঐতিহাসিক আফজল খাঁ-শিবাজী সংবাদ বেরিয়ে আসে কার মধ্য থেকে।
ট্রাম-বাসের পথে পথেও জনতার এই স্বাধীনতাপ্রাপ্তি লীলা চললো মধ্যরাত্রি অবধি।
আর মৌখিক কৃত্রিম ভাষণ কথাবার্তা কোলাহলের মাঝ থেকে, ব্যর্থ গন্ধজল বর্ষণের মাঝ থেকে ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট মধ্যরাতে বিভক্ত, দ্বিখন্ডিত রক্তাক্ত ভারতের একটি জন্মান্তর হ’লো। ” - এপার গঙ্গা, ওপার গঙ্গা।
সুতারা দত্তকে হয়তো পাঠকের মনে আছে। অ্যাসিট্যান্ট প্রফেসর। দিল্লির হস্তিনাপুর যাজ্ঞসেনী কলেজের। ছাত্রীদের ইতিহাস পড়ান। যেটুকু পড়ানোর কথা বলে দেওয়া হয় সেইটুকুই। অথচ জানেন বেশ, যা পড়ান তা ইতিহাসের খন্ডাংশ মাত্র। লিখিত ইতিহাসেরও ভগ্নাংশ। যতটুকু শাসকের অনুমোদন পায়। আর যে ইতিহাস লেখা থাকে না? সবাই জানে, তবুও যে ইতিহাসের দিকে চোখ বুঁজে থাকাই দস্তুর?
আসলে সুতারা নিজেই ধারণ করে ছিলেন সেই ইতিহাস। সেই সময় তিনি ম্যাট্রিক দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছেন। বাবা গ্রামের স্কুলের শিক্ষক। দাদারা সব কলকাতায়। সেই সময়ে শুরু হয় দাঙ্গা। নোয়াখালির গ্রামের সচ্ছল গার্হস্থ্য, বাবা-মা-দিদির স্নেহ সব এক রাতে ‘নেই’ হয়ে যায়। তারপর শুরু হয় নতুন গল্প। লিখলেন জ্যোতির্ময়ী দেবী। উপন্যাসের নাম “এপার গঙ্গা, ওপার গঙ্গা”। প্রথম বেরোল প্রবাসীতে, সময় ১৯৬৭।
সুতারা কল্পনার। লেখকের মানসভূমিতে তাঁর জন্ম। ননীপিসিমা কিন্তু নিতান্ত বাস্তব। ঢাকার ঝাঁকপালের মেয়ে। বিবাহিত, তবে স্বামীকে ত্যাগ করে বাপের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া। বয়সে সুতারার থেকে খানিকটা বড়। দেশভাগের সময় তাঁর বয়স পঁচিশের এধার-ওধার। তিনি সেই অর্থে দাঙ্গা দেখেন নি, তবে দেশভাগ শরীরে-মনে উদ্বাস্তু করে দিয়েছে তাঁকে। অবশ্য এমনিতে তাঁর হারিয়ে যাওয়ার কথাই ছিল। দেশ-গাঁয়ে এমন দশের চোখে “আশ্রিতা” মাসিমা-পিসিমা কতই না থাকেন! কেই বা তাঁদের মনে রাখে! তবে ননী-পিসিমা ভাগ্যবান। বহু বছর পরে তাঁর ভাইপো গোপালচন্দ্র মৌলিকের স্মৃতিচারণে ঠাঁই পান তিনি। সেই স্মৃতিকথার নাম “দেশভাগ ও ননীপিসিমার কথা”। প্রথম সংস্করণ বেরোয় ২০১১ সালে।
দুটি বই-এর প্রকৃতি ভিন্ন। প্রথমটি উপন্যাস। দ্বিতীয়টি স্মৃতিকথা। প্রথমটি মেয়ের লেখা, দ্বিতীয়টি এক পুরুষের চোখে রোম্যান্টিক ফিরে দেখার কথন। তবে তফাৎ অনেক থাকলেও দুটি বইই একটা নির্দিষ্ট সময়কালের আবহে দুই নারীর যাত্রা তুলে ধরেছে। দেশভাগের সময়। বাস্তুহারা হওয়ার সময়। দেশজোড়া হিংসার সময়।
আমাদের দেশভাগ এক জটিল, বহুস্তরীয় ইতিহাস। বিভিন্ন ছোটগল্প, উপন্যাস, স্মৃতিকথায় তার বিভিন্ন দিক উন্মোচিত হয়েছে। কোনও একটি লেখা তো তার সব কোণ ধরতে পারে না। তার উপর উদ্বাস্তু শব্দটা তো আর কোন সমসত্ত্ব গোষ্ঠীকে বোঝায় না। বিভিন্ন জাত-ধর্ম-লিঙ্গ-দেশ-কালের স্থিতির ভিত্তিতে একেক জনের দেশভাগের স্মৃতি একেক রকমের। প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন লেখা জুড়ে জুড়ে তৈরি হয় এক রক্তমাখা ইতিহাস। সেখানে হতাশা, দুঃখ, যন্ত্রণার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সংগ্রাম, সাফল্য আর ব্যর্থতার কাহিনি। যে দেশভাগ মধ্যবিত্ত উচ্চবর্ণ বাঙালি পুরুষের কাছে ধন-মান-প্রাণ নিয়ে পলায়ন, এবং পরবর্তীকালে এক ধরণের স্মৃতিমেদুরতার জন্মদাতা, সেই একই দেশভাগ অন্য অনেক মেয়েদের ব্যক্তিগত যাতনার উৎসমুখ। বহু মেয়ের আশ্চর্য উড়ালের ইতিহাসও আছে অবশ্যই। সব বাধা অতিক্রম করে স্বপ্ন ছোঁয়ার ইতিহাস। সে সব কাহিনী আমাদের উজ্জীবিত করে। তবু সবরকমের লেখার মধ্য থেকে এই দুটি বইকে বেছে নেওয়ার কারণ হল এই দুটি বই-ই সেইসময়ের বাঙ্গালি উচ্চবর্ণের মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়েদের জীবনে পিতৃতান্ত্রিকতার ধারাটির বেশ স্পষ্ট ছবি আঁকে। আর পুরোন কথা পড়তে পড়তে সেই ফাঁকে যদি নিজেদের আজকের জীবনকেও সেই আলোতে দেখে নেওয়া যায় তো মন্দ কী!
তুমি রবে নীরবে
সুতারার ভাগ্যে সেই রাতে ঠিক কী ঘটেছিল সে বিষয়ে কথক নীরব। কাজেই সুতারাকে আমরা ঠিক কোন ভাগে ফেলব, ধর্ষিত নাকি শুধুই দাঙ্গা-কবলিত সেই জায়গাটা আবছাই থেকে যায়। সবাইকে হারিয়ে সে আশ্রয় পায় পিতৃবন্ধু, তমিজ সাহেবের বাড়ি। তিনি আবার সুতারার বন্ধু সাকিনার বাবাও। কন্যাস্নেহে তিনি ঠাঁই দেন সুতারাকে। সেই সঙ্গে তাকে নিজের পরিবারের কাছে ফেরত পাঠানোর চেষ্টাও চলে। সেই পর্বেই এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে পরিবারের মধ্যে তার স্থানবদল ঘটেছে। পরিবারের আদরিণী কন্যা এবার তিন ভাই থাকতেও হয়ে যায় অনাথ। অবশ্য সে ফিরে আসাতেই যত ঝামেলা। তার দিদির মত হারিয়ে গেলে কোন সমস্যাই হত না। এই উপন্যাসে এর পরের পর্বে বারকয়েক তার ভগ্নীপতি বিমলের কথা উঠলেও একবারও সুতারার দিদি সুজাতার কথা ওঠে না। নীরবতায় মিলিয়ে যায় সুজাতা।
ননীপিসিমার ভাগ্যের গতি ছিল অন্যরকম। উচ্চবর্ণের স্বচ্ছল বাড়ির বাসন্তী নামের কন্যাটির চৌদ্দ বছরে বিয়ে হয়। কন্যাপক্ষের অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার বোধহয় কিছুটা কম ছিল। তাই মহাসমারোহে বিয়ের পরে আবিষ্কার হয় যে নতুন জামাই লম্পট এবং তার কামাতুর পিতৃদেবও পুত্রবধূকে সম্ভোগের জন্য লালায়িত। কন্যা পালিয়ে আসে বাপের বাড়ি, আর ফিরে যায় না। বাপ- (সৎ)দাদার স্নেহে, (সৎ)বৌদির ভালবাসায় সুখেই ছিল সে। তাল কাটল বাবা-দাদার মৃত্যুতে। আর তার পাশাপাশি এসে পড়া দেশভাগের ঝড়ে। লেখকের বয়ানে আমরা ননীপিসিমার বহু গুণের বয়ান শুনি। গান গাইতে ভালবাসা, বই পড়তে ভালবাসা, আলপনা দিতে পটু এক সংবেদনশীল সুন্দরী যুবতীর ছবি ভেসে ওঠে মনে। একটি স্নেহ-মমতা-ভরা পরিবারের পটভূমিতে। সেখানে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা তার দ্বিতীয় বিবাহের কথা আলোচনা করেন। যদিও অবস্থাগতিকে সে কথা এগোয় না। দেশভাগের পরেও, লেখক জানান, ননীপিসিমার সঙ্গে লেখকের মামাতো দাদার একসঙ্গে গান গেয়ে আনন্দ পাওয়ার কথা। শৈশবের দৃষ্টিতে মনে হয়েছিল এদের দুটিতে বিয়ে হলে ভাল হত। আর বাসন্তীর নিজের কি মনে হয়েছিল? সেটা নীরবতাতেই ঢাকা থাকে। তাঁর ভাবনাচিন্তার হদিশ মেলে না মোটেই। অবশ্য ‘বাসন্তী’ও খুব বেশি নেই এই বইতে, যতটা আছেন ননীপিসিমা।
মেয়েদের ঘিরে এই নীরবতার উৎসব কি সমাজেরই শিক্ষা না? নিজের কথা নিজে মুখ ফুটে বলা – নিতান্তই নিলাজ ব্যাপার! বিশেষত যৌনতা সংক্রান্ত বা যৌনতা-সম্পৃক্ত যে কোন বিষয়ই আলোচনার সীমার বাইরে। মেয়েদের আবার মতামতই বা কী! তারা হল মাটির ঢেলা, গুরুজনরা যা বলবে, মুখ বুজে তাই করবে - যেখানে রাখবে, সেখানেই চুপ করে থাকবে। বুক ফাটে তাও মুখ ফোটে না – এই না হলে মেয়ে। আর যে মেয়ের শুচিতাহানি হয়, সে তো পরিবারের পুরুষের লজ্জা। রক্ষকের সামর্থ্যের অভাব। তার অস্তিত্ব মেনে নেওয়া মানে তো পৌরুষের লজ্জাকে প্রতিনিয়ত স্মরণ করা। কাজেই তাকে ভুলে যাও।
ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে, অন্ধ সেজন মারে আর শুধু মরে
সুতারার ফিরে আসাটা তার পরিবারের কাছে সমস্যা। কলকাতার দাঙ্গার আশঙ্কায় তার দাদারা তখন নিজেদের বাসা ছেড়ে বড় দাদা সনতের শ্বশুরবাড়িতেই থাকে। সেখানে মুসলমানের ঘরে এতদিন কাটিয়ে আসার দোষে তাকে অস্পৃশ্য বলে গণ্য করা হয়। এমন মেয়েকে তো বাপ-মায়েও ঘরে ফিরিয়ে নেয় না। এই অনাথ মেয়েটির প্রতি সনতের শ্বশুরমশাই এর সমবেদনা ছিল। কিন্তু সে ধোপে টেঁকে না। বাড়ির গৃহিণী সুতারাকে ‘হাড়ী-বাগদি’র অধিক মর্যাদা দিতে রাজি নন। সে জলের জালা ছুঁয়ে ফেললে, রান্নাঘরের কিছুতে হাত দিলে সব অশুদ্ধ হয়ে যাবে। যুগ যুগ ধরে ধর্মের নামে যে বিভেদ গড়ে তোলা হয়েছে, শুচিতার যে গন্ডি টেনে রাখা হয়েছে, তার বাঁধন বড় শক্ত। একটি কিশোরী কন্যার ম্লানমুখ তাকে টলাবে এমন কী আর হয়! তাকে ইচ্ছাকৃত ভাবে ঠেলে দেওয়া হয় পরিবারের উপান্তে। লোক-লৌকিকতার বাইরে। প্রায় একঘরে করে দেওয়া হয় তাকে। এমনকি পরিবারের শুভকাজে তাকে নিমন্ত্রণ করে এনে তাকে আলাদা ঘরে বসিয়ে খাওয়ানো হয়। জাত-জন্ম খোয়ানো সুতারার সঙ্গে অন্য মেয়েরা পংক্তিভোজে বসতে চাইবে না এই অজুহাতে। অথচ সেই অভ্যাগতরাই খ্রিস্টান অতিথিদের সঙ্গে এক পংক্তিতে বসে অন্নগ্রহণ করেন। পাকিস্তানে অনেকদিন পড়ে থাকা, মুসলমানের আশ্রয়ে থাকা, ধরে-নিয়ে-যাওয়া মেয়ের মিথ্যে তকমা সব জড়িয়ে-মড়িয়ে সুতারাকে এক অদ্ভুত ‘অপর’ এর কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। সেই অপরকে নিয়ে নগ্ন কৌতুহল থাকতে পারে, কিন্তু মর্মব্যথা থাকে না।
এমন কিছু ননীপিসিমাকে সহ্য করতে হয় নি। তবু তাকে ঘিরে এমন একটি ঘটনা ঘটে যাতে তাদের পরিবারটির দেশত্যাগ ত্বরাণ্বিত হয়। প্রতিবেশী একটি মুসলমান যুবক, সমসের আলি, ননীর দাদার কাছে ননীকে নিকাহ করার প্রস্তাব দেয়। সমসেরের দাদুর অন্নসংস্থান হয়েছে প্রতিপত্তিশালী ননীর বাবার দয়ায়, তার বাবা ছিলেন ননীর বাড়ির গোয়াল- আস্তাবলের চাকর। স্বাধীনতার সময় সমসের মুসলিম লিগের স্থানীয় নেতা। ‘পুরোন টাকা’র দর্পে ঘা দেয় নতুন রাজনৈতিক ক্ষমতা। ধর্মীয় বিভেদের বিষ এসে মেশে তাতে। এই নিকাহের প্রস্তাবে ননীর মত কি কেউ জিজ্ঞেস করেছিল? সে উত্তর লেখক দেন না। তবে ননীর বৌদি, লেখকের মা অনায়াসেই এই সমসের আলিকে সব থেকে ‘বড় বিপদ’ বলে চিহ্নিত করেন। আর সে রাতেই শুধু সোনা-দানা-নগদ টাকা নিয়ে দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। তেরজনের দলের অভিভাবক সে দলের একমাত্র পরিণত-বয়স্ক পুরুষ, লেখকের কাকা।
তমিজ সাহেবের স্ত্রীও সুতারাকে পুত্রবধূ হিসেবে পেতে চেয়েছিলেন। অভিজ্ঞ গৃহিণীর মনে সংশয় ছিল যে সুতারাকে তার হিন্দু পরিবার গ্রহণ করবে কী না। তমিজ সাহেব অবশ্য বলেছিলেন, “দায়ে পড়ে, কারে পড়ে হয়তো ধর্মান্তর নেয় কেউ কেউ। মনে থেকে আপন করা বড় শক্ত।” বাস্তবেও দেখা গেল কাকির স্নেহ ভালাবাসা সুতারা মনে রেখেছিল। তবু সেই সুতারাও অনেকদিন পরেও ব্যক্তিস্নেহের উপরে রাখল সাকিনার পরিবারের গোষ্ঠীগত ধর্মপরিচয়। দাঙ্গাকারীর দলে তাঁরা মোটেই ছিলেন না জেনেও, তাঁদেরই পরিচর্যায়, তাঁদেরই আশ্রয়ে সে প্রাণ ফিরে পেয়েছে জেনেও। এমনই বেড়ে ওঠার ধারা।
অবশ্য ননী আর সুতারা দুজনেরই যেটুকু ছবি মনে গড়ে ওঠে, বলা কথা আর পাঠকের নিজের কল্পনার ভিত্তিতে, তাতে দুজনকেই নিতান্তই প্রথানুসারী বলে মনে হয়। ধর্ম, জাত এবং আর্থিক অবস্থার ভিত্তিতে যে সামাজিক অবস্থানে জন্ম তাঁদের, সেই সমাজের সকল অনুশাসন তারা বিনা প্রতিবাদে ধারণ করেছে। ননীপিসিমা শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে এসে, আর ফিরে না গিয়ে তাও যদিবা একটু বিদ্রোহী মনের পরিচয় দিয়েছিলেন, তবু সে কিন্তু প্রশ্ন তোলে না যে বাবা বা পরিবার কেন যথেষ্ট খোঁজ-খবর না নিয়ে তাকে এই পরিবারে বিয়ে দিলেন? কেন স্বামীর লাম্পট্যের খবর তাদের কান এড়াল? তাই সন্দেহ জাগে যে এই পালিয়ে আসা হয়ত বা শুধু নিজের আজন্মলালিত শুচিতার ধারণাকে রক্ষার জন্যেই। বৃহত্তর কোন প্রশ্ন বোধহয় জাগে নি তাঁর মনে। এবং সেই সময়ের ওই গ্রামীণ স্বল্প-শিক্ষিত মেয়ের কাছে তা আশা করাও অন্যায়। কাজেই হয়ত সমসের আলির নিকাহের প্রস্তাবের উত্তরে তার নিজস্ব মতামতও বাড়ির অন্যদের মতের থেকে আলাদা কিছু হত না।
যে ধর্ম তাকে একা থেকে আরও একা করে দেয়, সুতারা কিন্তু সেই ধর্মের ছায়ায় ফিরে যায়। তীর্থে মা-বাবা-দিদিকে জলদান করতে গিয়ে পাণ্ডা বলে দিদিকে জল দেবেন না। তাঁর স্বামী দেবেন। সুতারা বিনা প্রশ্নে মেনে নেয়। ভাবেও না, যে দিদির কথা সবাই ভুলে গেছে, তাকে কি কেউ মনে করে আদৌ জল দেবে? প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম কিভাবে মানবিকতাকে ঢেকে দেয় তা স্পষ্ট হয় সুতারার এই বিনা-প্রশ্নে নিয়ম-মেনে চলা ব্যবহারেও। দিল্লিতে থাকার দরুণ ইতিমধ্যেই সুতারার জানার গণ্ডী কিন্তু বেড়েছে। সে জেনেছে সব ধর্মের এমনকি হিন্দুদের সব জাতেও মেয়েদের একই ভাবে দেখা হয় না। আবার হিন্দু পুরুষদের মুসলমান নারী অপহরণের কথাও সে শুনেছে। কেন এনেছে সেও নিশ্চয় বুঝেছে। তবুও ধর্মের অভ্যাস চিরন্তন !
জানি আমার অঙ্গ জুড়ায় তোমার ছায়ায় এসে
সুতারার অবশ্য একটি উপায় জুটল। লক্ষ্মীহীনা কন্যাটির ঠাঁই মিলল সরস্বতীর পায়ের তলায়। বয়স কম এবং মাথার উপর পিতৃতুল্য অমুল্যবাবু, প্রতিষ্ঠিত বড়দা, ভগ্নিপতি থাকার কারণে। মনের একটা আশ্রয় পায়। শরীরেরও। আর যাই হোক সুতারা সচ্ছল জীবন না পেলেও, থাকা-খাওয়া-পরার শারীরিক যন্ত্রণা তাকে বইতে হয়নি। একটি মিশনারি হোস্টেলে থেকে সে বি এ, এম এ পাশ করে। তারপর সবাইকে স্বস্তি দিয়েই সে চাকরি নেয়। তারই সমবয়সী শুভা-প্রভা কিন্তু সংসারে ঢোকে। সুতারার এই চাকরি নেওয়া কি আদৌ নারী স্বাধীনতার দ্যোতক? নাকি পরিবারের আশ্রয়হীন মেয়েটির কুটোটি আঁকড়ে ধরে ভেসে থাকতে চাওয়া? নাহলে চাকরি পাওয়ার পরে সুতারার মনে প্রশ্ন জাগে কেন যে “মেয়েরা কি স্বাধীন হয়?”
সুতারার ভাগ্য ভাল যে সে গ্রামের মেয়ে হয়েও কিঞ্চিৎ প্রথাগত স্কুলের শিক্ষা পেয়েছিল। হয়ত তার বাবা গ্রামের স্কুলের শিক্ষক হওয়ার কারণেই। অবশ্য এই গ্রামটিতে সাধারণভাবে মেয়েদের শিক্ষার বাবদে একটু বেশিই আগ্রহ ছিল। তবু কিন্তু আমরা দেখি যে এই উপন্যাসে আন্তঃধর্ম বিবাহ নিয়ে যেটুকু কথা হয় সেটা হয় পুরুষদের মুখ দিয়ে, সাকিনার বর এবং অধ্যাপক ভাইদের আলোচনায়। সাকিনা নিজের মন দিয়ে সুতারার অবস্থান বোঝে এবং সমর্থন করে। কিন্তু তত্ত্ব আলোচনার আসরে সে অনুপস্থিত। ননীপিসিমার স্কুলগত বিদ্যা কতটা তা জানা যায় না। তবে অনুমান করা যায় চৌদ্দ বছরে যার বিয়ে হয়, তার যতই স্মৃতিশক্তি থাক আর পড়ারও আগ্রহ থাক, স্কুলের ঘরে তার বেশিদিন পা পড়েনি। প্রথাগত বিদ্যা বেশি থাকলে কিছু অন্যরকম হত কি? অনুমান করাও মুশকিল।
ননীপিসিমা ও তাঁর বউদিমার যে দিকটা নজরে আসে তা হল অভিভাবকহীন নিজস্ব জীবনযাপনের প্রতি ভীতি। বোঝা যায় নারীর স্বাতন্ত্র্য না থাকার মনুস্মৃতির বিধানটি এঁদের মজ্জায় মজ্জায় প্রবাহিত। তার বাইরে আর কিছু ভাবতে পারেন নি। মনের মধ্যে শিকড় গেঁথে থাকা মনুমহারাজকে উপড়ে ফেলা কি অতই সহজ!
এদিকে যে পুরুষমানুষের অভিভাবকত্বে দেশ ছাড়লেন, সেই মানুষটি এদেশে এসেই হাত ছাড়লেন তাঁদের। অবশ্য দেশে থাকতেই সব পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে সে টাকা নিজের পকেটে পুরেছেন তিনি। ছয় সন্তানকে নিয়ে ননদ-বৌদি অর্থনৈতিকভাবে স্থানচ্যুত হয়ে অতলে গড়িয়ে পড়লেন। তবু রিফিউজি ক্যাম্পে ঠাঁই নেওয়ার কথা ভাবলেন না। চললেন মাথা গোঁজার জায়গার সন্ধানে, অভিভাবকের সন্ধানেও। বৌদির এই ভাইয়ের বাড়ি থেকে ওই ভাইয়ের বাড়ি। এক ছাতা থেকে আরেক ছাতা। যে সহায়সম্বলহীন পরিবার নিজেই অন্যের গলগ্রহ, সেই পরিবারেরও যদি আশ্রিতা থাকে, তার অবস্থা কেমন হয়? সব আশ্রয়দাতা পরিবারেই সে অবাঞ্ছিতেরও অবাঞ্ছিত। তবু একটাই সান্ত্বনার জায়গা যে শেষ অবধি তার মাতৃসমা বৌদি, নিজের সীমিত সামর্থ্য নিয়েও তার হাত ছাড়েন নি। এমনকি যখন ননীর রাজরোগ ধরা পড়ে, তখন বিধবার শেষ সম্বল সোনার গয়না বিক্রি করেও যতটা সম্ভব চিকিৎসা করান। ননী অবশ্য শীঘ্রই মরে গিয়ে বৌদিকে রেহাই দিয়ে যান। একটি স্বামী-সন্তান-সংসার না পাওয়া যুবতীর জীবনে অবশেষে দাঁড়ি পড়ে। অভিভাবক থাকলে কি তাঁর জীবন অন্যরকম হত? হয়ত। তাহলে কি সুতারা আর ননীপিসিমার জীবনের গতির একমাত্র তফাৎ পুরুষ অভিভাবক থাকা আর না থাকা? ননীপিসিমা রবীন্দ্রনাথের গল্প পড়ে কাঁদতেন। জানি না, তিনি এই লাইনকটি কখনও পড়েছিলেন কিনা, ‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার’ বা পড়ে থাকলে তাঁর কি মনে হয়েছে!
সুতারার সব পরিচিতরাই অবশ্য তার এমন নির্বাসন মন থেকে মেনে নেয় নি। সনতের কলেজে-পড়া শ্যালিকা শুভা তর্ক জোড়ে মা-পিসিমা-মাসিমার সঙ্গে। সনতের শ্যালক প্রমোদও ভাবে, বন্ধুদের বলে “রামের বনবাসে সীতার বনবাস হয়েছিল। সীতার বনবাসে রামের বনবাস কিন্তু হয়নি।” সে সুতারাকে বিবাহের ইচ্ছার কথা জানায়। বাবার সম্মতি থাকলেও মায়ের তীব্র আপত্তি। সে মায়ের অবশ্য স্বামী-পুত্রের যাবতীয় অনাচারে কোন বাধা নেই, মেম পুত্রবধূকেও বরণ করে ঘরে তুলতে আপত্তি নেই। যত আপত্তি সুতারার কলঙ্ককে ঘিরে। মায়ের অনিচ্ছাসত্ত্বেও প্রমোদ সুতারাকে বলে, “আমি তোমার সব ভার নিলাম সুতারা।” সুতারা স্বপ্নের মুখোমুখি হয়। স্বামী-সংসার-সন্তানের। যে পরিবার তাকে একদা নির্বাসন দিয়েছিল, সেই পরিবারের আওতায় ফেরার।
দেশভাগের পরে কেটে গেছে বহু, বহু বছর। বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ঘাত-প্রতিঘাতে মধ্যবিত্ত সমাজে বেশ খানিকটা বদল এসেছে। পিতৃতন্ত্রের আগেকার কঠোর মুষ্ঠিও কিছুটা আলগা হয়েছে বলেই মনে হয়। আজকের মেয়েদের অনেকেরই চিন্তার সীমানাতেও হয়ত “মেয়েরা কি আর স্বাধীন হয়?” এর মত প্রশ্ন ঢুকতে পারবে না। তবু সামগ্রিকভাবে শিবরাত্রি জাতীয় অনুষ্ঠানের বর্তমানের বোল-বোলাও থেকে ঝকঝকে স্মার্ট সুশিক্ষিতা মেয়ের গলায় “এই ব্যাপারগুলো তো আমার হাবিই ভাল বোঝে, তাই ওই এসব ঠিক করে – আমি ভাই এসবে মাথাই ঘামাই না” উচ্চারণ বা “মেয়ের তো শ্বশুরবাড়িই আছে, তার আবার বাপের বাড়ির ভাগ কী? ” বলা বা “সব কথা বলতে নেই” জাতীয় শিক্ষা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে দেওয়া দেখে দেখে কেমন যেন সন্দেহ জাগে সত্যিই কি আজও জাত-পাত-ব্রাহ্মণত্ব মেনে চলা বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজে পিতৃতান্ত্রিকতা ততটাই পিছু হটেছে, যতটা আমরা ভাবতে ভালবাসি? সুতারার মত অনুগত-প্রাণ মেয়েরা, পিতৃতন্ত্রের অনুশাসন মানাতেই যাঁদের স্বস্তি, তাঁরা কি মিলিয়ে গেলেন? নাকি আমাদের প্রত্যেকের মনের মধ্যেই কোন না কোন ভাবে ঢুকে রইলেন, জিইয়ে রেখে দিলেন একটি প্রশ্নহীন আনুগত্যের ধারা, সে যে রূপ ধরেই হোক না কেন, আমাদের আপাত-স্বাধীনতার ঝলমলে চেহারার আড়ালে বেশির ভাগ সময় চাপা পড়ে থাকলেই বা। উত্তরটা খুঁজেই যেতে হবে, যার যার নিজের নিজের জীবনে।
অসম্ভব ভাল লাগল সুলিখিত এই আলোচনাটা স্বাতী। ননীপিসিমার বইটা পড়ি নি। পড়ব। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে নিয়ে চলা অচলায়তন আজও প্রায় তেমনই আছে।
কিছু যে পালটায়নি সেটা বুঝে মন ভারাক্রান্ত হয়। তবু অনবরত সংগ্রাম পারে পরিবর্তন আনতে। এই লেখাগুলো সেই সংগ্রামের অংশ।
জয় অবশ্যম্ভাবী।
এই বিষয়ে এমন সমৃদ্ধ, সুদীর্ঘ আলোচনা আজকাল বিরল। এই উপমহাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট এক অত্যন্ত জটিল এবং ঘোঁটপাকানো বিষয়। আলোচ্য বইদুটি সেই বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করেছে বলে মনে হল। নিবন্ধকারের দক্ষতা অতুলনীয়, এইমাপের আলোচনার পড়ার লোভের জন্যই সোশ্যাল মিডিয়ায় থেকে যাওয়া।
খুব ভালো লাগল
খুব ভালো লাগল
সুতারাকে চোখে দেখিনি , কিন্তু ননীপিসিমাকে চিনি , আমাদের পূর্ববঙ্গীয় পরিবারে ছড়িয়ে আছেন তাঁরা।
দ্বিতীয় বইটি হয়তো কিছু অতিরিক্ত কথা বলে। একজন ভ্রাতষ্পুত্র বুঝছেন পিতৃস্বসাকে , সামান্য হলেও এ তো সমাজ বদলের ইঙ্গিত।