পিতা পূর্বং পিতা পরং
তামিমৌ ত্রমি
দশরথের বুক উঠছে নামছে। বুক তো নয় যেন ছিন্ন ভূলুণ্ঠিত বৃক্ষকাণ্ড - নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের করাত চালনার হেতুমাত্র।
তার বুকের পাঁজর রাম যাচ্ছে বনে। যার চক্রান্তে, সে পাপীয়সীর নাম আর মুখে আনার ইচ্ছে নেই। শুধু রাম নয় ; যাচ্ছে জানকী ও লক্ষ্মণ। প্রিয় পুত্রকে দশরথ অনুরোধ করেছিলেন একটি দিন অন্ততঃ থেকে যেতে। কিন্তু রাম শুনল না। সত্যিই তো, যেতে যখন হবেই তখন বিলম্বে শুধু দুঃখ ও উদবেগ বাড়িয়ে তোলা ক্ষত্রিয়োচিত নৈতিকতা নয়।
সুতরাং রামচন্দ্র বনে যাচ্ছে, একথা যখন পূর্বোদিত সূর্য্যের মতো ধ্রুব, তখন নিজেকে সংহত করে রাজা দশরথ সুমন্ত্রকে আজ্ঞা দিলেন - ' রামের সঙ্গে যাবার জন্য তুমি চতুরঙ্গ বল সজ্জিত কর। বচনচতুরা বেশ্যা, ধনবান বণিক, মল্ল এবং অরণ্যতত্ত্বজ্ঞ ব্যাধগণ সঙ্গে যাক।'
হ্যাঁ পাঠক মহাশয় ও পাঠিকা মহোদয়ারা- ঠিকই পড়েছেন। পিতা পুত্রের বনবাসের অনুযাত্রিক হিসেবে সৈন্যসামন্তের পরেই নাম করেছেন বচনচতুরা বেশ্যার।
না।
পিতা পুত্রকে এমত 'কুপথে' চালনা করার প্রস্তাবেও সূর্য্যদেব পশ্চিমে উদিত হন নি, ভূমিকম্প, আয়লা বা করোনাকল্প অতিমারীতে প্রকৃতিদেবী নিজের ধ্বংসলীলা প্রকট করেন নি। কারণ 'কাম' নামক অনুভূতিটি জঠরের ক্ষুধার মতোই স্বাভাবিক একটি প্রবৃত্তি। তাই প্রবৃত্তিতে প্রবৃত্ত হওয়ার স্বাভাবিক উদযাপনটাকে এড়িয়ে বা লুকিয়ে যাওয়ার মতো হাস্যকর আত্মবঞ্চনা রাজা দশরথ করেন নি। কৈকেয়ীর প্রতি আসক্তি ও কামের বশে আজ তাঁর এই নিষ্ঠুর পরিণতি - সকলের মুখে এ কটুক্তি শুনতে শুনতেও তিনি ভুলে যান নি কাম অপরিহার্য। আত্মরক্ষার জন্য যেমন চতুরঙ্গ বল দরকার, আত্মরঞ্জনের জন্য তেমনি দরকার বচনচতুরা গণিকাদের।
মহাভারতেও আমরা দেখি, অর্জুন ইন্দ্রের সভায় উর্বশীর লাস্যময়ী নৃত্য দেখছেন, অর্জুনের অস্বস্তি হচ্ছে চন্দ্রবংশের জন্মদায়িনীর এহেন রূপ দেখতে কিন্তু ইন্দ্রের তাতে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই তিনি দিব্য প্রিয় পুত্রকে পাশে নিয়ে আইটেম ধ্রুবপদীতে মজে আছেন।
কামার্ত দশরথ ও লম্পট ইন্দ্রের উদাহরণে আমি কি বলতে চাইছি যে পুত্রদের পিতারা সোনাগাছির পথ দেখান?
না, তা বলছি না।
শুধু বলছি কমল মিত্র না-ই বা হলেন। এমন বাবা না-ই বা হলেন, যার সামনে কথা বলতে গেলে ছেলে মেয়েকে ঘাড় চিরকাৎ করে রাখতে হয়।
সায়েন্স নিয়ে না পড়লে ভবিষ্যৎ অন্ধকার; জয়েন্ট না দিলে কিস্যু হবে না - এই অমোঘ বিধির বিধান না-ই দিলেন।
সেক্স এডুকেশন দিলে ছেলেমেয়েরা উচ্ছন্নে যাবে এই দৃষ্টিভঙ্গী না-ই পোষণ করলেন।
টেবিলে রাখা চশমাটা তুলতে গিয়ে 'লাবিউ ঘঞ্চু' মর্মে পিং টংকারে মেসেজ জ্বলে উঠলে চোখের ওপরের ধনুর্বাণ দুটিকে না কুঁচকিয়ে ঘঞ্চুর পিঠে হাত দিয়ে সস্নেহে স্মিতমুখেই না হয় জিজ্ঞেস করে ফেললেন- 'লাবিউলতিকা বা লাবিউরঞ্জনটি কে'?
পিরিয়ড, সেক্স এসব ব্যাপার ছেলেমেয়েরা বদ হাওয়া সমবয়সী বন্ধু আর মোচীপর্ণ থেকেই শিখে যাবে যেমনটি আপনারা নিজেরা শিখে গিয়েছিলেন, এরকম ভাবনা নাহয় উত্তুরে হাওয়াতেই উড়িয়ে দিলেন।
বিপরীত লিঙ্গ যে শুধু নীল মাংস নয়, সেখানে চুনি'র মতো হৃদয় জ্বলে, পান্নামোহন অরণ্যে যৌবন মাকড়সা-জালে প্রেমের রোদ পড়লে শিরশিরে রামধনু খেলে, হীরক খণ্ডের মতো সেখানে পারস্পরিক মূল্যবোধ ও শ্রদ্ধাবোধের মতো সূক্ষ্ম উপলব্ধিগুলো সদা উদ্দীপিত হয়- এইসব লেসেরর পর্দাসম নরম নমনীয় ও কারুকার্যময় অনুভূতিদের কখনো হলকাটুকু কখনো বা হালকাটুকু সন্তানদের অপরিণত ইঁটপাঁজরে ঠারে ঠোরে অশ্বত্থ বন্ধুর মতো চারিয়ে দিলেন...
এগুলোতে যদি আপনার পিতৃসুলভ কমল কাঠিন্য,স্বরাট গাম্ভীর্য কিঞ্চিৎ ক্ষয়ে যায় তো যাক না- পিতৃতন্ত্র আপনাকে 'পিতা' করে গড়েছে আসলে তো আপনি ধুকপুক সমন্বিত আদ্যন্ত জলজ্যান্ত মানুষ...
তাই পিতৃটুলির ব্র্যাণ্ডনিউ থিম্যাটিক বাবা নাহয় আপনিই হলেন, যাকে ছেলেমেয়েরা যমের মতো ভয় পায় না, বটের মতো আশ্রয় করে, পৃথিবীর সর্বতীক্ষ্ণ পরাজয়ের গ্লানি অনুভব করে ফেলবার অব্যবহিত পরে সে যেন বাবা জানলে তো পিটিয়েই মেরে ফেলবে ভেবে গলায় দড়ি দেওয়ার বদলে আপনার গলাটাই জড়িয়ে ধরে কাঁদে..
আজ পিতৃদিবসে এই অনুরোধ, কমল থেকে কোমলে আসুন, খাপবদ্ধ আন্ধার থেকে অচিরেই গান্ধারে বেজে উঠবে জীবন...
লিখুন, আরও লিখুন।
হ্যাঁ, আমি দুই মেয়ের পিতা। আর ওরা আমার বন্ধু।
"পৃথিবীর সর্বতীক্ষ্ণ পরাজয়ের গ্লানি অনুভব করে ফেলবার অব্যবহিত পরে সে যেন বাবা জানলে তো পিটিয়েই মেরে ফেলবে ভেবে গলায় দড়ি দেওয়ার বদলে আপনার গলাটাই জড়িয়ে ধরে কাঁদে"----এই অংশটা দুর্ধর্ষ লাগলো ! সেক্স এডুকেশনের ব্যাপারেও একমত ... এই প্রবল যৌনতাবিরোধি সমাজে কনসেপ্টগুলো শুরুতেই ক্লিয়ার হয়ে যাওয়া উচিত... অন আ লাইটার নোট বং সিনেমায় খারুশ বড়লোক কমল মিত্র ( পুত্র সন্তানের পিতা ), কোমল লিবারাল পাহাড়ী বাবু (কন্যা সন্তানের পিতা ) ছাড়া আর একজন ইন্টারেস্টিং পিতা হলো কালী ব্যানার্জী ... ইনি নিম্নমধ্যবিত্ত, চার পাঁচ সন্তান যার 80% মেল্ এবং ইনি তাদের শৈশবে কৈশোরে কিভাবে ট্রিট করেছেন তা জানা যায় না কিন্তু বার্ধক্যে (তখন ভাতা ছিল না )দেখি যখন তাদের উপর ডিপেনডেন্ট তারা কর্তব্য পালন করলেও বাবার প্রতি কিছুটা উদাসীন যেন একটা মানসিক দূরত্ব আছে এবং বৃদ্ধ সবচে বেশি ভালোবাসা, সহমর্মিতা পায় "এক" বৌমার থেকে
রঞ্জন দা, নমস্কার। সেইটাই তো কাম্য মেয়ের বন্ধু হওয়া... হ্যাঁ, অবশ্যই লিখব, আপনাদের প্রেরণায় লেখার আয়ু বেড়ে যায়...
গ্রেগর সামসা, আরেকজনও আছেন, কোমলে কঠোরে ছবি বিশ্বাস। 'অতল জলের আহবান' এর ছবি বিশ্বাসকে আমার দিব্য লাগে।
ধৈর্য্য ধরে পড়ার জন্য ধন্যবাদ
তেমন পিতৃদেব আর কোথা? সংস্কার বড় কঠিন চিজ
সেইতো...মস্ত মস্ত ব্যাপার হওয়া চিজের পক্ষে কি চাট্টিখানি কথা!