এবং দ্রৌপদী ( গল্প)
তামিমৌ ত্রমি
হরিপর্বতে একটি কৃষ্ণ বিজুরি এলিয়ে আছে স্থির… তাকে ঘিরে পাঁচটি কাজল কালো বাদল-মেঘ বিষণ্ণ গাম্ভীর্য্যে গলে গলে ঝরে পড়ছে। পঞ্চপাণ্ডব-প্রিয়া পাঞ্চালী এইমাত্র ঢলে পড়লেন। তার কৃষ্ণ-কুন্তল নির্ঝর-কারুসাজে সজ্জিত করেছে পাথুরে মাটির হৃদয়। চোখ-দুটি বোজা- স্নিগ্ধ দুটি নিষ্প্রদীপ জ্বলে রয়েছে যেন। নিষ্প্রাণ অনবদ্যাঙ্গীকেও হরিপর্বতের অজস্র পাথরের একটি বললে অত্যুক্তি হোত না। কিন্তু তার স্বরাট ব্যক্তিত্বের বিভামাধুরী – যা এই মুহুর্তে মোহনীয়তা থেকে স্নিগ্ধতায় উত্তরিত হয়েছে -তা তাকে একটি অনন্য ভাস্কর্য্যে রূপান্তরিত করেছে।
অয়স্কান্ত মণি যেমন তার নিকটস্থ লৌহকণিকাকে পরমাকর্ষণে নিজের লগ্ন করে রাখে তেমনই অগ্নিজ্যোৎস্না দ্রৌপদীকে কেন্দ্র করে পঞ্চপাণ্ডব বৃত্তাকারে শোকজর্জর চিত্তে হাহুতাশ করছেন। তাদের যেন কোথাও আর যাওয়ার নেই। আর কোন কর্তব্য বাকি নেই। প্রত্যেকেই মনে মনে ভাবছেন, তাকে আরেকটু যদি পাওয়া যেত। আরেকটু আপন করে… একান্ত নিজের করে…মন্দিরস্থ কানন - পুষ্পের যেমন মন্দিরের দেবতার মস্তকে,কন্ঠে, বক্ষে এবং চরণে ঠাঁই হয়, তেমন করে যদি একান্ত তার বুকেই ঠাঁই হোত ঐ শোভিনীর… হায়…যে নারীকে তারা সারাটা জীবন ধরে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসলেন- সে যেন পরিখা বেষ্টিত দুর্গ – সাঁতরাতে সাঁতরাতেই জীবন গেল… দুর্গপ্রাচীরে কড়াঘাত করা হল কি হল না… মহাপ্রলয়ে দুর্গ ধুলোয় লুটিয়ে পড়ল… তারাও ভেসে গেলেন।
জ্যেষ্ঠপাণ্ডব কথঞ্চিত শোক সামলে উঠলেন। তিনিই এই পরিবারের অভিভাবক; বিচার -কর্তা। তাই বিচারের বাণী তাঁর মুখেই কেঁদে উঠল বিলাপের স্বরে… দ্রৌপদী পঞ্চ স্বামীকে সমদৃষ্টিতে দেখতেন না; অর্জুনের প্রতি তাঁর দুর্বলতা ছিল বেশি। তাই তার সশরীরে স্বর্গারোহণ হয়ে উঠল না। এই কথা শেষ হতে না হতেই ভূমিতে শায়িত ভাস্কর্য্যকে চুম্বন করে একটি শীতল বাতাস ‘হা হা’ স্বরে বয়ে গেল।
দ্রৌপদী উঠে বসলেন। অবশ্য তার আলোড়ন, আন্দোলন -কিছুই এখন চর্মচক্ষুসম্পন্ন পাণ্ডবদের গোচর হওয়ার কথা নয়। তিনি অল্প একটু হাসলেন। কৃষ্ণা দ্বিতীয়ার আকাশে একফালি চাঁদের স্ফূরণ… ভালবাসা বুঝি গণিতের মতো কষা যায়। ঝরা পাতার মতো তার সামনে খসে পড়ল স্বয়ংবরের দিনটি- স্বয়ংবর তো আসলে কখনোই স্বয়ংবর নয়, ও নামেমাত্র। আসলে তো অর্জুনের গলায় মালা দেওয়ারই অছিলামাত্র ছিল ঐ স্বয়ংবর। ভারত-শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধরকে আবিষ্কারের জন্যই তো অমন কড়া পরীক্ষার ব্যবস্থা।
দ্রৌপদী অলস অবসরে মায়াকাননে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে সরোবরে হংসকেলি দেখতে দেখতে কত শুনেছেন অর্জুনের শৌর্য্য-বীর্য্যের কথা… কী তাঁর পরাক্রম ! পিতাকে যুদ্ধে পরাস্ত করে দ্রোণাচার্য্যের সমীপে তাঁকে গুরুদক্ষিণারূপে উপস্থাপিত করার ক্ষমতা রাখে! অর্জুন! অর্জুন! অর্জুন! এই বীরোচিত নাম কতবার মনে মনে স্তব করেছেন পাঞ্চালী। সেই বীর তাকে বাহুবলে জয়ও করলেন অথচ একান্তে তাকে পাওয়া হল না।
হ্যাঁ। পঞ্চস্বামী বলে তাকে হিসেব কষে কষে সর্বমোট ভালবাসার এক -পঞ্চমাংশ প্রত্যেক স্বামীর প্রতি বর্ষিত করতে হবে বৈকি। নইলে অন্যায় হবে না?
এই সময়ে পাঞ্চালীর আরেকটি কথা মনে পড়ল। এবার কৃষ্ণাধরে দুইফালি চাঁদের স্ফূরণ। যদিও এই কথা তার মনে পড়ার বা জানার কথা নয়। কিন্তু মৃত্যু তাকে সর্বজ্ঞা করেছে। তিনি জানেন, কর্ণকে পাণ্ডবপক্ষে নিয়ে আসার জন্য ‘তিনি’ কর্ণকে দ্রৌপদীর প্রলোভন দেখিয়েছিলেন। নরোত্তম বলেছিলেন, ষষ্ঠবারের বার আঁধারোন্মেষে ত্রিভুবনখ্যাত সুন্দরী দ্রৌপদী আসবেন তোমার কাছে…
তাহলে? কী হোত? কর্ণ যদি এ পক্ষে আসতেন তাহলে তাকে তখন নির্দিষ্ট বছরের প্রত্যেকটি দিন দ্রৌপদীকে তার ভালবাসার এক-ষষ্ঠাংশ বিতরণ করতে হোত- সেই লোকটাকে… যে ভরা সভায় দুঃশাসনকে তার কাপড় চোপড় খুলে নিতে বলেছে আর বেশ্যা বলে গালাগালি দিয়েছে?
না।
বস্ত্রহরণের জন্য অবশ্য তাঁর আর কোন ক্ষোভ নেই।কারণ তিনি ভালো করেই জানেন, তাঁর মতো অগ্নিজ্যোৎস্নাকে যদি পঞ্চপাণ্ডবের পত্নী না করা হোত, তাহলে বস্ত্র হরণের ঘটনাটা পাঞ্চাল রাজ্যের সেই কুমোরের ঘরেই ঘটত আর পাঁচ ভাইয়ে কুরুক্ষত্র সেদিনই বাঁধবার উপক্রম হোত।
ভালবাসা। গজকীটভুক্ত কপিত্থের মতো একটা ধারণা। ভাবনায় সে যতটা পূর্ণ, অন্তরে ততটাই ফাঁকা।
খারাপ কি কাউকেই বেসেছিলেন? যুধিষ্ঠিরের মতো অভিভাবকসুলভ ধর্মসার প্রাজ্ঞ মানুষকে যতটা আপন করা যায় করেছেন। ছেলেমানুষ নকুল, সহদেবের প্রতি প্রণয়ের চেয়ে বাৎসল্য রসের ভাগটাই বেশি ছিল। দ্রৌপদীর চিত্তহরণ করাটা কি মুখের কথা? অতবড় শালপ্রাংশু মহাভুজ বৃষস্কন্ধ পরম রূপবান মানুষটা? একহাতে বৃক্ষ উপড়ে ফেলতে পারেন এরকম চণ্ড মানুষটাও দ্রৌপদীর কাছ থেকে এক কণা ভালবাসা পাবার জন্য কেমন শিশু হয়ে যেতেন। এই মানুষটাকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন তিনি। বিপদের সময়ে ছুটে গিয়েছেন একমাত্র ভীমের কাছে।
কিন্তু সেই মানুষটা? যৌবন-কাননে যার শৌর্য্য- বীর্য্যের ভ্রমর-গুঞ্জন শুনে দেহ-কুসুম কেঁপে কেঁপে উঠত, সেই মানুষটার গলায় মালা দিয়েও কুসুম-শয্যায় প্রথম তাকে পাওয়া গেল না। দাঁতে দাঁত চেপে যৌধিষ্ঠিরী বছরটি কাটিয়ে দেওয়ার আগেই বারো বছরের দীর্ঘ বিচ্ছেদ… খরার পর প্রথম বৃষ্টিপাতের মতো যদিও অর্জুন অবশেষে ফিরলেন তার কাছে…কিন্তু খণ্ডিত হয়ে… সুভদ্রা সমভিব্যাহারে … সোঁদা গন্ধের বিলাসিতাটুকুও বরাতে জুটল না … আষাঢ়ের যত বৃষ্টি এসে জুটল তার দুই চোখে। সেই নয়নলোর, অপেক্ষার দীর্ঘশ্বাস, আহত অভিমান- এ সবের কী পাঁচ পাঁচটা সমান খণ্ড হয়?
আর ‘তার’ ভাগে কতটা কী ধরা রইল? সেই যে - 'সে'? চিরসখা? কেন নিজ জ্ঞাতিদের অমতে ভগিনী সুভদ্রার সঙ্গে অর্জুনের বিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর হলেন তিনি ? শুধুই একটি রাজনৈতিক জোটগঠন ? যাকে স্বয়ংবর সভায় পেয়েও বৃহত্তর স্বার্থে পাওয়ার চেষ্টাটুকুও করা গেল না.. অর্জুনও যেন কোনদিন সেই দুর্লভ রত্নাকে একান্ত করে পেতে না পারে,তারই প্রযত্ন নয় তো?
কৃষ্ণার মনে পড়ে গেল, বনবাসে কৃষ্ণের সঙ্গে যেদিন দেখা হল, সেদিন তিনি বলেছিলেন… আসলে আমার কেউ নেই…স্বামীরা নেই, ছেলেরা নেই, আত্মীয়-স্বজন-বাপ-ভাই নেই, এমনকী তুমিও আমার নও কৃষ্ণ-নৈব ত্বং মধুসূদন। এই ‘তুমিও’ শব্দের মধ্যে কী ছিল? কী যেন ছিল?
কৃষ্ণার হাসি অধরে লীন হয়ে গেল। চোখ দুটি বুজে এল। কোন কোন সম্পর্ক চন্দ্রহীন জ্যোৎস্নারহিত নিকষ মহাব্যাপ্ত আকাশের মতো নিগূঢ়। তিনি অমাবস্যামথিতা হলেন।
হঠাৎ রথচক্রের ঘর্ঘর -ধ্বনিতে তার নিশিঘোর কেটে গেল। দ্রৌপদী একটি দীর্ঘঃশ্বাস মোচন করে উঠলেন। তাহলে স্বর্গ থেকে স্বর্ণরথ এসে গেছে। ঐ তো দ্বিতীয় মার্তণ্ডের মতো ঝলসে উঠছে রথের গা। ধবধবে দুটি ধবল ঘোড়া টগবগ করে জানান দিচ্ছে, বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার ইচ্ছে তাদের মোটেও নেই। তাহলে সময় হয়ে গেল। দ্রৌপদী রথের দিকে এক পা বাড়িয়েও পিছন ফিরে চাইলেন।
এখনও তার স্বামীরা তার ভূতাবশেষ নিয়ে বিলাপ করছেন। তিনি অর্জুনের সর্বাঙ্গ একবার চক্ষু দিয়ে লেহন করলেন। সহদেবের মাথায় দৃষ্টি বুলিয়ে আদর করে দিলেন। এখনও, এই বয়সেও মানুষটা নিজের হাতে ভালো করে খেতে শিখল না। কে যে তাকে বিছানা পেতে দেবে এরপর? নকুলের কাঁধে তার দৃষ্টি আলতো করে হাত রাখল। কী সুন্দর তার পুতুল পুতুল সাথীটি! কে তার ক্লান্ত দুখানা রক্ত -চরণ-কমল টিপে দেবে পরম যত্নে ! মধ্যপাণ্ডবের প্রকাণ্ড বুকে তার দুই নয়নের সমস্ত উজাড় গিয়ে জড়ো হল-অহো স্বস্তি! যুধিষ্ঠিরের চরণ দুখানি ছুঁয়ে এল তার নয়ন -যুগল। রথের দিকে মুখ ফেরালেন তিনি।
এক পা
দু পা
তিন পা
দ্রৌপদীকে কে যেন অমোঘ টানে টানতে লাগল পিছনে। তিনি মুখ ফেরালেন… তার যাবতীয় গুঁড়ো গুঁড়ো সত্ত্বাকে এক ছুটে মিশিয়ে দিলেন অর্জুন-কাঠামোয়। লালে যেমন সাদা মেশে, হলুদে নীল, দ্রৌপদী তেমনই গলে গুলে মিলে মিশিয়ে নতুন করে গড়ে নিচ্ছিলেন নিজেকে… অনুরাগরঞ্জিত গোলাপিময়তায়… প্রথম যৌবনের সবুজাভ ঝলমলে … অর্জুনের কালিতে কৃষ্ণার কালিন্দী কলম যেন স্রোতবতী সুখবতী ছবি এঁকে যেতে লাগল একের পর এক…
আহা! এমন সুখের উত্তুঙ্গ মুহুর্তে রেণুতে রেণুতে বেণু কে বাজায়! হৃদিস্রোতের প্রবল ওপারে কার যেন বাঁশি বাজে, কেউ যেন সুর- আখরে চিঠি লিখছে … আর ছড়িয়ে দিচ্ছে তাল-তমালের পাতায় পাতায় … উনপঞ্চাশ পবন বয়ে আনছে সেই ঢেউ -চিঠিদের… তবে কী হলুদে লাল মেশার সময় হয়ে গেল? এত যে কমলাভ প্রখর আকাঙ্খারা, এতদিনকার জৈবিক অভ্যেস, সংসার সংসার খেলা, তবে কি এখনই বিসর্জন দিতে হবে রক্তিম আশা আকাঙ্খা? কমলায় পীতাম্বর সাত্ত্বিকতা গুলে গুলে শুরু করতে হবে গৈরিক সাধনা?
তবে তাই হোক। পাঞ্চালী অর্জুনের কালোকে তার নিজস্ব সব রঙ শুষে নিতে দিলেন। অতঃপর …শান্ত স্নিগ্ধ ধীর পদে এগিয়ে যেতে লাগলেন রথের দিকে, আকাশের সমূহ নীলিমা তার অবর্ণা দেহলতাকে জড়িয়ে ধরল সর্পিল পাকে। নীলাম্বরী রথে উঠলেন। সারথীর শিখিপাখা নড়ে উঠল। তিনি রথের রশি ধরে টান দিলেন। টগবগাশ্বরা ছোটবার জন্য বিহবল হয়ে উঠল। সারথী কৃষ্ণা দ্বিতীয়ার চাঁদ -বিভঙ্গে হেসে বল্লেন-‘চল সখি।’
- ‘তুমিও।’
ছবি - রাজা রবি বর্মা
ঋণ ঃ কৃষ্ণা কুন্তী এবং কৌন্তেয় ঃ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
একটি কবিতা লেখা হোল।
ধন্যবাদ
হায় দ্রৌপদীর ভালবাসা, মন্দবাসা!
লেখাটি চলিত ভাষায় হলে বোধহয় সোনায় সোহাগা হতো। শুভ
খুব ভালো। কিন্তু, "ছবি - রাজা রবি বর্মা" - কোথায় সে ছবি? আসেনি মনে হয় কোনো কারণে।
আচ্ছা, বিপ্লব দা, মাথায় রাখব।
যদুবাবু, ওহো আমি দেখে নিচ্ছি