আমি, সোনার কেল্লার ফুলমতী (গল্পনা)
আমার নাম ফুলমতী। এই যে রুখাসুখা রাক্ষসের মতো মরুভূমির বালি হাঁ সর্বক্ষণ আমাদের গিলে খেতে আসছে তার থেকে পঁচিশ কি ছাব্বিশটা ময়ূর দূরেই আমাদের কেল্লা। বিশাল আমাদের কেল্লাটা। সোনার মতো ঝকমকে। তার উপর যখন রোদ্দুরের গনগন এসে পড়ে, মনে হয়, মরুভূমির মাথায় যেন সোনার মুকুট ঝলসাচ্ছে।
আমাদের জীবন বালির ঘড়ি। আমাদের নিঃশ্বাসে বালি, প্রশ্বাসে বালি, পথেঘাটে, উঠোনে, ঘর- দালানে সর্বত্র কিচকিচ করছে বালি। যেমন হাড় গলানো গরম এখানে, তেমন হাড়ে কামড় ধরানো ঠাণ্ডা।
সারাদিনে বত্রিশ বার ঝাঁট দিয়ে বালি সরিয়ে ঘরদোর সাফসুতরো রাখতে হয়। অবশ্য এসব ঝামেলা ঝক্কির কাজ আমাকে করতে হয় না। সুরতিয়া যত ফাঁই ফরমাশ খাটে। কুয়ো থেকে জল তুলে আনে। চন্দা রান্নাবান্না করে।
আমার পতিদেব এই কেল্লার সবচেয়ে নামজাদা সোনার। খোদ রাজপরিবারের গয়না গড়ার বরাত আসে তার কাছে।
আমি আমার স্বামীর নয়নের মণি। সবসময়ে পুতুলের মতো আমাকে আগলে আগলে রাখেন। কোন নতুন নকশার গয়না গড়া হলেই সেইটা দিয়ে আমাকে না সাজানো অব্দি তাঁর শান্তি নেই।
এই তো সেদিনের কথা। বিকেল বেলায় আমি গা ধুয়ে কাচা কাপড় পরে চুল বাঁধছিলাম আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ পিছন থেকে আমার চোখ চেপে ধরলেন। সঙ্গে সঙ্গে বজ্রকন্ঠে হুকুম হল, ' খবরদার, চোখ খোলা চলবে না। তাহলে কিন্তু...'
অগত্যা... চোখ বন্ধ অবস্থাতেই টের পেলাম বারোমেসে হারখানা গলা থেকে খুলে ফেলে একখানা নতুন কিছু গলায় পরানো হল। এবার হুকুম, ' চোখ খোল'.
খুললাম। আবছা পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে যেন কয়েকটা সোনার প্রজাপতি ঝিলমিলিয়ে গেল।
দুটি সোনার গজপতি তাদের শুঁড় দিয়ে মাঝখানে একটি পদ্ম ধরে রেখেছে। কমলটিতে আবার চুনি বসানো। কী অপূর্ব নকশা! মাঝে মাঝে মনে হয়, তিনি যেন সোনার নন; আঁকিয়ে।
আয়নায় আমার অপলক মূর্তি দেখে তিনি আমার কাঁধ ধরে তাঁর দিকে ফেরালেন। প্রদীপের মতো তাঁর দুহাতে আমার মুখটি তুলে বললেন, 'সাক্ষাৎ গজলক্ষ্মী'। আমিও তক্ষুণি আমার নারায়ণের বুকে মুখটি লুকোলাম।
তবু উটের মুখে কাঁটার মতো দুঃখে আমার বুকটা দিবারাত্র খচখচ করত। সোনার সংসারে একটা ছেলেপিলে দিলেন না পরমেশ্বর । কত মন্নত, কত ব্রত, জরিবুটি, কিছুতেই কিছু হল না। কাঁদতে কাঁদতে কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল চোখেই শুকিয়ে গেল। শাশুড়ির তানা শুনে শুনে কুয়োয় গিয়ে ঝাঁপ দিতে গিয়েও পারিনি, কারণ তাঁর ভালবাসায় তো কমতি ছিল না। এছাড়া আরেকটা ভালবাসার দীঘি বুকে টলটল করত সারাক্ষণ।
কানহাইয়া। আমাদের মণিকারের পুঁচকে ছেলেটা।
কী সুন্দর মুখটা কানহাইয়ার। পাথর কুঁদে কুঁদে গড়ে দিয়েছে কেউ যেন তার নাক, ঠোঁট, চিবুক। চোখদুটো যেন আস্ত এক একখানা পুষ্কর। এমন কাঠখোট্টা বালি পাথরের দেশে কেমন করে যে এমন টলটলে ছেলে জন্মালো! ওকে দেখলেই আমার বুকফাটা তৃষ্ণা জুড়িয়ে যায়। আমার হাতের রোটি আর ডালবাটি চুর্মা খেতে যে কীই ভালবাসে ছেলেটা। ওর বাবা মণি, পাথর মাপমতো কেটে কেটে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসতেন আমার স্বামীকে যোগান দিতে। সঙ্গে সঙ্গে আসত ছোট্ট কানহাইয়া। খিলখিল করে হাসতে হাসতে ভাবিশা'র কাছে ছুট্টে এসে আদর খেত। আমি ওর জন্য দর্জিকে দিয়ে নতুন নতুন জামা তৈরি করাতাম।পুতুল খেলা খেলতাম। যেমন খুশি সাজাতাম। শাশুড়ি ঠোঁট উলটে বলতেন , 'মরণ, পরের বাচ্চা দেখে জিভ থেকে সর্বক্ষণ লাল ঝরছে। আবার ছেলের বিয়ে দেব আমি। দশ ছেলের বাপ হবে আমার ছেলে... '
কিন্তু আমার সব চাবুকের মলম ছিল কানহাইয়া। জন্মাষ্টমীতে ঘেওয়রের এতখানি মাথা তার জন্য তুলে রাখতে হোত। আমার কোলে বসে তারিয়ে তারিয়ে সবটা খেয়ে তবে শান্তি। কানহাইয়াই তো আমার রক্তমাংসের কৃষ্ণ।
যেমন করে উটের খাবার উটকেই রক্তাক্ত করে। কানহাইয়া তেমনই আমায় আদরে আদরে বাঁচিয়ে রাখত, আবার ভিতর ভিতর মা হবার তৃষ্ণাটা জাগিয়ে তুলত।
বালির কাজ ওড়া ; হাওয়ার কাজ ওড়ানো। বালি আর দিন এইভাবে উড়তে উড়তে একদিন হাওয়ায় হাওয়ায় খবর এল যুদ্ধ হবে ..
বালি হাওয়ার দুষ্টুমিতে যেমন মুহুর্তের মধ্যে একদিকে বালির ঢেউ ওঠে ফুলে, আরেকদিকে যায় ভেঙে তেমনই আমাদের সৈন্যরা মার খেয়ে খেয়ে হারতে লাগল আর দুশমনরা বিজয়ের হাসি হাসতে হাসতে ফুলে ফেঁপে উঠল।
শেষপর্যন্ত শত্রুরা কেল্লা অবরোধ করল। আমরা খাঁচায় বদ্ধ বাঘের মতো আছাড়িপিছাড়ি খেতে লাগলাম। তিন মাস পেরিয়ে গেল। জানতাম, শেষের সময় ঘনিয়ে এসেছে।
সবার মুখ থেকে হাসি, চোখ থেকে ঘুম, পেট থেকে খাবার, আশ মেটানোর পানি, শরীর থেকে জীবন... সবই চলে গেল। শুধু দিনের পর দিন আধপেটা খেয়ে বা না খেয়ে শাশুড়ি মরার আগে আমার হাত ধরে বলে গেলেন, ' যা বলেছি ভুলে যা বৌ। বেঁচেবর্তে থাকিস, নইলে সিঁদুর নিয়ে স্বর্গে যাস' । আমি হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। শ্বশুরও চোখ বুজলেন।
চোখ আমাদেরও বুজতে হবে, বুঝতে পারছিলাম। কেল্লার প্রধান - দ্বার যেকোন মুহুর্তে ভেঙ্গে পড়তে পারে। না হলেও না খেয়ে মরতে হবে। তবে তা হবে না। প্রধান দরজায় যে বিক্রমে বজ্রপাতের মতো আওয়াজ হচ্ছে,আর কোনমতেই ঠেকানো যাবে না, এটা নিশ্চিত । এখন আর সৈন্য বলে কিছু নেই। একমাত্র বয়স্ক আর শিশুরা বাদ দিয়ে ঘরে ঘরের সব পুরুষই যার কাছে যা অস্ত্র, সেই নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে শত্রুর মোকাবিলায়।
তলোয়ার নিয়ে ঘর থেকে বেরোনোর সময়ে তাঁর কপালে জয়টীকা পরিয়ে যখন আরতি করছিলাম মনে পড়ছিল বিয়ের দিনের কথা। এরকমই টীকা ছিল তার কপালে,হাসি হাসি দৃপ্ত মুখ, তবে আধপেটা খেয়ে খেয়ে আর চেহারায় উজ্জ্বলতা বলে কিছু নেই।
আমারও বোধহয় নেই। আমি ঠিক জানি না। কারণ আমি আয়নার সামনে দাঁড়াই না আর বহুদিন। গয়নাগাটি বালাটালা সব খুলে রেখেছি। কী ভারী কী ভারী! একদিন তো হাত থেকে বরফিবালাটা খসেই পড়ে গেল। স্নান করে কাঁকই দিয়ে চুল আঁচড়ানো আর সিঁথেয় সিঁদুর দেওয়ার মতো অভ্যস্ত কাজ বিনা আয়নাতেই দিব্যি তরে যায়।
'তিনি' বেরোলেন। দরজার চৌকাঠে গিয়ে দাঁড়ালাম। চোখাচোখি হল। দুজনের মুখেই হাসি। ল্যাহেরিয়া শাড়ির মতো প্রাণ নিঙড়ানো ঝলমলে হাসি।এতে কোন সন্দেহই নেই, যে আর আমাদের দেখা হবে না। রাজপুতরা হেরে কখনো ঘরে ফেরে?
অবরোধ ভেঙ্গে শত্রুরা কেল্লা কব্জা করার জন্য প্রায় প্রস্তুত। আমরাও প্রস্তুত। জমিন খোঁড়াখুঁড়ি হয়ে গেছে। আগুন জ্বালাবার সাজ - সরঞ্জামও প্রস্তুত। এখন শুধু অগ্নিতে নিজেকে সমর্পণ করাটাই বাকি। রাজ পরিবারের সকল নারীদের সঙ্গে আমাদের মতো সতীরাও জওহর ব্রত পালন করার জন্য মনে মনে তৈরি হচ্ছিল অনেকদিন ধরে। সতীদের আসল জওহর, মানে অলঙ্কার তো সতীত্ব, সেই রত্নই যদি হাতছাড়া হয়ে যায়, তাহলে আর থাকে কী!
হাতে পায়ে আলতা পরে নিলাম। কেল্লার দেওয়ালে সবচেয়ে ছোট দুই হাতের আলতাছাপ কারোর যদি নজরে পড়ে; বুঝবেন, ঐটাই ফুলমতীর হাত। হাতের ছাপ পিছনে ফেলে আমরা সতীদের দল এগিয়ে যাচ্ছি অগ্নিদেবতার দিকে। একদিন তো এ দেহ অগ্নিদেবের গর্ভে যেতোই, তা দুদিন আগে আর পরে। হে আগুন, তোমার ফুলকি যেন ফুল হয়ে ঝরে আমাদের সতীদের দেহে..
খুব কি কষ্ট হয়, খুব কি ব্যথা লাগে, এক সন্ধ্যেয় পুজো করতে করতে প্রদীপ থেকে ঘি ছিটকে এসে লেগেছিল বুড়ো আঙ্গুলে। বাপ্রে কী জ্বালা! জলে কতক্ষণ হাত ডুবিয়ে বসে থেকেও জ্বালা কমে না। হলুদ পট্টি.... কত কি তরিবত করে সারানো হয়েছিল। তা- ও একটা কালো দাগ রয়েই গেল। আর এখানে তো শুধু বুড়ো আঙুল নয়, গোটা শরীরটা জ্বলবে দাউদাউ করে। আমি তো মনে মনে যন্ত্রণার আন্দাজই পাচ্ছি না। হায় রে! আমি কী ভয় পেয়ে যাচ্ছি! রাজপুত রমণীরা জওহরে ভয় পায়, একথা কেউ শুনেছে কখনো! শরীর আর মনটাকে মুহুর্তের মধ্যে লোহার মতো করে নিলাম।
শুধু একজনের কথা মনে করেই চোখটা টলটল করে উঠল। কানহাইয়া। কে জানে, বেঁচে আছে কিনা। তাদের মতো ভরন্ত ঘরেই যা দুর্দশা, ওর কী আর প্রাণটা আছে? যুদ্ধ যবে থেকে শুরু হয়েছে, সবাই নিজের জানপ্রাণ নিয়ে ঘরে বন্দী।শুধু বাঁধা রেশনটুকু নেওয়ার জন্য যা ভিড়ভাট্টা। ছেলেটাকে মরার আগে একবার দেখতেও পেলাম না।
আমার নানহা কানহাইয়া। দেখিস, আমাদের এত বুক উপচোন সুখ, বুক নিঙড়ানো দুঃখ, হাসি, খেলা, মান, অভিমান, আনন্দ, এগুলো কিছুই ফেলা যাবে না।
জেনে রাখিস,, ভবিষ্যতে কোন এক বিশাল বড় আঁকিয়ে আমাদের সোনার কেল্লার ইতিহাস এঁকে রাখবে যত্ন করে। আমরা আবার জন্মাব। তুই আবার কেল্লায় এসে গোবর্ধন আর গিরিধারীর বাড়ি দেখে খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠবি। নিজের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে চোখ কচলে কাঁদবি। ময়ূর দেখে তার ডাক নকল করবি। যে দুর্গা মন্দিরে আমরা পুজো দিতাম, সেই মন্দিরের সামনে নমো ঠুকবি। ফুলমতী ভাবিশা'র কথা হয়তো তোর মনেও পড়বে না। কিন্তু আমাদের ঘর, বারান্দা, অলিগলি, পথঘাট, চৌবাচ্চার ছবি নিপুণ তুলিতে কেউ একজন রঙ বেরঙে একদিন ঠিক এঁকে ফেলবে আর পৌঁছে দেবে সক্কলের মন - ঠিকানায়।
চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে আমার।
কান্নায় নয়। ধোঁয়ায়...
চোখ কচলাতে কচলাতে হাসিকাশি মিশিয়ে....
এগিয়ে গেলাম।
তামিমৌ ত্রমি
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।