এই ভোরে নদীর বাঁকে কে ও বসে, কুয়াশার স্তুপ হয়ে!
কুয়াশা থিতিয়ে জল হওয়ার অপেক্ষায় বসে বৃদ্ধ জগৎ বাউরি। বাতাস চকচকে হয়ে উঠতে জগৎ বাউরি দেখল, সম্পূর্ণ উদোম একটা বেটাছেলে ওখানে বসে। পরখ করে মানুষটাকে চিনতেও পারল জগৎ বাউরি। এ যে বনের মৌনী বাবা! সকলার বনবাবা। কাঠ আর মধু সংগ্রহ করতে বনে গেলে বনবাবার আশীর্বাদ নিয়ে তবে বনে ঢুকেছে জগৎ বাউরি। যেমনটা আর সকলে করে। নইলে দক্ষিণা রায়ের বাহন প্রাণ নিতে পারে। বনের গা ঘেঁষা গাঁয়ে বনবাবার ডেরা। এই ভাটির দেশ তার বশে। তাকে বাঘে খায় না। কুমিরে গেলে না। সাপে দংশায় না। বয়সও তার শরীরে বাসা বাঁধতে পারে না। গাঁ-ঘরের লোকেরা বলে, বয়সের গাছপাথর নি বনবাবার! আশ্চর্য সব ক্ষমতা মানুষটার। লোকের মুখে মুখে ফেরে তা সব। আর সেই মানুষটাই কিনা এখন তার সম্মুখে ধ্যানী হয়ে বসে! এ তার পরম সৌভাগ্য মানে জগৎ বাউরি। ভক্তিভরে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম সারে। মাথা তুলে জোড়হাত হয়।
মানুষটা চির মৌন। মাটির রঙ গা। মেদহীন টানটান প্রাণবান শরীর। উদাস অথচ গভীর দুটো চোখ। টিকাল নাক। ঘন কালো ভ্রুযুগল। পাতলা ঠোঁট দুটোয় ধরা শিশুর সারল্য। মাথার চুল, গোঁফদাড়ি বাড়ে না। মানুষটার যা কিছু বলার বা বোঝাবার তা সবই চোখমুখের অভিব্যক্তি দেখে পড়ে নিতে হয়।
জগৎ বাউরি গাঁয়ের মানুষজনার বসতির দিকে মুখ করে হাঁক পাড়ে, ছুট্টি এসো গো সকলায়, দেকি ঝাও, কে এয়েচে আমাদের গাঁয়ে! ছোটরা ছুটে এল সবার আগে। বড়রা বড় বড় পা ফেলে এল। বৃদ্ধরা এল সবার শেষে গুটিগুটি পায়ে। জগৎ বাউরি ভক্তিতে গদগদ কন্ঠে বলল, দেকো সকলায়, কত বন, বাদা, নদী উজিয়ে বনবাবা এয়েচেন আমাদের গাঁয়ে। এতদিনি আমাদের বাউরি গাঁ পয়মন্ত হল রে বাপসকল! মনের খেয়ালে যে কটা দিন থাকে, সেবা আর ভক্তি করি রাকতি হবে একি।
বনবাবা, সেই আশ্চর্য সব ক্ষমতার মানুষটা! সবাই ভক্তিভরে প্রণাম সারলো। ঘিরে দাঁড়িয়ে কৌতূহলী দৃষ্টি মেলে দেখছে। সে দেখার শেষ হয় না। মানুষটার ওসবে ভ্রুক্ষেপ নেই। স্থির দৃষ্টি মেলে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। তিরতির করে নদীতে জোয়ার লাগছে। চরভূমি নোনাজলে স্নান করছে। নৌকোগুলো নড়েচড়ে উঠে দোল খায়। ঢেউয়ের মাথায় সকালের আলো পড়ে শতখন্ডে ভাঙ্গছে। মানুষটা কি শুধু এসবই দেখছে, নাকি বিশ্বপ্রকৃতির অনন্ত রহস্যকে উপলব্ধি করছে। সময়ের সঙ্গে প্রশান্ত হয়ে উঠছে তার মুখমণ্ডল।
জগৎ বাউরি স্বস্তির শ্বাস ফেলে বললো, বনবাবা আমাদের গাঁয়ে এসি খুশি হয়িচে রে বাপসকল। দেকচিস নে কেমন আলো ফুটিচে মুকে। এবারি বাবার যত্নআত্তির ব্যবস্থা করতি হয় ঝে। কেওড়া ফলের অম্বল দিয়ি আতপ চালের ভাত আর গরান ফুলের মধু, এই হল গে বাবার সাধের খাবার। তা বাবা কখন খাবে তা জানা আমাদের অসাধ্যি। কিন্তুক ব্যবস্থা করি তো রাকতি হবে নাকি? খিদে পেলি সুমুখে না ধরি দিতি পারলি মহা পাপ হবে ঝে! আর সব বৃদ্ধরা জগৎ বাউরির কথায় সায় দিয়ে বলল, ও বাপসকল, এ মানুষকে হেলাফেলা নয় মোটে! কখন কোন দিকি হাঁটা দেয় তার ঠিকনি। তকন শত বার পায়ে পড়িও আটকে রাকতি পারবি নে। বংশী বাউরি আশ্বস্ত করতে বলল, গরান ফুলের মধু আর আতপ চাল আমার ঘরেতিই আচে। সে মধুতে দানা পড়ে একেবারি মিছরির ডেলা। বৃদ্ধ প্রহ্লাদ বাউরি বলল, মাটির মালসায় সর্ষের তেল মেরি মধু রেকিচিলি বুঝি? হ্যাঁ গো, গেল বারে জঙ্গল থিকি আনা। একন তার কী সোয়াদ! কিন্তুক কেওড়া ফল কোতায় পাবে? ফকির বলল, নিদু জ্যাটা জঙ্গল থিকি ফিরিচে গেল দিনি। বেশ খানটা এনিচে ও ফল। আমারেও দিইচে কটা। তমে আর চিন্তার কী। একন আন্নাটুকু জোগায়ে বাবার সুমুকে রাকা শুধু। জগৎ বাউরি খুশি হয়ে বলল।
ঘরের কাজ আধখ্যাঁচড়া সেরে খানিক বেলা করে গাঁয়ের মেয়েবউরাও এল দল বেঁধে। প্রণাম সেরে গ্যাঁদা, ঘেঁটু, কল্কেফুল মানুষটার চারপাশে ছড়িয়ে দিল। তারপর শাঁখ বাজাল, উলুধ্বনি দিল। পুরুষরা মানুষটার নামে জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল।
সুফল বাউরি ভক্ত মানুষ। বাউরি গাঁয়ের এক কোণে কুটির গড়ে তার একার বাস। বউ মরতে সংসারে সুফলের কদর কমে। অশান্তি না বাড়িয়ে সে সংসার ছাড়ে। পাঁচ গাঁয়ে কর্তাল বাজিয়ে ঠাকুরের নাম গেয়ে চাল পয়সা যা পায় তাতে তার একার পেট চলে যায়। সে বনবাবার গলায় পরাবে বলে নিজের হাতে একটা জবাফুলের মালা গড়ে ছুটে এল। তাকে বাধা না দিয়ে পারল না জগৎ বাউরি, ও সুফল, ও মালা বাবাকে পরালি তোমার পাপ হবে গো। ঝেদিন থিকি বনবাবা তার শরিল থিকি কাপড়জামা খসায়ে মৌনী হয়িচে সেদিন থিকি শরিলি সে কিচ্চুটি নেয় নে। ভক্তি তোমার মনেই রাকো। তাতিই বনবাবার কৃপা তুমি পাবে।
বনবাবার আশ্চর্য সব ক্ষমতার কথায় গোমর নদীর বাঁক মেতে উঠতে লাগল। একদিন মানুষটা খালি হাতে গহীন বনে ঢুকে গেল। দিনের পর দিন যায়, মানুষটা আর ডেরায় ফেরে না। ভক্তরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। ফিরে আসার কামনায় বনবিবি,গাজিপির আর বাশুলির থানে মানত রাখল। সাতদিনের দিন বনবাবা তার ডেরার সামনে এসে দাঁড়াল। তার দুহাত দুটো নধরকান্তি হরিণ শিশুর উপর রাখা। শিশু দুটোর আচরণ এমনই বাধ্যের যেন বহুদিনের পোষমানা। ডেরার চারপাশের ঘাস, লতাপাতা খায়। বনের দিকে ফিরেও তাকায় না। এর দু’দিন বাদে ওই হরিণ শিশু শিকার করতে গাঁয়ে বাঘ পড়ল। মানুষজন সব মশাল জ্বালিয়ে, টিন আর ক্যানেস্তারা পিটিয়ে বাঘ তাড়াল। কিন্তু খিদের পেটের বাঘ, ফের হানা দিতে পারে। ওই বনবাবা ছাড়া কে বাঁচাবে তাদের। তারা আকুতি জানাতে ডেরায় এসে দেখল, বাঘটা বনবাবার পায়ের কাছে মাথা এলিয়ে শুয়ে আছে। তার মাথায় বনবাবার আদর সোহাগের হাত। মুখে মিটিমিটি হাসি। বাঘে আর দাঁতাল শুয়োরের অসম লড়াইয়ে বনবাবা সবসময় শুয়োরটাকেই জিতিয়ে দেয়। খরায় চাষাবাদ বন্ধ হওয়ার উপক্রম। বনবাবা বৃষ্টি নামায়। বন্যাও রোখে। আরও কত কত ক্ষমতা মানুষটার। সব কী আর সবার সামনে প্রকাশ করা যায়! ভিড়টা পাতলা হলে বৃদ্ধরা বনবাবার পরমাশ্চর্য সেই ক্ষমতার কথা পাড়ে। বন্ধ্যা নারীর কোল ভরাতে পারে বনবাবা। তার পুরুষাঙ্গ বন্ধ্যা নারীর যেকোনও অঙ্গে একবার মাত্র ছুঁইয়ে দেবে, তাতেই কাজ হবে। মাথার চুলে ছুঁইয়ে দিলেও? হ্যাঁ, চুলেও। শরিলির অক্ত অসের সঙ্গি চুলের যোগ আচে নে! উতিই তো চুল বাড়ে। তাহলি হবে নে কেন? তাপ্পর তিন আত্তির শুদ্দ মন আর শুদ্দ বসনে সোয়ামির সঙ্গি সহবাস কল্লি দুই অমাবস্যা না ঘুরতি গভ্ভে ভুন আসবেই।
মাটির পাত্রে জল আর খাবারটা বেড়ে বনবাবার সামনে ধরল জগৎ বাউরি। নাও বাবা, খাও। তোমার এটুকুনি সেবা কত্তি পেরি গাঁয়ের পুন্নি হোক। কিপা কর বাবা, বালবাচ্চা নিয়ি গাঁঘরের মানুষগুনো ঝেন সুকে থাকে। বনবাবা একরকম গোগ্রাসে পুরো খাবারটা খেলো। এক নিঃশ্বাসে জলটা শেষ করে দীর্ঘ এক ঢেঁকুর তুলল। যেন বহুদিনের অভুক্ত পেট তৃপ্ত হল আজ। এঁটো থালা আর জলপাত্রটা ঢেউয়ের মুখে ছেড়ে দিয়ে মুখহাত ধুয়ে আগের জায়গায় এসে বসলো। ফের নদী ছাড়িয়ে অনেক দূরে নিমগ্ন তার দুচোখ।
বনবাবা খুশি মনে তাদের হাতের খাবার খেয়েছে, এরচেয়ে বড় পুন্যি আর কী হতে পারে! নিজেদের মধ্যে একটা পরামর্শে মাতলো ওরা। এত দয়া যখন বনবাবা তাদের প্রতি করলই তখন আরেকটা আব্দার তারা রাখতেই পারে। জগৎ বাউরি বনবাবার সামনে জোড়হাত হয়ে বসে প্রার্থনা জানালো, বাবা, দুটো দিন ঝদি দয়া করি আমাদের এ গাঁয়ে থাকো! ঝানি বাবা, তুমি না চাইলি ঝোর করি তোমায় ধরি রাকার সাধ্যি আমাদের নি। এ গরিবির ঘরে এট্টু পায়ের ধুলো দাও। বাউরি গাঁয়ের মানুষ তোমার সেবা করি ধন্য হতি চায়।
কেমন আত্মিক ভাবনায় ডুবে গেল বনবাবা। কী ভাবছে? আরও দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার কথা? নাকি অনেকদিন হলো বলে নিজের ডেরায় ফিরে যাওয়ার কথা? তার গ্রামের মানুষগুলো তাকে না পেয়ে হয়ত ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। অন্তরে তা অনুভব করছে বনবাবা। এবার ফেরার মন করছে হয়ত। বছরের যেকোনও একটা সময় এমনই বেরিয়ে পড়ে বনবাবা। কীসের ডাক যেন তাকে এই বাদার দেশে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায়। সে এক আশ্চর্য পরিক্রমা। মানুষটার জন্মও যে পরম রহস্যময়। মানুষের গর্ভে নয়, স্বয়ম্ভূ সে। কেউ কেউ বলে, স্বয়ং বনবিবির গর্ভে বাবার জন্ম।
ফের কাতর আবেদন রাখে জগৎ বাউরি, দয়া করো বাবা, দয়া করো! ওই তো, চোখের দুকূলে জেগে উঠছে সম্মতিসূচক আলোর ঝিলিক। ঠোঁটের বাঁকে রহস্যময় হাসির আভা। নদীর বাঁকে বনবাবার নামে ফের জয়ধ্বনি ওঠল। ভক্তি শ্রদ্ধায় বিগলিত জগৎ বাউরির দুচোখ কৃতজ্ঞতায় জলে ভরে ওঠে। অস্ফুট স্বগতোক্তি করে, বাবা তুমি অন্তর্যামী। আমার সমসারির দুক্কু তুমি ছাড়া আর কে বুঝবে। এ মানুষটার টাকাপয়সা আচে, জমিজিরাত আচে, সমাজি মান আচে, দশজনায় পূজ্যমান মানে কিন্তুক মনে আমার সুকনি বাবা। তুমি দয়া না করলি এ দুক্কু আমার ঘুচবার নয় বাবা।
বনবাবা হঠাৎই উঠে দাঁড়াল। দীর্ঘ দেহের অলৌকিক দ্যুতি মর্যাদায় যেন আকাশ ছোঁয়। লম্বা লম্বা পা ফেলে গাঁয়ের দিকে হাঁটতে থাকে। পিছনে পিছনে সম্মোহিত ভিড়। এসো বাবা, এই তো গরিবের কুটির। তোমার পায়ের ধুলো পড়ুক। আসনপিঁড়ি পেতে দেওয়ারও সময় দিল না বনবাবা। উঠোন পেরিয়ে সোজা দাওয়ায় উঠে বসল। মানুষজনে ভরে উঠল জগৎ বাউরির উঠোন। জগৎ বাউরির বউ মোক্ষদা গলায় আঁচল ঘুরিয়ে নিয়ে এক হাত ঘোমটা টেনে ভক্তিভরে বনবাবাকে প্রণাম করল। উঠে দাঁড়িয়ে ছেলের বউকে ডাকল, ও বউমা, বউমা, কোতায় গেলে?
মানুষজন সব চোখ ঘুরিয়ে বাঁজা বউটাকে খোঁজে। পোড়া কপাল বউটার। জগৎ বাউরি মাদুর পেতে বয়স্কদের ডেকে বসাল। তারপর সেও তার বউমাকে ডাকল, এসো মা, বাবাকে গড় করি ঝাও। বউমা সয়েনি দ্বিধা জড়ানো পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। মাথায় বড় করে ঘোমটা টানা। প্রণামটা সেরেই চট করে ঘরে ঢুকে গেল। সবাই তার পায়ের পাতা দুটো দেখল শুধু।
জগৎ বাউরি বনবাবার উদ্দেশ্যে বলল, ছেলি আমার বনে গেচে বাবা, তুমি তারি দূর থিকিই আশিব্বাদ করো ঝেন ভালোয় ভালোয় ঘরে ফিরতি পারে।
দুপুর যত গড়ায় শীতের নিপাট নীল আকাশ ফিকে থেকে রুপোর রঙ পায়। মাঠঘাট ভেঙ্গে আরও মানুষের ঢল নামে জগৎ বাউরির উঠোনে। তাদের কত দুঃখ, কত কত কষ্টযন্ত্রণা। কত যে প্রার্থনা। মনস্কামনা। এখন বাবা তাদের সহায়। এমন পরম সৌভাগ্যের দিন আর হয়তো জীবনে আসবে না।
বাবা, সংসারে বড় অভাব। বাবা, ছেলির পিটে বাঘের ছোঁয়া ঘা, কিচুতিই শুকোচ্চে না। বাবা, সোয়ামির শূল বেদনা। বাবা, শরিকি বিবাদে নাজেহাল হয়ি গেনু, আর অশান্তি সয় নে। বাবা, মেয়িকি আমার জামাইতি নেয় নে। বাবা, ছেলির বউ বচর বচর খালি মেয়ি বিয়োচ্চে, বংশ অক্কা কর বাবা। বাবা, ছেলি আমায় ভাত দেয় নে। বাবা, ঝমিটুকা আঝ পর্যন্তি রেকট হলনি। নোনা জল ঢুকি চাষের ঝমিটা আমার সেই ঝে বাঁজা হল বাবা, এ্যাদগুনো বচরেও মিঠেন হলনি বাবা। বাবা, ভাতারের আমার অন্য মেয়িছেলির দিকি নঝর। ঘরের বউয়ির বারমুকি মন, বাবা। মেয়ির আমার কিচুতিই বে হচ্চে নে, বাবা, কোন শত্তুরি তুক করিচে। বাবা, আমার এমন চমৎকার ছেলিকে কোন ওলাউটো বাণ মেরি ওগে বুইরে রেকেচে, গো বাবা। বাবা, বাবা, বাবা...! হাজার কাকুতিমিনতির বিপরীতে বনবাবার মুখমণ্ডলে হাজার রকমের অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে। ওই পড়ে ভক্তদের বুঝে নিতে হয় কার কার মনোবাঞ্ছা পূরণ হবে। কোন কোন পাপী আর শয়তান বঞ্চিত হবে। তারা ভগ্নমনোরথ হয়ে কেঁদেকেটে আকুল হচ্ছে, ক্ষেমা কর বাবা, ক্ষেমা কর!
কৃষ্ণপক্ষের কালো চাদর মুড়ি দিয়ে শীতের সন্ধ্যা নেমে এল। জগৎ বাউরির উঠোন এখন ফাঁকা। সয়েনি তুলসিমঞ্চে প্রদীপ দেখায়। মোক্ষদা বনবাবার জন্য বিছানা তৈরি করছে। মাঝের ঘরের মেঝেতে খড় বিছানো হয়েছে। দুপুরে সয়েনি ঘরটা গোবরলেপা করে শুদ্ধ করে দিয়েছে। যথেষ্ট পরিমাণ বাসমতী আতপ চাল, গরান ফুলের মধু আর কেওড়া ফলের ব্যবস্থা করেছে জগৎ বাউরি। বনবাবা কয়দিন দয়া করবে তা যে জানা নেই ওদের।
রাত এখন অনেক। ঘন অন্ধকারে ডুবে আছে চরাচর। ঝিঁঝিঁর ডাক আর জোনাকির ওড়াউড়ি। জগৎ বাউরির ঘরে ডিবির আলো জ্বলছে এখনও। স্বামী-স্ত্রীতে অনেক আলোচনা সারা হলে জগৎ বাউরি মোক্ষদার কাছে জানতে চাইল, হ্যাঁ গো, বউমা শুদ্দ আচে তো?
— আচে।
— ধোয়া বস্ত্র?
— আচে।
— বউমার ষোল আনা মনের সায় আচে তো?
— আচে। তমে চুলে ছোঁয়াবে।
— তাই ছোঁয়াক।
ওরা তিনজন মাঝের ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। খড়ের উপর ধ্যানী হয়ে বসে আছে বনবাবা। হ্যারিকেনের অনুজ্জ্বল আলোয় এক অপার্থিব গভীর মগ্ন মুখমণ্ডল। জগৎ বাউরি বুকের কাছে জোড়হাত করে বলল, আজ্ঞা কল্লি এ অধমের এট্টা নিবেদন ছিল বাবা। সম্বিৎ ফেরে বনবাবার। চোখের ইশারায় ওদের ঘরের ভিতরে আসতে বলল। জগৎ বাউরি বলতে থাকে, আঝ দশ বচ্চর হতি চল্ল ছেলির বে দিইচি বাবা। বউমার কোল উনোই থেকি গেল। তোমায় বাবা ভেঙ্গি আর কী বলব। বংশ অক্কা কর বাবা! মোক্ষদা বলল, বউমা আমাদের ভারি নক্কিমন্ত বাবা। মুকির দিকি তাকাতি পারিনে।তুমি ওকে দয়া করো বাবা।
মোক্ষদা হাত ধরে সয়েনিকে বনবাবার সামনে এগিয়ে দেয়। সয়েনি লজ্জা সংকোচে থরথর করে কাঁপছে। মনের সায় বুঝি উবে যেতে চাইছে তার। এক অজানা ভয়তাড়িত বিহ্বলতা তাকে গ্রাস করছে। বুঝতে পারছে মোক্ষদা। বলল, ভয় কী বউমা, বাবা আমাদের সাক্কাৎ দেপতা। তারি ভয় কল্লি চলে! জগৎ বাউরি বলল, ছেলি আমার বনে, তিন আত্তির সহবাস কী করি হবে বাবা। কাতর গলা তার। শুনে বনবাবার মুখমণ্ডলজুড়ে প্রশান্ত হাসি ছড়িয়ে পড়লো।
বনবাবার অপার করুণায় বিহ্বল হয়ে পড়ল জগৎ বাউরি। বাবা কিনা তার দৈবীক্ষমতায় রাত করে ছেলেকে বন থেকে বউমার কাছে এনে দেবে! জোড়হাত হয়ে দুজনে সয়েনিকে বনবাবার কাছে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। কতটুকু আর সময় লাগল, পিঠে একঢাল চুল ছড়িয়ে বনবাবার ঘর থেকে বেরিয়ে এল সয়েনি। লজ্জাসংকোচে রক্তিম তার মুখ। দ্রুত পায়ে সে নিজের ঘরে ঢুকে গেলো ।
পরম স্বস্তি বোধ করছে জগৎ বাউরি আর মোক্ষদা। তিনদিন পর পর গভীর রাত্রি করে, তাদের ভিটি বিচিত্র শব্দের উচ্ছ্বাসে ভেসে যেতে লাগল। সমুদ্র যেন দুর্বার হয়ে নদীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে তীব্র আলিঙ্গনে নিজের মধ্যে মিশিয়ে নিচ্ছে। হয়ত ওটা তাপিত চরাচরে প্রবল বর্ষণের শব্দ। বর্ষণ বীজের অঙ্কুর উদ্গমের সহায়ক। সৃষ্টির সমারোহ তার হাত ধরে। তিন রাত্রি ছেলে এল ঘরে, ফিরেও গেল বনে। সুখসহবাসে সয়েনির দেহমনে নতুন করে প্রাণের ছোঁয়া লাগল। মুখে পরিতৃপ্তির হাসি। আর জগৎ বাউরির ভিটি যেন হয়ে উঠল তীর্থভূমি।
চারদিনের দিন ভাল করে সকাল না ফুটতে বনবাবা জগৎ বাউরির ভিটি ত্যাগ করে সোজা হাঁটা লাগাল। পিছনে মেঘের গায়ে মেঘ জড়িয়ে চলার মতো মানুষের ঢল। বনবাবা যেন ওদের অনাথ করে দিয়ে চলে যাচ্ছে। হাহাকার করছে ওরা। বনবাবা গঞ্জের পথ ধরলে আৎকে ওঠে জগৎ বাউরি, ও পোল্লাদ, গঞ্জি ঝে ঝত ঠগ ঝোচ্চর আর অবিশ্বাসীর মেলা। বাবার সঙ্গি দুব্ব্যহার কল্লি! তুমি আমি তো আর বাবার চলার পথ ঘুরোতি পারবনি। ওরা খারাপ ব্যবহার কল্লিও আমরা কী কত্তি পারব বলো? ওদের ঝা শাস্তি দেওয়ার বাবাই দেবে।
দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বনবাবা গঞ্জেই ঢুকল। সম্পূর্ণ উলঙ্গ মানুষটাকে দেখে সারা গঞ্জ যেন এই শীতের সকালে গা গরম করে নেওয়ার এক উপাদেয় খোরাক পেল। ওরা বনবাবাকে ঘিরে হাসি ঠাট্টা বিদ্রুপে হৈচৈ বাধিয়ে দিল। বাউরি গাঁয়ের ভক্ত মানুষগুলো বাধা দিতে বলল, বনবাবা আমাদের দেপতা গো। তোমরা এমনটা কল্লি বাবার অভিশাপ নাগবে। শুনে ওরা অবজ্ঞার হাসি হাসছে। দেবতা না ঠগ! বেটা ডাকাতের সর্দার, ভেক ধরে আছে। পুলিশের গুঁতুনি পড়লে আসল রূপ বেরিয়ে পড়বে। বাবুঘরের স্কুলকলেজ পাশ দেওয়া কিছু টেরি বাগানো ছেলেও জুটেছে। তারা বলল, অলৌকিক ক্ষমতা না ছাই, সব হল গিয়ে ভন্ডের বুজরুকি।
বাউরি গাঁয়ের নরম মন, দুর্বল শরীরের মানুষগুলো একটু একটু করে পিছু হটতে লাগল। গঞ্জের যত অবিশ্বাসী বিটকেল স্বভাবের মানুষগুলো উলঙ্গ মানুষটাকে একরকম তাড়া করে নিয়ে চললো। কেউ কেউ এটা ওটা মানুষটার গায়ে ছুড়ে মারতে লাগলো। কেউ কেউ ইচ্ছে করে গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তে লাগলো। একজন আরেকজনকে ঠেলে মানুষটার গায়ের উপর ফেলতে লাগলো। তথাপি মানুষটা নির্বিকার। দুচোখে ক্রোধের আগুন বা অভিশাপের বিষাক্ত তির নেই। বরং সারা মুখে এক অনির্বচনীয় শান্ত সমাহিত ভাব। ক্ষমাসুন্দর দুচোখ। মানুষটার এমন হেনস্থা দেখে বাউরি গাঁয়ের মানুষগুলোর বুক ফেটে যাচ্ছে। সবচেয়ে অসহায় লাগছে জগৎ বাউরির। তবুও সে এত তাড়াতাড়ি হাল ছাড়তে রাজি নয়। মনে মনে কামনা করে, বাবা, তোমার ক্ষেমতা দেকিয়ে এদির এত আস্পদ্দার জবাব দিয়ি দাও। হাতেনাত শাস্তি পেয়ি ঝাক।
একসময় কী খেয়ালে বনবাবা গঞ্জের বুড়ো শিবতলার বটের ছায়ায় এসে বসল। নোনাদেশের বটগাছ বয়স বাড়লেও গতর বাড়েনি। লিকলিকে ঝুরিগুলো মাটিও ছুঁতে পারেনি। পাতার প্রাচুর্যও নেই। ছায়াতে তাই অসংখ্য আলোর ফোঁটা। বটের খোদলে একটা কালো পাথরে ফুল আর বেলপাতা ছড়ানো। পাশে তেলসিঁদুর মাখানো একটা ত্রিশূল মাটিতে গাঁথা।
একটা বখাটে ছোকরা জগৎ বাউরির উদ্দেশ্যে খিকখিক হেসে বলল, তোমাদের বাবাকে বলো না, দুয়েকটা ক্ষমতা দেখাক! জগৎ বাউরি যেন এমনই একটা প্রস্তাবের অপেক্ষায় ছিল। মনে করে, ওদের সমুচিত শিক্ষা দেওয়ার এই এক সুযোগ। সব শয়তানের মাথা বাবার পায়ের তলে হেঁট হয়ে যাক। বনবাবার উদ্দেশ্যে বলল, হ্যাঁ বাবা, দেকিয়ে দাও। তোমাকে এদির অবিশ্বাস, তিনটে কড়ে আঙ্গুলির উপরি ভেসি থেকি দেকিয়ে দাও বাবা! তারপর জগৎ বাউরি ভিড়টার উদ্দেশ্যে বলল, বাবা তার সাধনার বলে শরিলির পুরো বাতাস নিজির বশে আনবে। এট্টুসময় বাদে বাবার শ্বাসপাত বন্দ হয়ি ঝাবে।তাপ্পর আপনাদির ঝেকোনও তিনঝনায় বাবার শরিলি তাদির কড়ে আঙ্গুল ছোঁয়ানো মাত্তর বাবার শরীল পাকির পালকের মতো হাল্কা হয়ি শূন্যে ভেসি উটবে। সহসা ভিড়ের মধ্যে থেকে বিকট চিৎকার উঠল, হোক হোক, দেখি বেটার কেমন ক্ষমতা! তারপর ওরা কোন তিনজন কড়ে আঙুল ছোঁয়াবে তাই নিয়ে নিজেদের মধ্যে লড়াই, রেষারেষি, ধস্তাধস্তি, গুঁতোগুঁতি বাধিয়ে দিলো। শেষপর্যন্ত ডাকাবুকো, বলশালী তিনজনের জয় হলো। ওরা ওদের ডান হাতের কড়ে আঙুল বাগিয়ে বনবাবার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। মুখে বিদ্রুপমেশা কুটিল হাসি। ওদের একজন খিকখিক হেসে বললো, নাও তোমার বাবাকে সাধনা না ফাদনা করে হাল্কা হতে বলো! জগৎ বাউরি ভিড়ের মাঝখানে ঢুকে বনবাবার সামনে নতজানু হয়ে জোড়হাত করে বললো, অবিশ্বাসীর মনে বিশ্বাস আনাই ঝে তোমার কাঝ বাবা। দয়া করি ওদের মনে বিশ্বাস আনো বাবা। দেইকে দাও তোমার অসীম ক্ষেমতা। কিন্তু জগৎ বাউরি এ কী দেখছে, ওদের বাবার মুখে যে স্পষ্ট নেতিবাচক অভিব্যক্তি! অর্থাৎ বাবা তার ওই ক্ষমতা দেখাতে রাজি নয়। কিন্তু কেন? বুঝতে পারে জগৎ বাউরি। বললো, এতো অত্যেচার আর অবিশ্বাসির মদ্যি বাবা আমাদের সাধনা কত্তি পারবেনি গো বাবুরা। আমায় আপনেরা ক্ষেমা করবেন।
একথা শুনেই ওই তিনজন তাদের কড়ে আঙুল দিয়ে মানুষটাকে খোঁচাতে শুরু করলো। সেইসঙ্গে অশ্রাব্য ভাষা যত মানুষটার উদ্দেশ্যে ঢেলে দিতে লাগলো। মানুষটা এখনও যথাযথ নির্বিকার। হতাশায় ভেঙে পড়ল বাউরি গাঁয়ের মানুষগুলো। এমন সময় বাজার কমিটির সেক্রেটারি মল্লিনাথ হালদার ভিড় সরিয়ে ভিতরে ঢুকলো। এদিক দিয়েই কোথায় যেন যাচ্ছিল সে। কোনও গন্ডগোল হয়েছে ভেবে এগিয়ে এসেছে। তার নাদুসনুদুস সুখি কালো চেহারা। পরনে ধুতি পাঞ্জাবি। বয়স ষাটের কাছাকাছি। মাথায় কদম ছাঁট পাকা চুল। বড়সড় মুখমণ্ডলে নাকটা যেন পুলটিশের মতো আলগা বসানো। চোখ দুটো কুঁতকুঁতে। জর্দা পানে লাল টুকটুকে মুখগহ্বর আর ঠোঁট। গলাটা বাজখাই। ঘটনা দেখেশুনে কপট রাগ দেখিয়ে ভিড়টার উদ্দেশ্যে ধমক দিয়ে উঠল। নিমেষে ভিড়টা খানিক পাতলা হলে বাউরি গাঁয়ের লোকগুলোর উদ্দেশ্যে বলল, তোমাদের এইসব বাবাটাবাকে শিগগির গঞ্জের বাইরে নিয়ে যাও। খরিদ্দার সব এখানে দাঁড়িয়ে মজা লুটলে দোকানিদের মাথায় হাত পড়বে যে।
ইতিমধ্যে বনবাবা উঠে দাঁড়িয়েছে। মল্লিনাথ হালদার ফের বলল, গঞ্জের মধ্যে দিয়ে মানুষটাকে এভাবে হেঁটে যেতে দেওয়া যায় না! পাশে দাঁড়ানো একটা ছেলেকে বলল, এই ভজা, আমার নাম করে বনবিবি বস্ত্রালয় থেকে একটা লুঙ্গি এনে একে পরিয়ে দে। ভাল দেখে আনিস যাতে কটা দিন পরতে পারে। জগৎ বাউরি মল্লিনাথকে বোঝাবার চেষ্টা করে, বাবা কিচু পরবেনি বাবু! পরবে না মানে! ওর ঘাড় পরবে। তোমাদের বাবা ন্যাংটো থাকবে, সে তোমাদের গাঁয়ে গিয়ে থাকুক। কিন্তু আমি বাজার কমিটির সেক্রেটারি হয়ে এ অবস্থায় মানুষটাকে হাঁটতে দিতে পারি না!
ভজা সবচেয়ে ভাল লাট্টুমার্কা লুঙ্গি এনে মানুষটার কোমরে জড়িয়ে দিলো। মানুষটা কোনও বাধা দিল না। মল্লিনাথ জগৎ বাউরির উদ্দেশ্যে বললো, এবার একে নিয়ে তোমরা সরে পড়ো তো দেখি, যত্তসব! মানুষটা ফের গঞ্জের মধ্যে দিয়ে হাঁটা লাগালো। মল্লিনাথের ধমক খেয়ে যারা এতক্ষণ আড়ালে ওঁৎ পেতে ছিল তারা ফের সুযোগ পেয়ে বেরিয়ে এসে মানুষটার পিছু নিলো। ফের মজা লোটায় মেতে উঠলো। মানুষটাকে তাড়া করে গঞ্জের বাইরে নিয়ে চললো। ওদের পিছনে পিছনে এখনও বাউরি গাঁয়ের মানুষগুলো। জগৎ বাউরি। গঞ্জের সীমানা পেরিয়ে মানুষটা একসময় খোলা আকাশের নীচে উদোম মাঠে এসে দাঁড়াল। যেন এক পাথরমূর্তি। হঠাৎই সকলকে হতচকিত করে দিয়ে সে এক হ্যাঁচকা টানে কোমর থেকে লুঙ্গিটা খুলে আবার উলঙ্গ হয়ে গেল। পরক্ষণেই অমন শক্ত লুঙ্গিটাকে অবলীলায় কাগজ ছেঁড়ার মতো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে রোদ আর হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে যেদিকে জঙ্গল সেদিক পানে মাঠ ভাঙতে লাগলো।
পিছনে পড়ে রইলো যতো বিশ্বাস আর অবিশ্বাস। ভিড়টা চুপ হয়ে ফিরে আসছে। শুধু জগৎ বাউরি কী ভেবে গঞ্জের মানুষগুলোর উদ্দেশ্যে বললো, দেকলেন তো বাবুরা, মানুষটার ক্ষেমতা! উত্তরে গঞ্জের মানুষগুলো কিছুই বলছে না। ওরা ওদের দামি বাহারি পোশাকও অমন করে ছেঁড়ার প্রতিযোগিতায়ও নামছে না। জগৎ বাউরি ওদের মুখের দিকে তাকিয়েই আছে, কিন্তু ওদের মনের ভিতরের কথা কিছুতেই পড়তে পারছে না, যেমনটা সে বনবাবারটা পারতো।
দূরে উলঙ্গ মানুষটা বিন্দু হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। ওখানে জঙ্গল।
সুন্দর গল্প।
আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন অনিরুদ্ধবাবু।
বাহ বেশ ভাল লাগল।
ধন্যবাদ জানবেন।
ভালো লাগলো বেশ ।
ধন্যবাদ জানবেন।