১
এক সময়ের নকশাল নেত্রী পূরবী হুদার পোষ্য কুকুর গুস্তাভের অভিমান পানির মত।
একটু আগে রাজুর হাতে মার খাওয়ার কথা একদম ভুলে গেছে। বারান্দা জুড়ে আবার শুরু করে দিয়েছে লাফালাফি ঝাপাঝাপির খেলা। সামনের বাড়ির জানালার কার্নিসে সাদা রঙের একটি হুলি বিড়ালনী মুখ ভার করে বসে আছে। তার মানভঞ্জনের চেষ্টা করে যাচ্ছে বিশাল গুঁফো খয়েরি রঙের এক হুলো । গুস্তাভের চোখ পড়তেই মনের সুখে ঘেউঘেউ করে ধমক ধামক মারতে শুরু করেছে। তাতে বয়েই গেছে প্রেমিক যুগলের। লেজ উঁচিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে গুস্তাভকে পালটা ধমক মেরে হুলো আবার তোয়াজ সঙ্গীতে হুলিকে সিডিউস করে যাচ্ছে।
হুলোর দাবড়ানি খেয়ে গুস্তাভের বীরত্ব তলিয়ে গেছে। সাদা তুলতুলে ছোট্ট লেজটা থেকে থেকে কয়েকবার নাড়িয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে জানালা ধরে। পাল্টা ধমক মারার সাহস পায় না। শেষপর্যন্ত গুটগুট করে নেমে আসে পূরবীর কাছে।
মনে মনে হাসে পূরবী। এ প্রজাতির কুকুরগুলো কেবল নামেই পশু। মনুষ্যগৃহ আর মনিবের উষ্ণ কোল এদের নির্ভরতার নিরাপদ জায়গা। কখনও বাইরে বেরুলে কিছুতেই নিচে নামতে চায় না গুস্তাভ। ভয়ে শক্ত মেরে বসে থাকে কোলের ভেতর।
পূরবী বোঝে। আসলে এরা ত কখনও অরণ্য জীবন যাপন করেনি। প্রকৃতির দয়া বা নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে এদের প্রত্যক্ষ কোন অভিজ্ঞতা নেই। শিকার ধরে বা কেড়ে নিয়ে খেতেও শেখেনি। বড় বড় জন্তুর থাবা এড়িয়ে কী করে বাঁচতে হয় তাও এরা জানে না। বছরের পর বছর মানুষের ঘরে বা খামারে এদের উৎপন্ন করা হয়। মানুষের সঙ্গী হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিমা ধনীদের পৃথিবীতে। ধনী ঘরের লেডি, মিস বা মাদামরা আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে এদের কোলে কাঁখে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কেউ কেউ সম্পত্তির মালিকানাও দিয়ে যায়। ফলে এদের দাম নেহায়েত কম নয়। সেক্ষেত্রে বলা চলে গুস্তাভ বেশ দামি কুকুর। পঙ্গু মায়ের একঘেয়ে জীবনকে ব্যস্ত করে তুলতে বুদ্ধি করে কিনেছিল বড় মেয়ে রুমকি। যদিও এককালের এক স্বীকৃত বামদলের পুরানো বান্ধবী টিজ করে পূরবীকে বলেছিল, কী সব বুর্জোয়া অভ্যাস করেছিস! এত খর্চা দিয়ে ফরেন কুত্তা না পুষে দুটো স্টুডেন্টের পড়ার খরচ ত দিতে পারতিস তুই!
তাই শুনে রুমকি মিতিল রেগে গেছিল। এসব বান্ধবী যারা কখনও খোঁজ নিতে আসে না, পূরবী কেমন আছে, কী খাচ্ছে তাদের হুল ফুটানো কথা শুনলে ক্ষেপে আগুন হয়ে যায় দুবোন। মায়ের বান্ধবীকে কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে দিতে তখুনি ছুটে যেতে চেয়েছিল। কোন মতে ওদেরকে বুঝিয়ে শান্ত করেছে পূরবী।
তবে রুমকির বুদ্ধিটা কাজে লেগেছে। গুস্তাভ এখন ছেলের মত হয়ে গেছে পূরবীর কাছে। কে যে কাকে পুষছে বোঝা কঠিন!
ছোট মেয়ে মিতিন ধুমধাম করে কেক কেটে ওর নামকরণ করেছিল। প্রথম হাজবেন্ড জার্মান নাগরিক গুস্তাভ মার্কলের সাথে তখন প্রেমে মজে ছিল মিতিন। ছেলেটাও বড় ভাল মানুষ ছিল। একেবারে বাঙালি ঘরের ছেলেদের মত মা মা করে পূরবীকে ডাকত। ঘরের নানান কাজে সাহায্য করত। রান্নাবান্না, হাউস ক্লিনিংয়ে দক্ষ ছিল। মাসের প্রথম সানডে নিজে এসে কাজ করে, গল্প করে পূরবীকে একেবারে মুগ্ধ করে ফেলেছিল। বিয়ের বছর না ঘুরতে ওদের ছেলে হল। বাবার মতই সাদা ধপধপে। কালো চোখের বাচ্চাটিকে দেখলে মনে হত মোমের পুতুল। বুকে পিঠে বেঁধে ওইটুকু বাচ্চা নিয়ে দুজনে বাংলাদেশের নানা জায়গা ঘুরে বেড়িয়েছে। পূরবীর কেমন শান্তি শান্তি লাগত ওদের দেখে।
এরপর কী যে হল দুজনের ভেতর!
ছেলের দু বছর বয়সের মাথায় মিতিনই সব ছেড়েছুড়ে ফ্রি হয়ে যেতে চাইলো। মুখ কালো করে মন খারাপ নিয়ে দেশে ফিরে গেল গুস্তাভ। যাওয়ার আগে সৌজন্য সাক্ষাৎকার করতে এসেছিল। পূরবীর লজ্জা করছিল সামনে যেতে। মায়াও লাগছিল। মাতৃত্ব তো সেকাল একালের প্রাচীনতা আধুনিকতার কাটাছেঁড়া বোঝে না। সে কেবল স্নেহজলে ভেসে মায়া মমত্বে দোলে। সব বাঁধন, সম্পর্ক শত টুকরো হয়ে ছিঁড়েখুঁড়ে গেলেও মনের তলানিতে ভালোবাসা আর সমবেদনার স্নেহসর লেগে থাকে।
অথচ মিতিন কেমন সহজে হাত নেড়ে হেসে হেসে বলছিল, গুড লাক গুস্তাভ। উইশ ইয়ু এ ভেরি গ্লোরিয়াস ফিউচার। তাছাড়া আমাদের ছেলের জন্যে তোমার সাথে ত যোগাযোগ থাকবেই। গুড বাই অ্যান্ড টেক কেয়ার ডার্লিং ।
২
বড় মেয়ে রুমকি বিয়ে থা না করেনি। শিক্ষকতা আর রাজনীতিতে ঝানু চক্করবাজ। তবে ওর মতলব কিছুটা বোঝা যায়। কাজবাজ উদ্দেশ্য একেবারে অবোধ্য অস্পষ্ট নয়। কিন্তু মিতিনের মনের গতিবিধি বোঝা কঠিন। আপাত স্পষ্ট মনে হলেও ভয়ঙ্কর রকমের অস্পষ্ট জীবন ধারায় চলাচল করে মিতিন। যা করে ফটাফট করে ফেলে। তাতে কেউ মানুক না মানুক, সমালোচনা বা হেয় করুক, বর্জন অথবা নিষিদ্ধ করলেও ওর কিস্যু যায় আসে না। যা করার শেষ পর্যন্ত তা করেই ছাড়ে। রাজু একটি বয়স পর্যন্ত মিতিনকে প্রচণ্ড প্রশ্রয় দিয়েছে। বিয়ে সম্পর্কিত ব্যাপারে মেয়ের মানসিক অস্থিরতায় পূরবী চিন্তিত হলেও রাজু উৎসাহ দিয়ে বলেছে, এটা আমার মেয়ের ব্যক্তিগত ইচ্ছে। সামাজিক ভর্ৎসনা আর লোকলজ্জা ছাড়া রাষ্ট্রীয় বা ধর্মীয় নিয়মে কোথাও তো লেখা নেই একজন মানুষ, সে নারী অথবা পুরুষই হোক, তার জন্যে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ! জীবনভর একটি বিয়েই টেনে নিয়ে যেতে হবে! আর থাকলেই মানতে হবে কেন? বিয়ে কি হাঁড়িকাঠ?
এ পর্যন্ত তিনটে বিয়ে করেছে মিতিন। দেশি বিদেশি তিনজন স্বামীর ঘরে চারটে বাচ্চা। ফেসবুক, ইন্সট্রাগ্রাম উপচে ছবি দেয়। তাতে মনে হয় বেশ সুখেই আছে। মাঝে মাঝে রুমকি কাজের সূত্রে বিদেশ গেলে মিতিনের সাথে দেখা করে আসে। ছোট বোনের উপর ওর অপত্য স্নেহ। মিতিনও রুমকির অন্ধ অনুরাগী।
রাজুর সাথে দু মেয়ের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে। যে কারণে নষ্ট হয়েছে তাতে রাজুর উপর পূরবীর পূর্ণ সহানুভূতি রয়েছে। অনেক বার গোপনে আলোচনা হয়েছে মা মেয়েদের ভেতর। পূরবী ছাড় দিতে চাইলেও ওরা ঘোর আপত্তি জানিয়েছে। সে ক্ষেত্রে পূরবী প্রশ্ন তুলেছে, তোরা কেন এখন কনজারভেটিভ হচ্ছিস ? তোদের বাবার কি অধিকার নেই স্বাভাবিক জীবন যাপনের? একজন পঙ্গু, খোঁড়া স্ত্রীর সাথে আর কতকাল সে থাকবে? এটা জোর অন্যায় হচ্ছে। তোদের বাস্তবতা বোঝা উচিত।
রুমকি মিতিন দুজনেই বাস্তবতা বুঝেও রাজুকে ছাড় দিতে নারাজ। দু বোনেরই একমত, বিকজ মাম হি হিজ এ চিটার। আমাদের সাথে চিটিং করেছে। এর ক্ষমা নেই।
বাম রাজনীতির অঙ্গনে ঘোরাফেরা করা একজন নারী কবির সাথে গোপনে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল রাজু। সেখানে একটি ছেলে সন্তানেরও জন্ম হয়েছে। তাতে রুমকি মিতিনের কোন আপত্তি ছিলনা। কিন্তু যখন এ ফ্ল্যাটটি, যা কিনা পূরবীর দলের দেশি ও প্রবাসী কমরেড ও সমর্থকরা ডোনেশন তুলে পূরবীকে কিনে দিয়েছিল, রাজু জোর করে নিজের নামে করে নিতে চাইছিল। তাতেই ওরা রেগে গেছিল। রাজুর এই আচরণ এবং পূরবীকে ঠকানোর মানসিকতা মেয়েরা মেনে নিতে পারেনি। জোর আপত্তি করেছিল। রাজু অবশ্য তাতে থেমে ছিল না। নিজের প্রভাবে ফ্ল্যাটের মালিকানা জাল করে ওই মহিলার নামে করে দিচ্ছিল। এ খবর পেয়ে দুবোন ছুটে গিয়ে দুজনকেই এমন মার মেরেছিল যে রাজু অবাক হয়ে গেছিল, এরা তার সন্তান!
সেই থেকে রাজুর সাথে ওদের সম্পর্ক না থাকার মত। এখন দু মেয়েই রাজুর কাছে স্রেফ পরিচিতজনের মত অমুক তমুক।
তবে এত কিছু ঘটার পরেও কী এক অদ্ভুত কারণে রাজু পূরবীকে ছেড়ে যায়নি। পূরবী ভাবে, হয়ত বয়েস, আর্থিক সচ্ছলতা এবং নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য। কিম্বা সেই মেয়েটি রাজুর কাছে কিছুই পাবে না বুঝে প্রবাসী এক কাজিনকে বিয়ে করে সন্তানসহ বিদেশে চলে গেছে সে কারণে!
রাজুর শিশু সন্তানটির জন্যে খারাপ লাগে পূরবীর। প্রৌঢ় বয়সে রাজুর এই অবিমৃষ্যকারী কাজটি কিছুতেই মেনে নিতে পারে না সে। চিটিং হলে ওই শিশুটির সাথেই হয়েছে।
রুমকির সাথে রাজুর তেমন যোগাযোগ না থাকলেও মাঝে মধ্যে দেখা হয়ে গেলে সমবয়স্কের মত রাজনৈতিক বিষয় আশায় নিয়ে কথা হয়। মিতিন হঠাৎ হঠাৎ ফোন করে। স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে বলতে শেষতক ঝগড়া হয়ে যায় বাবা মেয়ের । তাৎক্ষণিক রাগে দুজনেই ধুম করে কল কেটে দেয়।
মেয়েদের সাথে পূরবীর সম্পর্ক ভালো। দু মেয়েকে মন থেকে বুঝতে চেষ্টা করে। অনেক কিছুই মেলে না। তবু ওদের সাথে লেগে থাকে। সময় বদলে গেছে, বদলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে পুরানো অনেককিছু। পূরবী তাই রক্তের ভেতর প্লাজমার মত লেগে থাকে।
৩
শৃঙ্গারমত্ত হুলোহুলিকে ছেড়ে হুইল চেয়ারে বসা পূরবীর চুল নিয়ে এবার খেলা করতে শুরু করেছে গুস্তাভ। পূরবী মোবাইলে নম্বর টিপছে আর মাঝে মাঝে চুলে টান লাগলে বকে দিচ্ছে। গুস্তাভের তাতে আরও উৎসাহ বেড়ে যাচ্ছে। জানালার ধারে ছুটে গিয়ে হুলোহুলিকে ঘেউঘেউ করে কী সব জানিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে রুমকির দোলনায়। সাদা শরীর দুলিয়ে খুশিতে দোল খাচ্ছে। কথা বলতে পারলে হয়ত গানও গেয়ে উঠত!
পূরবীর বাঁ হাতের একটা আঙ্গুল ছোট। ডান হাতের তিনটে আঙ্গুলের মাথা গোল। তাতে নখ নেই। আলুর মত মাংস গুট পাকিয়ে আছে। ঘরোয়া কিছু বিশেষ কাজ করতে ওর বেশ কষ্ট হয়। আগে মোবাইলের নম্বর টিপতেও অনেক যন্ত্রণা সহ্য করতে হত। আচমকা সূঁচ ফোটার মত একটি ব্যথা খ্যাচ করে ডান হাত জুড়ে ছড়িয়ে পড়ত কাঁধে। ব্যথায় ভারি হয়ে থাকত হাত। মনে পড়ে যেত কোন এক মফঃস্বল শহরের থানার ভেতর নিদারুণ অত্যাচারের কথা। যদিও সে নরক যন্ত্রণা ছিল সামান্য কয়েকটা দিনের জন্যে। কিন্তু তার মাত্রা ছিল ভয়ঙ্কর। পূরবীর শরীরের উপর দুবেলা মার্চ করে যেত দুজন সৈনিক। আঙ্গুলগুলোর উপর থেমে কঠিন চাপ দিয়ে স্ট্যান্ড আপ হয়ে ঠাট্টা করে ছড়া কাটত, তোমার নেতা আমার নেতা, মাও সেতুং মাও সেতুং।
ভাগ্য ভাল যে রেপটেপ করেনি। আড়াইটে দিন হাজতে ছিল প্রায় উলঙ্গ রক্তাক্ত অবস্থায়। কনভেনশনাল পলিটিক্স ছেড়ে পূরবীর অন্য পথে যাওয়া ওর বাবা কিছুতেই সমর্থন করেননি। কিন্তু মেয়ে ধরা পড়েছে জেনে সমস্ত রাগ অভিমান, বিরক্তি, অস্বস্তিকে পাশ কাটিয়ে পূরবীকে উদ্ধার করতে সে সময়ের রাজনীতি ও ক্ষমতার সাথে জড়িত ওর বাবা ছুটে গেছিলেন। বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে ছাড়িয়ে আনতে পেরেছিলেন অসুস্থ মেয়েকে। চিকিৎসা করাতে গিয়ে জানা গেল মেয়ে গর্ভবতী। নিজের রাজনৈতিক জীবন বিসর্জন দিয়ে তিনি রাজুকেও খুঁজে বের করে আনেন দক্ষিণাঞ্চলের কোন এক জেল থেকে।
ততদিনে মোহ কেটে গেছে রাজুর। স্বেচ্ছায় মুচলেকা দিয়ে অপেক্ষা করছিল সরকারের অনুকম্পা পাওয়ার আশায়।
৪
অবুঝ বয়সে রুমকি আর মিতিন ওই আঙ্গুলগুলো ধরে বার বার জানতে চাইত, মা মা মা তোমার আঙুলগুলো এমন কেন গো মা? নেইল নাই। জাস্ট রাউন্ড। পটোটো টাইপ শেপ। হোয়াট হ্যাপেনড মা?
কোন দিন হয়ত কোলে ঝাঁপ দিয়ে মিতিন জানাত, জানো মা, হিস্ট্রি মিস কী সুন্দর নেইলপালিশ পরে। তুমি কেন পর না। ইয়ু ডোন্ট হ্যাভ দ্যাট নেইল। হোয়াই মা? কী হয়েছিল বল না প্লিজ! প্লিজ মা।
সে সময় রুমকি এসে ছোট্ট মিতিনকে অন্য খেলায় ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে যেত। অতটুকু বয়সে কী করে যেন বড়দের মত বুদ্ধিমতী হয়ে যাচ্ছিল রুমকি। মিতিনও ছিল রুমকির ন্যাওটা। প্রায় সারাক্ষণ বড়বোনের গায়ের সাথে লেপ্টে থাকত। খুব ভালবাসত দুজন দুজনাকে। এখনও মিতিনের শ্রেষ্ঠ আশ্রয় রুমকি। আর রুমকির কাছে মিতিন হচ্ছে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার। মিতিনের দেশের যে কোন শহরের ইউনিভার্সিটিতে যত স্বল্প সময়ের জন্যে রুমকি যাক না কেন, দুবোন দেখা করে। ব্যস্ততার জন্যে রুমকি যেতে না পারলে মিতিন চলে আসে। কী করে পারে কে জানে!
মেয়েদের শৈশবে পুরবী নিজের পায়ে হাঁটতে পারত। দু একটা নখ কালো হয়ে যাওয়া ছাড়া পা দুটো তখন ভালই ছিল। নিজেই ওদের ইশকুলে নিয়ে যেত। ছুটির পর আনতে যেত। কোচিং, প্রাইভেট সংসার একা পূরবীই সামলেছে সবদিক। সপ্তাহে একদিন বিকেলে কারওয়ান বাজারে চলে যেত। হেঁটেই যেত। দশ টাকা বেঁচে যেত তাতে। সপ্তাহের চাল, ডাল, নুন তেল চিনি আর সব্জি কিনে রিকশায় ফিরে আসত। মাছ মাংস পাড়ার দোকান আর ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে প্রচুর দামদর করে কেনাকাটা করত।
তখনও টাকা পয়সার তেমন কোন স্থায়ী সংস্থান ছিল না ওদের। পূরবী রাজু দুজনের কেউই পড়াশুনা কমপ্লিট না করে আন্ডার গ্রাউন্ড পার্টিতে চলে গেছিল। প্রথমে রাজু। এরপর পূরবী। তারপর ধরপাকড়। পুলিশের মার। সে সময় বেঁচে যাওয়াটা ছিল এক রকমের অলৌকিক ঘটনা। ওদের অনেক বন্ধু কমরেড হারিয়ে গেছে মৃত্যুর অন্ধকারে। কী সব কমরেড ছিল তারা! উজ্জ্বল একেকটি নক্ষত্র। ঊনসত্তর সত্তর সালেই তারা নাম লিখেছিল বিপ্লবের খাতায়। মাঝে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে চিনের ভূমিকায় দ্বিধাগ্রস্ত থাকলেও একটি অংশ স্বাধীনতার পক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর বিপক্ষে যুদ্ধ করেছে। কিন্তু যুদ্ধ শেষে আবার তারা ফিরে গেছে আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতিতে। কেননা ভূমিগত স্বাধীনতা পেলেও একটি জাতির আর্থিক ও সামাজিক অসাম্য দূর করা সম্ভব হয়নি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে।
বাংলাদেশেরও ক্ষমতা ও রাজনীতিতে তখন ঘন ঘন পালাবদল হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর সাথে আওয়ামী লীগের নাম নিশানা মুছে দেওয়ার কাজ সুসম্পন্ন হচ্ছে দেশিয় দালাল আর বিদেশি অপশক্তিদের যড়যন্ত্রে। ক্রমশ ৭ মার্চের ভাষণ মুছে গেল। স্বাধীনতার ঘোষণা আর ঘোষক নিয়ে তৈরি করা হল ষড়যন্ত্র। সংবিধান থেকে খসিয়ে দেওয়া হল ধর্মনিরপেক্ষতা ও সামাজিক সাম্যের স্তম্ভগুলোকে। ঠিক এরকম সময়ের সুযোগে রাজু তখন খোলস পাল্টে ফেলেছে। মরিয়া চেষ্টা করে যাচ্ছে যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসছে তার নজর কাড়তে । যে কোন উপায়ে হোক, সে সময়ের সামরিক সরকারের সাথে যোগাযোগ করার একটা কোন ক্লু খুঁজছিল রাজু। শক্ত ক্লু। বিশ্বস্ত, ভরসার আর লেনদেনে পটু যে কোন কনটেক্সট।
সেই সব কষ্টের সময় মেয়েরা ঘুমিয়ে গেলে চারতলা বাসার লাল বারান্দায় বসে অবাক হয়ে ওরা ভাবত, এত লোক অসন্তুষ্ট ছিল বঙ্গবন্ধুর উপর? ওরা ছাড়াও এত বাঙ্গালী? সারাদেশ থেকে কয়েকজন প্রতিবাদী গ্রেফতার হওয়া ছাড়া পঞ্চাশ জনের একটি সম্মিলিত মিছিল বেরিয়ে এলো না বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করে! অথচ পুরো যুদ্ধকাল কত শত মুক্তিযোদ্ধা তাদের জীবন দিয়ে দিয়েছে শুধু জয় বাংলা আর জয় বঙ্গবন্ধুর নামে! পকেটে পকেটে টুপিতে পাঞ্জাবিতে রাজপথ আর ব্যারাকে অফিসে ঘরে ঘরে গ্রাম ও শহরে কখন বাঙ্গালীদের মনে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে জমে উঠেছিল এত ক্ষোভ আর অবিশ্বাস?
তবে কি রাজু পূরবীরাই ঠিক ছিল? তা কী করে হয়!
তাদের দলকেও ত সাধারণ জনগণ মেনে নেয়নি! যশোর কুষ্টিয়া পাবনাসহ নড়াইল, খুলনা, সাতক্ষীরা, আলমডাঙ্গা, বরিশাল, চট্টগ্রামের বিভিন্ন জেলা থেকে খবর পাওয়া যাচ্ছিল গ্রামের মানুষ আর শহরের নাগরিকরা তাদের হয় নকশাল ডাকাত, না হয় বিপথগামী তরুণ বলেই মনে করত। এমনকী গ্রামবাসীরা তাদের অনেক কমরেডকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে।
৫
রাজনীতির আদর্শ নিয়ে রাজু আর ভাবত না। শুধু রাজনীতির মোয়া মুড়ি ঘি নিয়েই তখন ভেবে গেছে। প্রথাগত নিয়মে সংসার পেতেছে। সন্তানের বাবা হয়েছে। এখন ওর পেট ভরে মাছ মাংস ভাত খেতে ইচ্ছে করে। ঘন দুধের পায়েস। রাতে এক কাপ ধোঁয়া ওঠানো কফির বিলাসিতা! দুনিয়ার কত মানুষ ক্ষুধার্ত আছে এসব ভেবে এখন আর মন খচখচ করে ওঠে না। বরং ষোড়শোপচারে খেতে ইচ্ছে করে। মুরগির হাড় চিবিয়ে ছাতু করে ফেলে। গরুখাসির হাড়ের মজ্জাও খেয়ে ফেলে দুর্দমনীয় লিপ্সায়। ভোগে এত সুখ!
সারাদিন রাজনীতির গোপন অঙ্গনে ঘুরাঘুরি করে চাঙা মন নিয়ে রাতে ঘরে ফিরত রাজু। ঘামে ভেজা পাঞ্জাবি আর বাজারের ব্যাগ পূরবীর হাতে দিয়ে খুশি খুশি গলায় সারাদিনের ফিরিস্তি শোনাত। পূরবী তখন প্লাস্টিকের বড় গামলায় থলে উপুড় করে বাজার ঢেলে রাজুর কথা শুনে অবাক হয়ে যেত। রাতের কারওয়ান বাজারে সস্তায় কেনা নানা রকমের সবজি, মাছ, ডিম, মাংস। কী যে ভাল ছিল সেই দিনগুলো। সংসার সংসার গন্ধ ভেসে আসত টম্যাটো, পেয়াঁজ, পটল, কুমড়োর গা থেকে। রাজু গোসল করে মেয়েদের নিয়ে আরাম করে বসে রঙ চা খেতে খেতে আবদার করত, মাংসের পুর দিয়ে পটলের দোলমা রান্ধো তো পূরবী। আর এখন ডিম সেদ্ধ করে দাও। আমার রাজকন্যাদের নিয়ে খাই!
খুশিতে রাজুর পিঠে চড়ে বসত মেয়েরা। ছুরি দিয়ে পটলের চোকলা ছাড়াতে ছাড়াতে পূরবী মনে মনে হাসত। রাজনৈতিক বিশ্বাস বদলে যাওয়ার সাথে কেমন বদলে যাচ্ছে তারা। যে কায়েমি রাজতন্ত্র আর পুঁজিবাদকে বিনাশ করতে ওরা পথে নেমেছিল সেখানে রাজকন্যাদের কোন স্থান ছিল না। শ্রমিক কৃষক মেহনতি জনমজুর আর গরিব মানুষদের ব্যথা বেদনার গল্প ছিল। কাউকে কোন প্রেমের গান বা কবিতা নিয়ে ভাবাবেগে আকুল হতে দেখলে ওরা বুর্জোয়া বলে উপহাস করত। কখনও কখনও দুর্বলচিত্তের কল্পনাপ্রবণ বলেও দলনেতার কাছে গোপনে রিপোর্ট চলে যেত।
রাজু তখন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে। তেয়াত্তরের ক্ষমতাসীন দল বহু বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে। রাজুরা আঁটসাঁট করে দল পাকিয়ে ফেলেছে। কিছুতেই আবার ক্ষমতায় আসতে দেওয়া চলবে না ওদের। যে সরকারই তখন এসেছে, রাজুকে ডেকে পাঠিয়েছে। জলপাই রঙ জিপ যখন তখন অপেক্ষা করত বাসার নিচে। ঝোলা ব্যাগ, খদ্দরের পাঞ্জাবি সাদা পাজামাতে গুরুগম্ভীর তাত্ত্বিক রাজু কোন দিকে না তাকিয়ে চলে যেত জলপাইপাড়া। রাত্তিরে ফিরে খবরে কাগজে মোড়ানো টাকার বান্ডিল আলমারিতে রেখে রাজু পূরবীকে জানাত, প্রতিশোধ নিতে হবে বুঝলে পুরবী। যারা আমাদের কমরেডদের খুন করেছে তাদের বিপক্ষের যে কোন দল বা জোটকে আমরা সমর্থন দেব। দেবই। আমাদের শত্রুর শত্রু হবে আমাদের কৌশলী মিত্র।
পূরবী সেই উনসত্তরে যেমন রাজুর কথাকে মেনে চলেছে, সেভাবে মাথা নেড়েছে। সত্যি কথাই ত। জাতি ভুলে যেতে পারে। কিন্তু পূরবী রাজুর মত যারা, তারা কি করে ভুলে যাবে কমরেডদের আত্মত্যাগকে? থানার টর্চার সেল, জেলখানা, রেললাইন, নদী, রাস্তা, ক্ষেত মাঠ এদেশের কোথায় নেই রাজু পূরবীদের সেই সব কমরেডদের রক্ত, প্রাণ মাংস?
শুধু স্বপ্নটা হারিয়ে গেছে।
আজকাল কারও চোখে ওই স্বপ্নটা নেই। পূরবী খুঁজে পায় না। এমনকি ওর নিজের মেয়েদের চোখেও না। নতুন প্রজন্ম ডুবে আছে প্রযুক্তির আসক্তে আর প্রবীণরা সম্পদের উপসেবক হয়ে ভোগ লালচে ভরপেট হয়ে আরও সম্পদ বাড়াচ্ছে।
কেন যেন নিজের কাছে এখন নিজেকেই খুব সুবিধাবাদী বলে মনে হয় পূরবীর । রাজুর মত সেও কি কম সুযোগসন্ধানী? তিয়াত্তরের ক্ষমতাসীন দলটি এখন সরকার গঠন করেছে। রাজু পূরবীকে প্রচুর সুবিধা ও সম্মান দিচ্ছে। মন্ত্রিপরিষদে রাজুর নামও সুপারিশ করেছে কেউ কেউ। এসব নেওয়ার সময় কই একবারের জন্যেও তো মনে পড়ে না সেই সব খুন হয়ে যাওয়া কমরেডদের কথা! এমনকি ভাবনাতেও কখনও ভেসে ওঠে না, এদেশে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার পক্ষে স্বপ্নপাগল সেই বন্ধু, সতীর্থ বিপ্লবী সহযোদ্ধাদের মুখ!
কোলের উষ্ণতায় আহ্লাদি গরগর তোলা গুস্তাভের মাথায় আদর করতে করতে পূরবী ভাবে, সত্যিকার অর্থে এক জীবনে খুব অল্পকিছু সময়ের জন্যে মানুষ সৎ থাকে। থাকতে পারে।
বাকি জীবনটা আসলে তলিয়ে থাকে মুখোশের আড়ালে।
এ-ই রাজনৈতিক স্বপ্নভঙ্গ অনেক চেনা। বিশ্বস্ত দলিল।
সততা বড় বিষম বস্তু। দুর্লভ।